রাজকাজের পাশাপাশি বিমান ওড়ানো ও তলোয়ারবাজিতে সেরা ভোপালের মুসলিম রাজকন্যা

অনলাইন ডেস্ক    
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১: ৩৬
আবিদা সুলতান। ছবি: সংগৃহীত

যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে—এই প্রবাদের এক অনন্য উদাহরণ ভোপালের রাজকন্যা আবিদা সুলতান। তিনি ছোট বেলা থেকেই ছিলেন একেবারেই ভিন্নধর্মী এক রাজকন্যা। তিনি ছোট চুল রাখতেন, বাঘ শিকার করতেন এবং দুর্দান্ত পোলো খেলতেন। মাত্র ৯ বছর বয়স থেকেই নিজেই রোলস রয়েস গাড়ি চালাতেন, ওড়াতেন বিমানও। তলোয়ারবাজিতেও ছিলে দুর্দান্ত।

আবিদা সুলতান ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের উত্তর প্রদেশে ভোপালের (বর্তমানে মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত) মুসলিম শাসক পরিবারে জন্ম নেওয়া আবিদা ছিলেন সাহসী ‘বেগমদের’ উত্তরসূরি। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আবিদার পরিবার ভোপাল শাসন করেছে। তিনি সাধারণ নারী, বিশেষত মুসলিম নারীদের ঘিরে প্রচলিত ধ্যানধারণাকে অস্বীকার করে এ ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন।

আবিদা পর্দাপ্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। সে সময়, মুসলিম ও কিছু হিন্দু নারীদের মধ্যে নিজেকে ঢেকে রাখা ও পুরুষদের থেকে আলাদা থাকার নিয়ম ছিল। ছোটবেলা থেকেই আবিদা ছিলেন সাহসী ও স্বাধীনচেতা। ১৩ বছর বয়সে তাঁর দাদি তাঁকে পর্দার মধ্যে থাকতে বাধ্য করতে চাইলে তিনি বিদ্রোহ করেন। তাঁর সাহস আর বাবার উদার মানসিকতার কারণে তিনি আর কখনোই পর্দা মেনে চলেননি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ভোপালের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন।

কয়েক দশক ধরে তিনি তাঁর বাবার রেখে যাওয়া শানসভার সামলেছেন। তিনি তাঁর শাসনামলে ভারতের শীর্ষস্থানীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যে বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে তারও প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন তিনি।

আবিদা ছোটবেলা থেকেই যেন শাসকের হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। তাঁর দাদি কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ সুলতান জাহান—যিনি নিজেও ভোপালের শাসক ছিলেন—তাঁকে নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত আবিদা সুলতান তাঁর আত্মজীবনী ‘মেমোয়ার্স অব আ রেবেল প্রিন্সেসে’—উল্লেখ করেন, কীভাবে তাঁকে ভোর ৪টায় উঠে কোরআন পড়তে হতো। এরপর খেলাধুলা, সংগীত ও ঘোড়দৌড় শেখার পাশাপাশি ঘর ঝাড়ু দেওয়া ও টয়লেট পরিষ্কারের মতো কাজও করতে হতো।

নিজের শৈশব নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে আবিদা সুলতান বলেন, ‘আমরা মেয়েরা কখনোই লিঙ্গের কারণে নিজেদের নিম্নতর ভাবতে শিখিনি। সবকিছুতেই সমতা ছিল। ছেলেদের মতোই আমাদের সব স্বাধীনতা ছিল, আমরা ঘোড়ায় চড়তে পারতাম, গাছে উঠতে পারতাম, যেকোনো খেলাধুলা করতে পারতাম। কোনো বিধিনিষেধ ছিল না।’

ভোপালের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে আবিদা ১২ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী রাজ্য কুরওয়াইয়ের শাসক ও শৈশবের বন্ধু সরওয়ার আলী খানকে সঙ্গে বিয়ে করেন। বিয়ে নিয়ে নিজের মজার অভিজ্ঞতার কথাও আত্মজীবনীতে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন তিনি।

আবিদ তাঁর বইতে লিখেন, একদিন তিনি যখন তাঁর চাচাতো ভাইবোনদের সঙ্গে বালিশ লড়াইয়ে মেতেছিলেন। এ সময় তাঁর দাদি ঘরে ঢুকে তাঁকে একটি বিয়ের জন্য তৈরি হতে বলেন। কিন্তু কেউই তাকে জানায়নি যে, বিয়েটা তাঁর নিজেরই। আবিদা লিখেন, ‘কেউ আমাকে (বিয়ের জন্য) সাজিয়ে-গুছিয়ে দেয়নি বা কীভাবে আচরণ করতে হবে তাও শেখায়নি। ফলে আমি বিয়ে আসরে ঢুকেছিলাম সেখানে জড়সড় হয়ে থাকা নারীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে, মুখ খোলা রেখে এবং বরাবরের মতোই গোমড়া মুখে।’

