মুহম্মদ আবদুল বাছেদ
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পরে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করে। বছরাধিক অপেক্ষার পর গত এপ্রিলে ন্যাটোর সদস্যপদ পেয়েছে ফিনল্যান্ড, কিন্তু সুইডেনের প্রতীক্ষার অবসান হয়নি।
এর মধ্যেই খবর এসেছে, সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানে তুরস্ক সমর্থন দেবে। এ বিষয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে। লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে গত সোমবার তুর্কি ও সুইডিশ নেতাদের আলোচনার পর ন্যাটোর প্রধান স্টলটেনবার্গ এ তথ্য দিয়েছেন। তবে এটুকুই পুরো তথ্য নয়।
দীর্ঘদিন ধরে বেঁকে বসে থাকা এরদোয়ান হঠাৎ কীভাবে রাজি হলেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে। কয়েক দিন আগেও সুইডেনের মসজিদে কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এরদোয়ান বলেছিলেন, ন্যাটো সদস্যপদে তুরস্ক এই দেশকে সমর্থন দেবে না।
এরদোয়ান যে অত্যন্ত কৌশলী শাসক, তা এরই মধ্যে বিশ্বদরবারে প্রতিভাত হয়েছে। বিনিময়ে কিছু না পেয়ে এত সহজে রাজি হওয়ার পাত্র নন এরদোয়ান। কড়ির বদলে কড়ি নিয়েই ছাড়বেন বলে মনে হচ্ছে।
১৯৮৭ সালে নাকচ হয়ে যাওয়া তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের দাবিকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন তিনি। গত মঙ্গলবার ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে আঙ্কারা ছাড়ার আগে এরদোয়ান বলে দিয়েছেন, ন্যাটো সামরিক জোটে সুইডেনের যোগদানের প্রস্তাব তুরস্কের সংসদে পাস হওয়ার আগে ইইউর উচিত আঙ্কারার অন্তর্ভুক্তির পথ খুলে দেওয়া।
এ সময় তুরস্ককে প্রায় ৫০ বছর ধরে ইইউর দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য তিনি সমালোচনাও করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এরদোয়ানের প্রথম মেয়াদে ২০০৫ সালে তুরস্কের ইইউতে সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে আলোচনা আবার শুরু হলেও বেশি দূর এগোয়নি।
২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর আঙ্কারার সঙ্গে এই জোটের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়। পরে সম্পর্কের উন্নতি হয়। কারণ, অভিবাসনসহ নানা দিক থেকে ইইউ তুরস্কের ওপর নির্ভরশীল।
তুরস্কের দাবির বিষয়ে ইউরোপীয় কমিশনের এক মুখপাত্র বলেছেন, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কোনো দেশের যোগ্যতার ভিত্তিতে ইইউতে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখন এরদোয়ান যদি গো ধরে থাকেন, তাহলে সুইডেনের সদস্যপদ পাওয়া হবে না।
চতুর এরদোয়ানের কৌশলে নতুন চাপে পড়েছেন ইউরোপ-আমেরিকার মোড়লেরা। নতুন চাপ বলা হচ্ছে কারণ, এর আগেও এরদোয়ান ন্যাটোর সদস্য হওয়ার বিষয়ে সুইডেনের ওপর বেশ কিছু শর্ত চাপিয়েছিলেন। সেই সব শর্ত পূরণের পর এরদোয়ান নতুন এই দাবি তুললেন।
এরদোয়ানের জুড়ে দেওয়া আগের শর্ত
সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল ‘সন্ত্রাসবাদ’ প্রশ্ন। আঙ্কারা অভিযোগ করে, তুরস্ক যাদের সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে, তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি সুইডেন। মূলত নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সদস্যদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে এরদোয়ান প্রশাসন। তুরস্ক, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র এই গোষ্ঠীকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।
আর ঈদুল আজহার দিন সুইডেনের স্টকহোমে মসজিদের সামনে কোরআন পোড়ানোর অনুমতি দেয় দেশটির সরকার। কোরআন পোড়ানোও হয়। এ নিয়ে তুরস্কসহ আরব বিশ্বে বিক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় ওঠে, যা ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদান আরও ঘোলাটে করে দেয়। পরে সুইডেন কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে।
গত ১৭ মে এরদোয়ান বলেন, ‘সবার আগে যে কথা বলতে চাই তা হলো—যারা তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাদের ইতিবাচক কিছু বলব না। তা বললে ন্যাটো আর সামরিক জোট থাকবে না। সেখানে (পিকেকে-কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি) ‘সন্ত্রাসীদের’ প্রতিনিধিত্ব চলে আসবে।’
তবে ন্যাটোর সদস্যপদ পেতে মরিয়া সুইডেন এরদোয়ানের শর্ত মেনে নিয়েছে। সুইডেন নিজের সংবিধান সংশোধন, আইন পরিবর্তন, পিকেকে (কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি, যা তুরস্কে নিষিদ্ধ) সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান প্রসার এবং তুরস্কে আবার অস্ত্র রপ্তানি শুরু করেছে।
তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের ঢিমেতাল
তুরস্ক ১৯৮৭ সালে প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে ইইউ তুরস্ককে সদস্যপ্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করে। তবে ইইউ-তুর্কি কাস্টমসের বেশ কিছু বৈঠকের পর স্তিমিত হয়ে পড়ে এসব। এরপর ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এরদোয়ানের প্রথম মেয়াদে ইইউতে তুরস্কের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর আঙ্কারা ও ইইউ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হলে এই আলোচনাও স্থগিত হয়ে পড়ে।
কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কের উন্নতি হতে থাকে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ন্ত্রণে ইইউ ন্যাটো মিত্র আঙ্কারার সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে। সম্প্রতি বিষয়টি আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নানা ক্ষেত্রে আঙ্কারা গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। এরদোয়ান মস্কোয় প্রভাবশালী ন্যাটো নেতা হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।
তিনি গত বছরে কৃষ্ণসাগরের শস্য চুক্তি অনুমোদনে মধ্যস্থতাকারী ছিলেন। এর ফলে ইউক্রেন কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছিল। বারবার রাশিয়ার প্রত্যাহার হুমকি সত্ত্বেও তুরস্ক চুক্তিটিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে। তুরস্ক ইউক্রেনে সশস্ত্র ড্রোন সরবরাহ করে ক্রেমলিনকে ক্ষুব্ধ করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিমত
লিথুনিয়ায় যাওয়ার আগে ইস্তাম্বুলে সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান বলেন, ‘প্রথমে ইইউতে তুরস্কের যোগদানের জন্য পথ উন্মুক্ত করুন। এরপর আমরা সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের অনুমতি দেব, যেমনটি ফিনল্যান্ডকে দিয়েছি।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোয়ান ইইউতে তুরস্কের যোগদানের তোলা দাবিকে ইইউ ভালোভাবে নেয়নি। ইউরোপীয় কমিশনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণ আলাদা প্রক্রিয়া। প্রতিটি প্রার্থী দেশের যোগদান প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট দেশের যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। দুটি প্রক্রিয়াকে মিলিয়ে ফেলা যাবে না।
এবার তুরস্ক কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাবে?
আগের যেকোনো পরিস্থিতি থেকে ইউরোপের রাজনীতিতে তুরস্কের অবস্থান শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে। এ অবস্থায় বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পোষণ করছেন। কেউ বলছেন তুরস্কের জন্য এটাই ইইউতে যোগদানের মোক্ষম সুযোগ। আবার কেউ বলছেন, ইইউতে যোগদানের সুযোগ আরও দীর্ঘায়িত হবে।
ব্লুমবার্গে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে কলাম লেখেন ববি ঘোষ। তিনি বলেছেন, ‘ইইউর সদস্য হতে হলে তুরস্কে বেশ কিছু সংস্কার করতে হবে। এসবের মধ্য অন্যতম হলো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর আইন বাতিল করা। কিন্তু এরদোয়ান সেই আইন পুনর্বহাল করেছেন। ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর দমন-নিপীড়ন ও শরণার্থীদের ইউরোপে পাঠানোর পর্যায়ক্রমিক হুমকিও রয়েছে।
‘এখন ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদানের সঙ্গে তুরস্কের ইইউতে যোগদানকে গুলিয়ে ফেলছেন। এটি ইইউতে তুরস্কের যোগদানের বিষয়ে আরও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সত্যি বলতে, তুরস্কের ইইউতে যোগদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা এখন স্বয়ং এরদোয়ান।’
সাবেক কূটনীতিক ও ইস্তাম্বুলভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড ফরেন পলিসি স্টাডিজের পরিচালক সিনান উলগেন বলেছেন, এরদোয়ানের কৌশল পরিবর্তন ভিলনিয়াস সম্মেলনে তুরস্কের হাতকে শক্তিশালী করবে না। এই অবাক করা পদক্ষেপের ইতিবাচক দিকটি হলো, তুরস্ক এখনো ইইউ সদস্য হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। তবে এটা বলা কঠিন যে, এর ফলে তুরস্কের ইইউ সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে কোনো সহযোগিতা করবে।
এরদোয়ানের অনড় অবস্থান
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবার ইইউতে যোগদানের আগে সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশের অনুমতি দেবে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান গত গ্রীষ্মে মাদ্রিদে জোটের শীর্ষ সম্মেলনের একটি চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল। আঙ্কারার কাছ থেকে কারও ছাড় আশা করা উচিত নয়।’
তবে এরদোয়ান আরও বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের অবসান হলে কিয়েভের ন্যাটো সদস্যপদের প্রক্রিয়া সহজ হবে।
যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও ন্যাটোর সম্মতির সুর
এক বিবৃতিতে ন্যাটো বলেছে, তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানে এগিয়ে আসায় সুইডেন বিষয়টিকে সহজ করতে কাজ করবে। এর মধ্য ইইউ-তুর্কি কাস্টমস ইউনিয়নের আধুনিকায়ন এবং ভিসা উদারীকরণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এদিকে এরদোয়ানের মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ন্যাটো মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘আঙ্কারার ইইউ সদস্যপদকে তিনি সমর্থন করেন। তবে এখনকার বিবেচনার বিষয় হলো, সুইডেন ইতিমধ্যে ন্যাটোতে যোগদানের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেছে।’
এক সংবাদ সম্মেলনে স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘ভিলনিয়াসে সুইডেনের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া এখনো সম্ভব।’
সোমবার হোয়াইট হাউস বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে এবং তা অব্যাহত রেখেছ। তবে এটি আঙ্কারা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ সদস্যের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তই মুখ্য।
সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীও জানিয়েছেন, তারা চান, ইইউ ও তুরস্ক আরও কাছে আসুক এবং সমন্বয় করে চলুক।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট, ইউরো নিউজ, ডেইলি সাবাহ
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পরে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করে। বছরাধিক অপেক্ষার পর গত এপ্রিলে ন্যাটোর সদস্যপদ পেয়েছে ফিনল্যান্ড, কিন্তু সুইডেনের প্রতীক্ষার অবসান হয়নি।
এর মধ্যেই খবর এসেছে, সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানে তুরস্ক সমর্থন দেবে। এ বিষয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে। লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে গত সোমবার তুর্কি ও সুইডিশ নেতাদের আলোচনার পর ন্যাটোর প্রধান স্টলটেনবার্গ এ তথ্য দিয়েছেন। তবে এটুকুই পুরো তথ্য নয়।
দীর্ঘদিন ধরে বেঁকে বসে থাকা এরদোয়ান হঠাৎ কীভাবে রাজি হলেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে। কয়েক দিন আগেও সুইডেনের মসজিদে কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এরদোয়ান বলেছিলেন, ন্যাটো সদস্যপদে তুরস্ক এই দেশকে সমর্থন দেবে না।
এরদোয়ান যে অত্যন্ত কৌশলী শাসক, তা এরই মধ্যে বিশ্বদরবারে প্রতিভাত হয়েছে। বিনিময়ে কিছু না পেয়ে এত সহজে রাজি হওয়ার পাত্র নন এরদোয়ান। কড়ির বদলে কড়ি নিয়েই ছাড়বেন বলে মনে হচ্ছে।
১৯৮৭ সালে নাকচ হয়ে যাওয়া তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের দাবিকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন তিনি। গত মঙ্গলবার ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে আঙ্কারা ছাড়ার আগে এরদোয়ান বলে দিয়েছেন, ন্যাটো সামরিক জোটে সুইডেনের যোগদানের প্রস্তাব তুরস্কের সংসদে পাস হওয়ার আগে ইইউর উচিত আঙ্কারার অন্তর্ভুক্তির পথ খুলে দেওয়া।
এ সময় তুরস্ককে প্রায় ৫০ বছর ধরে ইইউর দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য তিনি সমালোচনাও করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এরদোয়ানের প্রথম মেয়াদে ২০০৫ সালে তুরস্কের ইইউতে সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে আলোচনা আবার শুরু হলেও বেশি দূর এগোয়নি।
২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর আঙ্কারার সঙ্গে এই জোটের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়। পরে সম্পর্কের উন্নতি হয়। কারণ, অভিবাসনসহ নানা দিক থেকে ইইউ তুরস্কের ওপর নির্ভরশীল।
তুরস্কের দাবির বিষয়ে ইউরোপীয় কমিশনের এক মুখপাত্র বলেছেন, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কোনো দেশের যোগ্যতার ভিত্তিতে ইইউতে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখন এরদোয়ান যদি গো ধরে থাকেন, তাহলে সুইডেনের সদস্যপদ পাওয়া হবে না।
চতুর এরদোয়ানের কৌশলে নতুন চাপে পড়েছেন ইউরোপ-আমেরিকার মোড়লেরা। নতুন চাপ বলা হচ্ছে কারণ, এর আগেও এরদোয়ান ন্যাটোর সদস্য হওয়ার বিষয়ে সুইডেনের ওপর বেশ কিছু শর্ত চাপিয়েছিলেন। সেই সব শর্ত পূরণের পর এরদোয়ান নতুন এই দাবি তুললেন।
এরদোয়ানের জুড়ে দেওয়া আগের শর্ত
সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল ‘সন্ত্রাসবাদ’ প্রশ্ন। আঙ্কারা অভিযোগ করে, তুরস্ক যাদের সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে, তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি সুইডেন। মূলত নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সদস্যদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে এরদোয়ান প্রশাসন। তুরস্ক, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র এই গোষ্ঠীকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।
আর ঈদুল আজহার দিন সুইডেনের স্টকহোমে মসজিদের সামনে কোরআন পোড়ানোর অনুমতি দেয় দেশটির সরকার। কোরআন পোড়ানোও হয়। এ নিয়ে তুরস্কসহ আরব বিশ্বে বিক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় ওঠে, যা ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদান আরও ঘোলাটে করে দেয়। পরে সুইডেন কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে।
গত ১৭ মে এরদোয়ান বলেন, ‘সবার আগে যে কথা বলতে চাই তা হলো—যারা তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাদের ইতিবাচক কিছু বলব না। তা বললে ন্যাটো আর সামরিক জোট থাকবে না। সেখানে (পিকেকে-কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি) ‘সন্ত্রাসীদের’ প্রতিনিধিত্ব চলে আসবে।’
তবে ন্যাটোর সদস্যপদ পেতে মরিয়া সুইডেন এরদোয়ানের শর্ত মেনে নিয়েছে। সুইডেন নিজের সংবিধান সংশোধন, আইন পরিবর্তন, পিকেকে (কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি, যা তুরস্কে নিষিদ্ধ) সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান প্রসার এবং তুরস্কে আবার অস্ত্র রপ্তানি শুরু করেছে।
তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের ঢিমেতাল
তুরস্ক ১৯৮৭ সালে প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে ইইউ তুরস্ককে সদস্যপ্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করে। তবে ইইউ-তুর্কি কাস্টমসের বেশ কিছু বৈঠকের পর স্তিমিত হয়ে পড়ে এসব। এরপর ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এরদোয়ানের প্রথম মেয়াদে ইইউতে তুরস্কের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর আঙ্কারা ও ইইউ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হলে এই আলোচনাও স্থগিত হয়ে পড়ে।
কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কের উন্নতি হতে থাকে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ন্ত্রণে ইইউ ন্যাটো মিত্র আঙ্কারার সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে। সম্প্রতি বিষয়টি আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নানা ক্ষেত্রে আঙ্কারা গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। এরদোয়ান মস্কোয় প্রভাবশালী ন্যাটো নেতা হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।
তিনি গত বছরে কৃষ্ণসাগরের শস্য চুক্তি অনুমোদনে মধ্যস্থতাকারী ছিলেন। এর ফলে ইউক্রেন কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছিল। বারবার রাশিয়ার প্রত্যাহার হুমকি সত্ত্বেও তুরস্ক চুক্তিটিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে। তুরস্ক ইউক্রেনে সশস্ত্র ড্রোন সরবরাহ করে ক্রেমলিনকে ক্ষুব্ধ করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিমত
লিথুনিয়ায় যাওয়ার আগে ইস্তাম্বুলে সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান বলেন, ‘প্রথমে ইইউতে তুরস্কের যোগদানের জন্য পথ উন্মুক্ত করুন। এরপর আমরা সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের অনুমতি দেব, যেমনটি ফিনল্যান্ডকে দিয়েছি।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোয়ান ইইউতে তুরস্কের যোগদানের তোলা দাবিকে ইইউ ভালোভাবে নেয়নি। ইউরোপীয় কমিশনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণ আলাদা প্রক্রিয়া। প্রতিটি প্রার্থী দেশের যোগদান প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট দেশের যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। দুটি প্রক্রিয়াকে মিলিয়ে ফেলা যাবে না।
এবার তুরস্ক কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাবে?
আগের যেকোনো পরিস্থিতি থেকে ইউরোপের রাজনীতিতে তুরস্কের অবস্থান শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে। এ অবস্থায় বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পোষণ করছেন। কেউ বলছেন তুরস্কের জন্য এটাই ইইউতে যোগদানের মোক্ষম সুযোগ। আবার কেউ বলছেন, ইইউতে যোগদানের সুযোগ আরও দীর্ঘায়িত হবে।
ব্লুমবার্গে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে কলাম লেখেন ববি ঘোষ। তিনি বলেছেন, ‘ইইউর সদস্য হতে হলে তুরস্কে বেশ কিছু সংস্কার করতে হবে। এসবের মধ্য অন্যতম হলো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর আইন বাতিল করা। কিন্তু এরদোয়ান সেই আইন পুনর্বহাল করেছেন। ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর দমন-নিপীড়ন ও শরণার্থীদের ইউরোপে পাঠানোর পর্যায়ক্রমিক হুমকিও রয়েছে।
‘এখন ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদানের সঙ্গে তুরস্কের ইইউতে যোগদানকে গুলিয়ে ফেলছেন। এটি ইইউতে তুরস্কের যোগদানের বিষয়ে আরও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সত্যি বলতে, তুরস্কের ইইউতে যোগদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা এখন স্বয়ং এরদোয়ান।’
সাবেক কূটনীতিক ও ইস্তাম্বুলভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড ফরেন পলিসি স্টাডিজের পরিচালক সিনান উলগেন বলেছেন, এরদোয়ানের কৌশল পরিবর্তন ভিলনিয়াস সম্মেলনে তুরস্কের হাতকে শক্তিশালী করবে না। এই অবাক করা পদক্ষেপের ইতিবাচক দিকটি হলো, তুরস্ক এখনো ইইউ সদস্য হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। তবে এটা বলা কঠিন যে, এর ফলে তুরস্কের ইইউ সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে কোনো সহযোগিতা করবে।
এরদোয়ানের অনড় অবস্থান
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবার ইইউতে যোগদানের আগে সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশের অনুমতি দেবে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান গত গ্রীষ্মে মাদ্রিদে জোটের শীর্ষ সম্মেলনের একটি চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল। আঙ্কারার কাছ থেকে কারও ছাড় আশা করা উচিত নয়।’
তবে এরদোয়ান আরও বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের অবসান হলে কিয়েভের ন্যাটো সদস্যপদের প্রক্রিয়া সহজ হবে।
যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও ন্যাটোর সম্মতির সুর
এক বিবৃতিতে ন্যাটো বলেছে, তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানে এগিয়ে আসায় সুইডেন বিষয়টিকে সহজ করতে কাজ করবে। এর মধ্য ইইউ-তুর্কি কাস্টমস ইউনিয়নের আধুনিকায়ন এবং ভিসা উদারীকরণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এদিকে এরদোয়ানের মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ন্যাটো মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘আঙ্কারার ইইউ সদস্যপদকে তিনি সমর্থন করেন। তবে এখনকার বিবেচনার বিষয় হলো, সুইডেন ইতিমধ্যে ন্যাটোতে যোগদানের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেছে।’
এক সংবাদ সম্মেলনে স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘ভিলনিয়াসে সুইডেনের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া এখনো সম্ভব।’
সোমবার হোয়াইট হাউস বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে এবং তা অব্যাহত রেখেছ। তবে এটি আঙ্কারা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ সদস্যের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তই মুখ্য।
সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীও জানিয়েছেন, তারা চান, ইইউ ও তুরস্ক আরও কাছে আসুক এবং সমন্বয় করে চলুক।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট, ইউরো নিউজ, ডেইলি সাবাহ
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
১ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
৫ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
৭ দিন আগেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর বিশ্বের অনেক অঞ্চলে নতুন উদ্বেগ ও প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, ইউক্রেন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর ইসরায়েল অনেকটা খুশিতে উদ্বেলিত। তবে বিশেষ নজরে আছে পারস্য উপসাগরীয় তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো।
৮ দিন আগে