শরিফুল হাসান
নিশ্চিন্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে উপস্থিত সবার মধ্যেই সেদিন ছিল আহাজারি আর চরম অনিশ্চয়তা। তারিখটা ছিল ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন কারখানায় সেদিন আগুনে ১১১ শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিলেন। পরে লাশগুলো উদ্ধার করে স্কুলমাঠে সারি সারি করে রাখা হয়। অবশ্য লাশ না কঙ্কাল–বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। এর মধ্যেই পরম মমতায় ব্যাগে মোড়ানো একেকটি মৃতদেহ ছুঁয়ে চেনার চেষ্টা করছিলেন স্বজনেরা।
পুড়ে যাওয়া এমনই একটি কঙ্কালসম শরীরের কানে সোনার দুল দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন রাজবাড়ীর মোহাম্মদ শোয়েব। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, এটাই তাঁর স্ত্রী শিউলির লাশ। সোনার এই দুলটা তিনি স্ত্রীকে কিনে দিয়েছিলেন। আর সেই দুল দেখেই স্ত্রীর মরদেহ নিশ্চিত করতে পারলেন।
তবে, তাঁর পাশে থাকা রংপুরের মিঠাপুকুরের নূরজাহান বেগম পোড়া লাশগুলো থেকে তাঁর বোনকে আলাদা করতে পারেননি। স্কুলমাঠে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলছিলেন: ‘এত লাশ, হামার ছোট বোইন ববিতার লাশ কোনঠে?’
আগুন লাগার খবর পেয়ে সাংবাদিক হিসেবে সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম। ঘটনার ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও শোয়েব-নূরজাহানদের সেই আহাজারি আজও কানে বাজে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় আগুনে পুড়ে অর্ধশত মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় সেই আহাজারি ফিরে এল।
খবরে দেখছিলাম, ১৪ বছরের কিশোরী শান্তার মা সীমা আক্তারের আহাজারি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন: ‘বাবামরা মেয়ে আমার। সকালে ভাত খেয়েও আসেনি। আমি শুধু মেয়ের লাশটা চাই।’
ঢাকা মেডিকেলের সামনে ছোট বোনের ছবি নিয়ে অস্থির হয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন মো. মোস্তফা (২৬)। তাঁর ১৩ বছর বয়সী কিশোরী বোন মোছা. সেলিনা নারায়ণগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছে। বোনের বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন মোস্তফা। এখন শুধু দগ্ধ লাশ পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
তাজরীন আর হাশেম বেভারেজের দৃশ্যগুলো প্রায় একই রকম। আহাজারিগুলোও। তাজরীন ভবন ছিল নয়তলা আর হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানাটি ছয়তলা। তাজরীন ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর তৃতীয় তলার মূল ফটকে তালা মেরে দেওয়া হয়। এর ফলে সেখান থেকে লোকজন বের হতে পারেনি। একই ঘটনা ঘটেছে রূপগঞ্জেও। আগুন লাগার পর কাউকে বের হতে দেওয়া হয়নি। সবাই আটকা পড়েছেন তৃতীয় তলায়। সেখানেই পুড়ে কয়লা হয়েছেন।
তাজরীনের আগুন লেগেছিল সন্ধ্যায়, জ্বলে ছিল রাতভর। রূপগঞ্জেও। দুই ঘটনাতেই রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে। স্বজনদের অপেক্ষার পরিণতি–আগুনে পুড়ে যাওয়া মাংসপিণ্ড আর কঙ্কাল। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৫৮টি লাশ কোনোভাবেই চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। এবারও সেই ডিএনও প্রক্রিয়া চলছে। তাজরীনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিল এবং জরুরি নির্গমন পথ না থাকায় প্রাণহানি বেশি হয়েছিল বলে জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। এবারও প্রায় একই রকম কথা শোনা যাচ্ছে।
তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড ছিল তোবা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। ঘটনার দুই দিন পর প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসেন বলেছিলেন, আগুন লাগার দায় তাঁর নয়। রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাশেমও বলছেন, এই ঘটনার দায় তাঁর নয়। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটা মামলা হলেও কোনো ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট করে আসামি করা হয়নি। পুলিশ বলেছিল, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযুক্তদের আসামি করা হবে। কিন্তু সেই ঘটনার বিচার আর হয়নি। এবার কী ঘটবে দেখার অপেক্ষা।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, রূপগঞ্জের ওই ভবনে প্রচুর প্লাস্টিক, কেমিক্যাল, কার্টনসহ প্রচুর দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন ভয়াবহ হয়ে ওঠে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা তো দেশে প্রথম ঘটছে না। এই যে বারবার কারখানায় আগুন লাগে, গরিব মানুষ মারা যায়, কারও কি কোনো দায় নেই?
আর বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, জুস ও পানীয় উৎপাদনকারী হাশেম বেভারেজের কারখানায় ছিল প্লাস্টিকসামগ্রীসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ও রাসায়নিক। এ ধরনের কারখানায়
হঠাৎ আগুন লাগতেই পারে। আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক ব্যবস্থা থাকাটা বাধ্যতামূলক। থাকতে হয় শ্রমিকদের যথেষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা। যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনায় শ্রমিক-কর্মচারীরা যাতে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারেন, সেই ধরনের ব্যবস্থাও থাকতে হয়। অথচ এখন বোঝা যাচ্ছে, এগুলোর যথেষ্ট অভাব ছিল। কিন্তু এসব দেখার কেউ ছিল না।
অবশ্য শুধু এবার কেন? কখনোই দেখার কেউ থাকে না। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে আগুন লেগেছিল। এই ঘটনায় ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর পুরান ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার দাবি উঠেছিল। এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির বিশেষজ্ঞরা যে ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিলেন, সেগুলোর প্রথমেই ছিল বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া। কিন্তু সরেনি।
নিমতলীর সেই ঘটনায় বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল। সেই ঘটনার কোনো বিচারও হয়নি। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে ভয়ানক আরেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। সেই একই আহাজারি। কারণও সেই রাসায়নিক। এতে প্রাণ যায় ৭৮ জনের। এবারও বিচার হয়নি।
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ২২ তলা ভবন এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগে। এতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর জানা যায়, এফ আর টাওয়ার রাজউক থেকে ১৮ তলার নকশার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা করা হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর নকশার এই অনিয়ম নিয়ে মামলা হয়, যা এখনো চলছে। কিন্তু কথা হলো, নকশা অনুমোদন ছাড়া এই শহরে একটা ভবন হলো–কর্তৃপক্ষ কি দেখেনি?
২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৪১ জন। ঘটনার পর জানা যায়, এই কারখানা ভবনে যথাযথ সিঁড়িই ছিল না। আরও জানা যায়, ইমারত নির্মাণের যে লে-আউটের অনুমোদন নিয়েছিল, তা তারা বাস্তবে অনুসরণ করেনি। ঘটনার পর আরও নানা অনিয়মের কথা শোনা যায়। অথচ বিসিক শিল্প এলাকার ভেতরেই ছিল এই কারখানা। কিন্তু কেউ যেন কিছু দেখেনি।
২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লাগলে ১৩ জন মারা যান। এরপর জানা যায়, আগুন লাগার পর শ্রমিকেরা তাৎক্ষণিক বের হতে পারেননি। পরে জানা যায়, কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই চলছিল কারখানাটি। না পরিবেশগত ছাড়পত্র, না আগুন নেভানোর সক্ষমতা–কিছুই ছিল না। অথচ কোনো দিন সেখানে কোনো অভিযান হয়নি।
একই ধরনের ঘটনা শোনা গিয়েছিল রানা প্লাজার পরেও। এ যেন এক বিস্ময়কর ঘটনা! প্রতিবারই ঘটনা ঘটার পর জানা যায়, নানা ধরনের ত্রুটি ছিল। অনুমোদন ছিল না। আগুন নেভানোর যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। বছরের পর বছর ধরে যেন একই গল্প। অথচ একটা ভবন বা কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে সরকারি বহু দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। শুধু অনুমোদনেই শেষ নয়। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সরকারের নানা দপ্তর আছে, যাদের কাজ নিয়মিত এগুলো তদারকি করা। কিন্তু প্রতিটি দুর্ঘটনার পর একই কথা। তদারককারীরা সবাই যেন ঘুমাচ্ছিল!
নারায়ণগঞ্জের এই কারখানায় নিহত অনেকে ছিল শিশু-কিশোরী, যাদের বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে। এগুলোও যেন দেখার কেউ ছিল না। অবশ্য অগ্নিকাণ্ডের পর এখন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, বরাবরই যেমন হয়। আগামী কয়েক দিন এখন তদন্ত হবে, বহু আলোচনা হবে, জানা যাবে বহু কিছু। তারপর আবার সব হারিয়ে যাবে। এরপর আবার একই দুর্ঘটনা ঘটবে। একই গল্প শোনা যাবে। তখন জানা যাবে বহু কিছু।
বড়ই বিস্ময়কর! এই দেশে লঞ্চ ডুবলে ঘটনার পর জানা যায়, লঞ্চের অনুমোদন নেই। ভবনে আগুন লাগলে জানা যায়, অনুমোদন নেই। গাড়ি দুর্ঘটনার পর জানা যায়, ফিটনেস নেই। অথচ তদারকের দায়িত্বে থাকা নানা কর্তৃপক্ষ আছে! কিন্তু মানুষ মরে যাওয়ার আগে কারও হুঁশ হয় না।
ফলে বারবার বাবার কাঁধে ওঠে সন্তানের লাশ, সন্তানের কাঁধে বাবার। ভাই নিয়ে যাবে বোনের লাশ, বোন অপেক্ষা করবে ভাইয়ের লাশের। প্রতিটা ঘটনার পর শোনা যাবে এমন আহাজারি: ‘ও স্যার, আমার মায়ের হাড্ডিগুলা খুঁইজ্জা দেন, স্যার।’
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
নিশ্চিন্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে উপস্থিত সবার মধ্যেই সেদিন ছিল আহাজারি আর চরম অনিশ্চয়তা। তারিখটা ছিল ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন কারখানায় সেদিন আগুনে ১১১ শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিলেন। পরে লাশগুলো উদ্ধার করে স্কুলমাঠে সারি সারি করে রাখা হয়। অবশ্য লাশ না কঙ্কাল–বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। এর মধ্যেই পরম মমতায় ব্যাগে মোড়ানো একেকটি মৃতদেহ ছুঁয়ে চেনার চেষ্টা করছিলেন স্বজনেরা।
পুড়ে যাওয়া এমনই একটি কঙ্কালসম শরীরের কানে সোনার দুল দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন রাজবাড়ীর মোহাম্মদ শোয়েব। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, এটাই তাঁর স্ত্রী শিউলির লাশ। সোনার এই দুলটা তিনি স্ত্রীকে কিনে দিয়েছিলেন। আর সেই দুল দেখেই স্ত্রীর মরদেহ নিশ্চিত করতে পারলেন।
তবে, তাঁর পাশে থাকা রংপুরের মিঠাপুকুরের নূরজাহান বেগম পোড়া লাশগুলো থেকে তাঁর বোনকে আলাদা করতে পারেননি। স্কুলমাঠে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলছিলেন: ‘এত লাশ, হামার ছোট বোইন ববিতার লাশ কোনঠে?’
আগুন লাগার খবর পেয়ে সাংবাদিক হিসেবে সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম। ঘটনার ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও শোয়েব-নূরজাহানদের সেই আহাজারি আজও কানে বাজে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় আগুনে পুড়ে অর্ধশত মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় সেই আহাজারি ফিরে এল।
খবরে দেখছিলাম, ১৪ বছরের কিশোরী শান্তার মা সীমা আক্তারের আহাজারি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন: ‘বাবামরা মেয়ে আমার। সকালে ভাত খেয়েও আসেনি। আমি শুধু মেয়ের লাশটা চাই।’
ঢাকা মেডিকেলের সামনে ছোট বোনের ছবি নিয়ে অস্থির হয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন মো. মোস্তফা (২৬)। তাঁর ১৩ বছর বয়সী কিশোরী বোন মোছা. সেলিনা নারায়ণগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছে। বোনের বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন মোস্তফা। এখন শুধু দগ্ধ লাশ পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
তাজরীন আর হাশেম বেভারেজের দৃশ্যগুলো প্রায় একই রকম। আহাজারিগুলোও। তাজরীন ভবন ছিল নয়তলা আর হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানাটি ছয়তলা। তাজরীন ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর তৃতীয় তলার মূল ফটকে তালা মেরে দেওয়া হয়। এর ফলে সেখান থেকে লোকজন বের হতে পারেনি। একই ঘটনা ঘটেছে রূপগঞ্জেও। আগুন লাগার পর কাউকে বের হতে দেওয়া হয়নি। সবাই আটকা পড়েছেন তৃতীয় তলায়। সেখানেই পুড়ে কয়লা হয়েছেন।
তাজরীনের আগুন লেগেছিল সন্ধ্যায়, জ্বলে ছিল রাতভর। রূপগঞ্জেও। দুই ঘটনাতেই রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে। স্বজনদের অপেক্ষার পরিণতি–আগুনে পুড়ে যাওয়া মাংসপিণ্ড আর কঙ্কাল। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৫৮টি লাশ কোনোভাবেই চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। এবারও সেই ডিএনও প্রক্রিয়া চলছে। তাজরীনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিল এবং জরুরি নির্গমন পথ না থাকায় প্রাণহানি বেশি হয়েছিল বলে জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। এবারও প্রায় একই রকম কথা শোনা যাচ্ছে।
তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড ছিল তোবা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। ঘটনার দুই দিন পর প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসেন বলেছিলেন, আগুন লাগার দায় তাঁর নয়। রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাশেমও বলছেন, এই ঘটনার দায় তাঁর নয়। তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় একটা মামলা হলেও কোনো ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট করে আসামি করা হয়নি। পুলিশ বলেছিল, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযুক্তদের আসামি করা হবে। কিন্তু সেই ঘটনার বিচার আর হয়নি। এবার কী ঘটবে দেখার অপেক্ষা।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, রূপগঞ্জের ওই ভবনে প্রচুর প্লাস্টিক, কেমিক্যাল, কার্টনসহ প্রচুর দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন ভয়াবহ হয়ে ওঠে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা তো দেশে প্রথম ঘটছে না। এই যে বারবার কারখানায় আগুন লাগে, গরিব মানুষ মারা যায়, কারও কি কোনো দায় নেই?
আর বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, জুস ও পানীয় উৎপাদনকারী হাশেম বেভারেজের কারখানায় ছিল প্লাস্টিকসামগ্রীসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ও রাসায়নিক। এ ধরনের কারখানায়
হঠাৎ আগুন লাগতেই পারে। আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক ব্যবস্থা থাকাটা বাধ্যতামূলক। থাকতে হয় শ্রমিকদের যথেষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা। যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনায় শ্রমিক-কর্মচারীরা যাতে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারেন, সেই ধরনের ব্যবস্থাও থাকতে হয়। অথচ এখন বোঝা যাচ্ছে, এগুলোর যথেষ্ট অভাব ছিল। কিন্তু এসব দেখার কেউ ছিল না।
অবশ্য শুধু এবার কেন? কখনোই দেখার কেউ থাকে না। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে আগুন লেগেছিল। এই ঘটনায় ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর পুরান ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার দাবি উঠেছিল। এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির বিশেষজ্ঞরা যে ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিলেন, সেগুলোর প্রথমেই ছিল বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া। কিন্তু সরেনি।
নিমতলীর সেই ঘটনায় বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছিল। সেই ঘটনার কোনো বিচারও হয়নি। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে ভয়ানক আরেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। সেই একই আহাজারি। কারণও সেই রাসায়নিক। এতে প্রাণ যায় ৭৮ জনের। এবারও বিচার হয়নি।
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ২২ তলা ভবন এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগে। এতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর জানা যায়, এফ আর টাওয়ার রাজউক থেকে ১৮ তলার নকশার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা করা হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর নকশার এই অনিয়ম নিয়ে মামলা হয়, যা এখনো চলছে। কিন্তু কথা হলো, নকশা অনুমোদন ছাড়া এই শহরে একটা ভবন হলো–কর্তৃপক্ষ কি দেখেনি?
২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৪১ জন। ঘটনার পর জানা যায়, এই কারখানা ভবনে যথাযথ সিঁড়িই ছিল না। আরও জানা যায়, ইমারত নির্মাণের যে লে-আউটের অনুমোদন নিয়েছিল, তা তারা বাস্তবে অনুসরণ করেনি। ঘটনার পর আরও নানা অনিয়মের কথা শোনা যায়। অথচ বিসিক শিল্প এলাকার ভেতরেই ছিল এই কারখানা। কিন্তু কেউ যেন কিছু দেখেনি।
২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লাগলে ১৩ জন মারা যান। এরপর জানা যায়, আগুন লাগার পর শ্রমিকেরা তাৎক্ষণিক বের হতে পারেননি। পরে জানা যায়, কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই চলছিল কারখানাটি। না পরিবেশগত ছাড়পত্র, না আগুন নেভানোর সক্ষমতা–কিছুই ছিল না। অথচ কোনো দিন সেখানে কোনো অভিযান হয়নি।
একই ধরনের ঘটনা শোনা গিয়েছিল রানা প্লাজার পরেও। এ যেন এক বিস্ময়কর ঘটনা! প্রতিবারই ঘটনা ঘটার পর জানা যায়, নানা ধরনের ত্রুটি ছিল। অনুমোদন ছিল না। আগুন নেভানোর যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। বছরের পর বছর ধরে যেন একই গল্প। অথচ একটা ভবন বা কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে সরকারি বহু দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। শুধু অনুমোদনেই শেষ নয়। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সরকারের নানা দপ্তর আছে, যাদের কাজ নিয়মিত এগুলো তদারকি করা। কিন্তু প্রতিটি দুর্ঘটনার পর একই কথা। তদারককারীরা সবাই যেন ঘুমাচ্ছিল!
নারায়ণগঞ্জের এই কারখানায় নিহত অনেকে ছিল শিশু-কিশোরী, যাদের বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে। এগুলোও যেন দেখার কেউ ছিল না। অবশ্য অগ্নিকাণ্ডের পর এখন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, বরাবরই যেমন হয়। আগামী কয়েক দিন এখন তদন্ত হবে, বহু আলোচনা হবে, জানা যাবে বহু কিছু। তারপর আবার সব হারিয়ে যাবে। এরপর আবার একই দুর্ঘটনা ঘটবে। একই গল্প শোনা যাবে। তখন জানা যাবে বহু কিছু।
বড়ই বিস্ময়কর! এই দেশে লঞ্চ ডুবলে ঘটনার পর জানা যায়, লঞ্চের অনুমোদন নেই। ভবনে আগুন লাগলে জানা যায়, অনুমোদন নেই। গাড়ি দুর্ঘটনার পর জানা যায়, ফিটনেস নেই। অথচ তদারকের দায়িত্বে থাকা নানা কর্তৃপক্ষ আছে! কিন্তু মানুষ মরে যাওয়ার আগে কারও হুঁশ হয় না।
ফলে বারবার বাবার কাঁধে ওঠে সন্তানের লাশ, সন্তানের কাঁধে বাবার। ভাই নিয়ে যাবে বোনের লাশ, বোন অপেক্ষা করবে ভাইয়ের লাশের। প্রতিটা ঘটনার পর শোনা যাবে এমন আহাজারি: ‘ও স্যার, আমার মায়ের হাড্ডিগুলা খুঁইজ্জা দেন, স্যার।’
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
৮ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
৮ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
৮ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে