আব্দুর রহমান
শরণার্থী বিষয়ে ইউরোপ যে দ্বৈত মানদণ্ড অনুসরণ করে তা ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে নগ্নভাবে উন্মোচিত হলো। ইউরোপের এই মানদণ্ড প্রকৃতপক্ষে ‘নৈতিকভাবে বধির’ ও ‘ভূ-রাজনৈতিকভাবে মূক’। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এখন অবধি প্রায় ১০ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। দেশত্যাগী ইউক্রেনীয়দের আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রতিবেশী পোল্যান্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, মলডোভা, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়ার মতো দেশ। কিন্তু দেশগুলো শরণার্থী বিষয়ে দ্বৈত মানসিকতা বা মানদণ্ড প্রদর্শন করছে। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া মহৎ কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শরণার্থী যদি হয় অ-ইউরোপীয় তখন ইউরোপ যে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা কোনোভাবেই মানবিক নয়।
সিরিয়ার নাগরিক আহমদ আল হারিরি আজ থেকে ১০ বছর আগে যুদ্ধে সব হারিয়ে লেবাননে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই আশায় যে, হয়তো কোনো এক সুদিনে ইউরোপে পাড়ি জমাতে পারবেন। তাঁর কষ্টের দিনের অবসান হবে। কিন্তু সেই আশা বিগত ১০ বছরেও পূর্ণ হয়নি। হবে বলেও আর আশা নেই। তিনি দেখেছেন—সিরীয়রা যখন ইউরোপে প্রবেশ করতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে, সেখানে ইউক্রেনীয়রা যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্রই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করতে পেরেছে।
রয়টার্সের ‘আরব রিফিউজি সি ডাবল স্ট্যান্ডার্ডস ইন ইউরোপ’স এমব্রেস অব ইউক্রেনিয়ানস’—শীর্ষক এক নিবন্ধে বলা হয়, সিরিয়া যুদ্ধে ২০১১ সালেই প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তাঁরা ইউরোপে আশ্রয় পাননি। আশ্রয় পেয়েছেন আরও পাঁচ বছর পর, ২০১৬ সালে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের হিসাব মতে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অন্তত ১০ লাখ সিরীয় নাগরিক আশ্রয় পেয়েছেন। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৩৭ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে তুরস্ককে অর্থ সহায়তা দিয়েছে। তবুও প্রায় ৭০ লাখ সিরীয় নাগরিক এখনো উদ্বাস্তু নিজ অথবা অন্য দেশে।
ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর স্লোভেনিয়ার সরকার তাৎক্ষণিকভাবেই জানায় তারা ইউক্রেনের শরণার্থী নিতে প্রস্তুত। বিষয়টি নিয়ে স্লোভেনিয়ার দার্শনিক স্লাভয় জিজেক প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। ‘হোয়াট ডাজ ডিফেন্ডিং ইউরোপ মিন’ শীর্ষক নিবন্ধে জিজেক লিখেছেন, ‘স্লোভেনিয়ার একজন নাগরিক হিসেবে আমি গর্বিত, সেই সঙ্গে লজ্জিতও। মাত্র মাস ছয়েক আগেও যখন মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগের পর তালেবান দেশটির ক্ষমতা দখল করলে স্লোভেনিয়ার এই সরকারই আফগান শরণার্থী গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, দেশটি এও বলেছিল—আফগানদের উচিত দেশে থেকে তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। সেখানেই শেষ নয়, কয়েক মাস আগে যখন কয়েক হাজার শরণার্থী—যাদের বেশিরভাগই ইরাকি কুর্দি—বেলারুশ থেকে পোল্যান্ডে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। সে সময় সেই প্রচেষ্টাকে স্লোভেনিয়ার সরকার “ইউরোপ আক্রমণের মুখে” বলে আখ্যায়িত করেছিল। শরণার্থীরা যাতে পোল্যান্ড প্রবেশ করতে পারে সে জন্য সামরিক সাহায্যের প্রস্তাব করেছিল স্লোভেনিয়া।’
বিপরীতে ইউরোপীয় শরণার্থীদের ইউরোপীয় দেশগুলো কীভাবে স্বাগত জানাচ্ছে তার নমুনা দেখিয়েছে সুপ্রাচীন মার্কিন গণমাধ্যম ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর)। এনপিআরের ‘রেস, কালচার অ্যান্ড পলিটিকস আন্ডারপিন হাউ—অর ইফ—রিফিউজি আর অয়েলকামড ইন ইউরোপ’ শীর্ষক নিবন্ধে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের কীভাবে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড স্বাগত জানিয়েছিল তা উঠে এসেছে। নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনীয়রা হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করছিল তখন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান বলছিলেন, ‘ইউক্রেনীয়রা হাঙ্গেরিতে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশই পাবেন।’ কেবল হাঙ্গেরিই নয়, একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পোল্যান্ডও। দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিষয়ক মন্ত্রী মারিউস কামিনস্কি ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পোল্যান্ডে আমরা সবার জন্যই একটি নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করব।’ অথচ, এই পোল্যান্ডই ইরাকি কুর্দি শরণার্থীদের বেলারুশ সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশে বাধা দিয়েছিল। কেবল তাই নয়, শরণার্থী অনুপ্রবেশ সামরিকভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতিও নিয়েছিল। পোলিশ সীমান্তরক্ষীরা যেখানে ইউক্রেনীয়দের জন্য খাবার, ওষুধসহ অপেক্ষা করছে, সেখান তারাই আবার বেলারুশ থেকে পোল্যান্ডে প্রবেশ করতে চাওয়া ইরাকি কুর্দিদের নির্মমভাবে প্রতিহত করেছিল।
তবে ইউক্রেন শরণার্থীদের ব্যাপারে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের প্রতিধ্বনি করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিজ্জার্তো। তিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের তুলনা করতে নারাজ।
রয়টার্সের নিবন্ধটি অনুসারে জেনেভায় জাতিসংঘের এক বৈঠকে সিজ্জার্তো বলেন, ‘আমি অবশ্যই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা ও “অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকারীদের” মধ্যে তুলনা করার দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করব।’ অর্থাৎ তাঁর দৃষ্টিতে ইউক্রেনীয়রা শরণার্থী, আর যুদ্ধ থেকে পালানো আরবেরা ইউরোপের দেশে অনুপ্রবেশকারী। পশ্চিমের একাধিক গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক ব্যক্তির বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, ইউক্রেনীয়দের স্বাগত জানানো হচ্ছে একটি কারণেই—ইউক্রেনবাসীও ইউরোপীয়। এই জাতিগত প্রাধান্যের কারণেই পশ্চিমারা নিজেদের অ-ইউরোপীয়দের তুলনায় তাদের আলাদা, সভ্য এবং সুনাগরিক বলে চিত্রিত করতে পছন্দ করে। বিপরীতে আরব, এশীয়, লাতিন, আফ্রিকানরা তুলনামূলক অসভ্য, গ্রাম্য এবং তাদের সংস্কৃতি অপেক্ষাকৃত অমার্জিত।
জিজেক তাঁর নিবন্ধে আরও বলছেন, ইউরোপে যারা শরণার্থী হিসেবে আসছেন তাঁদের স্পষ্টত দুই ‘প্রজাতিতে’ বিভক্ত করা হচ্ছে। একদল ইউরোপীয় আর অন্যরা ইউরোপের বাইরের। বিষয়টি কেবল ইউরোপীয় আর অ-ইউরোপীয় ভেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং জাতিগত পার্থক্য হিসেবেও বিবেচনা করে ইউরোপ। এই পার্থক্যের বিষয়টি স্লোভেনিয়া সরকারের এক টুইট থেকে আরও স্পষ্ট হয়। জিজেক তাঁর নিবন্ধে স্লোভেনিয়া সরকারের টুইট নিয়ে বলেছেন, ‘চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি সরকারের এক টুইটে বলা হয়—ইউক্রেন থেকে আগত শরণার্থীরা এমন এক পরিবেশ থেকে আসছে যা সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক অর্থেই আফগান উদ্বাস্তুরা যে পরিবেশ থেকে আসছে তার থেকে একেবারেই আলাদা।’ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে দ্রুত টুইটটি মুছে ফেলা হয়। কিন্তু টুইটটির মাধ্যমে ইউরোপীয় মানসিকতার যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো—ইউরোপ নিজেকে অবশ্যই অ-ইউরোপীয়দের থেকে আলাদা রাখতে চায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি চলমান বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে ইউরোপকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে আরও ঝুঁকিতে ফেলবে। ইউরোপীয় দেশগুলোর গণমাধ্যম ও অভিজাত শ্রেণি এই সংকটকে কেবল ইউরোপ এবং ইউরোপ সংলগ্ন রাশিয়ার মধ্যকার সংকট হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। সেখানে লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে বাদ দেওয়া হচ্ছে এই ভেবে যে, এই যুদ্ধ কোনোভাবেই ওই সব অঞ্চলকে প্রভাবিত করবে না। অথচ এই দেশগুলোও কিন্তু ইউরোপের এই সংকটকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
মার্কিন তাত্ত্বিক স্যামুয়েল ফিলিপ হান্টিংটন তাঁর বিখ্যাত অভিসন্দর্ভ ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস’-এ যেমন উল্লেখ করেছেন—পৃথিবী ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতায় বিভক্ত। এর মধ্যে প্রধান সভ্যতা হলো—পাশ্চাত্য। এই পাশ্চাত্যের দুটি কেন্দ্র—এক. যুক্তরাষ্ট্র এবং দুই. ইউরোপ। পাশ্চাত্য সভ্যতার এই দুই কেন্দ্র আসলে একই ধরনের মূল্যবোধ লালন করে। পশ্চিমাদের বিবেচনায় দুনিয়া দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে আছে পশ্চিমারা, যারা নিজেদের চিহ্নিত করে ‘আমরা’ বলে। আর দুনিয়ার বাকি সভ্যতাগুলোকে বিবেচনা করে ‘অন্যরা’ বলে। ‘উই’ আর ‘আদার’ করে রাখার এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী-পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিষয়ক মন্ত্রী, স্লোভেনিয়া সরকারের টুইটে।
আধুনিকতা ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা ইউরোপের এমন দ্বৈত নীতি বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এমনকি ভূ-রাজনৈতিক বিভাজনকেও উসকে দিতে পারে। যেমনটা বলেছেন স্লাভয় জিজেক—এ ধরনের পদক্ষেপ চলমান বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে ইউরোপকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে আরও ঝুঁকিতে ফেলবে।
শরণার্থী বিষয়ে ইউরোপ যে দ্বৈত মানদণ্ড অনুসরণ করে তা ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে নগ্নভাবে উন্মোচিত হলো। ইউরোপের এই মানদণ্ড প্রকৃতপক্ষে ‘নৈতিকভাবে বধির’ ও ‘ভূ-রাজনৈতিকভাবে মূক’। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এখন অবধি প্রায় ১০ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। দেশত্যাগী ইউক্রেনীয়দের আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রতিবেশী পোল্যান্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, মলডোভা, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়ার মতো দেশ। কিন্তু দেশগুলো শরণার্থী বিষয়ে দ্বৈত মানসিকতা বা মানদণ্ড প্রদর্শন করছে। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া মহৎ কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শরণার্থী যদি হয় অ-ইউরোপীয় তখন ইউরোপ যে প্রতিক্রিয়া দেখায় তা কোনোভাবেই মানবিক নয়।
সিরিয়ার নাগরিক আহমদ আল হারিরি আজ থেকে ১০ বছর আগে যুদ্ধে সব হারিয়ে লেবাননে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই আশায় যে, হয়তো কোনো এক সুদিনে ইউরোপে পাড়ি জমাতে পারবেন। তাঁর কষ্টের দিনের অবসান হবে। কিন্তু সেই আশা বিগত ১০ বছরেও পূর্ণ হয়নি। হবে বলেও আর আশা নেই। তিনি দেখেছেন—সিরীয়রা যখন ইউরোপে প্রবেশ করতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে, সেখানে ইউক্রেনীয়রা যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্রই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করতে পেরেছে।
রয়টার্সের ‘আরব রিফিউজি সি ডাবল স্ট্যান্ডার্ডস ইন ইউরোপ’স এমব্রেস অব ইউক্রেনিয়ানস’—শীর্ষক এক নিবন্ধে বলা হয়, সিরিয়া যুদ্ধে ২০১১ সালেই প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তাঁরা ইউরোপে আশ্রয় পাননি। আশ্রয় পেয়েছেন আরও পাঁচ বছর পর, ২০১৬ সালে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের হিসাব মতে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অন্তত ১০ লাখ সিরীয় নাগরিক আশ্রয় পেয়েছেন। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৩৭ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে তুরস্ককে অর্থ সহায়তা দিয়েছে। তবুও প্রায় ৭০ লাখ সিরীয় নাগরিক এখনো উদ্বাস্তু নিজ অথবা অন্য দেশে।
ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর স্লোভেনিয়ার সরকার তাৎক্ষণিকভাবেই জানায় তারা ইউক্রেনের শরণার্থী নিতে প্রস্তুত। বিষয়টি নিয়ে স্লোভেনিয়ার দার্শনিক স্লাভয় জিজেক প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। ‘হোয়াট ডাজ ডিফেন্ডিং ইউরোপ মিন’ শীর্ষক নিবন্ধে জিজেক লিখেছেন, ‘স্লোভেনিয়ার একজন নাগরিক হিসেবে আমি গর্বিত, সেই সঙ্গে লজ্জিতও। মাত্র মাস ছয়েক আগেও যখন মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগের পর তালেবান দেশটির ক্ষমতা দখল করলে স্লোভেনিয়ার এই সরকারই আফগান শরণার্থী গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, দেশটি এও বলেছিল—আফগানদের উচিত দেশে থেকে তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। সেখানেই শেষ নয়, কয়েক মাস আগে যখন কয়েক হাজার শরণার্থী—যাদের বেশিরভাগই ইরাকি কুর্দি—বেলারুশ থেকে পোল্যান্ডে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। সে সময় সেই প্রচেষ্টাকে স্লোভেনিয়ার সরকার “ইউরোপ আক্রমণের মুখে” বলে আখ্যায়িত করেছিল। শরণার্থীরা যাতে পোল্যান্ড প্রবেশ করতে পারে সে জন্য সামরিক সাহায্যের প্রস্তাব করেছিল স্লোভেনিয়া।’
বিপরীতে ইউরোপীয় শরণার্থীদের ইউরোপীয় দেশগুলো কীভাবে স্বাগত জানাচ্ছে তার নমুনা দেখিয়েছে সুপ্রাচীন মার্কিন গণমাধ্যম ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর)। এনপিআরের ‘রেস, কালচার অ্যান্ড পলিটিকস আন্ডারপিন হাউ—অর ইফ—রিফিউজি আর অয়েলকামড ইন ইউরোপ’ শীর্ষক নিবন্ধে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের কীভাবে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড স্বাগত জানিয়েছিল তা উঠে এসেছে। নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনীয়রা হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করছিল তখন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান বলছিলেন, ‘ইউক্রেনীয়রা হাঙ্গেরিতে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশই পাবেন।’ কেবল হাঙ্গেরিই নয়, একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে পোল্যান্ডও। দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিষয়ক মন্ত্রী মারিউস কামিনস্কি ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পোল্যান্ডে আমরা সবার জন্যই একটি নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করব।’ অথচ, এই পোল্যান্ডই ইরাকি কুর্দি শরণার্থীদের বেলারুশ সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশে বাধা দিয়েছিল। কেবল তাই নয়, শরণার্থী অনুপ্রবেশ সামরিকভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতিও নিয়েছিল। পোলিশ সীমান্তরক্ষীরা যেখানে ইউক্রেনীয়দের জন্য খাবার, ওষুধসহ অপেক্ষা করছে, সেখান তারাই আবার বেলারুশ থেকে পোল্যান্ডে প্রবেশ করতে চাওয়া ইরাকি কুর্দিদের নির্মমভাবে প্রতিহত করেছিল।
তবে ইউক্রেন শরণার্থীদের ব্যাপারে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের প্রতিধ্বনি করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিজ্জার্তো। তিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের তুলনা করতে নারাজ।
রয়টার্সের নিবন্ধটি অনুসারে জেনেভায় জাতিসংঘের এক বৈঠকে সিজ্জার্তো বলেন, ‘আমি অবশ্যই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা ও “অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকারীদের” মধ্যে তুলনা করার দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করব।’ অর্থাৎ তাঁর দৃষ্টিতে ইউক্রেনীয়রা শরণার্থী, আর যুদ্ধ থেকে পালানো আরবেরা ইউরোপের দেশে অনুপ্রবেশকারী। পশ্চিমের একাধিক গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক ব্যক্তির বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, ইউক্রেনীয়দের স্বাগত জানানো হচ্ছে একটি কারণেই—ইউক্রেনবাসীও ইউরোপীয়। এই জাতিগত প্রাধান্যের কারণেই পশ্চিমারা নিজেদের অ-ইউরোপীয়দের তুলনায় তাদের আলাদা, সভ্য এবং সুনাগরিক বলে চিত্রিত করতে পছন্দ করে। বিপরীতে আরব, এশীয়, লাতিন, আফ্রিকানরা তুলনামূলক অসভ্য, গ্রাম্য এবং তাদের সংস্কৃতি অপেক্ষাকৃত অমার্জিত।
জিজেক তাঁর নিবন্ধে আরও বলছেন, ইউরোপে যারা শরণার্থী হিসেবে আসছেন তাঁদের স্পষ্টত দুই ‘প্রজাতিতে’ বিভক্ত করা হচ্ছে। একদল ইউরোপীয় আর অন্যরা ইউরোপের বাইরের। বিষয়টি কেবল ইউরোপীয় আর অ-ইউরোপীয় ভেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং জাতিগত পার্থক্য হিসেবেও বিবেচনা করে ইউরোপ। এই পার্থক্যের বিষয়টি স্লোভেনিয়া সরকারের এক টুইট থেকে আরও স্পষ্ট হয়। জিজেক তাঁর নিবন্ধে স্লোভেনিয়া সরকারের টুইট নিয়ে বলেছেন, ‘চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি সরকারের এক টুইটে বলা হয়—ইউক্রেন থেকে আগত শরণার্থীরা এমন এক পরিবেশ থেকে আসছে যা সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক অর্থেই আফগান উদ্বাস্তুরা যে পরিবেশ থেকে আসছে তার থেকে একেবারেই আলাদা।’ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে দ্রুত টুইটটি মুছে ফেলা হয়। কিন্তু টুইটটির মাধ্যমে ইউরোপীয় মানসিকতার যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো—ইউরোপ নিজেকে অবশ্যই অ-ইউরোপীয়দের থেকে আলাদা রাখতে চায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি চলমান বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে ইউরোপকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে আরও ঝুঁকিতে ফেলবে। ইউরোপীয় দেশগুলোর গণমাধ্যম ও অভিজাত শ্রেণি এই সংকটকে কেবল ইউরোপ এবং ইউরোপ সংলগ্ন রাশিয়ার মধ্যকার সংকট হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। সেখানে লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে বাদ দেওয়া হচ্ছে এই ভেবে যে, এই যুদ্ধ কোনোভাবেই ওই সব অঞ্চলকে প্রভাবিত করবে না। অথচ এই দেশগুলোও কিন্তু ইউরোপের এই সংকটকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
মার্কিন তাত্ত্বিক স্যামুয়েল ফিলিপ হান্টিংটন তাঁর বিখ্যাত অভিসন্দর্ভ ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস’-এ যেমন উল্লেখ করেছেন—পৃথিবী ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতায় বিভক্ত। এর মধ্যে প্রধান সভ্যতা হলো—পাশ্চাত্য। এই পাশ্চাত্যের দুটি কেন্দ্র—এক. যুক্তরাষ্ট্র এবং দুই. ইউরোপ। পাশ্চাত্য সভ্যতার এই দুই কেন্দ্র আসলে একই ধরনের মূল্যবোধ লালন করে। পশ্চিমাদের বিবেচনায় দুনিয়া দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে আছে পশ্চিমারা, যারা নিজেদের চিহ্নিত করে ‘আমরা’ বলে। আর দুনিয়ার বাকি সভ্যতাগুলোকে বিবেচনা করে ‘অন্যরা’ বলে। ‘উই’ আর ‘আদার’ করে রাখার এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী-পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিষয়ক মন্ত্রী, স্লোভেনিয়া সরকারের টুইটে।
আধুনিকতা ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা ইউরোপের এমন দ্বৈত নীতি বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এমনকি ভূ-রাজনৈতিক বিভাজনকেও উসকে দিতে পারে। যেমনটা বলেছেন স্লাভয় জিজেক—এ ধরনের পদক্ষেপ চলমান বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে ইউরোপকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে আরও ঝুঁকিতে ফেলবে।
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৬ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৮ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে