১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে, যার ভিত্তি কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। বাংলাদেশের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা। কথাগুলো এখনো কানে বাজে।
তারপর খুব কম সময়ের মধ্যেই সংবিধান রচিত হয়েছে। সংবিধান রচনার সময় তিনটি নীতির সঙ্গে চতুর্থ নীতি জাতীয়তাবাদ সংযুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ১২ অক্টোবর ১৯৭২ এবং ৪ নভেম্বর ১৯৭২ দীর্ঘ বক্তৃতায় গণপরিষদে এই জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝায়, সেটি তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন।
কিন্তু বর্তমানে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা, আমাদের চিন্তাচেতনা সবকিছুই মনে হয় বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি নয়। কারণ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে একটা জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন তাঁর ভাষণে, জাতীয়তাবাদ আসলে অনুভূতির ব্যাপার এবং আমার বিস্ময় লাগে, জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করেছি কিন্তু সবার এক কথা, যেমন বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন বলেছেন, ‘ন্যাশনালিজম’ হচ্ছে ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’। জাতীয়তাবাদ সব সময় চিন্তাচেতনা-অনুভূতির ব্যাপার—এ কথাটা বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ, তারপরে তো পাল্টা কথা এল—বাংলাদেশি। জাতীয়তাবাদ বলা হলেও এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বছরের পর বছর ধরে, বহু যুগ ধরে আবর্তিত-বিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হয়নি। রাতারাতি একটি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করা যায় না। কিন্তু সে কাজটি করার চেষ্টা হয়েছিল। অথচ বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলতে মূলত বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ বোঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সব মানুষকে নিয়ে একটি মঞ্চে অবস্থান করতে চেয়েছিলেন।
এখন আমাদের দেশে তো দুটো জাতীয়তাবাদ—বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এ কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে বহু যুগের আবর্তন-বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। আর কখনোই রাতারাতি জাতীয়তাবাদের লেবেল বদলিয়ে দেওয়া যায় না।
আরও একটি কথা বলি। বঙ্গবন্ধু সব সময় একটি কথা বলেছেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণেই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। আসলে একটি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে আবর্তিত-বিবর্তিত হয়ে পৌঁছায় তখনই কিন্তু সেই জাতিটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তো বাঙালি সেই জন্য ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জন্মকে অনেকে যে বলেছেন, ‘বার্থ অব আ নেশন বা একটি জাতির জন্ম’—এটা ভুল। জাতিটির জন্ম হয়েছে অনেক আগেই।
জন্ম নেওয়া জাতির জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সে জন্যই কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম। সুতরাং, এটা হবে—‘বাংলাদেশ, বার্থ অব আ স্টেট’। আমার একটি গ্রন্থে আমি ব্যাখ্যা করেছি, একটি জাতির মধ্যে আগে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। তারপর সেই গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রীয় সত্তার সন্ধান করার চেষ্টা করা হয়। বঙ্গবন্ধু সে জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আমাদের রাষ্ট্রীয় চেতনার মধ্যে, নীতি বা আদর্শের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং যে কাজটি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়।
তবে জাতীয়তাবাদের ভুল ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যার কারণে বাংলাদেশে অনেক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সব সময় এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টে লেখা আছে, ‘উই দ্য পিপল অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’। কারণ বহু জাতি নিয়ে দেশটি গঠিত। আমাদেরও বোধ হয় এ কথা লেখা উচিত ছিল—বাংলাদেশ কিন্তু শুধু এক জাতির রাষ্ট্র নয়, শুধু বাঙালি নয়, বাঙালি ছাড়াও ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ৫০টির মতো আছে। সুতরাং এটা বহু জাতির দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অত বড় না হলেও ছোট পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশের পাসপোর্টে লেখা উচিত ছিল, ‘আ সিটিজেন অব বাংলাদেশ’।
জাতীয়তাবাদ—বঙ্গবন্ধু যে উদ্দেশ্য-আদর্শ নিয়ে গড়েছিলেন, অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তা কিন্তু এখন আমরা দেখছি না। রাজনীতির হাতে পড়ে জাতীয়তাবাদ অনেকটা বিকৃত হয়ে গেছে। এটা আমাদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত।
লেখক: ইতিহাসবিদ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে, যার ভিত্তি কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। বাংলাদেশের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা। কথাগুলো এখনো কানে বাজে।