ভোপালের এই রাজকন্যার বিয়েটি খুবই কম সময় স্থায়ী হয়েছিল—এক দশকেরও কম। তাঁর বৈবাহিক জীবন ছিল কঠিন। বিষয়টি কেবল তাঁর কম বয়সের জন্য নয়, বরং তাঁর স্বামীর পরিবারের কঠোর, ধর্মীয় পরিবেশের জন্যও। আবিদা অকপটে স্বীকার করেছেন, যৌনতা নিয়ে জ্ঞানের অভাব ও অস্বস্তি তাঁর দাম্পত্য জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

আবিদা তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘বিয়ের পরপরই আমি দাম্পত্য যন্ত্রণার জগতে প্রবেশ করি। আমি বুঝতে পারিনি যে, বিয়ের রাতের ঘটনাগুলো আমাকে এতটা আতঙ্কিত, অসাড় ও অপবিত্র অনুভব করাবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আমি কখনোই মেনে নিতে পারিনি।’ এর ফলে তাঁর দাম্পত্য জীবনে ভাঙন ধরে।

দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম নারীদের আত্মজীবনীমূলক লেখায় অন্তরঙ্গতা ও যৌনতা নিয়ে এক গবেষণায় ঐতিহাসিক শিভন ল্যামবার্ট-হার্লি দেখিয়েছেন, যৌনতা নিয়ে আবিদার অকপট বর্ণনা সেই প্রচলিত ধারণা ভেঙে দেয় যে, মুসলিম নারীরা যৌনতা নিয়ে লেখেন না। আবিদার লেখা বরং একটি নির্ভীক এক নারীর চরিত্রকেই উপস্থাপন করেছে।

বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর আবিদা শ্বশুরবাড়ি কুরওয়াই ছেড়ে ভোপালে ফিরে আসেন। তবে একমাত্র সন্তান শাহরিয়ার মোহাম্মদ খানে অভিভাবকত্ব নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এই দীর্ঘ বিরোধে বিরক্ত হয়ে এবং ছেলেকে হারাতে না চেয়ে—আবিদা তাঁর স্বামীকে নিবৃত্ত করতে সাহসী এক পদক্ষেপ নেন। ১৯৩৫ সালের মার্চের এক উষ্ণ রাতে, আবিদা তিন ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে কুরওয়াইয়ে স্বামীর বাড়িতে পৌঁছান। সেখানে তাঁর স্বামীর শোয়ার ঘরে ঢুকে একটি রিভলবার বের করে স্বামীর কোলে ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘হয় আমাকে গুলি করো, না হলে আমি তোমাকে গুলি করব।’

সেদিন আবিদা তাঁর স্বামীর সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন এবং জয়ী হন। এরপর, তিনি নিজ সন্তানকে নিয়ে ফিরে আসেন ছেলেকে লালনপালন করেন। আবিদা সুলতান ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ভোপালের মন্ত্রিসভা পরিচালনা করেন। এরপর ভোপাল ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের সঙ্গে একীভূত হয়।

আবিদা ব্রিটিশ সরকারের আহ্বানে ভারত শাসনব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকগুলোতে অংশ নেন। সেখানে তিনি মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহরু এবং তাঁর ছেলে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগ পরবর্তী সহিংসতাও প্রত্যক্ষ করেন।

নিজের স্মৃতিকথায় আবিদা বর্ণনা করেন, কীভাবে ভোপালে তিনি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন পদে পদে। শতাব্দীর পর শতাব্দী তাঁর পরিবার ভোপালে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করলেও তাদের ‘বহিরাগত’ হিসেবে দেখা শুরু হয় ভারত ভাগের পর। এক সাক্ষাৎকারে তিনি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়কার একটি বিশেষত ভয়াবহ স্মৃতির কথা উল্লেখ করেন।

একদিন ভারত সরকার তাঁকে জানায়, মুসলিম শরণার্থীদের একটি ট্রেন ভোপালে পৌঁছাবে। ট্রেনটির যাত্রীদের দেখভাল করতে তিনি স্টেশনে যান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কামরাগুলো খুলতেই দেখা গেল, সবাই মৃত।’ এ ধরনের সহিংসতা এবং সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসই তাঁকে ১৯৫০ সালে পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য করে।

আবিদা চুপিসারে তাঁর ছেলেকে নিয়ে ভোপাল ছাড়েন, ভালো একটি ভবিষ্যতের আশায়। পাকিস্তানেও তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং গণতন্ত্র এবং নারীর অধিকারের পক্ষে কাজ করেন। ২০০২ সালে করাচিতে তার মৃত্যু হয়।

আবিদা পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর ভারত সরকার তাঁর বোনকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে। ভোপালে আজও আবিদা তাঁর ডাকনাম ‘বিয়া হুজুর’ নামে পরিচিত। ভোপালের নারী শাসকদের নিয়ে গবেষণা করা সাংবাদিক শামস উর রহমান আলভি বলেন, ‘গত কয়েক বছরের ধর্মীয় রাজনীতি তাঁর ঐতিহ্যকে ম্রিয়মাণ করেছে, তাঁকে নিয়ে তেমন কথা হয় না। কিন্তু তাঁর নাম এত সহজে ভুলে যাওয়ার মতো নয়।’

তথ্যসূত্র: বিবিসি

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত