চিররঞ্জন সরকার
বহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও না। মানুষ সবার আগে খেয়ে-পরে বাঁচতে চায়। যদি পকেট খালি থাকে, ঘরে খাবার না থাকে, তাহলে সব রকম সংস্কারই অসার হিসেবে বিবেচিত হবে। রুটি-রুজির প্রশ্নে মানুষ সব সময়ই আপসহীন।
তাই বলে মানুষের সব অধিকার কেড়ে নিয়ে, ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটের বন্দোবস্ত চালু রেখে একটা বিশেষ শ্রেণিকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি কি বহাল থাকবে? না, সেটাও থাকা উচিত নয়। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি এগিয়ে নিতে হবে। কর্তৃত্ববাদের অবসান ঘটাতে হবে। ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট বন্ধ করার মতো বিধিব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-আইনি সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রুটি-রুজি, জননিরাপত্তাকে কোনোমতেই উপেক্ষা করা যাবে না। দুটো একই সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। একটা বাদ দিয়ে আরেকটি নয়। যদি নিরাপদে বেঁচে থাকা এবং ভাতের ব্যবস্থা না করে কেবল রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে যাবতীয় তৎপরতা, তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে অসামঞ্জস্য বা ফাটল সৃষ্টি হতে বাধ্য।
মানুষ কিন্তু খুবই কষ্টে আছে। বিশেষ করে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে। আলু ৭০-৮০ টাকা কেজি। ভারত থেকে শত শত টন পেঁয়াজ আমদানির পরও এর দাম ১০০ টাকার আশপাশেই ঘোরাফেরা করছে। যে পাঙাশ মাছকে একসময় গরিবের খাবার বলা হতো, সেটাও বর্তমানে অনেকের কাছে স্বপ্ন। ব্রয়লার মুরগির দাম গরিব মানুষের সামর্থ্যের বাইরে। মোটা চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি। সয়াবিন তেল ২০০ টাকা, ৪০-৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি নাই, শাক কিনতে গেলে ১৫-২০ টাকা আঁটি, চিনি ১৫০ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে লোডশেডিং। অনেক জেলা-উপজেলায় দিন-রাত মিলিয়ে ৮ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না! কিন্তু মাস শেষে অনেক টাকার বিদ্যুৎ বিল গুনতে হয়।
মধ্যবিত্তরা এখন বাজারে গেলে নিজেদের নিম্নবিত্ত ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না। আর গরিবদের কথা তো যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। চারদিকে হতাশা। আয়ের হিসাব সংকীর্ণ হলেও ব্যয়ের হিসাব ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছে। অসহায় মানুষ কোথায় যাবে? কার কাছে ভরসা চাইবে?
দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের কাছে সংবিধান, সুশাসন, সংস্কার ইত্যাদির কোনো উপযোগিতা নেই। যদি রাষ্ট্র তাদের কাছে দাবি করত বশ্যতা, আর বিনিময়ে দিতে চাইত দুই বেলা পেটভরে খাওয়ার মতো ভাত? তারা কি বলতেন না, তোমরাই আমাদের বাপ-ঠাকুরদা-দুলাভাই, যা বলবা, তা-ই করব, শুধু চারটা খেতে দাও বাপ! ছেলেমেয়েগুলো যদি স্কুল অবধি পৌঁছাতে পারে, পড়তে দিয়ো; শরীর নিতান্ত কাবু হলে হাসপাতালের মেঝের এক কোণে শোয়ার মতো জায়গাটুকু যেন পাই! এসবের বিনিময়ে রাষ্ট্র যদি কারও মাথা কিনতে চায়, তবে আপত্তি করত কোন আহাম্মক?
আসলে গণতন্ত্র, সুশাসন, বাক্স্বাধীনতা, কালো আইন—অনেকটাই ‘মধ্যবিত্ত বিলাসিতা’। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের বেশির ভাগই এসব নিয়ে ভাবার অবসর পায় না। তারা স্বৈরাচার-আর আমের আচারের পার্থক্য খুঁজতে যায় না। দুই বেলার অন্ন সংস্থানের জন্য তারা যেকোনো কিছু বিনিময় করতে পারে।
তবু আমরা গণতন্ত্র, সুশাসন, বাক্স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাই। কারণ, প্রকৃত গণতন্ত্র চায় জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে, আইনের শাসন পালন করতে এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে। দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসন উদার গণতন্ত্রের পরিবর্তে এক অনুদার গণতান্ত্রিক আবহে আমাদের নিক্ষেপ করেছে। পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক অধিকার এবং আইনবহির্ভূতভাবে ভোটাধিকার হরণের একটা প্রথা গড়ে উঠেছে। সুশাসনের অভাবই আমাদের সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সুশাসনের মাধ্যমে জনগণ তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করতে পারে, অধিকার ভোগ করে এবং তাদের চাহিদা মেটাতে পারে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সামাজিক সাম্য, নাগরিক অধিকার, গণতান্ত্রিক সমাজ এবং রাজনৈতিক স্থিতি প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু আমরা বর্তমানে সেখান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি।
রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক দাক্ষিণ্য ভিক্ষা করেন না, বরং তাঁর অধিকার দাবি করেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা এই অবস্থান থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছি। অন্য সব অধিকারের পাশাপাশি আমাদের ভাতের অধিকারও গেছে। দেশে বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। অনেকের নিয়মিত আয় নেই। অথচ জিনিসপত্রের দাম ক্রমেই লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে কোনোমতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই একমাত্র আরাধ্য হয়ে পড়ছে। তাতে করে রাষ্ট্র সংস্কার, জবাবদিহিমূলক দল ও প্রশাসন গঠনের উদ্যোগগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে না। এগুলোকে বকেয়া রেখে সবাই চাইছে কেবল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচতে!
অনেকের কাছেই নতুন সংবিধান, আইন-প্রশাসন-রাষ্ট্র সংস্কারের বাগাড়ম্বর অর্থহীন—বস্তুত দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে, অথবা সেটুকুও না খেয়ে থাকার যন্ত্রণাটুকু ছাড়া গোপন করার মতো কিছুই যাঁদের নেই—তাঁদের এই অধিকার থাকল না গেল, তাতে কী-ইবা এসে যায়?
গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী, কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে বাজারে খাদ্য থাকলেও দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে তা কিনে খাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। এ কারণেই আমরা টিসিবির দোকান ও ট্রাকের সামনে নারী-পুরুষের লম্বা লাইন দেখি।
কাজেই সব ধরনের বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে অধিক খাদ্য ফলানো কিংবা অধিক আমদানি করলেই ক্ষুধা সমস্যার সমাধান হবে না। খাদ্য ক্রয়ে নাগরিকদের সামর্থ্য বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আর মনে রাখতে হবে যে রাষ্ট্র সংস্কারের আদর্শগত সাধনার চেয়ে নিরন্নদের ক্ষুধা মেটানো অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটি কথা, যে অধিকারের মূল্য মানুষই বোঝে না, রাষ্ট্র কীভাবে তাকে স্বীকার করে নিতে পারে, তাকে অলঙ্ঘনীয় বলে মেনে নিতে পারে? এখানে বলা ভালো, এই ভূখণ্ডে সর্বজনীন ভোটাধিকার কিন্তু সাধারণ মানুষের দাবির কারণে হয়নি। বরং ভোটার লিস্টে নামের বদলে কয়েক কেজি চাল বাড়িতে এলে ঢের খুশি হতেন অনেকেই। কিন্তু তদানীন্তন নেতৃত্ব এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে পরাধীন দেশের সব প্রজাকে স্বাধীন দেশের নাগরিক করে তোলার, তাঁদের গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় শামিল করাটা অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা মনে করতেন রাষ্ট্রকে স্বপ্রবৃত্ত হয়ে নিজের দায়িত্ব বুঝে নিতে হয়। মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশের নেতৃত্ব গত কয়েক দশকে ঠিক উল্টো মেরুতে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। ভোটের অধিকারও কেড়ে নিয়েছেন। অভুক্ত মানুষেরও যে অধিকার আছে যেকোনো মৌলিক অধিকারই অলঙ্ঘনীয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই অস্বীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে হাত পাতা ছাড়া যাঁদের উপায়ান্তর নেই, তাঁরাও যে প্রজা নন, নাগরিক; গণতান্ত্রিক পরিসরে রাজনীতিতে তাঁদের যে সমান অধিকার আছে, সেটা ভুললে চলবে কেন? অথচ রাষ্ট্র তাঁদের পোষ মানিয়ে রাখতে চেয়েছে। সবার মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো দাবি তুললেই রাষ্ট্র ধরে নিয়ে যেতে পারে, খুন করতে পারে, গুম করতে পারে বা নিদেনপক্ষে বন্ধ করে দিতে পারে ভর্তুকির দাক্ষিণ্যটুকু। সত্যিই পারে কি না, সেই প্রশ্নটা তেমন গুরুত্বপূর্ণও নয়। এই ভয়টুকু তৈরি করে দিতে পারলেই যথেষ্ট। নিজেদের দাবি পেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াবেন তাঁরা। অথবা আরও বেশি করে ঢুকে পড়তে চাইবেন কোনো এক নেতার বা দলের ক্লায়েন্টেলিজমের সামন্ততান্ত্রিক ছত্রচ্ছায়ায়। তাতে শেষ অবধি সমাজেরই ক্ষতি।
অধিকার আদায়ের কণ্ঠ দুর্বল হলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়। আর গণতন্ত্র দুর্বল হলে মানুষের অধিকারের লড়াইগুলোই বা লড়বে কে?
বহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও না। মানুষ সবার আগে খেয়ে-পরে বাঁচতে চায়। যদি পকেট খালি থাকে, ঘরে খাবার না থাকে, তাহলে সব রকম সংস্কারই অসার হিসেবে বিবেচিত হবে। রুটি-রুজির প্রশ্নে মানুষ সব সময়ই আপসহীন।
তাই বলে মানুষের সব অধিকার কেড়ে নিয়ে, ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটের বন্দোবস্ত চালু রেখে একটা বিশেষ শ্রেণিকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি কি বহাল থাকবে? না, সেটাও থাকা উচিত নয়। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি এগিয়ে নিতে হবে। কর্তৃত্ববাদের অবসান ঘটাতে হবে। ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট বন্ধ করার মতো বিধিব্যবস্থা চালু করতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-আইনি সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রুটি-রুজি, জননিরাপত্তাকে কোনোমতেই উপেক্ষা করা যাবে না। দুটো একই সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। একটা বাদ দিয়ে আরেকটি নয়। যদি নিরাপদে বেঁচে থাকা এবং ভাতের ব্যবস্থা না করে কেবল রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে যাবতীয় তৎপরতা, তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে অসামঞ্জস্য বা ফাটল সৃষ্টি হতে বাধ্য।
মানুষ কিন্তু খুবই কষ্টে আছে। বিশেষ করে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে। আলু ৭০-৮০ টাকা কেজি। ভারত থেকে শত শত টন পেঁয়াজ আমদানির পরও এর দাম ১০০ টাকার আশপাশেই ঘোরাফেরা করছে। যে পাঙাশ মাছকে একসময় গরিবের খাবার বলা হতো, সেটাও বর্তমানে অনেকের কাছে স্বপ্ন। ব্রয়লার মুরগির দাম গরিব মানুষের সামর্থ্যের বাইরে। মোটা চাল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি। সয়াবিন তেল ২০০ টাকা, ৪০-৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি নাই, শাক কিনতে গেলে ১৫-২০ টাকা আঁটি, চিনি ১৫০ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে লোডশেডিং। অনেক জেলা-উপজেলায় দিন-রাত মিলিয়ে ৮ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না! কিন্তু মাস শেষে অনেক টাকার বিদ্যুৎ বিল গুনতে হয়।
মধ্যবিত্তরা এখন বাজারে গেলে নিজেদের নিম্নবিত্ত ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না। আর গরিবদের কথা তো যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। চারদিকে হতাশা। আয়ের হিসাব সংকীর্ণ হলেও ব্যয়ের হিসাব ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছে। অসহায় মানুষ কোথায় যাবে? কার কাছে ভরসা চাইবে?
দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের কাছে সংবিধান, সুশাসন, সংস্কার ইত্যাদির কোনো উপযোগিতা নেই। যদি রাষ্ট্র তাদের কাছে দাবি করত বশ্যতা, আর বিনিময়ে দিতে চাইত দুই বেলা পেটভরে খাওয়ার মতো ভাত? তারা কি বলতেন না, তোমরাই আমাদের বাপ-ঠাকুরদা-দুলাভাই, যা বলবা, তা-ই করব, শুধু চারটা খেতে দাও বাপ! ছেলেমেয়েগুলো যদি স্কুল অবধি পৌঁছাতে পারে, পড়তে দিয়ো; শরীর নিতান্ত কাবু হলে হাসপাতালের মেঝের এক কোণে শোয়ার মতো জায়গাটুকু যেন পাই! এসবের বিনিময়ে রাষ্ট্র যদি কারও মাথা কিনতে চায়, তবে আপত্তি করত কোন আহাম্মক?
আসলে গণতন্ত্র, সুশাসন, বাক্স্বাধীনতা, কালো আইন—অনেকটাই ‘মধ্যবিত্ত বিলাসিতা’। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের বেশির ভাগই এসব নিয়ে ভাবার অবসর পায় না। তারা স্বৈরাচার-আর আমের আচারের পার্থক্য খুঁজতে যায় না। দুই বেলার অন্ন সংস্থানের জন্য তারা যেকোনো কিছু বিনিময় করতে পারে।
তবু আমরা গণতন্ত্র, সুশাসন, বাক্স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাই। কারণ, প্রকৃত গণতন্ত্র চায় জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে, আইনের শাসন পালন করতে এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে। দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসন উদার গণতন্ত্রের পরিবর্তে এক অনুদার গণতান্ত্রিক আবহে আমাদের নিক্ষেপ করেছে। পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক অধিকার এবং আইনবহির্ভূতভাবে ভোটাধিকার হরণের একটা প্রথা গড়ে উঠেছে। সুশাসনের অভাবই আমাদের সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সুশাসনের মাধ্যমে জনগণ তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করতে পারে, অধিকার ভোগ করে এবং তাদের চাহিদা মেটাতে পারে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সামাজিক সাম্য, নাগরিক অধিকার, গণতান্ত্রিক সমাজ এবং রাজনৈতিক স্থিতি প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু আমরা বর্তমানে সেখান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি।
রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক দাক্ষিণ্য ভিক্ষা করেন না, বরং তাঁর অধিকার দাবি করেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা এই অবস্থান থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছি। অন্য সব অধিকারের পাশাপাশি আমাদের ভাতের অধিকারও গেছে। দেশে বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। অনেকের নিয়মিত আয় নেই। অথচ জিনিসপত্রের দাম ক্রমেই লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে কোনোমতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই একমাত্র আরাধ্য হয়ে পড়ছে। তাতে করে রাষ্ট্র সংস্কার, জবাবদিহিমূলক দল ও প্রশাসন গঠনের উদ্যোগগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে না। এগুলোকে বকেয়া রেখে সবাই চাইছে কেবল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচতে!
অনেকের কাছেই নতুন সংবিধান, আইন-প্রশাসন-রাষ্ট্র সংস্কারের বাগাড়ম্বর অর্থহীন—বস্তুত দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে, অথবা সেটুকুও না খেয়ে থাকার যন্ত্রণাটুকু ছাড়া গোপন করার মতো কিছুই যাঁদের নেই—তাঁদের এই অধিকার থাকল না গেল, তাতে কী-ইবা এসে যায়?
গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী, কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে বাজারে খাদ্য থাকলেও দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে তা কিনে খাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। এ কারণেই আমরা টিসিবির দোকান ও ট্রাকের সামনে নারী-পুরুষের লম্বা লাইন দেখি।
কাজেই সব ধরনের বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে অধিক খাদ্য ফলানো কিংবা অধিক আমদানি করলেই ক্ষুধা সমস্যার সমাধান হবে না। খাদ্য ক্রয়ে নাগরিকদের সামর্থ্য বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আর মনে রাখতে হবে যে রাষ্ট্র সংস্কারের আদর্শগত সাধনার চেয়ে নিরন্নদের ক্ষুধা মেটানো অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটি কথা, যে অধিকারের মূল্য মানুষই বোঝে না, রাষ্ট্র কীভাবে তাকে স্বীকার করে নিতে পারে, তাকে অলঙ্ঘনীয় বলে মেনে নিতে পারে? এখানে বলা ভালো, এই ভূখণ্ডে সর্বজনীন ভোটাধিকার কিন্তু সাধারণ মানুষের দাবির কারণে হয়নি। বরং ভোটার লিস্টে নামের বদলে কয়েক কেজি চাল বাড়িতে এলে ঢের খুশি হতেন অনেকেই। কিন্তু তদানীন্তন নেতৃত্ব এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে পরাধীন দেশের সব প্রজাকে স্বাধীন দেশের নাগরিক করে তোলার, তাঁদের গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় শামিল করাটা অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা মনে করতেন রাষ্ট্রকে স্বপ্রবৃত্ত হয়ে নিজের দায়িত্ব বুঝে নিতে হয়। মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশের নেতৃত্ব গত কয়েক দশকে ঠিক উল্টো মেরুতে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। ভোটের অধিকারও কেড়ে নিয়েছেন। অভুক্ত মানুষেরও যে অধিকার আছে যেকোনো মৌলিক অধিকারই অলঙ্ঘনীয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই অস্বীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে হাত পাতা ছাড়া যাঁদের উপায়ান্তর নেই, তাঁরাও যে প্রজা নন, নাগরিক; গণতান্ত্রিক পরিসরে রাজনীতিতে তাঁদের যে সমান অধিকার আছে, সেটা ভুললে চলবে কেন? অথচ রাষ্ট্র তাঁদের পোষ মানিয়ে রাখতে চেয়েছে। সবার মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো দাবি তুললেই রাষ্ট্র ধরে নিয়ে যেতে পারে, খুন করতে পারে, গুম করতে পারে বা নিদেনপক্ষে বন্ধ করে দিতে পারে ভর্তুকির দাক্ষিণ্যটুকু। সত্যিই পারে কি না, সেই প্রশ্নটা তেমন গুরুত্বপূর্ণও নয়। এই ভয়টুকু তৈরি করে দিতে পারলেই যথেষ্ট। নিজেদের দাবি পেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াবেন তাঁরা। অথবা আরও বেশি করে ঢুকে পড়তে চাইবেন কোনো এক নেতার বা দলের ক্লায়েন্টেলিজমের সামন্ততান্ত্রিক ছত্রচ্ছায়ায়। তাতে শেষ অবধি সমাজেরই ক্ষতি।
অধিকার আদায়ের কণ্ঠ দুর্বল হলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়। আর গণতন্ত্র দুর্বল হলে মানুষের অধিকারের লড়াইগুলোই বা লড়বে কে?
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
৪ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
৪ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১ দিন আগে