প্রশান্ত মৃধা
দোকানটার পাশের একচালায় এনার্জি বাল্ব ঝুলছে। সেখানে ক্যারম ও মাটিতে পাটি পেতে চলছে তাস। সামনের রাস্তার উল্টোদিকে খাললাগোয়া বাঁশের লম্বা বেঞ্চিতে আড্ডা দিচ্ছে একটু বয়সীরা। বছর কুড়ি আগেও এই গ্রামে রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ এই দৃশ্য ভাবা যেত না। সন্ধ্যা হয়েছে অন্তত ঘণ্টা দুয়েক। বেশির ভাগ বাড়িতে রাতের খাওয়া শেষ হয়ে চলত ঘুমের আয়োজন। এখন একেবারেই উল্টো। বাড়ির বউ-ঝিরা এখন টিভিতে পশ্চিম বাংলার বাংলা সিরিয়াল দেখছে। একটার পর একটা প্রতি আধঘণ্টা অন্তর শুরু হয়েছে দুই ঘণ্টা আগে। আরও ঘণ্টাখানেক চলবে তাদের কারও পছন্দের সিরিয়াল। সিরিয়াল শেষ হলে এরা বাড়ি ফিরবে। ওসব দেখার ফাঁকে রাতের রান্না হয়েছে। এখনই বাড়ি গিয়ে হাজির হলে, সে খাদ্য হয়তো অতটা যত্নে তাদের পরিবেশন করা হবে না। সিরিয়াল থেকে কিছু আলগা ঢং-ও তো তারা রপ্ত করেছে।
এসব কথা শোনা গেল উল্টো পাশের বেঞ্চি থেকে। বয়সীদের জীবনাভিজ্ঞতা বেশি, সাংসারিক অভ্যাসও দীর্ঘদিনের। তাতে পরিবর্তন হয়েছেও বেশ। আগের সন্ধ্যারাতেই খাওয়া ও পরবর্তী দিনের কাজের জন্য অপেক্ষার ধরন বদলেছে। মাঠের কাজেও লাঙলের বদলে ট্রাক্টর। ভাড়ার হিসাব ঘণ্টাপ্রতি। তাদের পক্ষে অতীত আর বর্তমানের এই পরিবর্তন নিয়ে কথা তোলা স্বাভাবিকই।
সে তুলনায়, ক্যারম ও তাস খেলোয়াড়রা এখনকার দিনযাপনে বেশি অভ্যস্ত। তারাও সংসারী। কেউ স্মার্টফোন ব্যবহার করে। কারও ই-মেইল আইডি, ফেসবুক অ্যাকাউন্টও আছে। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকার অভ্যাস হয়েছে। ওদিকে তাদের বউরা ওসব সিরিয়ালের দর্শক। তারা জানে স্বামীদের ফিরতে আরও একটু রাত হবে। এটুকু মিলের ভেতরেও প্রজন্মের ব্যবধান। সেই ব্যবধানের প্রথম কারণ, এসব গ্রামে বিদ্যুৎ আসা। সে প্রায় পঁচিশ বছর। দ্বিতীয় দল মোটামুটি দশ-পনেরো বছর বয়স থেকেই বিদ্যুতে অভ্যস্ত। সন্ধ্যা হওয়ামাত্র একবারে নিঝুম হয়ে যাওয়া গ্রাম তাদের ছেলেবেলায় বিদায় নিয়েছে। বিড়ির বদলে তারা টানে সিগারেট। কেউ সাইকেল ছেড়ে মোটরসাইকেলে। সকাল বেলা চা ছাড়া চলে না। টিস্যু পেপারে মুখ মুছতে জানে। ওদিকে তাদের আগের প্রজন্মের অনেকেই এ বিষয়গুলোয় অভ্যস্ত হতে পারেনি। যদিও তাদের সে চেষ্টা আছে। কারণ, অনেকের সন্তান দেশের নানা প্রান্তে ও দেশের বাইরে থাকে। ভিডিও কল আসে। সেটা ধরতে শিখেছে কেউ; কিন্তু নিজের জন্য কেনার সামর্থ্য থাকলেও ব্যবহারের যোগ্যতা নেই।
ক্যারমের দুজন তাদের সমর্থকসহ চিৎকার করে উঠলে, এপাশে একজন জানতে চাইল গেম দেওয়া গেল কতয়। তা জানিয়ে বিজয়ীর একজন আনন্দে সিগারেট জ্বালালো। যে জানতে চেয়েছে, বিজয়ী সম্পর্কে তার ভাইপো। এতে আপত্তি নেই, ছোট কাকার সঙ্গে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস তার অনেক দিনের। দুজনের বয়সের ফারাক বছর বারো-চোদ্দ। কিন্তু ফারাক দুজনার বেড়ে ওঠার। সে ক্ষেত্রে তারা পরস্পর একেবারে আলাদা সময়ের। বিজয়ীর হাত থেকে সিগারেট তার পার্টনারের হাতেও যায়। ওদিকে পরাজিত দলের হাতেও সিগারেট। তারা বিজয়ীদের চেয়ে বয়সে সামান্য ছোট। তখন এদিকে একজন অন্যের কাছে জানতে চাইল, ‘ওমুকও দেখি সাদা চকলেট ধরেছে!’
প্রশ্নে বিস্ময়, কিন্তু এ কথা বলা হয়নি, তাদের এদের সামনে কিংবা এইটুকু দূরত্বে সিগারেট খাওয়া কোনো অপরাধ। অন্য একজন পাশ থেকে বললেন, ওর তো তবু বয়স হয়েছে। সংসার আছে। মাঝেমধ্যে এ রকম খেলার সময়ে এক-আধটা খায়। কিন্তু কাল তিনি ওমুকের ছোট ছেলেকে দেখেছেন, বন্ধুসহ তার সামনে দিয়ে দুজন ভাবলেশহীনভাবে সিগারেট টানতে টানতে যাচ্ছে।
অন্যজন জানতে চাইলেন, সে-না কেবল সবে কলেজে গেল?
হুঁ, বলেই জানিয়ে দেওয়া, তাহলেই তো ময়মুরুব্বিদের সামনে সিগারেট খাওয়ার লাইসেন্স জুটে গেছে। বাকিরাও বিস্মিত। কিন্তু জানে এটাই হাওয়া। তারাও বিড়ি খেয়েছে; কিন্তু বড়দের দেখলে লুকিয়েছে। বোঝা গেল, টিভি সিরিয়াল, ফেসবুক, ভিডিও কল মানা গেলে এটা মানা কষ্টকর। এগুলো তাদের ভাষায় বেয়াদবি। ওসব বর্তমান জমানায় আমদানি। যার ভাইপো ক্যারমে জিতে সিগারেট জ্বালিয়েছিল, সে বেঞ্চি ছেড়ে উঠল। বাড়ি যাবে। যাওয়ার আগে ভাইপোকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়ার জন্য বলে গেল এভাবে: ‘বউমা কল দিলিই বাড়ি আসপি। ভাত নিয়ে তোর জন্যি বইসে থাকতি পারব না।’
এতে, থমথমে পরিবেশে একটু হালকা হাওয়া খেলল।
লেখক: সাহিত্যিক
দোকানটার পাশের একচালায় এনার্জি বাল্ব ঝুলছে। সেখানে ক্যারম ও মাটিতে পাটি পেতে চলছে তাস। সামনের রাস্তার উল্টোদিকে খাললাগোয়া বাঁশের লম্বা বেঞ্চিতে আড্ডা দিচ্ছে একটু বয়সীরা। বছর কুড়ি আগেও এই গ্রামে রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ এই দৃশ্য ভাবা যেত না। সন্ধ্যা হয়েছে অন্তত ঘণ্টা দুয়েক। বেশির ভাগ বাড়িতে রাতের খাওয়া শেষ হয়ে চলত ঘুমের আয়োজন। এখন একেবারেই উল্টো। বাড়ির বউ-ঝিরা এখন টিভিতে পশ্চিম বাংলার বাংলা সিরিয়াল দেখছে। একটার পর একটা প্রতি আধঘণ্টা অন্তর শুরু হয়েছে দুই ঘণ্টা আগে। আরও ঘণ্টাখানেক চলবে তাদের কারও পছন্দের সিরিয়াল। সিরিয়াল শেষ হলে এরা বাড়ি ফিরবে। ওসব দেখার ফাঁকে রাতের রান্না হয়েছে। এখনই বাড়ি গিয়ে হাজির হলে, সে খাদ্য হয়তো অতটা যত্নে তাদের পরিবেশন করা হবে না। সিরিয়াল থেকে কিছু আলগা ঢং-ও তো তারা রপ্ত করেছে।
এসব কথা শোনা গেল উল্টো পাশের বেঞ্চি থেকে। বয়সীদের জীবনাভিজ্ঞতা বেশি, সাংসারিক অভ্যাসও দীর্ঘদিনের। তাতে পরিবর্তন হয়েছেও বেশ। আগের সন্ধ্যারাতেই খাওয়া ও পরবর্তী দিনের কাজের জন্য অপেক্ষার ধরন বদলেছে। মাঠের কাজেও লাঙলের বদলে ট্রাক্টর। ভাড়ার হিসাব ঘণ্টাপ্রতি। তাদের পক্ষে অতীত আর বর্তমানের এই পরিবর্তন নিয়ে কথা তোলা স্বাভাবিকই।
সে তুলনায়, ক্যারম ও তাস খেলোয়াড়রা এখনকার দিনযাপনে বেশি অভ্যস্ত। তারাও সংসারী। কেউ স্মার্টফোন ব্যবহার করে। কারও ই-মেইল আইডি, ফেসবুক অ্যাকাউন্টও আছে। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকার অভ্যাস হয়েছে। ওদিকে তাদের বউরা ওসব সিরিয়ালের দর্শক। তারা জানে স্বামীদের ফিরতে আরও একটু রাত হবে। এটুকু মিলের ভেতরেও প্রজন্মের ব্যবধান। সেই ব্যবধানের প্রথম কারণ, এসব গ্রামে বিদ্যুৎ আসা। সে প্রায় পঁচিশ বছর। দ্বিতীয় দল মোটামুটি দশ-পনেরো বছর বয়স থেকেই বিদ্যুতে অভ্যস্ত। সন্ধ্যা হওয়ামাত্র একবারে নিঝুম হয়ে যাওয়া গ্রাম তাদের ছেলেবেলায় বিদায় নিয়েছে। বিড়ির বদলে তারা টানে সিগারেট। কেউ সাইকেল ছেড়ে মোটরসাইকেলে। সকাল বেলা চা ছাড়া চলে না। টিস্যু পেপারে মুখ মুছতে জানে। ওদিকে তাদের আগের প্রজন্মের অনেকেই এ বিষয়গুলোয় অভ্যস্ত হতে পারেনি। যদিও তাদের সে চেষ্টা আছে। কারণ, অনেকের সন্তান দেশের নানা প্রান্তে ও দেশের বাইরে থাকে। ভিডিও কল আসে। সেটা ধরতে শিখেছে কেউ; কিন্তু নিজের জন্য কেনার সামর্থ্য থাকলেও ব্যবহারের যোগ্যতা নেই।
ক্যারমের দুজন তাদের সমর্থকসহ চিৎকার করে উঠলে, এপাশে একজন জানতে চাইল গেম দেওয়া গেল কতয়। তা জানিয়ে বিজয়ীর একজন আনন্দে সিগারেট জ্বালালো। যে জানতে চেয়েছে, বিজয়ী সম্পর্কে তার ভাইপো। এতে আপত্তি নেই, ছোট কাকার সঙ্গে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস তার অনেক দিনের। দুজনের বয়সের ফারাক বছর বারো-চোদ্দ। কিন্তু ফারাক দুজনার বেড়ে ওঠার। সে ক্ষেত্রে তারা পরস্পর একেবারে আলাদা সময়ের। বিজয়ীর হাত থেকে সিগারেট তার পার্টনারের হাতেও যায়। ওদিকে পরাজিত দলের হাতেও সিগারেট। তারা বিজয়ীদের চেয়ে বয়সে সামান্য ছোট। তখন এদিকে একজন অন্যের কাছে জানতে চাইল, ‘ওমুকও দেখি সাদা চকলেট ধরেছে!’
প্রশ্নে বিস্ময়, কিন্তু এ কথা বলা হয়নি, তাদের এদের সামনে কিংবা এইটুকু দূরত্বে সিগারেট খাওয়া কোনো অপরাধ। অন্য একজন পাশ থেকে বললেন, ওর তো তবু বয়স হয়েছে। সংসার আছে। মাঝেমধ্যে এ রকম খেলার সময়ে এক-আধটা খায়। কিন্তু কাল তিনি ওমুকের ছোট ছেলেকে দেখেছেন, বন্ধুসহ তার সামনে দিয়ে দুজন ভাবলেশহীনভাবে সিগারেট টানতে টানতে যাচ্ছে।
অন্যজন জানতে চাইলেন, সে-না কেবল সবে কলেজে গেল?
হুঁ, বলেই জানিয়ে দেওয়া, তাহলেই তো ময়মুরুব্বিদের সামনে সিগারেট খাওয়ার লাইসেন্স জুটে গেছে। বাকিরাও বিস্মিত। কিন্তু জানে এটাই হাওয়া। তারাও বিড়ি খেয়েছে; কিন্তু বড়দের দেখলে লুকিয়েছে। বোঝা গেল, টিভি সিরিয়াল, ফেসবুক, ভিডিও কল মানা গেলে এটা মানা কষ্টকর। এগুলো তাদের ভাষায় বেয়াদবি। ওসব বর্তমান জমানায় আমদানি। যার ভাইপো ক্যারমে জিতে সিগারেট জ্বালিয়েছিল, সে বেঞ্চি ছেড়ে উঠল। বাড়ি যাবে। যাওয়ার আগে ভাইপোকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়ার জন্য বলে গেল এভাবে: ‘বউমা কল দিলিই বাড়ি আসপি। ভাত নিয়ে তোর জন্যি বইসে থাকতি পারব না।’
এতে, থমথমে পরিবেশে একটু হালকা হাওয়া খেলল।
লেখক: সাহিত্যিক
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১৩ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১৩ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১৪ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ দিন আগে