প্রশান্ত মৃধা
‘আমার নাম তুলু, ভালো নাম জাকির। চিনতি পারিচেন?’
না। চিনতে পারিনি। বয়সে আমার চেয়ে একটু বড়ই হবেন হয়তো; কিন্তু চেহারায় তা ধরা পড়ছে না। চোখেমুখে কোনো অসহায়ত্ব নেই। ভেবেছিল, যেমন ভাবনা একটু নাগরিক ভদ্দরলোকি মনে কোনো কারণ ছাড়াই খাবি খায়। লোকটা নিশ্চয়ই সাহায্যপ্রার্থী! কিন্তু চিনিনি যে, তা তো সরাসরি বলাও যায় না; বরং চোখেমুখে সংশয় ঝুলিয়ে রাখা। যেন চিনেছি আর চিনিনির মাঝখানে একটা ভাব নেওয়া। কপটতার চূড়ান্ত আরকি। সরাসরি বলার মুরোদ নেই, তাই ওই চোখের সংশয়। আর সাহায্যপ্রার্থী মনে হওয়ার কারণ, লোকটির ডান হাতটা কনুইয়ের পরে আর নেই। এই লোকটাই আমাদের বাসের হেলপার। বাসটা মিনিবাসের চেয়ে বড়। চলে বাগেরহাট থেকে পিরোজপুর। এখন সাইনবোর্ড নামের জায়গায় মিনিট পনেরোর বিরতি। বলছে পনেরো মিনিট, আধঘণ্টাও হতে পারে। এই বিরতিটাও বিরক্তিকর। কারণ, বাসওয়ালারা মোরেলগঞ্জ থেকে আসা বাসটির অপেক্ষায় আছে। সেই যাত্রীদের যাঁরা পিরোজপুর যাবেন, তাঁদের না নিয়ে এ বাস ছাড়বে না।
আমার গন্তব্য এই মুহূর্তে একটু অনিশ্চিতই। পিরোজপুরের কথা বলে উঠেছি। এর মধ্যে যদি একজনের ফোন আসে, তাহলে আর যাব না সেদিকে, এখান থেকে চলে যাব কচুয়া। আবার পিরোজপুরেও যেতে পারি। সবই নির্ভর করবে এখানকার বিরতির সময় কতটা কিংবা আমার কাছে যে ফোনটি আসবে, সেটির ওপরও।
এ কথা ওই তুলু ওরফে জাকিরকে বলেছিও। বাসটার স্টার্স্ট বন্ধ করে ড্রাইভার চা খাওয়ার জন্য রাস্তার উল্টো দিকে গেছেন। যাত্রীরা কেউ কেউ রাস্তার এদিকে-ওদিকে। আমি তুলুকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি তাঁর পরিচিত চায়ের দোকানে। তিনিই চায়ের অর্ডার দিয়েছেন। গুরুত্বসহ চাওয়ালাকে বুঝিয়ে বলেছেন কাঁচা পাতি ইত্যাদি সহযোগে কীভাবে বানাতে হবে। সে নির্দেশ দিয়ে তারপরই তাঁর ওই কথা।
তাঁকে নিয়ে আমার তাবৎ ভাবনা অমূলক অথবা নয়। কিন্তু চিনতে যে পারিনি, সে কথা ততটা জোর দিয়ে বলতে পারলাম না। তার আগে তিনিই জানালেন, ওই যে কচুয়ায় আমার এক ভাইয়ের বাড়ি আছে না, তার উল্টো পাশে তাঁর এক আত্মীয়বাড়ি। সেখানেই একসময়ে দেখেছিলেন আমাকে। সেখানকার পোলের গোড়ার দোকানে চা খাচ্ছিলাম আমি। বৃষ্টি পড়ছিল। কথা হয়েছিল অনেকক্ষণ। তাঁর দুটো হাতই ছিল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
হলেও, সে তো অনেক কাল অন্তত পঁচিশ বছর। এত দিন আগে আমাকে দেখেছেন আর মনে রেখেছেন। অসম্ভব। তাঁকে বলি, নিশ্চয়ই আমার অন্য কোনো ভাই, এক ভাই আছে যে পিরোজপুরে থাকে, সে তো প্রায় আমার মতোই দেখতে। নিশ্চয়ই তাকে দেখেছেন তিনি।
না, না চিনতে পারায় তিনি আহত হলেন না। চায়ে চুমুক দিয়ে আমাকেই যে দেখেছেন সেদিন, এমন আরও দু-একটি উদাহরণ একেবারেই যথার্থ হাজির করলেন। একটু বিব্রত হয়ে কথাটা এখান থেকে ঘুরিয়ে নেওয়ার সুযোগ খুঁজছিলাম। তাই যেন, জীবনে বহুবার বহুক্ষণ বহুভাবে যে কথা তাকে শুনতে হয়েছে, সেই কথাই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও তুলুদা, হাতটা এমন হলো কী কইরে?’
এতে তাঁর চোখেমুখে কোনো বিষাদের ছায়া খেলল না। বরং জানালেন, আগে ড্রাইভার ছিলেন। ঢাকার গাড়ি নিয়ে আসার সময়ে, আরিচার এপারে বাসের ফাঁকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ দ্রুত এল আর একটা বাস। তিনি দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুই হতো না। সরে আসায় সেই ড্রাইভার বুঝতে পারেনি, আর দিছে টান, ওই বাসের একেবারে শেষ মাথা নিজের বাসটার সামনে লেগে তাঁর হাত ফেঁসে গেছে। হ্যাঁ, হাত ফেঁসে গেছে, ফেঁসে যাওয়া শব্দটাই তিনি ব্যবহার করেছেন। পরে ডাক্তাররা আর কোনোভাবে ঠিক করতে পারেননি।
একসময়ে আন্তনগর বাসের ড্রাইভার এখন আন্তজেলা বাসের হেলপার। তা-ও বাগেরহাট-পিরোজপুরের মতন লাইন, যার দূরত্ব সবচেয়ে কম। এ নিয়ে চোখে কোনো দুঃখভাব নেই। ডান হাতে কোনোমতে বাসের দরজা আঁকড়ে তিনি বাঁ হাতে বাসের গায়ে চাপড় মারেন, ‘যান বাড়ান!’
ড্রাইভার বাসে উঠে হর্ন দিয়েছে। তুলু না গেলে তো ছাড়বে না। হয়তো তুলুকে ডাকার সংকেত। যাত্রীদেরও। এ সময়ে আমার ফোন আসে। আমি হ্যালো বলে শুধু শুনি। তারপর বলি আচ্ছা। তুলু যা বোঝার বুঝে গেলেন। বললেন, আপনি আর যাচ্ছেন না তো! বলতে বলতে তিনি বাসের দিকে এগোন। আমি জানতে চাইলাম কন্ডাকটর কই, ভাড়া দেব না? তুলু বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ও আমি দিয়ে দেবানে। চায়ের দাম দিয়ে দিচি।’
শেষ দুটো বাক্যে একজন মানুষ সম্পর্কে ধারণা কীভাবে উল্টেপাল্টে গেল! এখন আমি সাহায্যপ্রার্থী না হলেও ঋণী তো থেকে গেলাম। মহান ‘নাগরিক-চেতনা’র উটকো শ্লাঘাকে উল্টে দিতে তাঁর মোটেও সময় লাগল না।
লেখক: সাহিত্যিক
‘আমার নাম তুলু, ভালো নাম জাকির। চিনতি পারিচেন?’
না। চিনতে পারিনি। বয়সে আমার চেয়ে একটু বড়ই হবেন হয়তো; কিন্তু চেহারায় তা ধরা পড়ছে না। চোখেমুখে কোনো অসহায়ত্ব নেই। ভেবেছিল, যেমন ভাবনা একটু নাগরিক ভদ্দরলোকি মনে কোনো কারণ ছাড়াই খাবি খায়। লোকটা নিশ্চয়ই সাহায্যপ্রার্থী! কিন্তু চিনিনি যে, তা তো সরাসরি বলাও যায় না; বরং চোখেমুখে সংশয় ঝুলিয়ে রাখা। যেন চিনেছি আর চিনিনির মাঝখানে একটা ভাব নেওয়া। কপটতার চূড়ান্ত আরকি। সরাসরি বলার মুরোদ নেই, তাই ওই চোখের সংশয়। আর সাহায্যপ্রার্থী মনে হওয়ার কারণ, লোকটির ডান হাতটা কনুইয়ের পরে আর নেই। এই লোকটাই আমাদের বাসের হেলপার। বাসটা মিনিবাসের চেয়ে বড়। চলে বাগেরহাট থেকে পিরোজপুর। এখন সাইনবোর্ড নামের জায়গায় মিনিট পনেরোর বিরতি। বলছে পনেরো মিনিট, আধঘণ্টাও হতে পারে। এই বিরতিটাও বিরক্তিকর। কারণ, বাসওয়ালারা মোরেলগঞ্জ থেকে আসা বাসটির অপেক্ষায় আছে। সেই যাত্রীদের যাঁরা পিরোজপুর যাবেন, তাঁদের না নিয়ে এ বাস ছাড়বে না।
আমার গন্তব্য এই মুহূর্তে একটু অনিশ্চিতই। পিরোজপুরের কথা বলে উঠেছি। এর মধ্যে যদি একজনের ফোন আসে, তাহলে আর যাব না সেদিকে, এখান থেকে চলে যাব কচুয়া। আবার পিরোজপুরেও যেতে পারি। সবই নির্ভর করবে এখানকার বিরতির সময় কতটা কিংবা আমার কাছে যে ফোনটি আসবে, সেটির ওপরও।
এ কথা ওই তুলু ওরফে জাকিরকে বলেছিও। বাসটার স্টার্স্ট বন্ধ করে ড্রাইভার চা খাওয়ার জন্য রাস্তার উল্টো দিকে গেছেন। যাত্রীরা কেউ কেউ রাস্তার এদিকে-ওদিকে। আমি তুলুকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি তাঁর পরিচিত চায়ের দোকানে। তিনিই চায়ের অর্ডার দিয়েছেন। গুরুত্বসহ চাওয়ালাকে বুঝিয়ে বলেছেন কাঁচা পাতি ইত্যাদি সহযোগে কীভাবে বানাতে হবে। সে নির্দেশ দিয়ে তারপরই তাঁর ওই কথা।
তাঁকে নিয়ে আমার তাবৎ ভাবনা অমূলক অথবা নয়। কিন্তু চিনতে যে পারিনি, সে কথা ততটা জোর দিয়ে বলতে পারলাম না। তার আগে তিনিই জানালেন, ওই যে কচুয়ায় আমার এক ভাইয়ের বাড়ি আছে না, তার উল্টো পাশে তাঁর এক আত্মীয়বাড়ি। সেখানেই একসময়ে দেখেছিলেন আমাকে। সেখানকার পোলের গোড়ার দোকানে চা খাচ্ছিলাম আমি। বৃষ্টি পড়ছিল। কথা হয়েছিল অনেকক্ষণ। তাঁর দুটো হাতই ছিল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
হলেও, সে তো অনেক কাল অন্তত পঁচিশ বছর। এত দিন আগে আমাকে দেখেছেন আর মনে রেখেছেন। অসম্ভব। তাঁকে বলি, নিশ্চয়ই আমার অন্য কোনো ভাই, এক ভাই আছে যে পিরোজপুরে থাকে, সে তো প্রায় আমার মতোই দেখতে। নিশ্চয়ই তাকে দেখেছেন তিনি।
না, না চিনতে পারায় তিনি আহত হলেন না। চায়ে চুমুক দিয়ে আমাকেই যে দেখেছেন সেদিন, এমন আরও দু-একটি উদাহরণ একেবারেই যথার্থ হাজির করলেন। একটু বিব্রত হয়ে কথাটা এখান থেকে ঘুরিয়ে নেওয়ার সুযোগ খুঁজছিলাম। তাই যেন, জীবনে বহুবার বহুক্ষণ বহুভাবে যে কথা তাকে শুনতে হয়েছে, সেই কথাই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও তুলুদা, হাতটা এমন হলো কী কইরে?’
এতে তাঁর চোখেমুখে কোনো বিষাদের ছায়া খেলল না। বরং জানালেন, আগে ড্রাইভার ছিলেন। ঢাকার গাড়ি নিয়ে আসার সময়ে, আরিচার এপারে বাসের ফাঁকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ দ্রুত এল আর একটা বাস। তিনি দাঁড়িয়ে থাকলে কিছুই হতো না। সরে আসায় সেই ড্রাইভার বুঝতে পারেনি, আর দিছে টান, ওই বাসের একেবারে শেষ মাথা নিজের বাসটার সামনে লেগে তাঁর হাত ফেঁসে গেছে। হ্যাঁ, হাত ফেঁসে গেছে, ফেঁসে যাওয়া শব্দটাই তিনি ব্যবহার করেছেন। পরে ডাক্তাররা আর কোনোভাবে ঠিক করতে পারেননি।
একসময়ে আন্তনগর বাসের ড্রাইভার এখন আন্তজেলা বাসের হেলপার। তা-ও বাগেরহাট-পিরোজপুরের মতন লাইন, যার দূরত্ব সবচেয়ে কম। এ নিয়ে চোখে কোনো দুঃখভাব নেই। ডান হাতে কোনোমতে বাসের দরজা আঁকড়ে তিনি বাঁ হাতে বাসের গায়ে চাপড় মারেন, ‘যান বাড়ান!’
ড্রাইভার বাসে উঠে হর্ন দিয়েছে। তুলু না গেলে তো ছাড়বে না। হয়তো তুলুকে ডাকার সংকেত। যাত্রীদেরও। এ সময়ে আমার ফোন আসে। আমি হ্যালো বলে শুধু শুনি। তারপর বলি আচ্ছা। তুলু যা বোঝার বুঝে গেলেন। বললেন, আপনি আর যাচ্ছেন না তো! বলতে বলতে তিনি বাসের দিকে এগোন। আমি জানতে চাইলাম কন্ডাকটর কই, ভাড়া দেব না? তুলু বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ও আমি দিয়ে দেবানে। চায়ের দাম দিয়ে দিচি।’
শেষ দুটো বাক্যে একজন মানুষ সম্পর্কে ধারণা কীভাবে উল্টেপাল্টে গেল! এখন আমি সাহায্যপ্রার্থী না হলেও ঋণী তো থেকে গেলাম। মহান ‘নাগরিক-চেতনা’র উটকো শ্লাঘাকে উল্টে দিতে তাঁর মোটেও সময় লাগল না।
লেখক: সাহিত্যিক
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
২ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
২ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
২ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে