আমীন আল রশীদ
সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে নানা মাত্রিক আলোচনার মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন: ‘গণহত্যার বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেব না। প্রয়োজনে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান হবে।’
বাংলাদেশে গত জুলাই মাসে সংঘটিত অভ্যুত্থানকে অনেকে ‘বিপ্লব’ এমনকি এই ঘটনাকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গেও তুলনা করেন এই যুক্তিতে যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে। ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ‘বিপ্লব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে যে বৃহত্তর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলো, সেটি নিঃসন্দেহে একটি বিরাট গণ-অভ্যুত্থান।
প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন পথের দিকে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করবে। কিন্তু এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের বেশি পার হয়ে গেলেও সাধারণ মানুষের সেই প্রত্যাশা খুব একটা পূরণ হয়নি। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতি, নিত্যপণ্যের দাম, আইনশৃঙ্খলা তথা নাগরিকের নিরাপত্তা, মব ভায়োলেন্স এবং নানা গোষ্ঠীর বিভিন্ন দাবিতে রাস্তায় নেমে গিয়ে জনদুর্ভোগ তৈরির ঘটনাগুলো জনমনে শঙ্কা বাড়াচ্ছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে শিক্ষার্থীরা এই অভ্যুত্থানের সামনে ছিলেন এবং যাঁরা আপাতদৃষ্টিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অংশীদার, এমনকি ড. ইউনূস তাঁর বক্তৃতায় যে শিক্ষার্থীদের তাঁদের ‘প্রাথমিক নিয়োগকর্তা’ বলে অভিহিত করেছেন, তাঁরাই এখন বলছেন প্রয়োজনে আবার অভ্যুত্থানের ডাক দেওয়া হবে। কেন তাঁরা এটি বলছেন? কারণ, তাঁরা যেভাবে চাইছেন দেশ সেভাবে চলছে না, নাকি অন্তর্বর্তী সরকার সেভাবে দেশ চালাতে পারছে না?
শিক্ষার্থী এবং অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা তাঁদের প্রতিনিধিরা মনে করেন এটি ‘বিপ্লবী সরকার’। যদিও তাঁরা সবাই শপথ নিয়েছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতির কাছে বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে এবং তাঁরা সংবিধান রক্ষারই শপথ করেছেন। অথচ তাঁদেরই একটা বড় অংশ এই সংবিধান বাতিলের দাবিতে সোচ্চার। ফলে এই ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে তাঁদের প্রধান অংশীদারদের একটি বড় ধরনের দূরত্ব আছে বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রশ্ন হলো, একটি বিরাট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে যে একটি নতুন ধরনের সরকার গঠিত হলো এবং তার আগে অজস্র মানুষ প্রাণ দিল, অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হলো, দৃষ্টিশক্তি হারাল—সেই রক্তাক্ত স্মৃতি এখনো যেখানে গণমানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল, সেখানে সত্যিই আরেকটা অভ্যুত্থানের ডাক এলে আবার কত লোকের প্রাণহানি হবে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, অভ্যুত্থানের লক্ষ্য উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষের মুক্তি ও দেশের কল্যাণ—তাহলে সেই অভ্যুত্থান কেন বারবার হবে এবং সেই অভ্যুত্থান কেন ব্যর্থ হবে?
বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম অভ্যুত্থানের শিকার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার তাঁকে হত্যা করা হয়। এর আড়াই মাসের মাথায় ওই বছরের ৩ নভেম্বর আরেকটি অভ্যুত্থানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। এর চার দিনের মাথায় ৭ নভেম্বর আরেকটি অভ্যুত্থান—যেটিকে একপক্ষ বলে সিপাহি-জনতার বিপ্লব, আরেকপক্ষ বলে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস। এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনিও ১৯৮১ সালের ৩০ মে আরেক অভ্যুত্থানে নিহত হন। এর এক বছর সময়ের আগে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল এরশাদ। কিন্তু অভ্যুত্থানের মুখে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা এরশাদও ৯ বছরের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত হন একটি বিরাট রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মুখে। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের কয়েক মাসের মধ্যে ওই বছরের ৭ নভেম্বর রাতে সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। যদিও সেটি ব্যর্থ হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে গত ৫৩ বছরের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে ১৯৯১-২০০১ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছরকে তুলনামূলকভাবে ভালো সময় বলা যায়। এর মাঝখানে ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের কারণে রাজনৈতিক সহিংসতা হলেও এই দশকটি অন্য দশকগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল বলে মনে করা হয়। অন্তত রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও সমঝোতার একটা পরিবেশ ছিল।
১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সাল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও নবম সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। আসে সেনানিয়ন্ত্রিত এক-এগারোর সরকার—যেটি আরেকটি অভ্যুত্থান।
সবশেষ আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকারেরও পতন হলো একটি বিরাট অভ্যুত্থানের মুখে। প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে যে অভ্যুত্থানের শুরু, তারপর আরও অনেকগুলো অভ্যুত্থানের ফলে দেশের মানুষের আসলে কতটুকু কল্যাণ হয়েছে?
প্রসঙ্গত, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সামরিক অভ্যুত্থানের শিকার হয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়া। ১৮২৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এই দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে পাকিস্তানে। অভ্যুত্থানের পেছনে সাধারণত দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, লাগামহীন দুর্নীতি, রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত প্রভাব, প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবাদ এবং নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য ও দারিদ্র্যকে দায়ী করা হয়। বিশ্বব্যাংকের মতে, যেসব দেশ মানব উন্নয়ন সূচকে পিছিয়ে থাকে, সেসব দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের ঝুঁকি তৈরি হয়। নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালের বাইরে চলে গেলে এবং রাজনৈতিক বিরোধ তীব্র হলে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়। আবার সব অভ্যুত্থান সামরিক না হলেও অনেক সময় বেসামরিক তথা রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পেছনেও সামরিক বাহিনীর সমর্থন থাকে।
অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের মতো এটি বিরাট দল এবং শেখ হাসিনার মতো একজন প্রবল পরাক্রমশালী শাসকের পতন হলো কেন, তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি পাল্টা যুক্তি রয়েছে। কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকার, দল ও রাষ্ট্র একাকার হয়ে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় হয়েছিল; নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতি ও দলীয়করণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ যেভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল—তাতে একটি বড় ধরনের অভ্যুত্থান হয়তো সময়ের ব্যাপার ছিল।
প্রশ্ন হলো, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে দেশ কি একটি দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার দিকে যাত্রা শুরু করতে পেরেছে, নাকি একটি বড় সংকটের ভেতর দিয়ে দেশ আরও বড় সংকটের ভেতরে ঢুকে গেল? অর্থাৎ একটি গণতান্ত্রিক, সহনশীল, মানবিক ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র গঠনের লড়াই কি চলতেই থাকবে? বর্তমান প্রজন্ম কি একটি কাঙ্ক্ষিত দেশ দেখতে পারবে, নাকি তাদের আরও বড় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে?
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক
সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে নানা মাত্রিক আলোচনার মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন: ‘গণহত্যার বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেব না। প্রয়োজনে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান হবে।’
বাংলাদেশে গত জুলাই মাসে সংঘটিত অভ্যুত্থানকে অনেকে ‘বিপ্লব’ এমনকি এই ঘটনাকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গেও তুলনা করেন এই যুক্তিতে যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে। ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ‘বিপ্লব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে যে বৃহত্তর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলো, সেটি নিঃসন্দেহে একটি বিরাট গণ-অভ্যুত্থান।
প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন পথের দিকে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করবে। কিন্তু এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের বেশি পার হয়ে গেলেও সাধারণ মানুষের সেই প্রত্যাশা খুব একটা পূরণ হয়নি। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতি, নিত্যপণ্যের দাম, আইনশৃঙ্খলা তথা নাগরিকের নিরাপত্তা, মব ভায়োলেন্স এবং নানা গোষ্ঠীর বিভিন্ন দাবিতে রাস্তায় নেমে গিয়ে জনদুর্ভোগ তৈরির ঘটনাগুলো জনমনে শঙ্কা বাড়াচ্ছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে শিক্ষার্থীরা এই অভ্যুত্থানের সামনে ছিলেন এবং যাঁরা আপাতদৃষ্টিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অংশীদার, এমনকি ড. ইউনূস তাঁর বক্তৃতায় যে শিক্ষার্থীদের তাঁদের ‘প্রাথমিক নিয়োগকর্তা’ বলে অভিহিত করেছেন, তাঁরাই এখন বলছেন প্রয়োজনে আবার অভ্যুত্থানের ডাক দেওয়া হবে। কেন তাঁরা এটি বলছেন? কারণ, তাঁরা যেভাবে চাইছেন দেশ সেভাবে চলছে না, নাকি অন্তর্বর্তী সরকার সেভাবে দেশ চালাতে পারছে না?
শিক্ষার্থী এবং অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা তাঁদের প্রতিনিধিরা মনে করেন এটি ‘বিপ্লবী সরকার’। যদিও তাঁরা সবাই শপথ নিয়েছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতির কাছে বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে এবং তাঁরা সংবিধান রক্ষারই শপথ করেছেন। অথচ তাঁদেরই একটা বড় অংশ এই সংবিধান বাতিলের দাবিতে সোচ্চার। ফলে এই ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে তাঁদের প্রধান অংশীদারদের একটি বড় ধরনের দূরত্ব আছে বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রশ্ন হলো, একটি বিরাট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে যে একটি নতুন ধরনের সরকার গঠিত হলো এবং তার আগে অজস্র মানুষ প্রাণ দিল, অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হলো, দৃষ্টিশক্তি হারাল—সেই রক্তাক্ত স্মৃতি এখনো যেখানে গণমানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল, সেখানে সত্যিই আরেকটা অভ্যুত্থানের ডাক এলে আবার কত লোকের প্রাণহানি হবে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, অভ্যুত্থানের লক্ষ্য উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষের মুক্তি ও দেশের কল্যাণ—তাহলে সেই অভ্যুত্থান কেন বারবার হবে এবং সেই অভ্যুত্থান কেন ব্যর্থ হবে?
বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম অভ্যুত্থানের শিকার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার তাঁকে হত্যা করা হয়। এর আড়াই মাসের মাথায় ওই বছরের ৩ নভেম্বর আরেকটি অভ্যুত্থানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। এর চার দিনের মাথায় ৭ নভেম্বর আরেকটি অভ্যুত্থান—যেটিকে একপক্ষ বলে সিপাহি-জনতার বিপ্লব, আরেকপক্ষ বলে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস। এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনিও ১৯৮১ সালের ৩০ মে আরেক অভ্যুত্থানে নিহত হন। এর এক বছর সময়ের আগে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল এরশাদ। কিন্তু অভ্যুত্থানের মুখে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা এরশাদও ৯ বছরের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত হন একটি বিরাট রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মুখে। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের কয়েক মাসের মধ্যে ওই বছরের ৭ নভেম্বর রাতে সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। যদিও সেটি ব্যর্থ হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে গত ৫৩ বছরের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে ১৯৯১-২০০১ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছরকে তুলনামূলকভাবে ভালো সময় বলা যায়। এর মাঝখানে ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের কারণে রাজনৈতিক সহিংসতা হলেও এই দশকটি অন্য দশকগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল বলে মনে করা হয়। অন্তত রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও সমঝোতার একটা পরিবেশ ছিল।
১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সাল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও নবম সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। আসে সেনানিয়ন্ত্রিত এক-এগারোর সরকার—যেটি আরেকটি অভ্যুত্থান।
সবশেষ আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকারেরও পতন হলো একটি বিরাট অভ্যুত্থানের মুখে। প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে যে অভ্যুত্থানের শুরু, তারপর আরও অনেকগুলো অভ্যুত্থানের ফলে দেশের মানুষের আসলে কতটুকু কল্যাণ হয়েছে?
প্রসঙ্গত, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সামরিক অভ্যুত্থানের শিকার হয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়া। ১৮২৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এই দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে পাকিস্তানে। অভ্যুত্থানের পেছনে সাধারণত দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, লাগামহীন দুর্নীতি, রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত প্রভাব, প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবাদ এবং নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য ও দারিদ্র্যকে দায়ী করা হয়। বিশ্বব্যাংকের মতে, যেসব দেশ মানব উন্নয়ন সূচকে পিছিয়ে থাকে, সেসব দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের ঝুঁকি তৈরি হয়। নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালের বাইরে চলে গেলে এবং রাজনৈতিক বিরোধ তীব্র হলে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়। আবার সব অভ্যুত্থান সামরিক না হলেও অনেক সময় বেসামরিক তথা রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পেছনেও সামরিক বাহিনীর সমর্থন থাকে।
অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের মতো এটি বিরাট দল এবং শেখ হাসিনার মতো একজন প্রবল পরাক্রমশালী শাসকের পতন হলো কেন, তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি পাল্টা যুক্তি রয়েছে। কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকার, দল ও রাষ্ট্র একাকার হয়ে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় হয়েছিল; নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতি ও দলীয়করণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ যেভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল—তাতে একটি বড় ধরনের অভ্যুত্থান হয়তো সময়ের ব্যাপার ছিল।
প্রশ্ন হলো, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে দেশ কি একটি দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার দিকে যাত্রা শুরু করতে পেরেছে, নাকি একটি বড় সংকটের ভেতর দিয়ে দেশ আরও বড় সংকটের ভেতরে ঢুকে গেল? অর্থাৎ একটি গণতান্ত্রিক, সহনশীল, মানবিক ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র গঠনের লড়াই কি চলতেই থাকবে? বর্তমান প্রজন্ম কি একটি কাঙ্ক্ষিত দেশ দেখতে পারবে, নাকি তাদের আরও বড় লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে?
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক
‘গণতন্ত্র মঞ্চ’র অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ঐক্য ফোরামের নেতা ছিলেন। তিনি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। এখন পর্যন্ত ২০টি বই লিখেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে...
১ দিন আগেতিন মাস পার হলো, আমরা একটি অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলের অধীনে আছি। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের অবসান ঘটেছে। অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছিল—সামাজিক সব বৈষম্যের অবসান ঘটবে, আমাদের সামগ্রিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হবে, প্রকৃত স্বাধীনতা..
১ দিন আগেচট্টগ্রামের আকবরশাহ থানার নাছিয়াঘোনা এলাকায় যাওয়া-আসা করতে গেলে বোঝা যায় সেটি দুর্গম এলাকা। এ কারণেই সেখানে বসানো হয়েছিল ফাঁড়ি। কিন্তু ৫ আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর পুলিশের থানা ও ফাঁড়িগুলোয় যখন আক্রমণ করা হচ্ছিল, তখন নুরু আলম নুরু নামের এক সন্ত্রাসীও সে সুযোগ নেন। তিনি পুলিশের ফাঁড়ি দখল করে...
১ দিন আগেশেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। যাঁরা পালাতে পারেননি তাঁদের জনাকয়েক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের দুঃশাসনকালে বিএনপিসহ অন্য নেতাদের যেভাবে হেলমেট পরিয়ে জেলখানা থেকে আদালতে হাজির করা হতো, এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের একই কায়দায়
২ দিন আগে