বাড়তি শুল্ক-ভ্যাটের উত্তাপে বাজার গরম

রোকন উদ্দীন, ঢাকা
প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২: ৪৩
Thumbnail image

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পুরানা পল্টনের বাসিন্দা আলিমুজ্জামান গতকাল রোববার বের হয়েছিলেন বারডেম হাসপাতালে একজন পরিচিত রোগীকে দেখতে। পথে সেগুনবাগিচা বাজারে থামেন রোগীর জন্য ফল কিনতে। আপেলের দাম জিজ্ঞেস করেই থমকে গেলেন। গত বৃহস্পতিবার এই একই বাজার থেকে যে দামে আপেল কিনেছিলেন, আজ (গতকাল) তার চেয়ে ২০ টাকা বেশি চাইছেন বিক্রেতা। তাঁর দাবি, আড়তে ফলের দাম বেড়েছে প্রতি কার্টনে ১০০-১৫০ টাকা। কাঁচাবাজারের ছোট ফল বিক্রেতা ভ্যাটের হিসাব অত না বুঝলেও আলিমুজ্জামান ঠিকই বুঝে গেলেন, ফলসহ বেশ কিছু পণ্য ও সেবায় সরকার যে ভ্যাট বাড়িয়েছে, তার প্রভাব শুরু হয়ে গেছে বাজারে।

বাজারেই কথা হলে এ প্রতিবেদককে আলিমুজ্জামান বলেন, এখন তেমন দেশীয় ফলের মৌসুম নেই। বছরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। বিশেষ করে ঢাকায় ডেঙ্গু ও সাধারণ জ্বরের রোগীর পথ্য হিসেবে আপেল, কমলা ও মাল্টার বাড়তি চাহিদা থাকে। এসব পণ্যকে বিলাসী হিসেবে ধরে আগেই এক দফা কর বাড়ানো হয়েছে। এখন আবার ভ্যাট বাড়ানোয় অনেক সাধারণ মানুষ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।

সরকার গত বৃহস্পতিবার শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তার প্রভাব ইতিমধ্যে বাজারে ফুটে উঠেছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু পণ্য ও সেবার খরচ বেড়ে গেছে। রেস্তোরাঁ-মালিকেরা ক্রেতার কাছ থেকে বিলে বাড়তি ভ্যাট আদায় করছেন। পোশাকের নতুন দাম কার্যকর করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। মোবাইল ফোনের কল ও ইন্টারনেটের বাড়তি খরচ কেটে নিচ্ছে অপারেটরগুলো। বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং সাধারণ ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, যেসব পণ্যের দাম এখনো বাড়েনি, সেগুলোর উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারীরা বলছেন, পুরোনো চালানের মজুত শেষ হয়ে নতুন পণ্য বাজারে এলে সেগুলোর দামও বাড়বে। নানা কারণে পণ্য উৎপাদন খরচ আগে থেকেই বেড়েছিল। এখন সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর কারণে খরচের সীমা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

সরকার বছরের মাঝপথে এসে মোবাইল ফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করেছে। ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার, কম্প্রেসর ও মোটরসাইকেলের করপোরেট কর ১০ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। ব্র্যান্ডের পোশাকের দোকান ও সব ধরনের রেস্তোরাঁর বিলের ওপর ভ্যাট একলাফে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মিষ্টির দোকান, এলপি গ্যাস, কিচেন টাওয়েল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন, ফেসিয়াল টিস্যু, হ্যান্ড টাওয়েল, সানগ্লাস, নন-এসি হোটেল, ব্র্যান্ডের তৈরি পোশাকের শোরুম বা বিপণিবিতানের পণ্য ও সেবা বিক্রিতে থাকা বিদ্যমান ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

শুল্ক-কর বৃদ্ধির তালিকায় আরও রয়েছে আমদানি করা বাদাম, রং ও ডিটারজেন্ট।

এ ছাড়া স্থানীয় উৎস বা দেশের মধ্যে উৎপাদিত তামাকযুক্ত সিগারেট, প্লাস্টিক ও মেটাল চশমার ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও তাতে ব্যবহৃত তেল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, সিআর কয়েল, জিআই তারসহ বেশ কয়েকটি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।

এই সিদ্ধান্তের প্রভাব ইতিমধ্যে বাজারে দেখা গেছে। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যেসব রেস্তোরাঁ এনবিআরের দেওয়া ইসিআর মেশিন ব্যবহার করে বা খরিদ্দারকে ভ্যাট চালান দেয়, তারা ইতিমধ্যে সরকারের নতুন ঘোষণা অনুসারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট নিতে শুরু করেছে। এতে ক্রেতাকে ১০০০ টাকা বিল হলে সঙ্গে বাড়তি ১৫০ টাকা দিতে হচ্ছে, যা আগে ছিল ৫০ টাকা।

এ ছাড়া একইভাবে ব্র্যান্ডের পোশাকের দোকানগুলোয় ১ হাজার টাকায় বাড়তি দিতে হচ্ছে ১৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৫০ টাকা।

ইতিমধ্যে সিগারেটের দাম প্রতি প্যাকেটে বেড়েছে ৬০-৭০ টাকা। ভ্যাটের প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের ওপরও। বিমানে যাতায়াতে তাঁদের খরচও বেড়েছে ৫০০ টাকা। বিমান ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে ইতিমধ্যে আড়াই হাজার টাকা নেওয়া শুরু করেছে এয়ারলাইনসগুলো। প্রভাব পড়েছে নির্মাণশিল্পেও। ভ্যাট বাড়ানোর ফলে ইতিমধ্যে রডের দাম টনপ্রতি ১০ হাজার টাকা বেড়েছে। ৭৭-৭৮ হাজার টাকা টনের রড রাতারাতি এখন ৮৬-৮৭ হাজার টাকায় উঠে গেছে।

সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে ১২ কেজি এলপিজিতে ভ্যাট বাড়বে ৩৬ টাকার কিছু বেশি। সরকার এখনো এলপিজির নতুন দাম নির্ধারণ না করলেও খুচরা পর্যায়ে বাড়তি দাম রাখছেন সরবরাহকারীরা। ১২ কেজির সিলিন্ডারের বর্তমান দাম ১ হাজার ৪৫৫ টাকা। অনেক এলাকায়ই তা ১ হাজার ৫৫০ টাকা পর্যন্ত রাখছেন বিক্রেতারা।

ইতিমধ্যে মোবাইল ফোনের খরচ বেড়েছে শতকরা ২ টাকা। অর্থাৎ আগে ১০০ টাকার কথা বললে ২৮ টাকা বাড়তি খরচ হতো। এখন তা ৩০ টাকা হচ্ছে।

ইতিমধ্যে বাজারে ২৫ টাকার টিস্যু ২৮ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে অনেক জায়গায়। ৬০ টাকার বিস্কুট এখন ৭০ টাকা।

সেগুনবাগিচা বাজারের দোকানি মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, ‘আমি এখনো বাড়তি দামের টিস্যু আনি নাই। তবে কোম্পানির সরবরাহকারীরা আমাকে জানিয়ে গেছে, এর দাম শিগগিরই বাড়বে।’

বসুন্ধরা গ্রুপের ফুড ডিভিশন অ্যান্ড এলপিজির হেড অব সেলস রেদোয়ানুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো পণ্য উৎপাদন থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে ৮-১০ দিন লাগে। এ জন্য এখনো বাজারে ভ্যাট-ট্যাক্সের প্রভাব পুরোপুরি পড়েনি। যখন নতুন পণ্য বাজারে আসবে, তখন দামের প্রভাব আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে।’

অফিস-আদালতের আলাপে, চায়ের দোকানের আড্ডায় বা গণপরিবহনের কথোপকথনে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সীমিত আয়ের মানুষের কষ্টের আভাস ভালোই পাওয়া যাচ্ছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকারের মরিয়া এই প্রয়াস ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা মানুষকে আরও দুর্ভোগে ফেলছে বলে মন্তব্য করেছেন বাজার বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগ নিলেও তার তেমন কোনো সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। সরকার ইতিপূর্বে ২৯টি পণ্যের ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করলেও ভোক্তা পর্যায়ে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। ওই শুল্ক প্রত্যাহারের পুরো সুবিধাটুকু হাতিয়ে নিয়েছে বড় বড় করপোরেট গ্রুপ ও আমদানিকারকেরা। মূল্যস্ফীতি ক্রমাগতভাবে ঊর্ধ্বমুখী থাকায় মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। প্রতি মাসে ধারদেনা ও খাবারের তালিকা কাটছাঁট করে কোনোরকমে সংসার চালাতে হচ্ছে।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘সীমিত ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ এমনিতেই নিত্যপণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। এই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা আরেক দফা মূল্য বাড়িয়ে তাদের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলবে। তাই এই অধ্যাদেশ বাতিল অথবা আগামী রমজান পর্যন্ত কার্যকর না করার দাবি জানিয়েছি আমরা।’

এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শুল্ক-কর বাড়ানোর কারণে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় করা যাবে। এতে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি কমবে। মানে হলো, এই ১২ হাজার কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই যাবে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে। কারণ, পণ্যের ভ্যাট নিতান্ত গরিব-মিসকিন থেকে শুরু করে সবাইকে দিতে হয়। আর আয়কর দিতে হয় শুধু ধনীদের। তাই অনেকের পরামর্শ, ভ্যাট বাড়িয়ে সীমিত আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের ওপর বোঝা না চাপিয়ে আয়করের আওতা বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো হোক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত