সবুজ আহমেদ
সবে মাত্র সূর্যটা অক্ষাংশ অতিক্রম করে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। নীলাভ আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘমালা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। একটি কাকের ঝাঁক কী কী করতে করতে চোখের পলকে উড়ে গেল। এমনিতে অন্যদিনের চেয়ে আলাদা নয়। চিরচেনা ময়মনসিংহ শহর, তারচেয়েও চেনা এই মাসকান্দা বাস টার্মিনাল। শহরের গাড়িগুলো টার্মিনালে সামান্য বাঁক নিয়েই দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে গন্তব্যে। শুধু কিছু বাস থেমেছে যাত্রী ওঠানামার তাগিদে।
চারদিকের পরিবেশ কেমন যেন রুক্ষ আর উত্তপ্ত। কিছু ঘর্মাক্ত মানুষ টং দোকানে চায়ের কাঁপে ধোঁয়া ওড়াচ্ছেন। কেউ রাজনীতি, কেউ অর্থনীতি, আবার কেউবা আলাপ করছেন সংসার-ধর্ম নিয়ে। দোকানের পাশেই একটা প্রকাণ্ড কড়াই গাছ। গাছটি আকাশ স্পর্শ করার তীব্র ইচ্ছা নিয়ে বেড়ে উঠে আবার ছড়িয়ে পড়েছে। গাছটির ঠিক নিচেই আধমরা লিকলিকে শরীরের একটি কুকুর পূর্ণ জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে। অনবরত লালা ঝরছে, যেমন অনেকেরই ঝরে গোপনে। পাশেই একটা ময়লার স্তূপ, ঠিক স্তূপ নয়, কিন্তু ময়লা গর্তমতো জায়গায় জড়ো করে রাখা হয়েছে। সেখানে রয়েছে নতুন পুরাতন বিবর্ণ রং ওঠা বিড়ি সিগারেট, চিপস, বেকারি ইত্যাদির খালি প্যাকেট।
টার্মিনালের অদূরে এক পা সামান্য ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। উসকোখুসকো চুল, খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি, কপালজুড়ে লেগে আছে ঘাম, চেহারায় মায়া, অথচ বিরক্তি ও দুশ্চিন্তার ছাপ বিদ্যমান। পোশাক পরিচ্ছদে বোঝাই যাচ্ছে লোকটি দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। একটি পুরাতন শার্ট পরেছেন; তার আবার মাত্র দুটি বোতাম অবশিষ্ট। বেশ কয়েক জায়গায় ফেঁসে গেছে। কোথাও কোথাও লেগে আছে তরকারির ঝোল। পরিহিত ঢেউখেলানো লুঙ্গিটি কোমরের সাথে এমনভাবে আটকে আছে, যেন লুঙ্গিটিও ঢেউ খেলছে। তাতে বেশ কয়েক জায়গায় সেলাই। সমস্ত লুঙ্গিতে ছোট ছোট ছিদ্র। তাঁর এই দাঁড়িয়ে থাকা যুদ্ধে বিধ্বস্ত জহুরুল হক হলের দেয়ালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
লোকটি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় তিন ঘণ্টা যাবৎ। এ সময়ের মধ্যে তিনি যেন সব ভুলে গেছেন—খাওয়া, বিশ্রাম এমনকি পানি পর্যন্ত। একটু পরপর লোকটি পিঠ, মাথা, নিতম্ব—এসব চুলকাচ্ছেন, আর কাকে যেন ফোনকল দিয়েই যাচ্ছেন। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। সম্ভবত ফোন বন্ধ।
এদিকে লোকটির পাশ দিয়ে তিনটি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দেখে সহজেই ঠাওর করা সম্ভব—এরা নব্য কলেজপড়ুয়া। এদের পোশাকপরিচ্ছদ একটু ওয়েস্টার্ন। সেই মধ্যবয়স্ক লোকটি বাদে টার্মিনালে যে লোকগুলো রয়েছে, তারা মেয়েগুলোকে দেখছে। অবশ্য সেদিকে তাদের কোনো খেয়ালই নেই। কারণ, এটা নতুন কোনো রোগের উপসর্গ নয়। এবারে মেয়ে তিনটির মধ্যে সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটি সেই মধ্যবয়স্ক লোকটিকে খেয়াল করল। প্রথমবারেই ঘৃণা আর অস্বস্তিতে তার সমস্ত শরীর ঘিনঘিন করে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে লেপটে থাকা থুতু একবার চেটে নিয়ে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে মাটিতে ছুড়ে দিল। বোধ হয় উদ্দেশ্য ছিল লোকটির গায়েই ফেলবে। ভাগ্যিস লোকটি খেয়াল করেনি। যদি করত তবে সে থুতু লোকটির অন্তরে গিয়ে পড়ত।
এরই মধ্যে একটি লাল-কালো ও বিচিত্র ধরনের রং মেশানো ফিটনেসবিহীন বাস টার্মিনালে এসে দাঁড়াল। বাস থেকে কেউ নামবে কি-না, তা দেখার জন্য লোকটি আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক তখনই সিলভার পাড়ের লাল শাড়ি পরিহিত একটি অল্প বয়সী মেয়ে বাস থেকে নেমে এল। নেমেই এক দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মধ্যবয়স্ক লোকটির বুকে। তারপর বাবা বাবা বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বাবাও মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আর কাঁদছেন কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না।
হঠাৎ করেই পরিবেশটা কেমন যেন ভারী হয়ে গেল। বাবা-মেয়ের মিলন দেখে বাস টার্মিনালের প্রতিটি মানুষের হৃদয় সিক্ত হলো বলা যায়। তারা মনে মনে বাহবা দিতে লাগলেন, হয়তো ভাবলেন—বাবা-মেয়ের ভালোবাসা এমনই তো হওয়া চাই। দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটির চোখ থেকেও।
ঠিক তখনই আনন্দে নেচে উঠল প্রকৃতি। এক ঝাপটা বাতাস বয়ে গেল কড়াই গাছের ওপর দিয়ে, মেঘমালাও ছায়া দিতে থাকল। মাতম করতে লাগল ময়লার স্তূপ, কুকুরের লালা, ছুড়ে ফেলা থুতু আর পড়ে থাকা নতুন পুরাতন বিড়ি-সিগারেটের খালি প্যাকেটগুলো!
সবে মাত্র সূর্যটা অক্ষাংশ অতিক্রম করে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। নীলাভ আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘমালা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। একটি কাকের ঝাঁক কী কী করতে করতে চোখের পলকে উড়ে গেল। এমনিতে অন্যদিনের চেয়ে আলাদা নয়। চিরচেনা ময়মনসিংহ শহর, তারচেয়েও চেনা এই মাসকান্দা বাস টার্মিনাল। শহরের গাড়িগুলো টার্মিনালে সামান্য বাঁক নিয়েই দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে গন্তব্যে। শুধু কিছু বাস থেমেছে যাত্রী ওঠানামার তাগিদে।
চারদিকের পরিবেশ কেমন যেন রুক্ষ আর উত্তপ্ত। কিছু ঘর্মাক্ত মানুষ টং দোকানে চায়ের কাঁপে ধোঁয়া ওড়াচ্ছেন। কেউ রাজনীতি, কেউ অর্থনীতি, আবার কেউবা আলাপ করছেন সংসার-ধর্ম নিয়ে। দোকানের পাশেই একটা প্রকাণ্ড কড়াই গাছ। গাছটি আকাশ স্পর্শ করার তীব্র ইচ্ছা নিয়ে বেড়ে উঠে আবার ছড়িয়ে পড়েছে। গাছটির ঠিক নিচেই আধমরা লিকলিকে শরীরের একটি কুকুর পূর্ণ জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে। অনবরত লালা ঝরছে, যেমন অনেকেরই ঝরে গোপনে। পাশেই একটা ময়লার স্তূপ, ঠিক স্তূপ নয়, কিন্তু ময়লা গর্তমতো জায়গায় জড়ো করে রাখা হয়েছে। সেখানে রয়েছে নতুন পুরাতন বিবর্ণ রং ওঠা বিড়ি সিগারেট, চিপস, বেকারি ইত্যাদির খালি প্যাকেট।
টার্মিনালের অদূরে এক পা সামান্য ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। উসকোখুসকো চুল, খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি, কপালজুড়ে লেগে আছে ঘাম, চেহারায় মায়া, অথচ বিরক্তি ও দুশ্চিন্তার ছাপ বিদ্যমান। পোশাক পরিচ্ছদে বোঝাই যাচ্ছে লোকটি দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। একটি পুরাতন শার্ট পরেছেন; তার আবার মাত্র দুটি বোতাম অবশিষ্ট। বেশ কয়েক জায়গায় ফেঁসে গেছে। কোথাও কোথাও লেগে আছে তরকারির ঝোল। পরিহিত ঢেউখেলানো লুঙ্গিটি কোমরের সাথে এমনভাবে আটকে আছে, যেন লুঙ্গিটিও ঢেউ খেলছে। তাতে বেশ কয়েক জায়গায় সেলাই। সমস্ত লুঙ্গিতে ছোট ছোট ছিদ্র। তাঁর এই দাঁড়িয়ে থাকা যুদ্ধে বিধ্বস্ত জহুরুল হক হলের দেয়ালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
লোকটি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় তিন ঘণ্টা যাবৎ। এ সময়ের মধ্যে তিনি যেন সব ভুলে গেছেন—খাওয়া, বিশ্রাম এমনকি পানি পর্যন্ত। একটু পরপর লোকটি পিঠ, মাথা, নিতম্ব—এসব চুলকাচ্ছেন, আর কাকে যেন ফোনকল দিয়েই যাচ্ছেন। ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। সম্ভবত ফোন বন্ধ।
এদিকে লোকটির পাশ দিয়ে তিনটি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দেখে সহজেই ঠাওর করা সম্ভব—এরা নব্য কলেজপড়ুয়া। এদের পোশাকপরিচ্ছদ একটু ওয়েস্টার্ন। সেই মধ্যবয়স্ক লোকটি বাদে টার্মিনালে যে লোকগুলো রয়েছে, তারা মেয়েগুলোকে দেখছে। অবশ্য সেদিকে তাদের কোনো খেয়ালই নেই। কারণ, এটা নতুন কোনো রোগের উপসর্গ নয়। এবারে মেয়ে তিনটির মধ্যে সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটি সেই মধ্যবয়স্ক লোকটিকে খেয়াল করল। প্রথমবারেই ঘৃণা আর অস্বস্তিতে তার সমস্ত শরীর ঘিনঘিন করে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে লেপটে থাকা থুতু একবার চেটে নিয়ে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে মাটিতে ছুড়ে দিল। বোধ হয় উদ্দেশ্য ছিল লোকটির গায়েই ফেলবে। ভাগ্যিস লোকটি খেয়াল করেনি। যদি করত তবে সে থুতু লোকটির অন্তরে গিয়ে পড়ত।
এরই মধ্যে একটি লাল-কালো ও বিচিত্র ধরনের রং মেশানো ফিটনেসবিহীন বাস টার্মিনালে এসে দাঁড়াল। বাস থেকে কেউ নামবে কি-না, তা দেখার জন্য লোকটি আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক তখনই সিলভার পাড়ের লাল শাড়ি পরিহিত একটি অল্প বয়সী মেয়ে বাস থেকে নেমে এল। নেমেই এক দৌড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মধ্যবয়স্ক লোকটির বুকে। তারপর বাবা বাবা বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বাবাও মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আর কাঁদছেন কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না।
হঠাৎ করেই পরিবেশটা কেমন যেন ভারী হয়ে গেল। বাবা-মেয়ের মিলন দেখে বাস টার্মিনালের প্রতিটি মানুষের হৃদয় সিক্ত হলো বলা যায়। তারা মনে মনে বাহবা দিতে লাগলেন, হয়তো ভাবলেন—বাবা-মেয়ের ভালোবাসা এমনই তো হওয়া চাই। দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটির চোখ থেকেও।
ঠিক তখনই আনন্দে নেচে উঠল প্রকৃতি। এক ঝাপটা বাতাস বয়ে গেল কড়াই গাছের ওপর দিয়ে, মেঘমালাও ছায়া দিতে থাকল। মাতম করতে লাগল ময়লার স্তূপ, কুকুরের লালা, ছুড়ে ফেলা থুতু আর পড়ে থাকা নতুন পুরাতন বিড়ি-সিগারেটের খালি প্যাকেটগুলো!
ভোরের আলো ফোটার আগেই রাজধানীর আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন শ্রমজীবীদের হাটে জড়ো হন শত শত শ্রমজীবী মানুষ। বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও নারী শ্রমিকেরা এই হাটে প্রতিদিন ভিড় করেন একটু কাজ পাওয়ার আশায়। তবে দিন যত যাচ্ছে, তাঁদের জীবনের লড়াই ততই কঠিন হয়ে উঠছে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি তাঁদের জীবনকে দুর্বিষ
২০ দিন আগেফেলুদার দার্জিলিং জমজমাট বইয়ে প্রথম পরিচয় দার্জিলিংয়ের সঙ্গে। তারপর অঞ্জন দত্তের গানসহ আরও নানাভাবে হিল স্টেশনটির প্রতি এক ভালোবাসা তৈরি হয়। তাই প্রথমবার ভারত সফরে ওটি, শিমলা, মসুরির মতো লোভনীয় হিল স্টেশনগুলোকে বাদ দিয়ে দার্জিলিংকেই বেছে নেই। অবশ্য আজকের গল্প পুরো দার্জিলিং ভ্রমণের নয়, বরং তখন পরিচয়
২৩ দিন আগেকথায় আছে না—‘ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরেমেঘ দেখলেই ডরায়’! আমার হইছে এই অবস্থা। বাড়িতে এখন বাড়িআলী, বয়স্ক বাপ-মা আর ছোট মেয়ে। সকাল থেকে চার-পাঁচবার কতা বলিচি। সংসার গোচাচ্ছে। আইজকা সন্ধ্যার দিকে ঝড় আসপি শুনতিছি। চিন্তায় রাতে ভালো ঘুমাতে পারিনি...
২৬ মে ২০২৪প্রতিদিন ভোরে ট্রেনের হুইসেলে ঘুম ভাঙে রাকিব হাসানের। একটু একটু করে গড়ে ওঠা রেলপথ নির্মাণকাজ তাঁর চোখে দেখা। এরপর রেলপথে ট্রেন ছুটে চলা, ট্রেন ছুঁয়ে দেখা—সবই হলো; কিন্তু এখনো হয়নি চড়া। রাকিবের মুখে তাই ভারতীয় সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লার বিখ্যাত গান। ‘আমার বলার কিছু ছিল না, চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