মোজাম্মেল হোসেন
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে। নোবেল বিজয়ী বিশ্বব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সাংবিধানিক আইনকানুন থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে ১০টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। ছয়টির কাজ শুরু হয়েছে। আরও কমিশন হবে।
এই ডামাডোলের মধ্যে লক্ষ করা যাবে যে গরিব মানুষের জীবনের বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধানের দিকে নজর ও গুরুত্ব আদৌ দেওয়া হচ্ছে না। শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত তথা দেশের সর্বাধিকসংখ্যক মানুষের তীব্র সমস্যা খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চড়া দাম নিয়ন্ত্রণে গত তিন মাসে সরকার কিছু গতানুগতিক পদক্ষেপ নিয়ে সফল না হয়ে দৃশ্যত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী শিল্পাঞ্চলে এ সময়ে থেকে থেকে শ্রমিকেরা আন্দোলন করছেন, সড়ক অবরোধ করায় জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে, তার পেছনে চক্রান্তমূলক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যে অভিযোগ তোলা হয়, তার সত্যতা কিছু থাকতেও পারে, যা সমাধানের দায়িত্ব প্রশাসনের, কিন্তু বকেয়া বেতনের যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, প্রশাসনও স্বীকার করে, তার সমাধান হয় না কেন? একটি সাময়িক সরকারের জন্য শুধু নয়, গরিব মেহনতি মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জাতীয় রাজনীতির মৌলিক সমস্যা বোঝার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
জুলাই-আগস্টে স্পষ্টত ছাত্র-তরুণ ও শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ রাস্তায় নেমে সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছে, সরকারের পদত্যাগ দাবি করে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে প্রধানত গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, যুবসমাজের বেকারত্ব দূর ও দ্রব্যমূল্য হ্রাসসহ জীবনমান উন্নত করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দল, গ্রুপ ও গোষ্ঠী বিভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ নিয়ে সক্রিয় হয়ে নানা কথা বলছে, যার মধ্যে প্রধান সুর হচ্ছে দেশকে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে সরিয়ে অন্য পথে নিয়ে যাওয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক অবদানের কথা ও তাঁর স্মৃতি মুছে ফেলা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনা, মুক্তিযুদ্ধের নতুন মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করানো, বাংলাদেশ ‘দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে’ বলে আবার ‘প্রজাতন্ত্র ঘোষণা’ করার অদ্ভুতুড়ে দাবি। এই ধারায় সরকারের ভেতর ও বাইরের ‘বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলন’ নামক মঞ্চের ছাত্রনেতারা বেশি সোচ্চার। এই ছাত্রনেতারা সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন জুলাইয়ের সূচনাতে, দ্রুত আন্দোলনকে সরকার উৎখাতের দিকে পরিচালিত করেন এবং তাঁরাই ইউনূসকে সরকারপ্রধান হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তিনিও ছাত্রদের তাঁর ‘প্রাথমিক নিয়োগকর্তা’ বলে উল্লেখ করেন। ড. ইউনূস সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁর ভাষণে এই ছাত্র-তরুণ নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং নিউইয়র্কে এক বেসরকারি অনুষ্ঠানে এই ছাত্রদের মধ্য থেকে মাহফুজ আলমকে পরিচয় করিয়ে দেন পুরো আন্দোলনের ‘পেছনের মস্তিষ্ক’ হিসেবে এবং বলেন যে আন্দোলনের সময় মানুষ জানত না কারা নেতৃত্ব দিচ্ছে। অর্থাৎ এই ছাত্রনেতারা আত্মপরিচয় গোপন করেছিলেন। তিনি বলেন, আন্দোলনটি হঠাৎ করে হয়নি, অনেক দিন ধরে ‘মেটিকিউলাসলি ডিজাইন্ড’ বা সুচারুভাবে পরিকল্পিত।
এই কথাগুলো বারবার মিডিয়ায় আসায় সবারই জানা বলে পাঠক বিরক্ত হতে পারেন যে কেন পুনরুক্তি করছি। করছি এই জন্য যে রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে, সত্য উদ্ঘাটনের জন্য, এখন এবং ভবিষ্যতে এই কথাগুলো বারবার আলোচনায় আসবেই। গত সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই মাহফুজ আলম বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণ করেন এবং এরপর তাঁর অনুসারী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ও সব সরকারি দপ্তরে কাজটি করছে। সরকার এ বিষয়ে নীরব রয়েছে।
নীরব রয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী হওয়ায় গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠা সম্পর্কে। তিনি গ্রামের দরিদ্র নারীদের জন্য ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম করে দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। রাষ্ট্রীয় সংস্কারের অনেকগুলো কমিশন করলেও দেশের দারিদ্র্য দূর করার সার্বিক জাতীয় নীতি ও কর্মপন্থা গ্রহণের সুপারিশ করার জন্য একটি কমিশন গঠনের কথা এখনো তিনি বলেননি। মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭২-এর সংবিধান প্রণয়নের সময় জনগণের যে শোষণ-বঞ্চনাহীন সাম্যের সমাজের স্বপ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু যাকে সরল ভাষায় ‘গরিবের মুখে হাসি ফোটানো’ বলে অভিহিত করতেন, সেই সমবায়কে গুরুত্ব দিয়ে মিশ্র অর্থনীতি ও কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্য, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ক্রমেই জিয়া, এরশাদ এবং বঙ্গবন্ধুর নিজের দল আওয়ামী লীগ ও নিজের কন্যা শেখ হাসিনাও যে পথ ছেড়ে লুটেরা ধনতন্ত্রের পতাকা উড়িয়ে দিলেন, এ সম্পর্কে ‘নতুন বাংলাদেশের’ নতুন ‘বিপ্লবীদের’ কোনো ভাবনাচিন্তা নেই। ‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্রনেতাদের মুখে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা ও সেই নিরিখে আর্থসামাজিক কোনো কর্মসূচির কথা এখনো শোনা যায়নি। সরকার একটি কমিটি করেছে দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে শ্বেতপত্র তৈরির জন্য। এটা বর্তমান অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে কিন্তু বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যের ওপর মৌলিকভাবে কোনো আলোকপাত করবে না। সে অ্যাজেন্ডা নেই।
সত্যিই কি গরিবের ভরসা শুধুই আল্লাহ তাআলা? আল্লাহ ছাড়া গরিবের কোনো গতি নেই? দেশে গরিব মানুষের প্রতি ভয়ানক অন্যায়-অবিচার-বঞ্চনার ঘটনা, এমনকি পরিবারের কেউ নিহত হলেও সচরাচর শোনা যায় ভুক্তভোগী বলছেন ‘বিচার চাই না, কে বিচার করবে? আল্লাহর কাছে বিচার দিছি।’ সারা বছর এ রকম সংবাদ শিরোনাম বারংবার দেখতে পাওয়া যায়। ‘আল্লাহর কাছে বিচার চাই’ লিখে গুগল সার্চ দিয়ে দেখুন সত্য কি না। গরিব ভুক্তভোগীরা বিচার চান না, মামলা করবেন না, আল্লাহর কাছে বিচার চাই বলেছেন বিগত দিনে আওয়ামী লীগ সরকারের ও বিচার বিভাগের ওপর ব্যাপক অনাস্থা থেকে। এখনো জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সন্তানদের ক্ষেত্রে অনেক অভিভাবক একই কথা বলছেন।
ফৌজদারি অপরাধের বিচারের প্রশ্ন ছাড়া আর যে বিষয়ে গরিবেরা আল্লাহর কাছে বিচার দেন, তা হচ্ছে ক্রমাগত বেড়ে চলা দ্রব্যমূল্যের কারণে খেয়েপরে বেঁচে থাকার সমস্যা। ১৫ নভেম্বর একটি দৈনিকে ‘আয় থেকে ব্যয় বেশি, সংসার আর চলে না’ মর্মে প্রধান শিরোনামের খবরে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ, তা হচ্ছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। স্বয়ং অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের একটি কথা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে দুমুঠো শাক, অন্য কিছু কিনতেই শেষ। মানুষ অধৈর্য হয়ে গেছে।’ সরকার যে টিসিবির মাধ্যমে কম দামে কিছু খাদ্যপণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করেছে, তাতে নিম্নবিত্ত মানুষের হুমড়ি খেয়ে পড়ার সংবাদচিত্র দেখছি প্রতিনিয়ত, যাতে তাদের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।
ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পোশাকশিল্পে চার মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে গত দেড় মাস থেমে থেমে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ ও রাস্তা অবরোধ করেন। আশুলিয়ায় জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস লিমিটেড নামের একটি কারখানার ২২ বছর বয়সী নারী সেলাই অপারেটর গত ২৩ অক্টোবর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষকালে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭ তারিখে মারা যান। ঘটনার দিন গুলিতে আহত বলে প্রথমে খবর বের হলেও হাসপাতালের নথিতে শারীরিক আঘাতে মৃত্যুর উল্লেখ আছে বলে খবর বের হয়। এই মৃত্যুর জন্য কর্তৃপক্ষের কোনো স্তরে এক ফোঁটা অশ্রুপাতও হয়নি এবং কোনো তদন্ত ও বিচার-আচার হবে না।
দরিদ্রদের প্রতি এই যে অবহেলা, তার জন্য রাজনীতিতে তাদের কোনো সংগঠিত শক্তি না থাকাই বড় কারণ। দেশে একসময়ের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও শ্রমজীবী মানুষের বন্ধু বামপন্থীদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়াও অন্যতম কারণ। জুলাই-আগস্টের ‘বিপ্লব’ ও ‘নতুন বাংলাদেশ’ এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিশ্রুতি বহন করছে না।
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে। নোবেল বিজয়ী বিশ্বব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সাংবিধানিক আইনকানুন থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে ১০টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। ছয়টির কাজ শুরু হয়েছে। আরও কমিশন হবে।
এই ডামাডোলের মধ্যে লক্ষ করা যাবে যে গরিব মানুষের জীবনের বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধানের দিকে নজর ও গুরুত্ব আদৌ দেওয়া হচ্ছে না। শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত তথা দেশের সর্বাধিকসংখ্যক মানুষের তীব্র সমস্যা খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চড়া দাম নিয়ন্ত্রণে গত তিন মাসে সরকার কিছু গতানুগতিক পদক্ষেপ নিয়ে সফল না হয়ে দৃশ্যত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী শিল্পাঞ্চলে এ সময়ে থেকে থেকে শ্রমিকেরা আন্দোলন করছেন, সড়ক অবরোধ করায় জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে, তার পেছনে চক্রান্তমূলক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যে অভিযোগ তোলা হয়, তার সত্যতা কিছু থাকতেও পারে, যা সমাধানের দায়িত্ব প্রশাসনের, কিন্তু বকেয়া বেতনের যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, প্রশাসনও স্বীকার করে, তার সমাধান হয় না কেন? একটি সাময়িক সরকারের জন্য শুধু নয়, গরিব মেহনতি মানুষের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জাতীয় রাজনীতির মৌলিক সমস্যা বোঝার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
জুলাই-আগস্টে স্পষ্টত ছাত্র-তরুণ ও শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ রাস্তায় নেমে সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছে, সরকারের পদত্যাগ দাবি করে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে প্রধানত গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, যুবসমাজের বেকারত্ব দূর ও দ্রব্যমূল্য হ্রাসসহ জীবনমান উন্নত করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দল, গ্রুপ ও গোষ্ঠী বিভিন্ন রাজনৈতিক লক্ষ নিয়ে সক্রিয় হয়ে নানা কথা বলছে, যার মধ্যে প্রধান সুর হচ্ছে দেশকে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে সরিয়ে অন্য পথে নিয়ে যাওয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক অবদানের কথা ও তাঁর স্মৃতি মুছে ফেলা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনা, মুক্তিযুদ্ধের নতুন মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করানো, বাংলাদেশ ‘দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে’ বলে আবার ‘প্রজাতন্ত্র ঘোষণা’ করার অদ্ভুতুড়ে দাবি। এই ধারায় সরকারের ভেতর ও বাইরের ‘বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলন’ নামক মঞ্চের ছাত্রনেতারা বেশি সোচ্চার। এই ছাত্রনেতারা সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন জুলাইয়ের সূচনাতে, দ্রুত আন্দোলনকে সরকার উৎখাতের দিকে পরিচালিত করেন এবং তাঁরাই ইউনূসকে সরকারপ্রধান হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তিনিও ছাত্রদের তাঁর ‘প্রাথমিক নিয়োগকর্তা’ বলে উল্লেখ করেন। ড. ইউনূস সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁর ভাষণে এই ছাত্র-তরুণ নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং নিউইয়র্কে এক বেসরকারি অনুষ্ঠানে এই ছাত্রদের মধ্য থেকে মাহফুজ আলমকে পরিচয় করিয়ে দেন পুরো আন্দোলনের ‘পেছনের মস্তিষ্ক’ হিসেবে এবং বলেন যে আন্দোলনের সময় মানুষ জানত না কারা নেতৃত্ব দিচ্ছে। অর্থাৎ এই ছাত্রনেতারা আত্মপরিচয় গোপন করেছিলেন। তিনি বলেন, আন্দোলনটি হঠাৎ করে হয়নি, অনেক দিন ধরে ‘মেটিকিউলাসলি ডিজাইন্ড’ বা সুচারুভাবে পরিকল্পিত।
এই কথাগুলো বারবার মিডিয়ায় আসায় সবারই জানা বলে পাঠক বিরক্ত হতে পারেন যে কেন পুনরুক্তি করছি। করছি এই জন্য যে রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে, সত্য উদ্ঘাটনের জন্য, এখন এবং ভবিষ্যতে এই কথাগুলো বারবার আলোচনায় আসবেই। গত সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই মাহফুজ আলম বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণ করেন এবং এরপর তাঁর অনুসারী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ও সব সরকারি দপ্তরে কাজটি করছে। সরকার এ বিষয়ে নীরব রয়েছে।
নীরব রয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী হওয়ায় গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠা সম্পর্কে। তিনি গ্রামের দরিদ্র নারীদের জন্য ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম করে দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। রাষ্ট্রীয় সংস্কারের অনেকগুলো কমিশন করলেও দেশের দারিদ্র্য দূর করার সার্বিক জাতীয় নীতি ও কর্মপন্থা গ্রহণের সুপারিশ করার জন্য একটি কমিশন গঠনের কথা এখনো তিনি বলেননি। মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭২-এর সংবিধান প্রণয়নের সময় জনগণের যে শোষণ-বঞ্চনাহীন সাম্যের সমাজের স্বপ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু যাকে সরল ভাষায় ‘গরিবের মুখে হাসি ফোটানো’ বলে অভিহিত করতেন, সেই সমবায়কে গুরুত্ব দিয়ে মিশ্র অর্থনীতি ও কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্য, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ক্রমেই জিয়া, এরশাদ এবং বঙ্গবন্ধুর নিজের দল আওয়ামী লীগ ও নিজের কন্যা শেখ হাসিনাও যে পথ ছেড়ে লুটেরা ধনতন্ত্রের পতাকা উড়িয়ে দিলেন, এ সম্পর্কে ‘নতুন বাংলাদেশের’ নতুন ‘বিপ্লবীদের’ কোনো ভাবনাচিন্তা নেই। ‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্রনেতাদের মুখে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা ও সেই নিরিখে আর্থসামাজিক কোনো কর্মসূচির কথা এখনো শোনা যায়নি। সরকার একটি কমিটি করেছে দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে শ্বেতপত্র তৈরির জন্য। এটা বর্তমান অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে কিন্তু বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যের ওপর মৌলিকভাবে কোনো আলোকপাত করবে না। সে অ্যাজেন্ডা নেই।
সত্যিই কি গরিবের ভরসা শুধুই আল্লাহ তাআলা? আল্লাহ ছাড়া গরিবের কোনো গতি নেই? দেশে গরিব মানুষের প্রতি ভয়ানক অন্যায়-অবিচার-বঞ্চনার ঘটনা, এমনকি পরিবারের কেউ নিহত হলেও সচরাচর শোনা যায় ভুক্তভোগী বলছেন ‘বিচার চাই না, কে বিচার করবে? আল্লাহর কাছে বিচার দিছি।’ সারা বছর এ রকম সংবাদ শিরোনাম বারংবার দেখতে পাওয়া যায়। ‘আল্লাহর কাছে বিচার চাই’ লিখে গুগল সার্চ দিয়ে দেখুন সত্য কি না। গরিব ভুক্তভোগীরা বিচার চান না, মামলা করবেন না, আল্লাহর কাছে বিচার চাই বলেছেন বিগত দিনে আওয়ামী লীগ সরকারের ও বিচার বিভাগের ওপর ব্যাপক অনাস্থা থেকে। এখনো জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সন্তানদের ক্ষেত্রে অনেক অভিভাবক একই কথা বলছেন।
ফৌজদারি অপরাধের বিচারের প্রশ্ন ছাড়া আর যে বিষয়ে গরিবেরা আল্লাহর কাছে বিচার দেন, তা হচ্ছে ক্রমাগত বেড়ে চলা দ্রব্যমূল্যের কারণে খেয়েপরে বেঁচে থাকার সমস্যা। ১৫ নভেম্বর একটি দৈনিকে ‘আয় থেকে ব্যয় বেশি, সংসার আর চলে না’ মর্মে প্রধান শিরোনামের খবরে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ, তা হচ্ছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। স্বয়ং অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের একটি কথা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘৫০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে দুমুঠো শাক, অন্য কিছু কিনতেই শেষ। মানুষ অধৈর্য হয়ে গেছে।’ সরকার যে টিসিবির মাধ্যমে কম দামে কিছু খাদ্যপণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করেছে, তাতে নিম্নবিত্ত মানুষের হুমড়ি খেয়ে পড়ার সংবাদচিত্র দেখছি প্রতিনিয়ত, যাতে তাদের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।
ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পোশাকশিল্পে চার মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে গত দেড় মাস থেমে থেমে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ ও রাস্তা অবরোধ করেন। আশুলিয়ায় জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস লিমিটেড নামের একটি কারখানার ২২ বছর বয়সী নারী সেলাই অপারেটর গত ২৩ অক্টোবর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষকালে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭ তারিখে মারা যান। ঘটনার দিন গুলিতে আহত বলে প্রথমে খবর বের হলেও হাসপাতালের নথিতে শারীরিক আঘাতে মৃত্যুর উল্লেখ আছে বলে খবর বের হয়। এই মৃত্যুর জন্য কর্তৃপক্ষের কোনো স্তরে এক ফোঁটা অশ্রুপাতও হয়নি এবং কোনো তদন্ত ও বিচার-আচার হবে না।
দরিদ্রদের প্রতি এই যে অবহেলা, তার জন্য রাজনীতিতে তাদের কোনো সংগঠিত শক্তি না থাকাই বড় কারণ। দেশে একসময়ের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ও শ্রমজীবী মানুষের বন্ধু বামপন্থীদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়াও অন্যতম কারণ। জুলাই-আগস্টের ‘বিপ্লব’ ও ‘নতুন বাংলাদেশ’ এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিশ্রুতি বহন করছে না।
বহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
৪ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
৪ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগেশেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিছু যে হয়নি, তা নয়। তবে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অস্থিরতার লক্ষণ অস্পষ্ট নয়। এর মধ্যেই তিন দফায় উপদেষ্টার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
১ দিন আগে