বিভুরঞ্জন সরকার
১৯৮৯ সালের কথা। তখন লে জে হো মো এরশাদের জমানা। আমি কাজ করি সাপ্তাহিক ‘একতা’য়। সে বছর ২ অক্টোবর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসে জয়পুরহাট গেলেন একজন পিরের সঙ্গে দেখা করতে। পিরের নাম মজিবর রহমান চিশতি। তাঁকে নিয়ে, তাঁর ‘অলৌকিক’ শক্তি বা ক্ষমতা নিয়ে নানা কাহিনি সে সময় চালু ছিল। বাংলাদেশের দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদও ওই পিরের আস্তানায় হাজিরা দিয়েছেন।
আমার ইচ্ছা হলো জয়পুরহাট গিয়ে সরেজমিন একটি প্রতিবেদন করার। সম্পাদক মতিউর রহমান, সহকারী সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুরও আগ্রহ ছিল বিষয়টি নিয়ে।
যাত্রা করলাম জয়পুরহাটের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছে বুঝতে পারি আমার কাজটি সহজ নয়। পিরের মাজার শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এক নিভৃত গ্রামে। চরবকর ইউনিয়নে। হেঁটে যাওয়া ছাড়া সেখানে পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই। বেনজিরের সফর উপলক্ষে সেনাবাহিনী বিশেষ ব্যবস্থায় জয়পুরহাট শহর থেকে পিরের বাড়ি পর্যন্ত ইট বিছিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করলেও সে রাস্তায় সাধারণের চলাচল নিষিদ্ধ। শুধু নিরাপত্তা কর্মী বা সেনাবাহিনীর গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তাটি।
আমি ওই গ্রামে যেতে চাই এবং পির চিশতির মুখোমুখি হতে চাই—এটা শুনে স্থানীয় সাংবাদিকেরা কেউ নিরুৎসাহিত করলেন। কেউ দেখালেন ভয়।
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা-
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
কবিগুরুর এই লাইন ক’টি আমি বলতে গেলে সারাক্ষণ মনে মনে আওড়াই। যেহেতু আমার জীবনে বিপদ ও ভয়ের ভাগ বেশি। তাই এ দুটোকে তাড়ানোর মন্ত্র হিসেবে রবি ঠাকুরের আশ্রয় নেই। উপকারও পাই। একেবারে খাদের কিনারে দাঁড়িয়েও নিচে না পড়ে কী করে যেন রেহাই পেয়ে যাই।
যা হোক, জয়পুরহাটে আমি যে মিশন নিয়ে গেলাম অর্থাৎ পির মজিবর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া এবং বেনজির ভুট্টোর মতো একজন আধুনিক শিক্ষিত নারী কেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে উড়ে এলেন সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা—আমার এই উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার আশঙ্কায় মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। একটা জেদও চাপতে শুরু করল।
জয়পুরহাটে আমার পরিচিত দু–একজনকে খুঁজে বের করলাম। তাঁরা জানালেন, পির সম্পর্কে নানা রকম কথা চালু আছে। তাঁর অনেক মুরিদ। মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ যেমন বলতে পারেন, তেমনি বালা-মুসিবতও নাকি দূর করতে পারেন। কাজেই অনেকেই তাঁর দরবারে হাজিরা দেন। আয় রোজগারও ভালো। গরিব মুরিদ তাঁর নেই বললেই চলে। সব টাকাওয়ালা এবং উঠতি ধনিকেরা তাঁর শিষ্য। তাঁর গ্রামের লোকেরা তাঁকে খুব ভালো মানুষ মনে করেন না। পছন্দও করেন না। পির মজিবর নাকি একটি লাঠি ব্যবহার করেন। ওই লাঠিও নাকি অলৌকিক ক্ষমতাধর। পির ছাড়া আর কেউ নাকি ওই লাঠি হাতে তুলতে পারেন না। পির ধরলে লাঠি হালকা হয়ে যায়, অন্য কেউ ধরলে নাকি ওজন এত বেড়ে যায় যে, কারও পক্ষে তা উত্তোলন করা সম্ভব হয় না।
আমার খুব ইচ্ছা হলো, আহা একবার ওই লাঠিটা যদি ছুঁয়েও দেখতে পারতাম! পিরের দোয়ার বরকতে আমারও বদনসিব হয়তো দূর হয়ে যেত!
কিন্তু আমি পিরের কাছে পৌঁছাব কীভাবে? তাঁর পুরো গ্রাম কড়া নিরাপত্তা নজরদারিতে। একে তো এরশাদী শাসন, তার ওপর পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর আগমন! দুয়ে মিলে ওই গ্রামে কোনো বহিরাগত মানুষের গমনাগমন অসম্ভব!
একজন পরামর্শ দিলেন, বেনজির চলে যাওয়ার পর পিরের সঙ্গে দেখা করার একটি ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এদিকে আমার মন কিছুতেই পরাজয় মানতে চাইছে না। আমি বললাম, ‘আমি রাতেই পিরের গ্রামে যেতে চাই। কেউ একজন আমার সঙ্গী হলেই চলবে।’ কিন্তু কেউ সঙ্গী হতে রাজি হয় না। একজন উল্টো ভয় দেখান, আপনি হিন্দু মানুষ। ধরা পড়লে ‘ভারতীয় চর’ হিসেবে মিলিটারি প্যাঁদানি ভাগ্যে জুটতে পারে।
আমি দমে যাই। মারপিটে আমার খুব ভয়। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। এভাবে হার মানতে হবে! পথঘাট চেনা থাকলে একাই রওনা দিতাম। কিন্তু রাতের বেলায় রাস্তায় হয়তো কাউকে পাব না, তখন ‘পথ হারিয়ে কোন বনে যাই’ অবস্থায় না পড়ি!
আমাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে একজনের মনে একটু বুঝি দয়া হলো! বললেন, চলেন বেরিয়ে পড়ি। পিরের গ্রামের পাশের গ্রামে তাঁর এক আত্মীয় আছেন, সেখানেই আমরা গিয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম।
শহর থেকে গ্রামটি খুব দূরে নয়। আলপথ দিয়ে হেঁটে যেতে আমার সম্ভবত ঘণ্টা খানেক লেগেছিল। কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়াই গন্তব্য গিয়ে পৌঁছলাম। গৃহকর্তা প্রসন্ন হলেন, না বিষণ্ন হলেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে সব শুনে তিনি বললেন, এই ভণ্ডটার জন্য এত কষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। ব্যাটা একটা পাকিস্তানি চর!
আমাকে বিস্মিত হতে দেখে গৃহকর্তা বলেন, বোঝেন না, ওর কাছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এমনি এমনি এসেছেন? বুঝতে পারেন না, কানেকশনটা!
উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় যুক্তিটি।
রাতের খাবার রেডি হতে একটু সময় লাগল। ভদ্রলোক বললেন, খুব ভোরে তিনি আমাকে পিরের এক ভক্তের বাড়িতে পৌঁছে দেবেন।
কিন্তু ভোরে আর সেখানে যাওয়া সম্ভব হলো না। গ্রামজুড়ে কড়া পাহারা; কিলবিল করছে মিলিটারি, পুলিশ ইত্যাদিতে। বেনজির ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কারও বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। তবে সকালে বুঝলাম, আমি একেবারেই কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সামান্য দূরেই পিরের বাড়ি বা দরবার। প্রায় খালি জায়গায় অতি সুন্দর এক ভবন। চারদিকে ফসলের মাঠ। দরবার–সংলগ্ন খালি মাঠেই নামবে বেনজিরকে বহন করা হেলিকপ্টার।
সকাল এগারোটায় বেনজিরের পৌঁছানোর কথা। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সরকারি প্রশাসন কিছু বাছাই করা লোক হাজির করবে। তবে সংখ্যায় খুবই কম। বেনজির সরাসরি পিরের সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর আবার ঢাকা ফিরে যাবেন।
হেলিকপ্টার যথাসময় নামল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম বেনজিরের নেমে আসা। সালোয়ার-কামিজ পরা মাথায় ওড়না জড়ানো বেনজির দ্রুত পায়ে ঢুকে গেলেন পিরের আস্তানায়। গ্রামের লোকজন বেনজিরকে দেখার জন্য যতটা না, তারচেয়ে বেশি নিশ্চয়ই হেলিকপ্টার দেখার জন্য ঘরের বের হয়েছে।
নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের সামাল দিচ্ছেন। সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টার মধ্যে ফের আকাশে উড়ল বেনজিরকে বহন করা হেলিকপ্টার, উদ্দেশ্য ঢাকা। আর আমি পির দর্শনের উপায় ও অছিলা খুঁজতে থাকি।
বেনজির ভুট্টো চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নিরাপত্তার কড়াকড়ি কমতে শুরু করল। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, গ্রামের লোকজনের পিরের দরবারে যাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। যে যার মতো নিজ নিজ বাড়িঘরের দিকেই ফিরে যাচ্ছে। আমি এখন কী করি?
গুটি গুটি পায়ে পির সাহেবের আস্তানার দিকে এগোতে থাকি। তখন আর কেউ বাধা দেওয়ার নেই। আমি পির সাহেবের একেবারে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কয়েকজন মাত্র লোক ঘোরাঘুরি করছেন। স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ওই লোকগুলো পিরের মুরিদ কিংবা নিজস্ব বাহিনীর সদস্য বা তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। তাঁদের মধ্য থেকে একজন আমার কাছে এগিয়ে এলেন। নাম-পরিচয় জানতে চাইলেন। কাউকে খুঁজছি কিনা সেটাও জিজ্ঞেস করলেন।
আমি নামটা ঠিক না বলে অন্য সব তথ্য দিলাম। নাম বললাম আবদুর রহমান। এই নামে বহু মানুষ আছেন। অতি কমন একটি নাম। কেন আমি নাম গোপন করলাম? বুঝেশুনেই এটা করলাম। একজন ‘হিন্দু’র জন্য পিরের সাক্ষাৎ পাওয়া সহজ না-ও হতে পারে।
নাম ভাড়িয়েও কোনো লাভ হলো না। আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হলো যে ‘হুজুর’ সেদিন এবং পরের আরও দুই দিন কাউকে সাক্ষাৎ দেবেন না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত কষ্ট করে এবং কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কিছু না জেনেই চলে যাব?
আমি পাহারায় নিয়োজিত লোকটির কাছে অনেক কাকুতিমিনতি করলাম কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। বারবার একই অনুরোধ করতে থাকায় লোকটি বললেন, কী জানতে চান আপনি?
আমি বলি: পির সাহেবের দোয়া চাই আর চাই একটি ছোট সাক্ষাৎকার।
তিনি বললেন: দোয়া-সাক্ষাৎকার কোনোটাই পাবেন না।
পির সাহেবের আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতার গল্প শোনান দুচারটা—
আমার কথা শেষ না হতেই লোকটি কিছুটা যেন স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, আরে এই পির হলো পাকিস্তানের দালাল। তাঁর কাছ থেকে আর কি জানবেন? আপনাকে গোপনে একটি কথা বলি—এই পিরের ভুয়ামি শিগগিরই বন্ধ হবে। দেখবেন পির সাহেবকে তাঁর শিষ্যদেরই কেউ হয়তো খুন করে ফেলবে। পিরের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
ব্যস, আমি নিউজ পেয়ে গেলাম। দরকার নেই আর কিছু জানার। বেনজির ভুট্টো কেন পির মজিবরের সঙ্গে দেখা করতে এলেন সেটার চেয়ে আমার কাছে ‘হট’ খবর হলো সহসাই খুন হবেন পির সাহেব!
ঢাকা ফিরে আমি একটি সরেজমিন প্রতিবেদন লিখেছিলাম। ‘একতা’য় ছাপাও হয়েছিল। অনেকেই প্রতিবেদনটির প্রশংসা করেছিলেন।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ওই ঘটনার কয়েক বছরের মধ্যেই ২০০০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন পির মজিবর রহমান চিশতি। কোথায় গেল তাঁর অলৌকিক শক্তিধর লাঠি? নিজের ভাগ্যের পরিণতি যার জানা ছিল না, তাঁর কাছেই কিনা বিখ্যাত সব মানুষ ছুটত ভাগ্যবদলের ‘দাওয়াই-তাবিজ’ নিতে! সত্যি সেলুকাস কি আজব এই দেশ!
১৯৮৯ সালের কথা। তখন লে জে হো মো এরশাদের জমানা। আমি কাজ করি সাপ্তাহিক ‘একতা’য়। সে বছর ২ অক্টোবর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসে জয়পুরহাট গেলেন একজন পিরের সঙ্গে দেখা করতে। পিরের নাম মজিবর রহমান চিশতি। তাঁকে নিয়ে, তাঁর ‘অলৌকিক’ শক্তি বা ক্ষমতা নিয়ে নানা কাহিনি সে সময় চালু ছিল। বাংলাদেশের দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদও ওই পিরের আস্তানায় হাজিরা দিয়েছেন।
আমার ইচ্ছা হলো জয়পুরহাট গিয়ে সরেজমিন একটি প্রতিবেদন করার। সম্পাদক মতিউর রহমান, সহকারী সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুরও আগ্রহ ছিল বিষয়টি নিয়ে।
যাত্রা করলাম জয়পুরহাটের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছে বুঝতে পারি আমার কাজটি সহজ নয়। পিরের মাজার শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এক নিভৃত গ্রামে। চরবকর ইউনিয়নে। হেঁটে যাওয়া ছাড়া সেখানে পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই। বেনজিরের সফর উপলক্ষে সেনাবাহিনী বিশেষ ব্যবস্থায় জয়পুরহাট শহর থেকে পিরের বাড়ি পর্যন্ত ইট বিছিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করলেও সে রাস্তায় সাধারণের চলাচল নিষিদ্ধ। শুধু নিরাপত্তা কর্মী বা সেনাবাহিনীর গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তাটি।
আমি ওই গ্রামে যেতে চাই এবং পির চিশতির মুখোমুখি হতে চাই—এটা শুনে স্থানীয় সাংবাদিকেরা কেউ নিরুৎসাহিত করলেন। কেউ দেখালেন ভয়।
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা-
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
কবিগুরুর এই লাইন ক’টি আমি বলতে গেলে সারাক্ষণ মনে মনে আওড়াই। যেহেতু আমার জীবনে বিপদ ও ভয়ের ভাগ বেশি। তাই এ দুটোকে তাড়ানোর মন্ত্র হিসেবে রবি ঠাকুরের আশ্রয় নেই। উপকারও পাই। একেবারে খাদের কিনারে দাঁড়িয়েও নিচে না পড়ে কী করে যেন রেহাই পেয়ে যাই।
যা হোক, জয়পুরহাটে আমি যে মিশন নিয়ে গেলাম অর্থাৎ পির মজিবর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া এবং বেনজির ভুট্টোর মতো একজন আধুনিক শিক্ষিত নারী কেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে উড়ে এলেন সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা—আমার এই উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার আশঙ্কায় মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। একটা জেদও চাপতে শুরু করল।
জয়পুরহাটে আমার পরিচিত দু–একজনকে খুঁজে বের করলাম। তাঁরা জানালেন, পির সম্পর্কে নানা রকম কথা চালু আছে। তাঁর অনেক মুরিদ। মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ যেমন বলতে পারেন, তেমনি বালা-মুসিবতও নাকি দূর করতে পারেন। কাজেই অনেকেই তাঁর দরবারে হাজিরা দেন। আয় রোজগারও ভালো। গরিব মুরিদ তাঁর নেই বললেই চলে। সব টাকাওয়ালা এবং উঠতি ধনিকেরা তাঁর শিষ্য। তাঁর গ্রামের লোকেরা তাঁকে খুব ভালো মানুষ মনে করেন না। পছন্দও করেন না। পির মজিবর নাকি একটি লাঠি ব্যবহার করেন। ওই লাঠিও নাকি অলৌকিক ক্ষমতাধর। পির ছাড়া আর কেউ নাকি ওই লাঠি হাতে তুলতে পারেন না। পির ধরলে লাঠি হালকা হয়ে যায়, অন্য কেউ ধরলে নাকি ওজন এত বেড়ে যায় যে, কারও পক্ষে তা উত্তোলন করা সম্ভব হয় না।
আমার খুব ইচ্ছা হলো, আহা একবার ওই লাঠিটা যদি ছুঁয়েও দেখতে পারতাম! পিরের দোয়ার বরকতে আমারও বদনসিব হয়তো দূর হয়ে যেত!
কিন্তু আমি পিরের কাছে পৌঁছাব কীভাবে? তাঁর পুরো গ্রাম কড়া নিরাপত্তা নজরদারিতে। একে তো এরশাদী শাসন, তার ওপর পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর আগমন! দুয়ে মিলে ওই গ্রামে কোনো বহিরাগত মানুষের গমনাগমন অসম্ভব!
একজন পরামর্শ দিলেন, বেনজির চলে যাওয়ার পর পিরের সঙ্গে দেখা করার একটি ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এদিকে আমার মন কিছুতেই পরাজয় মানতে চাইছে না। আমি বললাম, ‘আমি রাতেই পিরের গ্রামে যেতে চাই। কেউ একজন আমার সঙ্গী হলেই চলবে।’ কিন্তু কেউ সঙ্গী হতে রাজি হয় না। একজন উল্টো ভয় দেখান, আপনি হিন্দু মানুষ। ধরা পড়লে ‘ভারতীয় চর’ হিসেবে মিলিটারি প্যাঁদানি ভাগ্যে জুটতে পারে।
আমি দমে যাই। মারপিটে আমার খুব ভয়। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়। এভাবে হার মানতে হবে! পথঘাট চেনা থাকলে একাই রওনা দিতাম। কিন্তু রাতের বেলায় রাস্তায় হয়তো কাউকে পাব না, তখন ‘পথ হারিয়ে কোন বনে যাই’ অবস্থায় না পড়ি!
আমাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে একজনের মনে একটু বুঝি দয়া হলো! বললেন, চলেন বেরিয়ে পড়ি। পিরের গ্রামের পাশের গ্রামে তাঁর এক আত্মীয় আছেন, সেখানেই আমরা গিয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম।
শহর থেকে গ্রামটি খুব দূরে নয়। আলপথ দিয়ে হেঁটে যেতে আমার সম্ভবত ঘণ্টা খানেক লেগেছিল। কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়াই গন্তব্য গিয়ে পৌঁছলাম। গৃহকর্তা প্রসন্ন হলেন, না বিষণ্ন হলেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে সব শুনে তিনি বললেন, এই ভণ্ডটার জন্য এত কষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। ব্যাটা একটা পাকিস্তানি চর!
আমাকে বিস্মিত হতে দেখে গৃহকর্তা বলেন, বোঝেন না, ওর কাছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এমনি এমনি এসেছেন? বুঝতে পারেন না, কানেকশনটা!
উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় যুক্তিটি।
রাতের খাবার রেডি হতে একটু সময় লাগল। ভদ্রলোক বললেন, খুব ভোরে তিনি আমাকে পিরের এক ভক্তের বাড়িতে পৌঁছে দেবেন।
কিন্তু ভোরে আর সেখানে যাওয়া সম্ভব হলো না। গ্রামজুড়ে কড়া পাহারা; কিলবিল করছে মিলিটারি, পুলিশ ইত্যাদিতে। বেনজির ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কারও বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। তবে সকালে বুঝলাম, আমি একেবারেই কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সামান্য দূরেই পিরের বাড়ি বা দরবার। প্রায় খালি জায়গায় অতি সুন্দর এক ভবন। চারদিকে ফসলের মাঠ। দরবার–সংলগ্ন খালি মাঠেই নামবে বেনজিরকে বহন করা হেলিকপ্টার।
সকাল এগারোটায় বেনজিরের পৌঁছানোর কথা। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সরকারি প্রশাসন কিছু বাছাই করা লোক হাজির করবে। তবে সংখ্যায় খুবই কম। বেনজির সরাসরি পিরের সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর আবার ঢাকা ফিরে যাবেন।
হেলিকপ্টার যথাসময় নামল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম বেনজিরের নেমে আসা। সালোয়ার-কামিজ পরা মাথায় ওড়না জড়ানো বেনজির দ্রুত পায়ে ঢুকে গেলেন পিরের আস্তানায়। গ্রামের লোকজন বেনজিরকে দেখার জন্য যতটা না, তারচেয়ে বেশি নিশ্চয়ই হেলিকপ্টার দেখার জন্য ঘরের বের হয়েছে।
নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের সামাল দিচ্ছেন। সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টার মধ্যে ফের আকাশে উড়ল বেনজিরকে বহন করা হেলিকপ্টার, উদ্দেশ্য ঢাকা। আর আমি পির দর্শনের উপায় ও অছিলা খুঁজতে থাকি।
বেনজির ভুট্টো চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নিরাপত্তার কড়াকড়ি কমতে শুরু করল। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, গ্রামের লোকজনের পিরের দরবারে যাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। যে যার মতো নিজ নিজ বাড়িঘরের দিকেই ফিরে যাচ্ছে। আমি এখন কী করি?
গুটি গুটি পায়ে পির সাহেবের আস্তানার দিকে এগোতে থাকি। তখন আর কেউ বাধা দেওয়ার নেই। আমি পির সাহেবের একেবারে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কয়েকজন মাত্র লোক ঘোরাঘুরি করছেন। স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ওই লোকগুলো পিরের মুরিদ কিংবা নিজস্ব বাহিনীর সদস্য বা তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। তাঁদের মধ্য থেকে একজন আমার কাছে এগিয়ে এলেন। নাম-পরিচয় জানতে চাইলেন। কাউকে খুঁজছি কিনা সেটাও জিজ্ঞেস করলেন।
আমি নামটা ঠিক না বলে অন্য সব তথ্য দিলাম। নাম বললাম আবদুর রহমান। এই নামে বহু মানুষ আছেন। অতি কমন একটি নাম। কেন আমি নাম গোপন করলাম? বুঝেশুনেই এটা করলাম। একজন ‘হিন্দু’র জন্য পিরের সাক্ষাৎ পাওয়া সহজ না-ও হতে পারে।
নাম ভাড়িয়েও কোনো লাভ হলো না। আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হলো যে ‘হুজুর’ সেদিন এবং পরের আরও দুই দিন কাউকে সাক্ষাৎ দেবেন না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত কষ্ট করে এবং কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কিছু না জেনেই চলে যাব?
আমি পাহারায় নিয়োজিত লোকটির কাছে অনেক কাকুতিমিনতি করলাম কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। বারবার একই অনুরোধ করতে থাকায় লোকটি বললেন, কী জানতে চান আপনি?
আমি বলি: পির সাহেবের দোয়া চাই আর চাই একটি ছোট সাক্ষাৎকার।
তিনি বললেন: দোয়া-সাক্ষাৎকার কোনোটাই পাবেন না।
পির সাহেবের আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতার গল্প শোনান দুচারটা—
আমার কথা শেষ না হতেই লোকটি কিছুটা যেন স্বগতোক্তির মতো করে বললেন, আরে এই পির হলো পাকিস্তানের দালাল। তাঁর কাছ থেকে আর কি জানবেন? আপনাকে গোপনে একটি কথা বলি—এই পিরের ভুয়ামি শিগগিরই বন্ধ হবে। দেখবেন পির সাহেবকে তাঁর শিষ্যদেরই কেউ হয়তো খুন করে ফেলবে। পিরের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
ব্যস, আমি নিউজ পেয়ে গেলাম। দরকার নেই আর কিছু জানার। বেনজির ভুট্টো কেন পির মজিবরের সঙ্গে দেখা করতে এলেন সেটার চেয়ে আমার কাছে ‘হট’ খবর হলো সহসাই খুন হবেন পির সাহেব!
ঢাকা ফিরে আমি একটি সরেজমিন প্রতিবেদন লিখেছিলাম। ‘একতা’য় ছাপাও হয়েছিল। অনেকেই প্রতিবেদনটির প্রশংসা করেছিলেন।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ওই ঘটনার কয়েক বছরের মধ্যেই ২০০০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন পির মজিবর রহমান চিশতি। কোথায় গেল তাঁর অলৌকিক শক্তিধর লাঠি? নিজের ভাগ্যের পরিণতি যার জানা ছিল না, তাঁর কাছেই কিনা বিখ্যাত সব মানুষ ছুটত ভাগ্যবদলের ‘দাওয়াই-তাবিজ’ নিতে! সত্যি সেলুকাস কি আজব এই দেশ!
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
৪ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
৪ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
৪ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে