দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ
অনলাইন ডেস্ক
শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনামলের অবসান ঘটে চলতি বছরের ৫ আগস্ট। তাঁর পতনে অনেকেই অবাক হয়েছেন। পতনের আগের দিন পর্যন্তও কেউ অনুমান করতে পারেনি যে, তাঁর সময় শেষ। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর তাঁর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন, হাসিনার শাসন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকবে।
হাসিনা তাঁর শাসনামলে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়ার মতো শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বহু বছর ধরেই অনুমান করেছেন, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে চীনের মতো ‘কর্তৃত্ববাদী’ মডেলের দিকে ঝুঁকেছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করা এবং ‘অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল’ সরকার ব্যবস্থা চাপানোর দিক থেকে হাসিনার কৌশল চীনা শাসনব্যবস্থার সঙ্গে কিছুটা মেলে।
চীনা মডেল অনুসরণের চেষ্টা করেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হন হাসিনা। প্রথমত, তাঁর আদর্শ সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি এবং দ্বিতীয়ত, ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট তাঁর সরকারের বৈধতাকে দুর্বল করেছে।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, হাসিনার শাসনকাল ক্রমেই চীনের একদলীয় মডেলের মতো হয়ে উঠছিল। দীর্ঘ সময়ের শাসনে হাসিনা ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক ভারসাম্য ভেঙে দিয়েছেন। বিচার ব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও নির্বাচনী ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেছেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) মতো তাঁর সরকারও বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করেছে, বিরোধী দলগুলোকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে।
হাসিনা সরকার উগ্রবাদ, অপরাধ ও মাদক-সম্পর্কিত অপরাধের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করেছে। আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক বৈধতার ভিত্তি হিসেবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দলটির ভূমিকাকে সামনে এনেছে। ঠিক যেমন, সিসিপি তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনা বিপ্লবের ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে। এসব কারণে, হাসিনার আমলে বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টিকে চীনের একদলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হতো।
তবে হাসিনা চীনা মডেল পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারেননি। চীনের কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থার সাফল্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ‘ম্যাস লাইন’ কৌশলের গভীরে প্রোথিত। এই কৌশল জনগণের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে শাসন পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করে। কমিউনিস্ট নেতা লি লিসান সর্বপ্রথম এই ধারণা হাজির করেন। পরে মাও সেতুং এটিকে আরও পরিশীলিত করেন। এই কৌশলের ভিত্তিতে সরকার জনগণের চাহিদা বুঝতে ও তা কাজকর্মে প্রতিফলিত করতে সচেষ্ট থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সিসিপি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন, ২০১০—এর দশকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দেহ ব্যবসাবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে জনগণের দাবির ভিত্তিতে। এ ছাড়া, সিপিসি চীনা সমাজের মূল ভিত্তি কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
বিপরীতে, হাসিনার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল ‘এলিটিস্ট’ বা অভিজাতপন্থী। এ কারণে দলটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাঁর মতাদর্শকে ‘বাঙালি-আওয়ামিবাদ’ বা ‘হাসিনাবাদ’ বলা যেতে পারে। এই বিষয়টি মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘মুজিববাদের’ উত্তরাধিকার—বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা থেকে উদ্ভূত। বাঙালি জাতীয়তাবাদ হাসিনার শাসনামলে এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশর সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা এক পরিচয় ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
মুজিববাদ অনেকটাই ইসলামপন্থার বিরোধী ছিল। কারণ, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসলামপন্থী দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। হাসিনা এই আদর্শকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে’ জোরদার করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতায় এই ‘চেতনা’ হয়ে উঠেছিল বিভাজনের মস্ত হাতিয়ার। যারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতেন, তাদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হতো এবং এই ‘চেতনার’ ফিল্টারে ফেলে তাদের পাকিস্তানের পক্ষের সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তাঁর আমলে আওয়ামী লীগ সমর্থন করা ছিল প্রকৃত বাঙালি হওয়ার সমার্থক এবং এর মাধ্যমে হাসিনার মতাদর্শ বিরোধীদের মানবিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করেছিল।
এই ‘নির্মিত’ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বা বাঙালি আওয়ামীবাদের নেতৃত্বে ছিল এলিট শ্রেণি। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গ্রামীণ গরিব, ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই অংশ বাঙালি আওয়ামীবাদের ন্যারেটিভের বাইরে ছিল। হাসিনার রাজনৈতিক মতাদর্শে তৃণমূলের অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। এই বিষয়টি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তীব্রভাবে বৈপরীত্যপূর্ণ। এই বিচ্ছিন্নতা হাসিনার ক্ষমতায় কেন্দ্রীভূতকরণের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ বাধা ছিল। যে বিষয়টি চীনের শাসকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে, সেই বিষয়টি শেখ হাসিনার আওয়ামীবাদে অনুপস্থিত ছিল। জনগণের বড় একটি অংশকে বঞ্চিত করে এবং তাঁর শাসনকে এলিট শ্রেণি ও ‘বিভাজনমূলক’ আদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার মাধ্যমে হাসিনা তাঁর অজনপ্রিয়তার বীজ বপন করেছিলেন।
আরেকটি যে গুরুত্বপূর্ণ কারণে হাসিনা চীনের সাফল্য অনুকরণ করতে পারেননি, তা হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক পতন। যেখানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শাসন-কর্তৃত্ব অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণে আরও দৃঢ় হয়েছে, সেখানে হাসিনার শাসন ২০২১ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। এর আগ পর্যন্ত, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল হিসেবে দেখা হতো, এমনকি ‘এশিয়ান টাইগার’ হিসেবেও বাংলাদেশকে অভিহিত করা হতো। কিন্তু ২০২১ সালের পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত পতন শুরু হয়।
২০২১ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের জুন মাসে তা নেমে দাঁড়ায় মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলারে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। এর ফলে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বহন কঠিন হয়ে পড়ে। এই অর্থনৈতিক অস্থিরতা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি ও যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে। কারণ, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবন ধারণ করতে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাচ্ছিল। এক সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে হাসিনা সরকার, কিন্তু সময়ের ব্যবধান তাদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
চীন কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের দারিদ্র্য দূর করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠেছে। চীনের সরকার সামাজিক শৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং এই বিষয়টি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এর বিপরীতে, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক শক্তি হ্রাস পেয়েছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার চ্যালেঞ্জগুলো তাঁর শাসনকে আরও জনবিচ্ছিন্ন করেছে।
চীনে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ধর্মীয় দলগুলোর সরকার বিরোধিতা নেই। বিপরীতে বাংলাদেশে একাধিক ইসলামি দল ও গোষ্ঠী রাজনৈতিক দৃশ্যপটে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে। এই গোষ্ঠীগুলো সংকটের সময় অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধিতা জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হাসিনা সরকারের ইসলামি সংগঠনগুলোকে দমন করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এসব গোষ্ঠী বিশেষত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়গুলোতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
এরপর, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন দ্রুত বিস্তৃত হয়ে সরকারবিরোধী এক বৃহত্তর গণআন্দোলনে পরিণত হয়। এই আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ পায়। প্রথম দিকে, আন্দোলনের অরাজনৈতিক চরিত্র আওয়ামী লীগ সরকারকে কিছুটা স্বস্তি দিলেও যখন ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো এর সমর্থনে এগিয়ে আসে তখন এই আন্দোলন দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে হাসিনার সরকার জনগণের বিক্ষোভকে দমন করতে ব্যর্থ হয়।
পরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর দৃঢ় অবস্থান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে। ছাত্রসমাজ ও দেশের জনগণের ক্ষোভ একযোগে হাসিনার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অনুবাদ: আব্দুর রহমান
শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময়ের শাসনামলের অবসান ঘটে চলতি বছরের ৫ আগস্ট। তাঁর পতনে অনেকেই অবাক হয়েছেন। পতনের আগের দিন পর্যন্তও কেউ অনুমান করতে পারেনি যে, তাঁর সময় শেষ। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর তাঁর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন, হাসিনার শাসন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকবে।
হাসিনা তাঁর শাসনামলে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়ার মতো শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বহু বছর ধরেই অনুমান করেছেন, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে চীনের মতো ‘কর্তৃত্ববাদী’ মডেলের দিকে ঝুঁকেছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করা এবং ‘অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল’ সরকার ব্যবস্থা চাপানোর দিক থেকে হাসিনার কৌশল চীনা শাসনব্যবস্থার সঙ্গে কিছুটা মেলে।
চীনা মডেল অনুসরণের চেষ্টা করেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হন হাসিনা। প্রথমত, তাঁর আদর্শ সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি এবং দ্বিতীয়ত, ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট তাঁর সরকারের বৈধতাকে দুর্বল করেছে।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, হাসিনার শাসনকাল ক্রমেই চীনের একদলীয় মডেলের মতো হয়ে উঠছিল। দীর্ঘ সময়ের শাসনে হাসিনা ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক ভারসাম্য ভেঙে দিয়েছেন। বিচার ব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও নির্বাচনী ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেছেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) মতো তাঁর সরকারও বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করেছে, বিরোধী দলগুলোকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে।
হাসিনা সরকার উগ্রবাদ, অপরাধ ও মাদক-সম্পর্কিত অপরাধের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করেছে। আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক বৈধতার ভিত্তি হিসেবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দলটির ভূমিকাকে সামনে এনেছে। ঠিক যেমন, সিসিপি তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনা বিপ্লবের ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে। এসব কারণে, হাসিনার আমলে বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টিকে চীনের একদলীয় ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হতো।
তবে হাসিনা চীনা মডেল পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারেননি। চীনের কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থার সাফল্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ‘ম্যাস লাইন’ কৌশলের গভীরে প্রোথিত। এই কৌশল জনগণের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে শাসন পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করে। কমিউনিস্ট নেতা লি লিসান সর্বপ্রথম এই ধারণা হাজির করেন। পরে মাও সেতুং এটিকে আরও পরিশীলিত করেন। এই কৌশলের ভিত্তিতে সরকার জনগণের চাহিদা বুঝতে ও তা কাজকর্মে প্রতিফলিত করতে সচেষ্ট থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সিসিপি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন, ২০১০—এর দশকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দেহ ব্যবসাবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে জনগণের দাবির ভিত্তিতে। এ ছাড়া, সিপিসি চীনা সমাজের মূল ভিত্তি কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
বিপরীতে, হাসিনার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল ‘এলিটিস্ট’ বা অভিজাতপন্থী। এ কারণে দলটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাঁর মতাদর্শকে ‘বাঙালি-আওয়ামিবাদ’ বা ‘হাসিনাবাদ’ বলা যেতে পারে। এই বিষয়টি মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘মুজিববাদের’ উত্তরাধিকার—বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা থেকে উদ্ভূত। বাঙালি জাতীয়তাবাদ হাসিনার শাসনামলে এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশর সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা এক পরিচয় ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
মুজিববাদ অনেকটাই ইসলামপন্থার বিরোধী ছিল। কারণ, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসলামপন্থী দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। হাসিনা এই আদর্শকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে’ জোরদার করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতায় এই ‘চেতনা’ হয়ে উঠেছিল বিভাজনের মস্ত হাতিয়ার। যারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতেন, তাদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হতো এবং এই ‘চেতনার’ ফিল্টারে ফেলে তাদের পাকিস্তানের পক্ষের সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তাঁর আমলে আওয়ামী লীগ সমর্থন করা ছিল প্রকৃত বাঙালি হওয়ার সমার্থক এবং এর মাধ্যমে হাসিনার মতাদর্শ বিরোধীদের মানবিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করেছিল।
এই ‘নির্মিত’ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বা বাঙালি আওয়ামীবাদের নেতৃত্বে ছিল এলিট শ্রেণি। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গ্রামীণ গরিব, ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই অংশ বাঙালি আওয়ামীবাদের ন্যারেটিভের বাইরে ছিল। হাসিনার রাজনৈতিক মতাদর্শে তৃণমূলের অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। এই বিষয়টি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তীব্রভাবে বৈপরীত্যপূর্ণ। এই বিচ্ছিন্নতা হাসিনার ক্ষমতায় কেন্দ্রীভূতকরণের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ বাধা ছিল। যে বিষয়টি চীনের শাসকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে, সেই বিষয়টি শেখ হাসিনার আওয়ামীবাদে অনুপস্থিত ছিল। জনগণের বড় একটি অংশকে বঞ্চিত করে এবং তাঁর শাসনকে এলিট শ্রেণি ও ‘বিভাজনমূলক’ আদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার মাধ্যমে হাসিনা তাঁর অজনপ্রিয়তার বীজ বপন করেছিলেন।
আরেকটি যে গুরুত্বপূর্ণ কারণে হাসিনা চীনের সাফল্য অনুকরণ করতে পারেননি, তা হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক পতন। যেখানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শাসন-কর্তৃত্ব অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণে আরও দৃঢ় হয়েছে, সেখানে হাসিনার শাসন ২০২১ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। এর আগ পর্যন্ত, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল হিসেবে দেখা হতো, এমনকি ‘এশিয়ান টাইগার’ হিসেবেও বাংলাদেশকে অভিহিত করা হতো। কিন্তু ২০২১ সালের পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত পতন শুরু হয়।
২০২১ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের জুন মাসে তা নেমে দাঁড়ায় মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলারে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। এর ফলে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বহন কঠিন হয়ে পড়ে। এই অর্থনৈতিক অস্থিরতা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি ও যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে। কারণ, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবন ধারণ করতে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাচ্ছিল। এক সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে হাসিনা সরকার, কিন্তু সময়ের ব্যবধান তাদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
চীন কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীনে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের দারিদ্র্য দূর করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠেছে। চীনের সরকার সামাজিক শৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং এই বিষয়টি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এর বিপরীতে, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক শক্তি হ্রাস পেয়েছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার চ্যালেঞ্জগুলো তাঁর শাসনকে আরও জনবিচ্ছিন্ন করেছে।
চীনে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ধর্মীয় দলগুলোর সরকার বিরোধিতা নেই। বিপরীতে বাংলাদেশে একাধিক ইসলামি দল ও গোষ্ঠী রাজনৈতিক দৃশ্যপটে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে। এই গোষ্ঠীগুলো সংকটের সময় অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধিতা জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হাসিনা সরকারের ইসলামি সংগঠনগুলোকে দমন করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এসব গোষ্ঠী বিশেষত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়গুলোতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
এরপর, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন দ্রুত বিস্তৃত হয়ে সরকারবিরোধী এক বৃহত্তর গণআন্দোলনে পরিণত হয়। এই আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ পায়। প্রথম দিকে, আন্দোলনের অরাজনৈতিক চরিত্র আওয়ামী লীগ সরকারকে কিছুটা স্বস্তি দিলেও যখন ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো এর সমর্থনে এগিয়ে আসে তখন এই আন্দোলন দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে হাসিনার সরকার জনগণের বিক্ষোভকে দমন করতে ব্যর্থ হয়।
পরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর দৃঢ় অবস্থান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে। ছাত্রসমাজ ও দেশের জনগণের ক্ষোভ একযোগে হাসিনার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অনুবাদ: আব্দুর রহমান
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১৪ ঘণ্টা আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৭ দিন আগেবিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি একটি বৃহত্তর সুরক্ষাবাদী নীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে ছোট দেশগুলোকে এর বিরোধিতা করার জন্য উৎসাহিত করা কঠিন হবে। তবে সবকিছু এখনো সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। ট্রাম্পের সতর্কতাগুলো হয়তো তাঁর কথার প্রতিফলন হতে পারে। তবে, বাস্তবতা হলো—এভাবেই একটি গুরুতর বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা হতে পারে
৮ দিন আগে