তারপর খুব কম সময়ের মধ্যেই সংবিধান রচিত হয়েছে। সংবিধান রচনার সময় তিনটি নীতির সঙ্গে চতুর্থ নীতি জাতীয়তাবাদ সংযুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ১২ অক্টোবর ১৯৭২ এবং ৪ নভেম্বর ১৯৭২ দীর্ঘ বক্তৃতায় গণপরিষদে এই জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝায়, সেটি তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন।
কিন্তু বর্তমানে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা, আমাদের চিন্তাচেতনা সবকিছুই মনে হয় বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি নয়। কারণ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে একটা জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন তাঁর ভাষণে, জাতীয়তাবাদ আসলে অনুভূতির ব্যাপার এবং আমার বিস্ময় লাগে, জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করেছি কিন্তু সবার এক কথা, যেমন বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন বলেছেন, ‘ন্যাশনালিজম’ হচ্ছে ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’। জাতীয়তাবাদ সব সময় চিন্তাচেতনা-অনুভূতির ব্যাপার—এ কথাটা বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ, তারপরে তো পাল্টা কথা এল—বাংলাদেশি। জাতীয়তাবাদ বলা হলেও এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বছরের পর বছর ধরে, বহু যুগ ধরে আবর্তিত-বিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হয়নি। রাতারাতি একটি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করা যায় না। কিন্তু সে কাজটি করার চেষ্টা হয়েছিল। অথচ বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলতে মূলত বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ বোঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সব মানুষকে নিয়ে একটি মঞ্চে অবস্থান করতে চেয়েছিলেন।
এখন আমাদের দেশে তো দুটো জাতীয়তাবাদ—বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এ কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে বহু যুগের আবর্তন-বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। আর কখনোই রাতারাতি জাতীয়তাবাদের লেবেল বদলিয়ে দেওয়া যায় না।
আরও একটি কথা বলি। বঙ্গবন্ধু সব সময় একটি কথা বলেছেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কারণেই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। আসলে একটি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে আবর্তিত-বিবর্তিত হয়ে পৌঁছায় তখনই কিন্তু সেই জাতিটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তো বাঙালি সেই জন্য ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জন্মকে অনেকে যে বলেছেন, ‘বার্থ অব আ নেশন বা একটি জাতির জন্ম’—এটা ভুল। জাতিটির জন্ম হয়েছে অনেক আগেই।
জন্ম নেওয়া জাতির জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সে জন্যই কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম। সুতরাং, এটা হবে—‘বাংলাদেশ, বার্থ অব আ স্টেট’। আমার একটি গ্রন্থে আমি ব্যাখ্যা করেছি, একটি জাতির মধ্যে আগে জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। তারপর সেই গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রীয় সত্তার সন্ধান করার চেষ্টা করা হয়। বঙ্গবন্ধু সে জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আমাদের রাষ্ট্রীয় চেতনার মধ্যে, নীতি বা আদর্শের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং যে কাজটি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়।
তবে জাতীয়তাবাদের ভুল ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যার কারণে বাংলাদেশে অনেক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সব সময় এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টে লেখা আছে, ‘উই দ্য পিপল অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’। কারণ বহু জাতি নিয়ে দেশটি গঠিত। আমাদেরও বোধ হয় এ কথা লেখা উচিত ছিল—বাংলাদেশ কিন্তু শুধু এক জাতির রাষ্ট্র নয়, শুধু বাঙালি নয়, বাঙালি ছাড়াও ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ৫০টির মতো আছে। সুতরাং এটা বহু জাতির দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অত বড় না হলেও ছোট পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশের পাসপোর্টে লেখা উচিত ছিল, ‘আ সিটিজেন অব বাংলাদেশ’।
জাতীয়তাবাদ—বঙ্গবন্ধু যে উদ্দেশ্য-আদর্শ নিয়ে গড়েছিলেন, অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তা কিন্তু এখন আমরা দেখছি না। রাজনীতির হাতে পড়ে জাতীয়তাবাদ অনেকটা বিকৃত হয়ে গেছে। এটা আমাদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত।
লেখক: ইতিহাসবিদ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪তত্ত্বগতভাবে সেক্যুলারিজমের ধারণা কয়েক শতাব্দী ধরে পাশ্চাত্যে এবং তারপরে প্রাচ্যে বিকাশ লাভ করেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে বাস্তব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সেক্যুলারিজমের স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুরই অবদান। শেখ মুজিব বাস্তব ঘটনাবলি দেখে উপলব্ধি করেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিব
১৭ মার্চ ২০২৪