বিশ্লেষণ /ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম থেকে ফ্যাক্ট-চেকিং সরিয়ে জাকারবার্গ কি ট্রাম্পের বশ্যতা স্বীকার করলেন

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ৩২
আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ৪৮
Thumbnail image
ফেসবুকের পাশাপাশি ইনস্টাগ্রাম-থ্রেডসেও ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রাম বন্ধ করছে মেটা। ছবি: এক্স

রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার দায় চাপিয়ে ফেসবুক থেকে ফ্যাক্ট-চেকিং নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন মার্ক জাকারবার্গ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপর ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ফেসবুকে ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে ৬০টির বেশি ভাষায় শতাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভুয়া বা মিথ্যা তথ্য মোকাবিলায় কাজ করেছে মেটা। এবার ট্রাম্পের আমল শুরুর আগেই ফ্যাক্ট-চেকিং অবসানের ঘোষণা এল।

তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফেসবুকের তথ্য যাচাই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকদের অভিযোগ ছিল। জাকারবার্গের ঘোষণার পর ট্রাম্প নিজেও বলেছেন, সম্ভবত তাঁর সমালোচনার কারণেই জাকারবার্গ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম প্ল্যাটফর্মে ফ্যাক-চেকিং বন্ধের ঘোষণাকে ট্রাম্পের বশ্যতা স্বীকার হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, এটি নতুন প্রশাসনের সঙ্গে গণমাধ্যমের খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্টার একটি উদাহরণ।

গতকাল মঙ্গলবার এক ভিডিওতে জাকারবার্গ বলেন, ফ্যাক্ট-চেকাররা রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে উঠেছে। মেটার কনটেন্ট মডারেশন টিমকে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে টেক্সাসে সরিয়ে নেওয়া হবে। আর ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের বিকল্প হিসেবে ইলন মাস্কের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘এক্সের’ মতো মেটাতেও ‘কমিউনিটি নোটস’ নামে ফিচার যুক্ত করা হবে। এছাড়া অভিবাসন ও লিঙ্গ সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে আলোচনার ওপর আরোপিত বিধিনিষেধও তুলে দেওয়া হবে।

এই ঘোষণার পরপর মেটার প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি, মেটা অনেক দূর এগিয়েছে।’ ট্রাম্পকে তখন জিজ্ঞাসা করা হয়, নতুন প্রশাসনের হুমকির কারণে জাকারবার্গ এই সিদ্ধান্ত নিলেন কিনা। উত্তরে ট্রাম্প বলেন, ‘সম্ভবত’।

২০২০ সালের নির্বাচনের সময় থেকে জাকারবার্গের ওপর ক্ষুব্ধ ট্রাম্প। করোনাভাইরাস মহামারীর ওই সময়ে জাকারবার্গ ও তাঁর স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান মিলে দেশজুড়ে নির্বাচন কার্যালয়ের জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেন। কিন্তু ওই অর্থ নির্বাচনের বাইডেনের জয় নিশ্চিত করতে দেওয়া হয় বলে ট্রাম্প ও তাঁর মিত্ররা অভিযোগ করেন। তীব্র আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। জাকারবার্গের এই পদক্ষেপকে ‘প্রতারণা’ আখ্যা দেন ট্রাম্প, নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগও তোলেন। তবে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবু রিপাবলিকানরা স্থানীয় নির্বাচন কার্যালয়ে অনুদান দেওয়া নিয়ে আপত্তি তোলে। এরপর ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন ক্যাপিটলে হামলার ঘটনার পর ট্রাম্পকে মেটা প্ল্যাটফর্ম থেকে ‘বিতাড়িত’ করেন জাকারবার্গ। তারপর ট্রাম্পের ক্ষোভ স্বাভাবিকভাবেই আরো বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারকালে এর বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। এক বইয়ে জাকারবার্গকে কারাগারে পাঠানোর হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প।

ট্রাম্পের প্রচারণাকালেও কিছুটা নিস্ক্রিয় ছিলেন জাকারবার্গ। এবার ট্রাম্পের বিজয়ের পর তাঁর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছেন মেটার নির্বাহী প্রধান। গত ডিসেম্বরে ট্রাম্পের অভিষেক তহবিলে ১ মিলিয়ন ডলার দেন তিনি। ট্রাম্পের ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোতে ডিনারেও গেছেন। এমনকি সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র আল্টিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপের প্রধান নির্বাহী ডানা হোয়াইটকে মেটার পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিয়েছেন।

শুধু মেটাই নয়, আরো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে নীতিগত পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন মার্কিন ফার্স্ট লেডি হতে যাওয়া মেলানিয়া ট্রাম্পকে নিয়ে ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে আমাজন। এদিকে ডিজনির মালিকানাধীন এবিসি নিউজ গত মাসেই ট্রাম্পের মানহানির মামলা সমঝোতা করেছে। ট্রাম্পের প্রেসিডেনশিয়াল লাইব্রেরি ফাউন্ডেশনকে ১৫ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এই গণমাধ্যম।

ডার্টমাউথ কলেজের রাজনীতি বিজ্ঞানী ব্রেন্ডান নায়হান এসব পরিবর্তনকে ‘ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকারের একটি ধাঁচ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এই যে নতজানু হওয়ার ধরন, তার মধ্যে প্রেসিডেন্টের ভয় প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।

এই প্রবণতাকে দেশের জন্য ‘গুরুতর ঝুঁকি’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। নায়হান বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি নানা দিক থেকেই বিশ্বের বহু দেশের জন্য ঈর্ষার কারণ। এখানে মানুষ ব্যবসা শুরু করতে আসে। কারণ এখানে তাঁদেরকে ক্ষমতাকে তোয়াজ করতে হয় না, যেমনটা অন্য দেশের ক্ষেত্রে ঘটে। কিন্তু এখন সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।’

এটিকে প্রকাশ্যেই ‘রাজনৈতিক চাল’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন বাণিজ্য বিশ্লেষকরা। ইমার্কেটার বিশ্লেষক জাসমিন এনবার্গ বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য নিজেকে পরিবর্তন করছে মেটা। এই পদক্ষেপ মেটার বিরুদ্ধে বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করার অভিযোগ তোলা রক্ষণশীলদের খুশি করবে। কিন্তু বহু উদারপন্থী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের সন্ত্রস্ত করবে। ট্রাম্পের সুনজরে থাকতে জাকারবার্গ কতদূর যেতে প্রস্তুত, এই ঘোষণায় তার প্রতিফলন স্পষ্ট।’

এনবার্গ বলেন, এক্স প্ল্যাটফর্মে কনটেন্ট মডারেশনের কারণে কিছু বিজ্ঞাপনদাতার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু মেটার বিশাল আকারের বিজ্ঞাপনী ব্যবসা থাকায় ব্যবহারকারী এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের বড় ক্ষতির সম্ভাবনা কম। তবে কনটেন্ট মডারেশনে পরিবর্তন আসার কারণে ব্যবহারকারীর সক্রিয়তা কমতে থাকলে বড় ক্ষতির সম্ভাবনা আছে।

নিউজ লিটারেসি প্রজেক্টের ডিজিটাল টুল রিউমারগার্ডের প্রধান লেখক ড্যান ইভন বলেন, মেটার ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রাম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত শুধু যে ব্যবহারকারীদের জন্য মূল্যবান পরিষেবার অবসান হলো তা-ই নয়, ‘ফ্যাক্ট-চেকিং রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট’— এই ভুল ও বিভ্রান্তিকর ধারণাটিকে আরও পাকাপোক্ত করে দিল। ফ্যাক্ট-চেকাররা মেটার প্ল্যাটফর্মের লাখ লাখ ব্যবহারকারীকে বিভ্রান্তিকর এবং ভুল তথ্য থেকে দূরে রাখেন।

অবশ্য বিতর্কিত কনটেন্ট নিয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী মেটার আধা-স্বায়ত্তশাসিত ওভারসাইট বোর্ড এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে। এসব পরিবর্তনকে ভালোমতো বুঝে নতুন পদ্ধতিকে যতটা সম্ভব কার্যকর এবং বাকস্বাধীনতা-বান্ধব করতে চায় এই বোর্ড।

যুক্তরাষ্ট্রে ইউটিউবের পর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম হলো ফেসবুক। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, প্রায় ৬৮ শতাংশ আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্ক ফেসবুক ব্যবহার করেন। তবে, গত এক দশকে ফেসবুক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কিশোর বয়সীরা। গত বছরের এক জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৩২ শতাংশ কিশোর-কিশোরী ফেসবুক ব্যবহার করছেন।

(বার্তা সংস্থার এপিতে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুবাদ করেছেন ফারহানা জিয়াসমিন।)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত