স্মৃতির দখিন দুয়ার খুলে একটু ঘুরে আসা

এম আব্দুল আলিম
প্রকাশ : ২১ মে ২০২১, ১০: ৪৫
আপডেট : ২১ মে ২০২১, ১৬: ১৮

শৈশবের চেয়ে সুমধুর কাল মানবজীবনে আর কি আছে? কীর্তিমানদের জীবনস্মৃতি কিংবা আত্মজীবনীতে চোখ বুলালে তাঁদের শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলোর বহুমাত্রিক রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। পৃথিবীর নানান প্রান্তে জন্ম নেওয়া সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, পণ্ডিতেরা তো বটেই বাঙালিরাও এর ব্যতিক্রম নন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার ছেলেবেলা’, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘আমার বোকা শৈশব’, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘ইচ্ছামতির সোনালি-রুপালি’ খুললেই হারিয়ে যেতে হয় তাঁদের শৈশবের হইহুল্লোড়মাখা দিনগুলোতে। এমন শত শত উদাহরণ হাজির করা যায়।

২. এবার করোনাভাইরাসের দুর্বিষহ সময়ে বিভিন্ন পত্রিকার ঈদসংখ্যা সংগ্রহ করতে বেগ পেতে হয়েছে। তবু মফস্বল জেলাশহর পাবনায় বসে ঈদের আগেই অন্তত চারটি পত্রিকার ঈদসংখ্যা হাতে পেয়েছি। জনসংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার এই কালে ঈদসংখ্যা চারটি প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গ দিয়েছে। বরাবরের মতো প্রবন্ধ, ভ্রমণ ও স্মৃতিকথাধর্মী লেখাগুলোই আমার মনোযোগ কেড়েছে। এর মধ্যে ‘দৈনিক আমাদের সময়’ পত্রিকায় স্থান পাওয়া খালেদ হোসাইন ও হামিদ কায়সারের আত্মজৈবনিক লেখা দুটি মনে দারুণ দাগ কেটেছে। গাড়ির সিট এবং বাড়ির ড্রয়িং রুমেবসে এই লেখা দুটি পড়তে পড়তে চলে গিয়েছিলাম চার দশক আগের জীবনে, মানে শৈশবের সেই আনন্দঘন দিনগুলোতে।

৩. জনসমাগম এবং আত্মীয়স্বজন থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকলেও সুযোগ পেলেই ছোট ভাই আর ছোট্ট ভাগ্নেদের সঙ্গে নিয়ে ঈদের সময় হেঁটেছি আমাদের বাড়ির সামনের বিলপারের পাট, মরিচ, পটল আর পাকা ধানের জমির আলপথ ধরে। ঈদের আগের দিন আমার লাগানো আমগাছের সঙ্গে মিতালি করেই ছুটে গিয়েছিলাম আব্বার যত্নে তৈরি সবজিবাগানের দিকে। সেখানে যেতেই দেখলাম গৌরী গ্রাম পূর্বপাড়া ঈদগাহ মাঠের গাছের ছায়ায় গোল হয়ে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন বিভিন্ন বয়সী জনা ১০-১২ মানুষ। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই একজনের মুখের হাসির হিল্লোল আমার মনের সব কুঠুরিতে ছড়িয়ে পড়ল। আরে, এ যে আমার সোরাপ মামা! মানে, তাঁর কাঁধে কেটেছে আমার শৈশবের সকাল, দুপুর, বিকেলের কৌতূহলভরা প্রহরগুলো। তিনি অনেক বছর ছিলেন আমার মামার বাড়িতে।

আগের দিনে আর্থিক টানাপোড়েনে থাকা পরিবারের কিশোর-যুবকেরা কেউ কেউ অন্যের বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করতেন। যাঁদের লেখাপড়ার আগ্রহ ছিল না, তাঁরা অনেকে বছর চুক্তিতে অন্যের বাড়িতে থাকতেন।

যা হোক, সোরাপ মামাকে দেখে ফিরে গেলাম ৪০ বছর আগের দিনগুলোতে। শরীরের অবয়বে নানা পরিবর্তন এলেও মুখের হাসি এবং কথার স্বরে তাঁর তেমন পরিবর্তন হয়নি। পাশের বাড়ি থেকে দুটি চেয়ার এনে কিছুক্ষণ পাশাপাশি বসে গল্প করলাম। কিছু মানুষের কাছে বসলে এবং তাঁদের কথা মনে হলে মনের অজান্তেই শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে, সোরাপ মামা আমার কাছে তেমনই একজন মানুষ।

গরু দিয়ে ধানের মলন মলার সময়ও আমাকে কাঁধে করে রেখেছেন। আমার দুরন্তপনায় কোনো দিন রাগ করেছেন বা বিরক্ত হয়েছেন, এমন কোনো ঘটনা তাঁর দ্বারা ঘটেনি। গাছের পাকা আমটি, পাখির ঠোকরানো সুমিষ্ট পেয়ারাটি, রসেভরা কালোজাম যখন হাতে তুলে দিতেন, তখন মনে হতো তাঁর চেয়ে প্রিয়জন আর কে আছে? কাগজ কেটে বওলার আঠা দিয়ে বানিয়ে দিতেন ঘুড়ি; ঘুড়ি যখন আকাশে উড়িয়ে আমার শিশুমনটিও যেন ঘুড়ির সঙ্গে ডানা মেলে দিত।

সোরাপ মামার দুই ছেলের বড়টিকে বিয়ে দিয়েছেন, ছোটটি স্কুলে পড়ে। দিনকাল কেমন কাটে, জানতে চাইলেই একগাল পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, আল্লাহ ভালোই চালান। ধানকাটা এবং পেঁয়াজের মৌসুমে পাঁচ–ছয় শত টাকা দিনে কাজ করে যা আয় হয়, তাতে বছর ভালোভাবেই চলে যায়। নিজেরও কিছু আবাদ-ফসল আছে। অঢেল টাকা না থাকলেও জীবনে সুখ-শান্তি আছে। ছোট ছেলেটিকে লেখাপড়া শেখাতে চান, তাই গৃহশিক্ষক রেখে দিয়েছেন। বললেন, পড়ালেখা ছাড়া আর কিছুই করতে দেন না তাকে। সোরাপ মামার হাসিমাখা মুখ দেখে আর বুকভরা স্বপ্নের গল্প কিছুক্ষণ শুনে ছুটলাম আমার আব্বার সবজির বাগানের দিকে।

৪. আব্বার এই বাগানটিসহ আমাদের আরও কয়েকটি জমিতে পটল, মরিচ, টমেটো, লালশাক, ফুলকপি, পাতাকপি, ওলকপি, ঢেঁড়শ, বেগুন, মূলা, কুমড়া, আলুর চাষ হতো। বনগ্রাম, বোয়াইলমারী, কাশীনাথপুরের হাটে পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি পাশ্বর্বর্তী গোপীনাথপুরের হাটে এসব সবজি বিক্রি করতে যেতাম। বড় হাটের তুলনায় এসব হাটে সবজির দাম থাকত অনেক বেশি। তবে বিক্রি হতো কম। এই ৫ কেজি, ১০ কেজি—এ রকম। স্কুল থেকে এসেই গামলাভর্তি সবজি মাথায় নিয়ে রবি ও বুধবারে গোপীনাথপুরের হাটে যেতাম। নানা রকম ক্রেতা। এখনো তাঁদের চেহারা, পোশাক, হাঁটার ধরন চোখের সামনে ভাসে। টাকা খুচরা করতে গিয়ে অনেকে মনের ভুলে চলে যেতেন! পরের হাটে এসে সবজি কিনে আগেরটাসহ দাম দিতেন।

বিকেলে শুরু হয়ে সন্ধ্যায় হাট শেষ হতো। ফেরার সময় একেক দিন একেক রকম খাজা যেমন–গজা, তিলের মটকা, জিলাপি, বাদাম, পাঁপড়, নিমকি কিনে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। সেই সাঁঝবেলা কিংবা সন্ধ্যার পরে সাতানির চর এবং গোপীনাথপুরের মাঝখানের বিশালাকৃতির বটগাছের নিচে এলেই তার এলানো ঝুরিগুলো দেখে ভয়ে গা ছমছম করত। কোনো কোনো দিন চোখ বন্ধ করে দোয়া-কলেমা পড়তে পড়তে একদৌড়ে বটগাছ পার হতাম।

৫. শৈশবের মধুর দিনগুলো কি আর দু-চার কথায় শেষ হয়? হাসান আজিজুল হক উঁকি দিয়ে শৈশব-কৈশোরের দিগন্ত দেখতে গিয়ে কয়েক খণ্ডে বই লিখে ফেলেছেন। হ্যাঁ, লিখবেনই তো বড় মানুষ, ক্ষুরধার লেখনি আর গভীর জীবনোপলব্ধির লেখকের কলমে ধরাপড়া শৈশব বলে কথা! অতটা গভীর দৃষ্টি কী আমার আছে! তবু সময় পেলে লিখব আমার সন্তানদের জন্য, যারা এমন মধুর শৈশব পায়নি। ফেসবুকের দীর্ঘ লেখা পাঠের বিরক্তি থেকে বন্ধুদের মুক্ত করে ‘দৈনিক আমাদের সময়’ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় কীর্তিমান দুই লেখকের আত্মজৈবনিক লেখা পাঠ ও সোরাপ মামার প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে আমার মধুর শৈশবের আঙিনা থেকে একটু ঘুরিয়ে আনলাম। আহারে শৈশব! এ জীবনে আর তার দেখা মিলবে না! তাই স্মৃতির দখিন দুয়ার খুলে আমিও সেখান থেকে একটু ঘুরে এলাম!

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত