জাহাঙ্গীর আলম
ইংরেজ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস উনিশ শতকের প্রথমভাগে একটি বিখ্যাত জনমিতিক তত্ত্ব প্রচার করেন। এ তত্ত্বের প্রস্তাব হলো— খাদ্যশস্যের উৎপাদন যখন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায় তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। ম্যালথাসের এই তত্ত্ব অনুসারে স্বাভাবিক নিয়মে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যসংকট এমনকি দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী। এই কারণে ম্যালথাস মনে করতেন, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ মারা পড়বে এবং এভাবেই জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
তৎকালীন বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এই তত্ত্ব অনেকখানি সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কৃষি, চিকিৎসা ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের হাত ধরে আর জনসংখ্যা বাড়েনি, উল্টো উন্নত দেশে দ্রুত জন্মহার কমেছে। সেটি এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে, শিল্পোন্নত দেশগুলো রীতিমতো জনসংখ্যা হ্রাসের সংকটে পড়েছে। এমনকি তরুণ (প্রজননক্ষম) জনগোষ্ঠীকে নানা প্রণোদনা দিয়েও সন্তান গ্রহণে উৎসাহিত করা যাচ্ছে না।
অথচ এক সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে নীতি নির্ধারকেরা চরম উদ্বেগে ছিলেন। ১৯৬০–এর দশকে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ৩ বিলিয়নের কিছু বেশি। ওই সময় জন্মহার ছিল বছরে প্রায় দুই শতাংশ। মানুষের ইতিহাসে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছিল জনসংখ্যা। অবশ্য এর আগের দুই বা তিন শতাব্দীতে জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারেই বাড়ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ২০ পর সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে শুরু করে।
যিশুখ্রিষ্টের সময় থেকে ১৭ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৭০০ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আবার প্রায় ২০০ বছরে এর দ্বিগুণ হয়। এরপর ১০০ বছরেরও কম সময়ে এর দ্বিগুণ হয়। ১৯৬০–এর দশকে উদ্বেগের বিষয় ছিল, ওই সময়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্থির থাকলে প্রতি ৩৫ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে। ওই সময় জনমিতি বিশারদেরা বলেছিলেন, বছরে দুই শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে দুই শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ১৫ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে। নীতি নির্ধারকেরা জোর বলাবলি শুরু করেছিলেন—মানবজাতির সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই গতি কমাতেই হবে। আর এর জন্য হয় বিশ্বের জন্মহার কমাতে হবে, অথবা কোনো কারণে মৃত্যুর হার অবশ্যই বাড়তে হবে।
অবশ্য ওই সময় বিশ্বের সব অঞ্চলে জনসংখ্যা সমান হারে বাড়েনি। যে প্রবণতা এখনো বিদ্যমান। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে—জাপান এবং ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে তখন তুলনামূলকভাবে ধীরে জনসংখ্যা বাড়ছিল। আর শিল্পোন্নত দেশগুলোর আরেকটি গ্রুপ—যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং আর্জেন্টিনা—দেশগুলোতে জাপান ও ইউরোপের ওই দেশগুলোর তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার কিছুটা বেশি ছিল।
অপরদিকে এশিয়া (জাপান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের এশিয়া অংশ বাদে), দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ (প্রধানত ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া), আফ্রিকা (ইউরোপীয় সংখ্যালঘুরা বাদে), ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং লাতিন আমেরিকা (আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ে বাদে)—মাঝারি থেকে খুব দ্রুত হারে জনসংখ্যা বাড়ছিল। এ সমস্ত এলাকায় বার্ষিক বৃদ্ধির হার দেড় থেকে তিন শতাংশের মধ্যে ছিল।
জনসংখ্যা হ্রাসের সমস্যা এরই মধ্যে টের পেতে শুরু করেছে চীন। যদিও বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন। সম্প্রতি ৬০ বছরের মধ্যে জনসংখ্যা হ্রাসের রেকর্ড করেছে দেশটি।
এক কোটির কিছু বেশি মানুষ বাস করে এমন আটটি দেশ গত এক দশকে ধারাবাহিকভাবে জনসংখ্যা হ্রাস দেখছে। এর বেশির ভাগই ইউরোপীয়। ইউক্রেনের জনসংখ্যা রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে হ্রাস পেয়েছে। ইতালি, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং গ্রিসেও মানুষের সংখ্যা কমছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপের এই দেশগুলোতে নারী প্রতি শিশুর জন্ম মাত্র ১ দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক ৬। জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে এর হার ২-এর বেশি হতে হবে।
পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং গ্রিসে একটি বিশাল অংশ বাইরে অভিবাসী হচ্ছে। এসব দেশে মানুষের মধ্যে বিদেশে গিয়ে বসবাসের প্রবণতা বেশি। ইউরোপের বাইরে জাপানও প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমছে। প্রতি নারীর বিপরীতে শিশুর সংখ্যা ১ দশমিক ৩। সেই সঙ্গে এখানে অভিবাসীর সংখ্যা অত্যন্ত কম। বিপরীতে জাপানে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি বড় সংকট হয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৩০ লাখের বেশি মানুষ হারিয়েছে জাপান।
মধ্যপ্রাচ্যেও একই অবস্থা। সিরিয়ায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের কারণে জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে। লক্ষাধিক শরণার্থী প্রতিবেশী দেশ এবং দূরের কোনো দেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের (এসওএইচআর) অনুমান, যুদ্ধে প্রায় ৬ লাখ ৬ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০২২ সালের জনশুমারির প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে দেশে জন্মহার কমেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৩০ বছর যাবৎই বাংলাদেশে জন্মহার ধারাবাহিকভাবে কমছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জন্মহার ছিল ২ দশমিক ১৭ শতাংশ, সর্বশেষ ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ। জন্মহার কমলেও বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। তবে হ্রাসের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এখানেও জনসংখ্যার সংকট দেখা দেবে।
জনসংখ্যা হ্রাসে কিসের প্রভাব
আন্তর্জাতিক অভিবাসন ওই বৃদ্ধির হারে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব ফেলেনি। যেটি বর্তমানে ইউরোপের কিছু দেশে দেখা যাচ্ছে।
ওই গবেষকেরা দেখেছেন, জন্মহার হ্রাসের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল বিবাহিতদের মধ্যে প্রজনন সক্ষমতার ওপর ইচ্ছাকৃত নিয়ন্ত্রণ। অবশ্য এর একমাত্র ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছিল আয়ারল্যান্ডে। সেখানে বেশি বয়সে বিয়ে এবং অবিবাহিত থাকার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। ওই দেশে বিয়ের গড় বয়স বেড়ে হয়েছিল ২৮ বছর। আইরিশ নারীদের এক চতুর্থাংশেরও বেশি ৪৫ বছর বয়সে অবিবাহিত থেকে যেতেন।
অবশ্য অন্যান্য দেশে আয়ারল্যান্ডের মতো সামাজিক পরিবর্তন জন্মের হারের ওপর নগণ্য বা অনুকূল প্রভাব ফেলেছে। এই দেশগুলোতে—ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, নিম্ন দেশ (উত্তর–পশ্চিম ইউরোপের উপকূলীয় দেশ—বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং লুক্সেমবার্গ), জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্স—বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে গর্ভনিরোধ পদ্ধতি গ্রহণ চর্চার কারণে জন্মহার কমে যায়। তবে বর্তমান সময়ের মতো প্রজনন সক্ষমতার কমে যাওয়ার কোনো উদ্বেগ তখন ছিল না। বরং খাদ্য, পুষ্টি, উন্নত চিকিৎসা এবং উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণে বরং মানুষের প্রজনন সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল।
পশ্চিম ইউরোপে জন্মহার হ্রাসের একটি সামান্য অংশই গর্ভনিরোধের আধুনিক কৌশল উদ্ভাবনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এর কারণ প্রথমত, কিছু ইউরোপীয় দেশে গর্ভনিরোধক কৌশলের উদ্ভাবন এবং ব্যাপক উৎপাদনের আগে জন্মহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, সমীক্ষা থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগের মতো গ্রেট ব্রিটেনের অর্ধেকেরও বেশি দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুশীলন করছিল। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতেও একই পরিস্থিতি ছিল।
তার মানে, জন্মহার হ্রাস গর্ভনিরোধের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ফলাফল নয়। বরং বিবাহিত দম্পতিরা বহু শতাব্দী ধরে চর্চিত স্থানীয় পদ্ধতি অবলম্বন করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপের জন্মহার পতনকে ব্যাখ্যা করতে হলে সেখানকার অধিবাসীদের কম সন্তান ধারণের জন্য নিজেদের যৌন আচরণ পরিবর্তন করার ইচ্ছাকেই বিবেচনায় নিতে হবে। মনোভাবের এই ধরনের পরিবর্তন নিঃসন্দেহে পশ্চিম ইউরোপের শিল্পায়ন ও আধুনিকীকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের একটি অংশ ছিল।
মনোভাবের এই বিশেষ পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত কারণগুলোর মধ্যে সন্তান জন্মদানের অর্থনৈতিক পরিণতির পরিবর্তন অন্যতম। প্রাক-শিল্প-প্রধান কৃষিভিত্তিক সমাজে শিশুরা অল্প বয়সেই কাজে সাহায্য করতে শুরু করে; আধুনিক সময়ে শিক্ষাগ্রহণের দীর্ঘ সময়ে তারা অভিভাবকের ওপর নির্ভরশীল থাকে না। তারা বৃদ্ধ পিতামাতার অবলম্বন হয়ে ওঠে, সেই সঙ্গে উচ্চ মৃত্যুহার বেশি সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় অনুঘটক ছিল। অন্যদিকে, একটি শহুরে, শিল্পোন্নত সমাজে শিশুদের ‘অর্থনৈতিক মূল্য’ কম, বিপরীতে তারা বড় ‘অর্থনৈতিক বোঝা’!
মনোভাবের পরিবর্তনের জন্য দায়ী হতে পারে এমন সামাজিক কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো—অর্থনৈতিক একক হিসেবে পরিবারের গুরুত্ব কমে যাওয়া। ইউরোপের শিল্পায়ন এবং আধুনিকীকরণের সঙ্গে এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। একটি শিল্পোন্নত অর্থনীতিতে পরিবার আর উৎপাদনের একক থাকে না। এ ধরনের পরিবারে বা সমাজে ব্যক্তিকে বিচার করা হয় কে কার চেয়ে বেশি উপার্জন করে তা দিয়ে। সন্তানেরা বড় হয়ে চাকরির খোঁজে বাড়ি ছাড়ে। বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে আর সন্তানদের ওপর নির্ভর করে না।
এই ধরনের আধুনিকীকরণ চলতে থাকায় নারীদের জন্যও জনশিক্ষা প্রসারিত হয়। এই শিক্ষা একটি শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরির জন্য অপরিহার্য। এইভাবে নারীদের ঐতিহ্যগত অধস্তন ভূমিকায় থাকার পরিবর্তিত ঘটে। যেহেতু শিশুদের যত্নের ভার পড়ে মূলত নারীদের ওপর, তাই নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি সম্ভবত পরিবারের আকার ইচ্ছাকৃতভাবে ছোট করে আনার মনোভাব বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এ ছাড়া একটি দেশের শিল্পায়ন এবং আধুনিকীকরণের বৈশিষ্ট্যযুক্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলো প্রথা ও ঐতিহ্যের জায়গায় ধর্মনিরপেক্ষতা, বাস্তববাদ এবং যুক্তিবাদের উত্থানের পাশাপাশি ঘটে। যেহেতু একটি জাতির আধুনিকায়নের সঙ্গে পরিবেশের ক্রমবর্ধমান পরিসরের ওপর মানুষের ইচ্ছাকৃত নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেহেতু এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে, শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে বিকশিত একটি অর্থনীতিতে বসবাসকারী লোকেরা তাদের নিয়ন্ত্রণের পরিসর—নিজেদের যৌন কার্যকলাপের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেবে কি না—সে পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে।
ব্যক্তিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভোগের নানা ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ার কারণে অনেক মানুষ এখন অবিবাহিত থাকতেই পছন্দ করছে। শুধু ক্যারিয়ারের কথা বিবেচনায় চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে মেয়েরা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে জড়াচ্ছে না। উন্নত দেশে সন্তান লালন–পালন এখন রীতিমতো আভিজাত্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ নিজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি একটি সন্তান লালন পালনের সামর্থ্য রাখাটা সক্ষমতার প্রশ্নে সামাজিক মর্যাদার বৃদ্ধির বিষয় বলেই মনে করেন অনেকে!
এটি স্পষ্ট যে, শিল্পায়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জন্মহার ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। তবে জন্মহার কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসবের প্রভাব বেশ ধীর। এর জন্য দরকার হয় সমাজে গভীরভাবে প্রবিষ্ট প্রথার পরিবর্তন।
জনসংখ্যা হ্রাসের প্রভাব
তরুণেরা যখন বড় শহর এবং শহরে চলে যায়, তখন তারা যে জায়গাটি রেখে যায় সেখানে জনসংখ্যার গড় বয়স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে যায়। বয়স্ক বাসিন্দাদের উচ্চ অনুপাতসহ একটি সমাজ তখন ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের জন্য কম আকর্ষণীয় হতে থাকে। কারণ স্থানীয়ভাবে উপযুক্ত কর্মী খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ভোক্তার সংকটে পড়ে ব্যবসা আর লাভজনক থাকে না।
কম শিশু থাকার কারণে কমবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; আবাসন ব্যবসায় ধস নামবে; বহু বাড়ি খালি পড়ে থাকবে; কেয়ার হোমের সংকট তৈরি হবে; ভোক্তা কমে যাওয়ায় ব্যবসা–বাণিজ্যের টার্নওভার কমবে; খেলাধুলার সুযোগ কমবে; থিয়েটার, সিনেমা বা কনসার্টে কম লোক যাবে, ফলে এ ধরনের চর্চার সুযোগ কমবে; গণপরিবহনে কম লোক যাতায়াত করবে, ফলে চলাচল হয়ে উঠবে ব্যয়বহুল; স্থানীয় বাসিন্দাদের তাদের পছন্দের স্থানে যেতে অনেক দূর ভ্রমণ করতে হবে— ইত্যাদি।
তথ্যসূত্র: যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমিস প্রেস, বিবিসি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
ইংরেজ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস উনিশ শতকের প্রথমভাগে একটি বিখ্যাত জনমিতিক তত্ত্ব প্রচার করেন। এ তত্ত্বের প্রস্তাব হলো— খাদ্যশস্যের উৎপাদন যখন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায় তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। ম্যালথাসের এই তত্ত্ব অনুসারে স্বাভাবিক নিয়মে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যসংকট এমনকি দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী। এই কারণে ম্যালথাস মনে করতেন, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ মারা পড়বে এবং এভাবেই জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
তৎকালীন বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এই তত্ত্ব অনেকখানি সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কৃষি, চিকিৎসা ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের হাত ধরে আর জনসংখ্যা বাড়েনি, উল্টো উন্নত দেশে দ্রুত জন্মহার কমেছে। সেটি এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে, শিল্পোন্নত দেশগুলো রীতিমতো জনসংখ্যা হ্রাসের সংকটে পড়েছে। এমনকি তরুণ (প্রজননক্ষম) জনগোষ্ঠীকে নানা প্রণোদনা দিয়েও সন্তান গ্রহণে উৎসাহিত করা যাচ্ছে না।
অথচ এক সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে নীতি নির্ধারকেরা চরম উদ্বেগে ছিলেন। ১৯৬০–এর দশকে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ৩ বিলিয়নের কিছু বেশি। ওই সময় জন্মহার ছিল বছরে প্রায় দুই শতাংশ। মানুষের ইতিহাসে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছিল জনসংখ্যা। অবশ্য এর আগের দুই বা তিন শতাব্দীতে জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারেই বাড়ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ২০ পর সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে শুরু করে।
যিশুখ্রিষ্টের সময় থেকে ১৭ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৭০০ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আবার প্রায় ২০০ বছরে এর দ্বিগুণ হয়। এরপর ১০০ বছরেরও কম সময়ে এর দ্বিগুণ হয়। ১৯৬০–এর দশকে উদ্বেগের বিষয় ছিল, ওই সময়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্থির থাকলে প্রতি ৩৫ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হবে। ওই সময় জনমিতি বিশারদেরা বলেছিলেন, বছরে দুই শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে দুই শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ১৫ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে। নীতি নির্ধারকেরা জোর বলাবলি শুরু করেছিলেন—মানবজাতির সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই গতি কমাতেই হবে। আর এর জন্য হয় বিশ্বের জন্মহার কমাতে হবে, অথবা কোনো কারণে মৃত্যুর হার অবশ্যই বাড়তে হবে।
অবশ্য ওই সময় বিশ্বের সব অঞ্চলে জনসংখ্যা সমান হারে বাড়েনি। যে প্রবণতা এখনো বিদ্যমান। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে—জাপান এবং ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে তখন তুলনামূলকভাবে ধীরে জনসংখ্যা বাড়ছিল। আর শিল্পোন্নত দেশগুলোর আরেকটি গ্রুপ—যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং আর্জেন্টিনা—দেশগুলোতে জাপান ও ইউরোপের ওই দেশগুলোর তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার কিছুটা বেশি ছিল।
অপরদিকে এশিয়া (জাপান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের এশিয়া অংশ বাদে), দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ (প্রধানত ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া), আফ্রিকা (ইউরোপীয় সংখ্যালঘুরা বাদে), ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং লাতিন আমেরিকা (আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ে বাদে)—মাঝারি থেকে খুব দ্রুত হারে জনসংখ্যা বাড়ছিল। এ সমস্ত এলাকায় বার্ষিক বৃদ্ধির হার দেড় থেকে তিন শতাংশের মধ্যে ছিল।
জনসংখ্যা হ্রাসের সমস্যা এরই মধ্যে টের পেতে শুরু করেছে চীন। যদিও বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন। সম্প্রতি ৬০ বছরের মধ্যে জনসংখ্যা হ্রাসের রেকর্ড করেছে দেশটি।
এক কোটির কিছু বেশি মানুষ বাস করে এমন আটটি দেশ গত এক দশকে ধারাবাহিকভাবে জনসংখ্যা হ্রাস দেখছে। এর বেশির ভাগই ইউরোপীয়। ইউক্রেনের জনসংখ্যা রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে হ্রাস পেয়েছে। ইতালি, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং গ্রিসেও মানুষের সংখ্যা কমছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপের এই দেশগুলোতে নারী প্রতি শিশুর জন্ম মাত্র ১ দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক ৬। জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে এর হার ২-এর বেশি হতে হবে।
পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং গ্রিসে একটি বিশাল অংশ বাইরে অভিবাসী হচ্ছে। এসব দেশে মানুষের মধ্যে বিদেশে গিয়ে বসবাসের প্রবণতা বেশি। ইউরোপের বাইরে জাপানও প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমছে। প্রতি নারীর বিপরীতে শিশুর সংখ্যা ১ দশমিক ৩। সেই সঙ্গে এখানে অভিবাসীর সংখ্যা অত্যন্ত কম। বিপরীতে জাপানে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি বড় সংকট হয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৩০ লাখের বেশি মানুষ হারিয়েছে জাপান।
মধ্যপ্রাচ্যেও একই অবস্থা। সিরিয়ায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের কারণে জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে। লক্ষাধিক শরণার্থী প্রতিবেশী দেশ এবং দূরের কোনো দেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের (এসওএইচআর) অনুমান, যুদ্ধে প্রায় ৬ লাখ ৬ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০২২ সালের জনশুমারির প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে দেশে জন্মহার কমেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৩০ বছর যাবৎই বাংলাদেশে জন্মহার ধারাবাহিকভাবে কমছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জন্মহার ছিল ২ দশমিক ১৭ শতাংশ, সর্বশেষ ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ। জন্মহার কমলেও বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। তবে হ্রাসের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এখানেও জনসংখ্যার সংকট দেখা দেবে।
জনসংখ্যা হ্রাসে কিসের প্রভাব
আন্তর্জাতিক অভিবাসন ওই বৃদ্ধির হারে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব ফেলেনি। যেটি বর্তমানে ইউরোপের কিছু দেশে দেখা যাচ্ছে।
ওই গবেষকেরা দেখেছেন, জন্মহার হ্রাসের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল বিবাহিতদের মধ্যে প্রজনন সক্ষমতার ওপর ইচ্ছাকৃত নিয়ন্ত্রণ। অবশ্য এর একমাত্র ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছিল আয়ারল্যান্ডে। সেখানে বেশি বয়সে বিয়ে এবং অবিবাহিত থাকার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। ওই দেশে বিয়ের গড় বয়স বেড়ে হয়েছিল ২৮ বছর। আইরিশ নারীদের এক চতুর্থাংশেরও বেশি ৪৫ বছর বয়সে অবিবাহিত থেকে যেতেন।
অবশ্য অন্যান্য দেশে আয়ারল্যান্ডের মতো সামাজিক পরিবর্তন জন্মের হারের ওপর নগণ্য বা অনুকূল প্রভাব ফেলেছে। এই দেশগুলোতে—ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, নিম্ন দেশ (উত্তর–পশ্চিম ইউরোপের উপকূলীয় দেশ—বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং লুক্সেমবার্গ), জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্স—বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে গর্ভনিরোধ পদ্ধতি গ্রহণ চর্চার কারণে জন্মহার কমে যায়। তবে বর্তমান সময়ের মতো প্রজনন সক্ষমতার কমে যাওয়ার কোনো উদ্বেগ তখন ছিল না। বরং খাদ্য, পুষ্টি, উন্নত চিকিৎসা এবং উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণে বরং মানুষের প্রজনন সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল।
পশ্চিম ইউরোপে জন্মহার হ্রাসের একটি সামান্য অংশই গর্ভনিরোধের আধুনিক কৌশল উদ্ভাবনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এর কারণ প্রথমত, কিছু ইউরোপীয় দেশে গর্ভনিরোধক কৌশলের উদ্ভাবন এবং ব্যাপক উৎপাদনের আগে জন্মহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, সমীক্ষা থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগের মতো গ্রেট ব্রিটেনের অর্ধেকেরও বেশি দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুশীলন করছিল। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতেও একই পরিস্থিতি ছিল।
তার মানে, জন্মহার হ্রাস গর্ভনিরোধের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ফলাফল নয়। বরং বিবাহিত দম্পতিরা বহু শতাব্দী ধরে চর্চিত স্থানীয় পদ্ধতি অবলম্বন করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপের জন্মহার পতনকে ব্যাখ্যা করতে হলে সেখানকার অধিবাসীদের কম সন্তান ধারণের জন্য নিজেদের যৌন আচরণ পরিবর্তন করার ইচ্ছাকেই বিবেচনায় নিতে হবে। মনোভাবের এই ধরনের পরিবর্তন নিঃসন্দেহে পশ্চিম ইউরোপের শিল্পায়ন ও আধুনিকীকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের একটি অংশ ছিল।
মনোভাবের এই বিশেষ পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত কারণগুলোর মধ্যে সন্তান জন্মদানের অর্থনৈতিক পরিণতির পরিবর্তন অন্যতম। প্রাক-শিল্প-প্রধান কৃষিভিত্তিক সমাজে শিশুরা অল্প বয়সেই কাজে সাহায্য করতে শুরু করে; আধুনিক সময়ে শিক্ষাগ্রহণের দীর্ঘ সময়ে তারা অভিভাবকের ওপর নির্ভরশীল থাকে না। তারা বৃদ্ধ পিতামাতার অবলম্বন হয়ে ওঠে, সেই সঙ্গে উচ্চ মৃত্যুহার বেশি সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় অনুঘটক ছিল। অন্যদিকে, একটি শহুরে, শিল্পোন্নত সমাজে শিশুদের ‘অর্থনৈতিক মূল্য’ কম, বিপরীতে তারা বড় ‘অর্থনৈতিক বোঝা’!
মনোভাবের পরিবর্তনের জন্য দায়ী হতে পারে এমন সামাজিক কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো—অর্থনৈতিক একক হিসেবে পরিবারের গুরুত্ব কমে যাওয়া। ইউরোপের শিল্পায়ন এবং আধুনিকীকরণের সঙ্গে এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। একটি শিল্পোন্নত অর্থনীতিতে পরিবার আর উৎপাদনের একক থাকে না। এ ধরনের পরিবারে বা সমাজে ব্যক্তিকে বিচার করা হয় কে কার চেয়ে বেশি উপার্জন করে তা দিয়ে। সন্তানেরা বড় হয়ে চাকরির খোঁজে বাড়ি ছাড়ে। বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে আর সন্তানদের ওপর নির্ভর করে না।
এই ধরনের আধুনিকীকরণ চলতে থাকায় নারীদের জন্যও জনশিক্ষা প্রসারিত হয়। এই শিক্ষা একটি শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরির জন্য অপরিহার্য। এইভাবে নারীদের ঐতিহ্যগত অধস্তন ভূমিকায় থাকার পরিবর্তিত ঘটে। যেহেতু শিশুদের যত্নের ভার পড়ে মূলত নারীদের ওপর, তাই নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি সম্ভবত পরিবারের আকার ইচ্ছাকৃতভাবে ছোট করে আনার মনোভাব বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এ ছাড়া একটি দেশের শিল্পায়ন এবং আধুনিকীকরণের বৈশিষ্ট্যযুক্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলো প্রথা ও ঐতিহ্যের জায়গায় ধর্মনিরপেক্ষতা, বাস্তববাদ এবং যুক্তিবাদের উত্থানের পাশাপাশি ঘটে। যেহেতু একটি জাতির আধুনিকায়নের সঙ্গে পরিবেশের ক্রমবর্ধমান পরিসরের ওপর মানুষের ইচ্ছাকৃত নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেহেতু এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে, শিল্পায়নের মধ্য দিয়ে বিকশিত একটি অর্থনীতিতে বসবাসকারী লোকেরা তাদের নিয়ন্ত্রণের পরিসর—নিজেদের যৌন কার্যকলাপের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেবে কি না—সে পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে।
ব্যক্তিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভোগের নানা ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ার কারণে অনেক মানুষ এখন অবিবাহিত থাকতেই পছন্দ করছে। শুধু ক্যারিয়ারের কথা বিবেচনায় চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে মেয়েরা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে জড়াচ্ছে না। উন্নত দেশে সন্তান লালন–পালন এখন রীতিমতো আভিজাত্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ নিজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি একটি সন্তান লালন পালনের সামর্থ্য রাখাটা সক্ষমতার প্রশ্নে সামাজিক মর্যাদার বৃদ্ধির বিষয় বলেই মনে করেন অনেকে!
এটি স্পষ্ট যে, শিল্পায়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জন্মহার ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। তবে জন্মহার কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসবের প্রভাব বেশ ধীর। এর জন্য দরকার হয় সমাজে গভীরভাবে প্রবিষ্ট প্রথার পরিবর্তন।
জনসংখ্যা হ্রাসের প্রভাব
তরুণেরা যখন বড় শহর এবং শহরে চলে যায়, তখন তারা যে জায়গাটি রেখে যায় সেখানে জনসংখ্যার গড় বয়স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে যায়। বয়স্ক বাসিন্দাদের উচ্চ অনুপাতসহ একটি সমাজ তখন ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের জন্য কম আকর্ষণীয় হতে থাকে। কারণ স্থানীয়ভাবে উপযুক্ত কর্মী খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ভোক্তার সংকটে পড়ে ব্যবসা আর লাভজনক থাকে না।
কম শিশু থাকার কারণে কমবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; আবাসন ব্যবসায় ধস নামবে; বহু বাড়ি খালি পড়ে থাকবে; কেয়ার হোমের সংকট তৈরি হবে; ভোক্তা কমে যাওয়ায় ব্যবসা–বাণিজ্যের টার্নওভার কমবে; খেলাধুলার সুযোগ কমবে; থিয়েটার, সিনেমা বা কনসার্টে কম লোক যাবে, ফলে এ ধরনের চর্চার সুযোগ কমবে; গণপরিবহনে কম লোক যাতায়াত করবে, ফলে চলাচল হয়ে উঠবে ব্যয়বহুল; স্থানীয় বাসিন্দাদের তাদের পছন্দের স্থানে যেতে অনেক দূর ভ্রমণ করতে হবে— ইত্যাদি।
তথ্যসূত্র: যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমিস প্রেস, বিবিসি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১৯ ঘণ্টা আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে