সেলিম জাহান
(গতকালের পর)
করোনা সংকটের বৈশ্বিক প্রভাবকে তিনটি সময়সীমার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করা যেতে পারে: স্বল্পকালীন, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্প মেয়াদে তিনটি বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে। প্রথমত, কর্মহীনতা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ৬৬ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, স্পেনে ৩৫ লাখ। এর ফলে তাদের কর্মসংস্থান, আয় ও জীবনযাত্রার মানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এই বিরূপ প্রভাবের মূল শিকার হচ্ছেন তাঁরাই, যাঁরা অদক্ষ শ্রমিক, সেবা খাতে কর্মরত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন।
দ্বিতীয়ত, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান কমে যাওয়ায় খাদ্যসামগ্রীর লভ্যতা একটা বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শিশুরা এর বড় শিকার। খাদ্যসামগ্রীর আকালে দরিদ্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নিঃসন্দেহে। তৃতীয়ত, ইতিমধ্যেই বিশ্ব অর্থবাজারে বেশ টালমাটাল অবস্থা দেখা দিয়েছে। নানান বিনিময়পত্রের দাম পড়ে গেছে, আর্থিক বাজারের গতিবিধি নিম্নমুখী, যাকে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্থবির হয়ে আছে।
মধ্যমেয়াদে আবারও তিনটি প্রবণতার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। প্রথমত, বৈশ্বিক একটি মন্দা দেখা দেবে। তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা হয়তো অভাবনীয় হবে। এ মন্দার ফলে দরিদ্র দেশগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত, দেশের মধ্যে উৎপাদনকাঠামো আরও বিপর্যস্ত হবে। যার ফলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান আরও সংকুচিত হবে। শ্রমজীবী মানুষ সেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জালে নিষ্পেষিত হবে। তৃতীয়ত, বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাবেন।
দীর্ঘ মেয়াদে এ বছরে কৃষিকাজে কর্মযজ্ঞ না হওয়ায় আগামী বছরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আকাল বা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দীর্ঘ মেয়াদে এমনও হতে পারে যে, কর্তৃত্ববাদী অর্থনীতিগুলোই হয়তো সমস্যার সমাধান দ্রুত ও অল্প আয়াসে করতে পারবে। সেটা যদি হয়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন হতে পারে।
সামাজিক দিক থেকে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হওয়ায় মানসিক চাপ পড়ছে সবার ওপরে। এর ফলে মানুষের ধৈর্য ও সহনশীলতা যেমন লুপ্ত হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে সহিংসতা ঘরে-বাইরে। শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি উদ্বেগজনক। বিদ্যালয়ে যেতে না পেরে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে না পেরে, একদিকে যেমন তারা বিষণ্ন হচ্ছে, খিটখিটে হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে সামাজিক পটুতা হারাচ্ছে। তরুণেরা তাদের অদম্য প্রাণশক্তিকে অবরুদ্ধ অবস্থায় কেমন করে ব্যবহার করবে, তা জানে না। সত্যিকার অর্থে তাদের মনোজগতে একটা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন মনোবৈকল্যের সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা।
আগে আমরা বাইরে বেরোলে দেখে নিতাম সঙ্গে চাবি, চশমা, মোবাইল ফোন আছে কি না। এখন দেখি পরিষ্কারক, মুখাবরণী ও দস্তানা আছে কি না। আগে মোবাইল ফোন বাড়িতে ফেলে গেলে যে রকম অসহায় বোধ করতাম, এখন পরিষ্কারক, মুখাবরণী আর দস্তানা ফেলে গেলে তেমনই বোধ করি। হাত হয়ে উঠেছে আমাদের সবচেয়ে সুযত্ন সংরক্ষিত অঙ্গ এবং হাত ও মুখের বিচ্ছেদের জন্য আমাদের বর্তমান সচেষ্ট থাকার প্রয়াস এখন রূপান্তরিত হয়েছে স্বাভাবিক অভ্যাসে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে করোনার অভিঘাত কী পড়বে? বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে করোনার অভিঘাত কী হবে? বলা বাহুল্য, বৈশ্বিক অভিঘাতের বিষয়গুলো বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব ফেলবে।
করোনার কারণে বাংলাদেশের এ পর্যন্ত অর্জিত অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়ন বিঘ্নিত হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
করোনার কারণে আরও অতিরিক্ত ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শতাংশের বিচারে বাংলাদেশেও গত তিন দশকে চরম দারিদ্র্যের হার ৪৪ থেকে ২১ শতাংশে নেমে এসেছিল। গত সাত বছরে ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে পেরেছে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন যে, করোনার ফলে এটা বেড়ে আবার ৪০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে।
