অনলাইন ডেস্ক
ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো একটি দুর্দশাপূর্ণ সময় পার করছে। যুদ্ধক্ষেত্রে দেশটি প্রায় ১৫৩টি ট্যাংক ও ৩১২টি সাঁজোয়া যান হারিয়েছে। ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স ব্লগ ওরিক্সের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট এ সংখ্যা জানিয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের যথাক্রমে ২৬টি ট্যাংক ও ৫৭টি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়েছে। যদিও এই দাবি একান্তই কিয়েভের। কিন্তু ট্যাংকের এমন দুর্দিন কেন এবং কীভাবে টিকে থাকতে পারে আগামী দিনে—এমন প্রশ্নও উঠছে এখন। তাই সমর বিশারদেরা বলছেন, ট্যাংক প্রতিরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণের পর ৩৭ দিনের যুদ্ধে রাশিয়ার সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক হারানোর সংখ্যাটি একেবারেই কম নয়। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের সমর বিশারদেরা আগামীর যুদ্ধে ট্যাংকের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বছরখানেক আগে, ব্রিটিশ সেনাপ্রধান জেনারেল মার্ক কার্লটন স্মিথ বলেছিলেন, তিনি মনে করেন—আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের অপ্রতিরোধ্য রূপ অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। তাই এর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তাঁরই কথার প্রতিধ্বনি করছে ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’।
ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু যুক্তরাজ্য নয়, পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রও একই পথে হাঁটছে। দেশটি বিশাল ট্যাংকবহর সমরসজ্জা থেকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কারণ, প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের মোকাবিলায় ট্যাংকের প্রয়োজনীয়তা খুব কম। সিরিয়া যুদ্ধেও তুর্কি ড্রোনের হাতে মার খেয়েছে ট্যাংকবহর। ফলে ট্যাংকের যে আগের দিন নেই তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু ট্যাংকের এমন দুর্দিন কেন? বিশ্লেষকেরা বলছেন, অতীতে ক্যামোফ্ল্যাজের (ছদ্মবেশ) কারণে ট্যাংক যুদ্ধক্ষেত্রে দৃষ্টি এড়াতে পারত। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। বর্তমানের যুদ্ধবিমান ও সার্ভিল্যান্স বিমানগুলোতে থাকা উন্নত সেন্সর দিয়ে ট্যাংক ইঞ্জিনের তাপ ও মাটিতে থেকে যাওয়া ট্যাংকের চাকার দাগ থেকে ট্যাংকের অবস্থান শনাক্ত করে তা ধ্বংস করা বেশ সহজ হয়ে গেছে। আবার ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও অনেক উন্নত হয়েছে। ফলে, ট্যাংক ধ্বংস করা এখন আর কঠিন কোনো কাজ নয়।
নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম পুরোনো থিংক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ নিক রেনল্ডস ও জ্যাক ওয়াটলিং মনে করেন, যুদ্ধের ময়দানে ট্যাংকের মতো ভারী বর্মের সাঁজোয়া যান ব্যবহারের যে ধারণা এখনো আছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ জাগাটা অযৌক্তিক নয়। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান হারানোর সংখ্যা রেনল্ডস ও ওয়াটলিংয়ের মতকেই প্রতিষ্ঠিত করছে। ট্যাংকের কার্যকারিতা প্রকৃতপক্ষেই হুমকির মুখে পড়েছে।
ইউক্রেন সেনাবাহিনী রাশিয়ার যেসব ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস করেছে তার বেশির ভাগই পদাতিক সেনাদের কাঁধে বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক গাইডেড মিসাইল (এটিজিএম) দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে কয়েক হাজার এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে—আমেরিকার জ্যাভলিন, সুইডিশ এনলস, জার্মান প্যানজারফাউস্ত-৩ এস। ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জেন্সের ‘ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার’ কৌশলের গুরু বলে খ্যাত জন হকস বলছেন, ‘এই যুদ্ধ (ইউক্রেন যুদ্ধ) আধুনিক আর্মার্ড ভেহিকেলের জন্য যে হুমকি স্পষ্ট হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনী।’
পরিহাসের বিষয় হলো, এক সময় যে রাশিয়া আর্মার্ড ভেহিকেলে ‘সক্রিয় সুরক্ষা ব্যবস্থা’ নিয়ে গর্বিত ছিল সেই রাশিয়ার ট্যাংক বাহিনী সহজে বহনযোগ্য অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল দিয়ে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যে এটিজিএমএস এতটা কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে—সেটি প্রতিহত করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা তথাকথিত যে ‘সক্রিয় সুরক্ষা ব্যবস্থা’ (অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেম—এপিএস) রয়েছে সেটির অগ্রদূত সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ ধরনের এপিএস মূলত ব্যবহার করা হয়—শত্রুপক্ষের কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ভেহিকেলে আঘাত হানলে ক্ষয়ক্ষতি যাতে কমানো যায়। সারা বিশ্বেই বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী এপিএসের উন্নয়ন নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।
এপিএস প্রধানত দুই প্রকার: ‘সফট-কিল’ ও ‘হার্ড-কিল’। সফট কিল এপিএস তার দিকে আগত ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ ইনফ্রারেড বা লেজার রশ্মি দিয়ে ভিন্ন দিকে পরিচালিত করা যায়। বিপরীতে হার্ড কিল সিস্টেম হলো আগত ক্ষেপণাস্ত্রকে পাল্টা আঘাত হেনে ধ্বংস করা।
তবে ইউক্রেনে সফট কিল সিস্টেম পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা গেছে। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন, ‘আপনি যে সিস্টেমটি ব্যর্থ করতে চেষ্টা করছেন সে বিষয়ে একটি উপযুক্ত প্রযুক্তিগত বোঝাপড়ার প্রয়োজন।’ কারণ, ইউক্রেনের সৈন্যরা যে পদ্ধতিতে তাদের অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল সিস্টেম ব্যবহার করেছে তা রাশিয়ার আর্মার্ড ভেহিকেলগুলোর পক্ষে জ্যাম করা সম্ভব নয়।
তবে হার্ড-কিল সিস্টেমেরও সমস্যা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগত ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করতে হলে প্রয়োজন অত্যাধুনিক রাডার এবং আগত ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করে সেগুলোতে আঘাত করার জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য। এ ছাড়া, ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর যে গতি তা হিসাবে আনাও জরুরি।
১৯৮০-এর দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘ড্রোজড সিস্টেম’ নামে প্রথম হার্ড কিল এপিএস সিস্টেম চালু করে। সে সময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনী এই ব্যবস্থা মোতায়েন করেছিল। সে সময় এই ব্যবস্থা আগত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে ধ্বংস করতে শেল নিক্ষেপ করত। তবে প্রায় ৪০ বছরের আগের ব্যবস্থার সঙ্গে আজকের ব্যবস্থার অনেক তফাৎ রয়েছে। ড্রোজডের আধুনিক এক ধরন রাশিয়ার সর্বশেষ প্রজন্মের ট্যাংক টি-১৪-এ স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্যবস্থা তৈরি করতে গিয়ে রাশিয়াকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে।
কিন্তু এরপরও কেন ইউক্রেনে রাশিয়ার ট্যাংক এবং আর্মার্ড ভেহিকেলগুলো দুর্দশায় পতিত তা বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন।
হার্ড কিল এপিএস সিস্টেমে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি হলো ইসরায়েল। রাফায়েলের (যুদ্ধবিমান) জন্য নকশা করা এই সিস্টেম দেশটির মেরকাভা ট্যাংকগুলোতে লাগানো হয়েছে। এই সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য হলো—এটি সুনির্দিষ্টভাবে আগত লক্ষ্যবস্তুর দিকে ‘স্প্রেড ফায়ার’ করে এবং নিকটস্থ পদাতিক বাহিনীর সম্ভাব্য বিপদ কমিয়ে আনে। ইসরায়েলের দাবি, তাদের এই সিস্টেম গাজায় অনেক ট্যাংক-বিধ্বংসী রকেট আক্রমণকে প্রতিহত করেছে। তবে জন হকস বলছেন, এ ধরনের আক্রমণ (গাজা থেকে আগত রকেট হামলা) সম্ভবত পুরোনো দুর্বল অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল থেকে আসা, ফলে ক্ষয়ক্ষতিও কম।
এই ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নেতিবাচক দিকও রয়েছে। অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেমের ওজন, এটি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা এবং শক্তি প্রয়োজন হয় তা সরবরাহ করতে গিয়ে ট্যাংকের প্রয়োজনীয় অস্ত্রগুলো কমিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে পড়বে। জ্যাক ওয়াটলিংয়ের মতে, পশ্চিমা ট্যাংকগুলো কার্যক্ষমতার সঙ্গে আপস না করায় ওজনে বেশ ভারী হয়ে যায়। ফলে এতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য খুব অল্প জায়গায়ই অবশিষ্ট থাকে।
হার্ড কিল সিস্টেম কেবল হাতে গোনা আগত কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পারে—যেহেতু এতে পর্যাপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র বিরোধী গোলা মজুত করা যায় না। আর করলে পদাতিক বাহিনীকে সহায়তা দিতে যে পরিমাণ অস্ত্র–গোলাবারুদ প্রয়োজন তা ধারণ করতে পারে না। এ ছাড়া, একটি সফল প্রতিরোধ শেষে যে ধ্বংসাবশেষ ছুটে আসে তা দিয়ে ট্যাংকের রাডারেরও ক্ষতি হতে পারে। জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, প্রতিপক্ষ যদি একটু চালাক হয় তবে, রাডার নিষ্ক্রিয় করার জন্য দূর থেকে মেশিনগানের গুলি দিয়েও ট্যাংকগুলোকে টার্গেট করতে পারে। যার ফলে, ট্যাংকে থাকা অ্যান্টি অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেমের কার্যকারিতা হ্রাস পায় অনেকাংশে।
তবে জন হকসের কথা হলো—প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিখুঁত হওয়ার চেয়ে কার্যকর হওয়া বেশি জরুরি। এ লক্ষ্যে জন হকস ট্যাংক বাঁচাতে বহু স্তরবিশিষ্ট ‘ওনিয়ন স্টাইল’ বা পেঁয়াজের মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজানোর কথা বলেন। যেখানে প্রথমে পদাতিক বাহিনী সম্ভাব্য হুমকি এবং আক্রমণের লক্ষ্য বাছাই ও নির্ণয় করবে, প্রয়োজন বোধে ধোঁয়া কিংবা অন্য কোনো উপায় ব্যবহার করে ট্যাংকের অবস্থান অস্পষ্ট রাখতে হবে এবং সর্বশেষ সবকিছুই যখন ব্যর্থ হবে তখন গিয়ে ট্যাংক আর্মার এবং ট্যাংকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা–অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেম–সেটিকে রক্ষা করবে।
তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার ট্যাংকের অবস্থা নির্দেশ করছে—‘ওনিয়ন স্টাইল’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আরও একটি স্তর যুক্ত করতে পারলে তা সত্যিই আরও কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন:
ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো একটি দুর্দশাপূর্ণ সময় পার করছে। যুদ্ধক্ষেত্রে দেশটি প্রায় ১৫৩টি ট্যাংক ও ৩১২টি সাঁজোয়া যান হারিয়েছে। ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স ব্লগ ওরিক্সের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট এ সংখ্যা জানিয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তাদের যথাক্রমে ২৬টি ট্যাংক ও ৫৭টি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়েছে। যদিও এই দাবি একান্তই কিয়েভের। কিন্তু ট্যাংকের এমন দুর্দিন কেন এবং কীভাবে টিকে থাকতে পারে আগামী দিনে—এমন প্রশ্নও উঠছে এখন। তাই সমর বিশারদেরা বলছেন, ট্যাংক প্রতিরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণের পর ৩৭ দিনের যুদ্ধে রাশিয়ার সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক হারানোর সংখ্যাটি একেবারেই কম নয়। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের সমর বিশারদেরা আগামীর যুদ্ধে ট্যাংকের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বছরখানেক আগে, ব্রিটিশ সেনাপ্রধান জেনারেল মার্ক কার্লটন স্মিথ বলেছিলেন, তিনি মনে করেন—আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের অপ্রতিরোধ্য রূপ অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। তাই এর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তাঁরই কথার প্রতিধ্বনি করছে ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’।
ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু যুক্তরাজ্য নয়, পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রও একই পথে হাঁটছে। দেশটি বিশাল ট্যাংকবহর সমরসজ্জা থেকে বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কারণ, প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের মোকাবিলায় ট্যাংকের প্রয়োজনীয়তা খুব কম। সিরিয়া যুদ্ধেও তুর্কি ড্রোনের হাতে মার খেয়েছে ট্যাংকবহর। ফলে ট্যাংকের যে আগের দিন নেই তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু ট্যাংকের এমন দুর্দিন কেন? বিশ্লেষকেরা বলছেন, অতীতে ক্যামোফ্ল্যাজের (ছদ্মবেশ) কারণে ট্যাংক যুদ্ধক্ষেত্রে দৃষ্টি এড়াতে পারত। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। বর্তমানের যুদ্ধবিমান ও সার্ভিল্যান্স বিমানগুলোতে থাকা উন্নত সেন্সর দিয়ে ট্যাংক ইঞ্জিনের তাপ ও মাটিতে থেকে যাওয়া ট্যাংকের চাকার দাগ থেকে ট্যাংকের অবস্থান শনাক্ত করে তা ধ্বংস করা বেশ সহজ হয়ে গেছে। আবার ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও অনেক উন্নত হয়েছে। ফলে, ট্যাংক ধ্বংস করা এখন আর কঠিন কোনো কাজ নয়।
নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম পুরোনো থিংক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ নিক রেনল্ডস ও জ্যাক ওয়াটলিং মনে করেন, যুদ্ধের ময়দানে ট্যাংকের মতো ভারী বর্মের সাঁজোয়া যান ব্যবহারের যে ধারণা এখনো আছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ জাগাটা অযৌক্তিক নয়। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান হারানোর সংখ্যা রেনল্ডস ও ওয়াটলিংয়ের মতকেই প্রতিষ্ঠিত করছে। ট্যাংকের কার্যকারিতা প্রকৃতপক্ষেই হুমকির মুখে পড়েছে।
ইউক্রেন সেনাবাহিনী রাশিয়ার যেসব ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস করেছে তার বেশির ভাগই পদাতিক সেনাদের কাঁধে বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক গাইডেড মিসাইল (এটিজিএম) দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে কয়েক হাজার এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে—আমেরিকার জ্যাভলিন, সুইডিশ এনলস, জার্মান প্যানজারফাউস্ত-৩ এস। ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জেন্সের ‘ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার’ কৌশলের গুরু বলে খ্যাত জন হকস বলছেন, ‘এই যুদ্ধ (ইউক্রেন যুদ্ধ) আধুনিক আর্মার্ড ভেহিকেলের জন্য যে হুমকি স্পষ্ট হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনী।’
পরিহাসের বিষয় হলো, এক সময় যে রাশিয়া আর্মার্ড ভেহিকেলে ‘সক্রিয় সুরক্ষা ব্যবস্থা’ নিয়ে গর্বিত ছিল সেই রাশিয়ার ট্যাংক বাহিনী সহজে বহনযোগ্য অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল দিয়ে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যে এটিজিএমএস এতটা কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে—সেটি প্রতিহত করার জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা তথাকথিত যে ‘সক্রিয় সুরক্ষা ব্যবস্থা’ (অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেম—এপিএস) রয়েছে সেটির অগ্রদূত সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ ধরনের এপিএস মূলত ব্যবহার করা হয়—শত্রুপক্ষের কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ভেহিকেলে আঘাত হানলে ক্ষয়ক্ষতি যাতে কমানো যায়। সারা বিশ্বেই বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী এপিএসের উন্নয়ন নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।
এপিএস প্রধানত দুই প্রকার: ‘সফট-কিল’ ও ‘হার্ড-কিল’। সফট কিল এপিএস তার দিকে আগত ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ ইনফ্রারেড বা লেজার রশ্মি দিয়ে ভিন্ন দিকে পরিচালিত করা যায়। বিপরীতে হার্ড কিল সিস্টেম হলো আগত ক্ষেপণাস্ত্রকে পাল্টা আঘাত হেনে ধ্বংস করা।
তবে ইউক্রেনে সফট কিল সিস্টেম পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা গেছে। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের জ্যাক ওয়াটলিং বলছেন, ‘আপনি যে সিস্টেমটি ব্যর্থ করতে চেষ্টা করছেন সে বিষয়ে একটি উপযুক্ত প্রযুক্তিগত বোঝাপড়ার প্রয়োজন।’ কারণ, ইউক্রেনের সৈন্যরা যে পদ্ধতিতে তাদের অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল সিস্টেম ব্যবহার করেছে তা রাশিয়ার আর্মার্ড ভেহিকেলগুলোর পক্ষে জ্যাম করা সম্ভব নয়।
তবে হার্ড-কিল সিস্টেমেরও সমস্যা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগত ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করতে হলে প্রয়োজন অত্যাধুনিক রাডার এবং আগত ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করে সেগুলোতে আঘাত করার জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য। এ ছাড়া, ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর যে গতি তা হিসাবে আনাও জরুরি।
১৯৮০-এর দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘ড্রোজড সিস্টেম’ নামে প্রথম হার্ড কিল এপিএস সিস্টেম চালু করে। সে সময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনী এই ব্যবস্থা মোতায়েন করেছিল। সে সময় এই ব্যবস্থা আগত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে ধ্বংস করতে শেল নিক্ষেপ করত। তবে প্রায় ৪০ বছরের আগের ব্যবস্থার সঙ্গে আজকের ব্যবস্থার অনেক তফাৎ রয়েছে। ড্রোজডের আধুনিক এক ধরন রাশিয়ার সর্বশেষ প্রজন্মের ট্যাংক টি-১৪-এ স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্যবস্থা তৈরি করতে গিয়ে রাশিয়াকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে।
কিন্তু এরপরও কেন ইউক্রেনে রাশিয়ার ট্যাংক এবং আর্মার্ড ভেহিকেলগুলো দুর্দশায় পতিত তা বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন।
হার্ড কিল এপিএস সিস্টেমে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর একটি হলো ইসরায়েল। রাফায়েলের (যুদ্ধবিমান) জন্য নকশা করা এই সিস্টেম দেশটির মেরকাভা ট্যাংকগুলোতে লাগানো হয়েছে। এই সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য হলো—এটি সুনির্দিষ্টভাবে আগত লক্ষ্যবস্তুর দিকে ‘স্প্রেড ফায়ার’ করে এবং নিকটস্থ পদাতিক বাহিনীর সম্ভাব্য বিপদ কমিয়ে আনে। ইসরায়েলের দাবি, তাদের এই সিস্টেম গাজায় অনেক ট্যাংক-বিধ্বংসী রকেট আক্রমণকে প্রতিহত করেছে। তবে জন হকস বলছেন, এ ধরনের আক্রমণ (গাজা থেকে আগত রকেট হামলা) সম্ভবত পুরোনো দুর্বল অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল থেকে আসা, ফলে ক্ষয়ক্ষতিও কম।
এই ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নেতিবাচক দিকও রয়েছে। অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেমের ওজন, এটি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা এবং শক্তি প্রয়োজন হয় তা সরবরাহ করতে গিয়ে ট্যাংকের প্রয়োজনীয় অস্ত্রগুলো কমিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে পড়বে। জ্যাক ওয়াটলিংয়ের মতে, পশ্চিমা ট্যাংকগুলো কার্যক্ষমতার সঙ্গে আপস না করায় ওজনে বেশ ভারী হয়ে যায়। ফলে এতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য খুব অল্প জায়গায়ই অবশিষ্ট থাকে।
হার্ড কিল সিস্টেম কেবল হাতে গোনা আগত কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে পারে—যেহেতু এতে পর্যাপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র বিরোধী গোলা মজুত করা যায় না। আর করলে পদাতিক বাহিনীকে সহায়তা দিতে যে পরিমাণ অস্ত্র–গোলাবারুদ প্রয়োজন তা ধারণ করতে পারে না। এ ছাড়া, একটি সফল প্রতিরোধ শেষে যে ধ্বংসাবশেষ ছুটে আসে তা দিয়ে ট্যাংকের রাডারেরও ক্ষতি হতে পারে। জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, প্রতিপক্ষ যদি একটু চালাক হয় তবে, রাডার নিষ্ক্রিয় করার জন্য দূর থেকে মেশিনগানের গুলি দিয়েও ট্যাংকগুলোকে টার্গেট করতে পারে। যার ফলে, ট্যাংকে থাকা অ্যান্টি অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেমের কার্যকারিতা হ্রাস পায় অনেকাংশে।
তবে জন হকসের কথা হলো—প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিখুঁত হওয়ার চেয়ে কার্যকর হওয়া বেশি জরুরি। এ লক্ষ্যে জন হকস ট্যাংক বাঁচাতে বহু স্তরবিশিষ্ট ‘ওনিয়ন স্টাইল’ বা পেঁয়াজের মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাজানোর কথা বলেন। যেখানে প্রথমে পদাতিক বাহিনী সম্ভাব্য হুমকি এবং আক্রমণের লক্ষ্য বাছাই ও নির্ণয় করবে, প্রয়োজন বোধে ধোঁয়া কিংবা অন্য কোনো উপায় ব্যবহার করে ট্যাংকের অবস্থান অস্পষ্ট রাখতে হবে এবং সর্বশেষ সবকিছুই যখন ব্যর্থ হবে তখন গিয়ে ট্যাংক আর্মার এবং ট্যাংকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা–অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেম–সেটিকে রক্ষা করবে।
তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার ট্যাংকের অবস্থা নির্দেশ করছে—‘ওনিয়ন স্টাইল’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আরও একটি স্তর যুক্ত করতে পারলে তা সত্যিই আরও কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন:
কোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
২ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৬ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
১০ দিন আগেযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় মোটামুটি সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের বড় প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী দেশগুলোয়।
১২ দিন আগে