শরিফুল হাসান
১৭ নভেম্বর ৪৩তম বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যোগদান করার কথা ছিল। এই বিসিএসে উত্তীর্ণ দুই হাজারের বেশি প্রার্থীর মধ্যে অধিকাংশই সরকারি-বেসরকারি নানা চাকরি করতেন। তাঁরা সেসব চাকরি ছেড়ে সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যোগদানের জন্য। কিন্তু ২৮ অক্টোবর রাতে হঠাৎ করেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ৪৩তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চাকরিতে যোগদানের তারিখ পিছিয়েছে, যেটা নজিরবিহীন। এ যেন চার বছরের বেশি সময় অপেক্ষার পর দেশের একদল মেধাবীর সঙ্গে প্রহসন!
২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল পিএসসি। প্রায় সাড়ে চার লাখ প্রার্থী এতে অংশ নেন। প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক সব পরীক্ষা শেষ করতে করতে সময় লাগে তিন বছর। এই তিন ধাপের পরীক্ষা শেষে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে ২ হাজার ১৬৩ জনকে ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এরপর তাঁরা জনপ্রশাসনের গেজেটের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু জুলাই থেকে আন্দোলন, এরপর ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনে গেজেট বিলম্বিত হয়। ৫ আগস্টের পর ফের এক দফায় পুলিশি প্রতিবেদন যাচাই হয়। এরপর ৫৪ জনকে বাদ দিয়ে গত ১৫ অক্টোবর নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। হতাশা কাটিয়ে গেজেটে থাকা ২ হাজার ৬৪ জন প্রার্থী ১৭ নভেম্বর যোগদানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
কিন্তু কেন হঠাৎ করে তাঁদের যোগদান পেছানো হলো, সেটি তাঁরা জানেন না। সরকারের তরফ থেকেও কোনো ব্যাখ্যা নেই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি শুধু দুটি লাইন, ‘যোগদানের তারিখ ১৭ নভেম্বরের পরিবর্তে ১ জানুয়ারি ২০২৫ নির্ধারণ করা হলো। জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হলো।’ কিন্তু এখানে ‘জনস্বার্থ’টা কোথায়?
এই প্রার্থীদের বেশির ভাগই সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন চাকরিতে ছিলেন। নভেম্বরে যোগদানের কথা ভেবে তাঁরা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। আগামী দুই মাস তাঁরা চলবেন কী করে? আর বিসিএস জীবনের শুরুতেই এমন ঘটনা এই দুই হাজার প্রার্থী এবং তাঁদের পরিবারের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা বোঝার কোনো প্রয়োজন মনে করেনি সরকার বা রাষ্ট্র।
দুঃখজনক বিষয় হলো, ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পর এই বিসিএসের প্রার্থীদের ফের যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলে গেজেট বিলম্বিত করা হয়েছিল। পরে সত্যি রাজনৈতিক রং খোঁজার নামে ৫৪ জনকে গেজেট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তারও কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তাঁদের ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে—এমন কারণে বাদ পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। যদিও এই প্রার্থীদের অধিকাংশই বলেছেন, ছাত্রজীবনে তাঁদের রাজনৈতিক কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। একজন তো জানালেন তাঁর বাবা বিএনপি করতেন।
এ কারণে তিনি ভয়ে ছিলেন তাঁর গেজেট আটকে না যায়। কিন্তু এখন দেখছেন ছাত্রলীগ কর্মী বলে তাঁর গেজেট আটকে গেছে!
গেজেট আটকে যাওয়ার পর একজন প্রার্থী যিনি একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর—দুটোতেই প্রথম হয়ে ডাবল ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তিনি আফসোস করে বললেন, ‘আমার অপরাধ কী? আমি কার কাছে জবাব চাইব? বৈষম্যহীন যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, এটাই কি তার নমুনা? এখনো যদি আমরা এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারি, তাহলে জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য লজ্জাজনক হবে।’
বাদ পড়াদের গল্পগুলো প্রায় একই। অন্তত ২০ জন বলেছেন, তাঁরা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। তারপরও তাঁরা কেন বাদ পড়েছেন, তা তাঁরা জানেন না। তাঁরা সবাই পুনরায় যাচাইয়ের জন্য জনপ্রশাসনে আবেদন করেছেন। সরকার নিশ্চয়ই সেগুলো পুনরায় যাচাই করবে।
অবশ্য বিসিএস নিয়ে এমন রাজনীতি নতুন নয়। গেজেট আটকে দেওয়ার এমন অনেক ঘটনা অতীতেও কম-বেশি হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে বিসিএসের ২৮তম ব্যাচ থেকে ৪২তম ব্যাচ পর্যন্ত অন্তত ২৬৫ জন প্রার্থীর নিয়োগ এভাবে আটকে ছিল। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা নেতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কারণ দেখিয়ে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ৫ আগস্টে সরকারের পতনের পর গত ১৪ আগস্ট তাঁদের সবার গেজেট হয়েছে। এর মানে বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণদের আটকে রাখার কোনো সুযোগ নেই। আফসোস, এরপরও রাজনৈতিক রং খোঁজার চেষ্টা চলছে।
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন প্রার্থীর প্রাক্-যাচাই ফরমে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হয়। সাধারণ তথ্যের পাশাপাশি তিনি কোনো মামলায় গ্রেপ্তার, অভিযুক্ত বা দণ্ডিত হয়েছেন কি না, এই তথ্য চাওয়া হয়। উত্তীর্ণ হওয়ার পর এসব যাচাই শেষ করে পুলিশের বিশেষ শাখা প্রতিবেদন দেয়। এর বাইরে অন্য কোনো তথ্য যাচাই করার কথা না থাকলেও বছরের পর বছর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রার্থীর পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই করছে। অথচ ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া একজনকেও আটকে দেওয়া ঠিক নয়। এটা অনৈতিক চর্চা।
কেবল ৪৩তম বিসিএসে নয়, সংকটে পড়েছেন ৪০তম বিসিএসের পুলিশ কর্মকর্তারাও। গত ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ৪০তম বিসিএসের শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারদের (এএসপি) প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি স্থগিত করা হয়। কিন্তু কেন, সেই উত্তর নেই। শুধু বলা হয়েছে, অনিবার্য কারণে কুচকাওয়াজ স্থগিত। সেই অনিবার্য কারণটা কী, কেউ জানে না!
অভিযোগ উঠেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৪০তম বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। এতে অন্তত ৬২ জন ছাত্রলীগ নেতা নিয়োগ পেয়েছেন। আশঙ্কার বিষয় হলো, কোনো তদন্ত ছাড়া ফেসবুকে একজনের স্ট্যাটাস দেখে ৬২ জন মেধাবী তরুণের জীবনকে অনিশ্চয়তায় ফেলা হলো। কেউ এখানে যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন মনে করলেন না? তাঁদের মনের ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে আমরা জানি? বাংলাদেশে এর আগে কখনো পুরো ব্যাচের কুচকাওয়াজ স্থগিতের ঘটনা সম্ভবত নজিরবিহীন।
কেউ যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করছে না, ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ৪০তম বিসিএসে ২৪৪ জন প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী কমিশনারসহ বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৯২৯ জনকে নিয়োগের গেজেট হয়েছিল। অন্য সবাই যোগ দিয়ে নানা পদে চাকরি করছেন, এমনকি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ বাকিদের অনেকেই গত নির্বাচনের সময় সরকারি কর্মকর্তাও ছিলেন। তাঁদের যোগদানে সমস্যা হয়নি অথচ একই বিসিএসে পুলিশ কর্মকর্তারা যাঁরা কি না প্রশিক্ষণ শেষ করে যোগদানই করতে পারলেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, ৪০তম বিসিএসের পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও আরও ছয়টি বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আট ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এগুলো অনৈতিক চর্চা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারপরও সরকার তদন্ত করুক। কিন্তু তদন্ত ছাড়াই নিয়োগ বিলম্বিত করা বা কাউকে রং দেওয়া কর্মকর্তাদের হতাশায় ফেলে। মনে রাখতে হবে, লাখ লাখ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবচেয়ে মেধাবীরা সাধারণত উত্তীর্ণ হন। কাজেই সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ বা যাচাই-বাছাই না করে ফেসবুকে কোনো সমন্বয়ক বা কোনো রাজনৈতিক দলের কারও কথা শুনে কাউকে বঞ্চিত বা হয়রানি করাটা অনুচিত। আদালতেও এগুলো টেকে না।
৪৩তম বিসিএসের সবার যোগদান বা ৪০তম বিসিএসের পুলিশের নিয়োগ যে শুধু বিলম্বিত হচ্ছে, তা-ই নয়, চার মাস ধরে ৪৪, ৪৫, ৪৬—সব কয়টি বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া ঝুলে আছে। এর মধ্যে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত। ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল এখনো প্রকাশ করা হয়নি। ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষাই এখনো হয়নি। এই বিসিএসগুলোও গত দুই-তিন বছর ধরে চলছে।
জুলাই মাসে প্রথমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এবং ৫ আগস্টের পরিবর্তন, এরপর পিএসসির আগের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পদত্যাগ, নতুন চেয়ারম্যান ও সদস্যের নিয়োগসহ সব মিলিয়ে চার মাস ধরে অচল হয়ে আছে পিএসসি। এর মধ্যে কোনো বিসিএসের পরীক্ষা নেওয়া হয়নি বা ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। ফলে চারটি বিসিএস নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন হাজার হাজার প্রার্থী। এর মধ্যে ৪৭-এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে চারটি বিসিএস নিয়ে যে সংকটে পড়বে পিএসসি, তা থেকে আগামী চার-পাঁচ বছরে উত্তরণের আশা করা কঠিন। সরকার ও পিএসসির দ্রুত এই সংকটের সমাধান ভাবতে হবে।
পৃথিবীর অনেক দেশে চার বছরে এক সরকারের মেয়াদ শেষে আরেক সরকার আসে। বাংলাদেশে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে চার বছরে স্নাতক শেষ করা যায়। অথচ চার বছরেও একটা বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হয় না। পৃথিবীর আর কোনো দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের পরীক্ষায় এত দীর্ঘ সময় লাগে না। এই দীর্ঘসূত্রতা কমাতেই হবে। বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর কমানো, নম্বরপত্র প্রকাশসহ পিএসসির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আরেকটা বিষয়। লাখ লাখ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একজন প্রার্থী যখন প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক শেষ করে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হন, তখন তাঁর রাজনৈতিক রং খোঁজার চেষ্টা অনাকাঙ্ক্ষিত। শুধু নিয়োগ নয়, রাজনৈতিক পরিচয় কোনোভাবেই সরকারি চাকরিতে পদ বা পদোন্নতির জন্য যোগ্যতা বা অযোগ্যতা কোনোটাই হতে পারে না। শক্তিশালী ও জনবান্ধব জনপ্রশাসন চাইলে রাজনৈতিক রং না খুঁজে কর্মকর্তাদের নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতিতে শুধু মেধা, সততা ও যোগ্যতাকে বিবেচনায় এনে জনপ্রশাসনের সংস্কার জরুরি।
লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক
১৭ নভেম্বর ৪৩তম বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যোগদান করার কথা ছিল। এই বিসিএসে উত্তীর্ণ দুই হাজারের বেশি প্রার্থীর মধ্যে অধিকাংশই সরকারি-বেসরকারি নানা চাকরি করতেন। তাঁরা সেসব চাকরি ছেড়ে সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন যোগদানের জন্য। কিন্তু ২৮ অক্টোবর রাতে হঠাৎ করেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ৪৩তম বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চাকরিতে যোগদানের তারিখ পিছিয়েছে, যেটা নজিরবিহীন। এ যেন চার বছরের বেশি সময় অপেক্ষার পর দেশের একদল মেধাবীর সঙ্গে প্রহসন!
২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল পিএসসি। প্রায় সাড়ে চার লাখ প্রার্থী এতে অংশ নেন। প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক সব পরীক্ষা শেষ করতে করতে সময় লাগে তিন বছর। এই তিন ধাপের পরীক্ষা শেষে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে ২ হাজার ১৬৩ জনকে ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এরপর তাঁরা জনপ্রশাসনের গেজেটের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু জুলাই থেকে আন্দোলন, এরপর ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনে গেজেট বিলম্বিত হয়। ৫ আগস্টের পর ফের এক দফায় পুলিশি প্রতিবেদন যাচাই হয়। এরপর ৫৪ জনকে বাদ দিয়ে গত ১৫ অক্টোবর নিয়োগের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। হতাশা কাটিয়ে গেজেটে থাকা ২ হাজার ৬৪ জন প্রার্থী ১৭ নভেম্বর যোগদানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
কিন্তু কেন হঠাৎ করে তাঁদের যোগদান পেছানো হলো, সেটি তাঁরা জানেন না। সরকারের তরফ থেকেও কোনো ব্যাখ্যা নেই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি শুধু দুটি লাইন, ‘যোগদানের তারিখ ১৭ নভেম্বরের পরিবর্তে ১ জানুয়ারি ২০২৫ নির্ধারণ করা হলো। জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হলো।’ কিন্তু এখানে ‘জনস্বার্থ’টা কোথায়?
এই প্রার্থীদের বেশির ভাগই সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন চাকরিতে ছিলেন। নভেম্বরে যোগদানের কথা ভেবে তাঁরা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। আগামী দুই মাস তাঁরা চলবেন কী করে? আর বিসিএস জীবনের শুরুতেই এমন ঘটনা এই দুই হাজার প্রার্থী এবং তাঁদের পরিবারের ওপর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা বোঝার কোনো প্রয়োজন মনে করেনি সরকার বা রাষ্ট্র।
দুঃখজনক বিষয় হলো, ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পর এই বিসিএসের প্রার্থীদের ফের যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলে গেজেট বিলম্বিত করা হয়েছিল। পরে সত্যি রাজনৈতিক রং খোঁজার নামে ৫৪ জনকে গেজেট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তারও কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তাঁদের ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে—এমন কারণে বাদ পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। যদিও এই প্রার্থীদের অধিকাংশই বলেছেন, ছাত্রজীবনে তাঁদের রাজনৈতিক কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। একজন তো জানালেন তাঁর বাবা বিএনপি করতেন।
এ কারণে তিনি ভয়ে ছিলেন তাঁর গেজেট আটকে না যায়। কিন্তু এখন দেখছেন ছাত্রলীগ কর্মী বলে তাঁর গেজেট আটকে গেছে!
গেজেট আটকে যাওয়ার পর একজন প্রার্থী যিনি একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর—দুটোতেই প্রথম হয়ে ডাবল ডিনস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তিনি আফসোস করে বললেন, ‘আমার অপরাধ কী? আমি কার কাছে জবাব চাইব? বৈষম্যহীন যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, এটাই কি তার নমুনা? এখনো যদি আমরা এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারি, তাহলে জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য লজ্জাজনক হবে।’
বাদ পড়াদের গল্পগুলো প্রায় একই। অন্তত ২০ জন বলেছেন, তাঁরা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। তারপরও তাঁরা কেন বাদ পড়েছেন, তা তাঁরা জানেন না। তাঁরা সবাই পুনরায় যাচাইয়ের জন্য জনপ্রশাসনে আবেদন করেছেন। সরকার নিশ্চয়ই সেগুলো পুনরায় যাচাই করবে।
অবশ্য বিসিএস নিয়ে এমন রাজনীতি নতুন নয়। গেজেট আটকে দেওয়ার এমন অনেক ঘটনা অতীতেও কম-বেশি হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে বিসিএসের ২৮তম ব্যাচ থেকে ৪২তম ব্যাচ পর্যন্ত অন্তত ২৬৫ জন প্রার্থীর নিয়োগ এভাবে আটকে ছিল। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা নেতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কারণ দেখিয়ে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ৫ আগস্টে সরকারের পতনের পর গত ১৪ আগস্ট তাঁদের সবার গেজেট হয়েছে। এর মানে বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণদের আটকে রাখার কোনো সুযোগ নেই। আফসোস, এরপরও রাজনৈতিক রং খোঁজার চেষ্টা চলছে।
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন প্রার্থীর প্রাক্-যাচাই ফরমে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হয়। সাধারণ তথ্যের পাশাপাশি তিনি কোনো মামলায় গ্রেপ্তার, অভিযুক্ত বা দণ্ডিত হয়েছেন কি না, এই তথ্য চাওয়া হয়। উত্তীর্ণ হওয়ার পর এসব যাচাই শেষ করে পুলিশের বিশেষ শাখা প্রতিবেদন দেয়। এর বাইরে অন্য কোনো তথ্য যাচাই করার কথা না থাকলেও বছরের পর বছর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রার্থীর পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই করছে। অথচ ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া একজনকেও আটকে দেওয়া ঠিক নয়। এটা অনৈতিক চর্চা।
কেবল ৪৩তম বিসিএসে নয়, সংকটে পড়েছেন ৪০তম বিসিএসের পুলিশ কর্মকর্তারাও। গত ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ৪০তম বিসিএসের শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারদের (এএসপি) প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি স্থগিত করা হয়। কিন্তু কেন, সেই উত্তর নেই। শুধু বলা হয়েছে, অনিবার্য কারণে কুচকাওয়াজ স্থগিত। সেই অনিবার্য কারণটা কী, কেউ জানে না!
অভিযোগ উঠেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৪০তম বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। এতে অন্তত ৬২ জন ছাত্রলীগ নেতা নিয়োগ পেয়েছেন। আশঙ্কার বিষয় হলো, কোনো তদন্ত ছাড়া ফেসবুকে একজনের স্ট্যাটাস দেখে ৬২ জন মেধাবী তরুণের জীবনকে অনিশ্চয়তায় ফেলা হলো। কেউ এখানে যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন মনে করলেন না? তাঁদের মনের ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে আমরা জানি? বাংলাদেশে এর আগে কখনো পুরো ব্যাচের কুচকাওয়াজ স্থগিতের ঘটনা সম্ভবত নজিরবিহীন।
কেউ যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করছে না, ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ৪০তম বিসিএসে ২৪৪ জন প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী কমিশনারসহ বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৯২৯ জনকে নিয়োগের গেজেট হয়েছিল। অন্য সবাই যোগ দিয়ে নানা পদে চাকরি করছেন, এমনকি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ বাকিদের অনেকেই গত নির্বাচনের সময় সরকারি কর্মকর্তাও ছিলেন। তাঁদের যোগদানে সমস্যা হয়নি অথচ একই বিসিএসে পুলিশ কর্মকর্তারা যাঁরা কি না প্রশিক্ষণ শেষ করে যোগদানই করতে পারলেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, ৪০তম বিসিএসের পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও আরও ছয়টি বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আট ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এগুলো অনৈতিক চর্চা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারপরও সরকার তদন্ত করুক। কিন্তু তদন্ত ছাড়াই নিয়োগ বিলম্বিত করা বা কাউকে রং দেওয়া কর্মকর্তাদের হতাশায় ফেলে। মনে রাখতে হবে, লাখ লাখ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবচেয়ে মেধাবীরা সাধারণত উত্তীর্ণ হন। কাজেই সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ বা যাচাই-বাছাই না করে ফেসবুকে কোনো সমন্বয়ক বা কোনো রাজনৈতিক দলের কারও কথা শুনে কাউকে বঞ্চিত বা হয়রানি করাটা অনুচিত। আদালতেও এগুলো টেকে না।
৪৩তম বিসিএসের সবার যোগদান বা ৪০তম বিসিএসের পুলিশের নিয়োগ যে শুধু বিলম্বিত হচ্ছে, তা-ই নয়, চার মাস ধরে ৪৪, ৪৫, ৪৬—সব কয়টি বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া ঝুলে আছে। এর মধ্যে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত। ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল এখনো প্রকাশ করা হয়নি। ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষাই এখনো হয়নি। এই বিসিএসগুলোও গত দুই-তিন বছর ধরে চলছে।
জুলাই মাসে প্রথমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এবং ৫ আগস্টের পরিবর্তন, এরপর পিএসসির আগের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পদত্যাগ, নতুন চেয়ারম্যান ও সদস্যের নিয়োগসহ সব মিলিয়ে চার মাস ধরে অচল হয়ে আছে পিএসসি। এর মধ্যে কোনো বিসিএসের পরীক্ষা নেওয়া হয়নি বা ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। ফলে চারটি বিসিএস নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন হাজার হাজার প্রার্থী। এর মধ্যে ৪৭-এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে চারটি বিসিএস নিয়ে যে সংকটে পড়বে পিএসসি, তা থেকে আগামী চার-পাঁচ বছরে উত্তরণের আশা করা কঠিন। সরকার ও পিএসসির দ্রুত এই সংকটের সমাধান ভাবতে হবে।
পৃথিবীর অনেক দেশে চার বছরে এক সরকারের মেয়াদ শেষে আরেক সরকার আসে। বাংলাদেশে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে চার বছরে স্নাতক শেষ করা যায়। অথচ চার বছরেও একটা বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হয় না। পৃথিবীর আর কোনো দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের পরীক্ষায় এত দীর্ঘ সময় লাগে না। এই দীর্ঘসূত্রতা কমাতেই হবে। বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর কমানো, নম্বরপত্র প্রকাশসহ পিএসসির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আরেকটা বিষয়। লাখ লাখ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একজন প্রার্থী যখন প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক শেষ করে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হন, তখন তাঁর রাজনৈতিক রং খোঁজার চেষ্টা অনাকাঙ্ক্ষিত। শুধু নিয়োগ নয়, রাজনৈতিক পরিচয় কোনোভাবেই সরকারি চাকরিতে পদ বা পদোন্নতির জন্য যোগ্যতা বা অযোগ্যতা কোনোটাই হতে পারে না। শক্তিশালী ও জনবান্ধব জনপ্রশাসন চাইলে রাজনৈতিক রং না খুঁজে কর্মকর্তাদের নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতিতে শুধু মেধা, সততা ও যোগ্যতাকে বিবেচনায় এনে জনপ্রশাসনের সংস্কার জরুরি।
লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে নীতিনির্ধারণী একটি বিষয় অগ্রাধিকার বিবেচনার জন্য অপেক্ষমাণ আছে, আর তা হলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন করা, নাকি যথাশিগগির নির্বাচন আয়োজন করা? অনেক ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য জাতীয় সংসদের বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না।
৯ ঘণ্টা আগেকিছু কিছু বিতর্ক তৈরি করা হয় সমসাময়িক বিষয় থেকে দৃষ্টি দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। পুরো পাকিস্তান আমলেই রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বিতর্ক জারি রাখা হয়েছিল। আমলাতন্ত্র আর সামরিক আমলাতন্ত্র মিলে পাকিস্তান নামক দেশটায় যে স্বৈরশাসন কায়েম করে রেখেছিল, সেদিকে যেন সচেতন মানুষের চোখ না যায়, সে অভিসন্ধি থেকেই রবীন্দ্রনাথ
৯ ঘণ্টা আগেএকটি কলা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। একটি সাধারণ কলা, যা নিলামে বিক্রি হলো ৭৪ কোটি টাকায়। এটি শিল্প, না কৌতুক, না সামাজিক শ্লেষ—নাকি তিনটির মিশেল? ইতালীয় শিল্পী মরিজিও ক্যাটালানের এই ‘কমেডিয়ান’ আমাদের শিল্পের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আর বাজারজাত সৃজনশীলতার প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
৯ ঘণ্টা আগে‘গণতন্ত্র মঞ্চ’র অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ঐক্য ফোরামের নেতা ছিলেন। তিনি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। এখন পর্যন্ত ২০টি বই লিখেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের রাজনীতি নিয়ে...
১ দিন আগে