করোনার কারণে বাংলাদেশে ১৬ লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে পারে। গত বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত পোশাকশিল্পে ৭০ হাজার কর্মসংস্থান হারিয়ে গেছে এবং এ বছরের শেষ পর্যন্ত আরও ১০ লাখ কর্মসংস্থান হারিয়ে যাবে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। করোনা অতিমারি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুরতাকে দৃশ্যমান করেছে এবং ভবিষ্যতে এ নাজুকতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাদান কাঠামো শিক্ষায় বর্তমান অসমতার ব্যাপ্তি ও গভীরতা আরও বাড়াতে পারে। কারণ, প্রযুক্তির লভ্যতা গ্রামীণ অঞ্চল ও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের কাছে অনেক কম হবে। সেই সঙ্গে এটাও সত্যি যে, আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে এবং গৃহাভ্যন্তরে নারীর ওপরে করোনার অসম প্রভাব পড়বে। আনুষ্ঠানিক খাতে নারীরা সবার আগে কর্মচ্যুত হয়েছে এবং যখন অর্থনীতি সচল হবে, তখন সবার শেষে নারীরা কর্মসুযোগ পাবে।
করোনা সংকটের কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে তিনটি প্রভাব পড়বে। প্রথমত, আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধির দুটো মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে পোশাক রপ্তানি ও বহির্বিশ্বে কর্মরত বাঙালি শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা সংকটের কারণে দুটো চালিকাশক্তির ওপরে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এর ফলে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার কমে আসবে এবং অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে। মন্দার কারণে কর্মসংস্থান কমে যাবে এবং বেকারত্ব বাড়বে। পোশাকশিল্পের হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে পড়বেন এবং বিদেশে কর্মরত অদক্ষ শ্রমিকেরা কর্মহীন অবস্থায় দেশে ফিরবেন। এসব জনগোষ্ঠী ও তাঁদের পরিবারের ওপরে বিরাট অর্থনৈতিক চাপ পড়বে। সেই সঙ্গে বর্তমানে তেলের দাম যে বাড়ছে, তার ফলে বাংলাদেশকে তেল আমদানির জন্য একদিকে যেমন অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে, তেমনি মূল্যস্ফীতিতে এটা একটা বিরাট ভূমিকা রাখবে। এ বছর যদি কৃষি খাতে কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়, তাহলে আগামী বছর কৃষি উৎপাদন কমে গিয়ে খাদ্যসামগ্রীর লভ্যতা হ্রাস পেতে পারে। এর ফলে খাদ্যসংকটের সেসব প্রভাবের কিছু কিছু তো এখনই দেখা যাচ্ছে। গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ হওয়ায় বহু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন বন্ধ। দোকান খোলা নেই, কারখানায় কাজ হচ্ছে না, লোকজন বাইরে বেরোচ্ছে না। ফলে যাঁরা ‘দিন আনে দিন খায়’ তাদের আয়ের পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছেন দিনমজুর, রিকশাচালক, বাজারের ক্ষুদ্র বিক্রেতা, যাঁরা রাস্তার পাশে বেসাতি সাজিয়ে বসতেন এবং এমন অজস্র মানুষ। বহু বাড়িতে সাহায্যকারী গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। অবরুদ্ধ জীবনের বিরূপ প্রভাবের ফলাফল এটি। ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী দেউলিয়া হয়ে যাবেন। দিনের পর দিন সেসব প্রতিষ্ঠান নিষ্ক্রিয় থাকায় সেগুলো সচল থাকতে পারবে না। তাদের এমন কোনো সঞ্চয় নেই যে, তারা ক্রমাগত লস দিয়েও টিকে থাকতে পারবে।
বাংলাদেশে সংকটের আর্থসামাজিক প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে নানা কথা উঠে এসেছে–কর্মসংস্থানের ঘাটতি, আয়ের অপ্রতুলতা, সামাজিক সেবার অনুপস্থিতি ইত্যাদি। তবে যে সমস্যা সবচেয়ে প্রকট বলে আবির্ভূত হয়েছে, তা হলো খাদ্য অনিরাপত্তা, বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। তাদের কাজ নেই, আয় নেই, সঞ্চয় নেই–তারা দিন আনে দিন খায়। ফলে আয় ও সঞ্চয়ের অভাবে তাদের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, দেশের ৩০ শতাংশ বা ৫ কোটি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে প্রায় এক কোটি পরিবার খাদ্যসংকটের শিকার হবে।
করোনার কারণে বাংলাদেশে অসমতা বৃদ্ধি পেতে পারে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে, বঞ্চিত ও সুবিধাভোগীদের মধ্যে এবং গ্রাম ও নগরের মধ্যে। বৈষম্য শুধু বাড়বে ফলাফলে নয় (যেমন আয়ের ক্ষেত্রে), অসমতা বাড়বে সুযোগের ক্ষেত্রেও (যেমন শিক্ষাসেবার ক্ষেত্রে)। কতগুলো নাজুক জনগোষ্ঠী (যেমন বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী) এই অসমতা ও বৈষম্যের সবচেয়ে বড় শিকার হবে।
করোনার কারণে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে অসমতা বৃদ্ধির একটি চালিকাশক্তি হবে কর্মসংস্থান ও আয়ের প্রক্রিয়া। করোনাকালে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যারা দিন আনে দিন খায়, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শ্রমিক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা। করোনা যখন সবাইকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে, সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন বিঘ্নিত হয়েছে, তখন এ-জাতীয় মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট হয়েছে, তাদের আয়ের পথ রুদ্ধ হয়েছে। বিত্তবানদের মতো তাদের কোনো সঞ্চয়ও নেই, যা তারা ব্যবহার করতে পারেন জীবনধারণের জন্য। করোনা থেকে উত্তরণের কালেও বিত্তবানরা যত দ্রুত সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ তা পারবে না। যেমন বলা হচ্ছে, করোনার কারণে ভারতের অনানুষ্ঠানিক খাতে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বহির্বিশ্বে চাহিদা সংকোচনের কারণে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে ২০ লাখ কর্মী, যার বেশির ভাগই নারী, কাজ হারাতে পারে। ফলে, আয় ও ভোগের অসমতা বৃদ্ধি পাবে। (চলবে)
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
(গতকালের পর)
করোনা সংকটের বৈশ্বিক প্রভাবকে তিনটি সময়সীমার পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করা যেতে পারে: স্বল্পকালীন, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্প মেয়াদে তিনটি বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে। প্রথমত, কর্মহীনতা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ৬৬ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, স্পেনে ৩৫ লাখ। এর ফলে তাদের কর্মসংস্থান, আয় ও জীবনযাত্রার মানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এই বিরূপ প্রভাবের মূল শিকার হচ্ছেন তাঁরাই, যাঁরা অদক্ষ শ্রমিক, সেবা খাতে কর্মরত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন।
দ্বিতীয়ত, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান কমে যাওয়ায় খাদ্যসামগ্রীর লভ্যতা একটা বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শিশুরা এর বড় শিকার। খাদ্যসামগ্রীর আকালে দরিদ্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নিঃসন্দেহে। তৃতীয়ত, ইতিমধ্যেই বিশ্ব অর্থবাজারে বেশ টালমাটাল অবস্থা দেখা দিয়েছে। নানান বিনিময়পত্রের দাম পড়ে গেছে, আর্থিক বাজারের গতিবিধি নিম্নমুখী, যাকে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্থবির হয়ে আছে।
মধ্যমেয়াদে আবারও তিনটি প্রবণতার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। প্রথমত, বৈশ্বিক একটি মন্দা দেখা দেবে। তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা হয়তো অভাবনীয় হবে। এ মন্দার ফলে দরিদ্র দেশগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত, দেশের মধ্যে উৎপাদনকাঠামো আরও বিপর্যস্ত হবে। যার ফলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান আরও সংকুচিত হবে। শ্রমজীবী মানুষ সেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জালে নিষ্পেষিত হবে। তৃতীয়ত, বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাবেন।
দীর্ঘ মেয়াদে এ বছরে কৃষিকাজে কর্মযজ্ঞ না হওয়ায় আগামী বছরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আকাল বা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দীর্ঘ মেয়াদে এমনও হতে পারে যে, কর্তৃত্ববাদী অর্থনীতিগুলোই হয়তো সমস্যার সমাধান দ্রুত ও অল্প আয়াসে করতে পারবে। সেটা যদি হয়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন হতে পারে।
সামাজিক দিক থেকে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হওয়ায় মানসিক চাপ পড়ছে সবার ওপরে। এর ফলে মানুষের ধৈর্য ও সহনশীলতা যেমন লুপ্ত হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে সহিংসতা ঘরে-বাইরে। শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি উদ্বেগজনক। বিদ্যালয়ে যেতে না পেরে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে না পেরে, একদিকে যেমন তারা বিষণ্ন হচ্ছে, খিটখিটে হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে সামাজিক পটুতা হারাচ্ছে। তরুণেরা তাদের অদম্য প্রাণশক্তিকে অবরুদ্ধ অবস্থায় কেমন করে ব্যবহার করবে, তা জানে না। সত্যিকার অর্থে তাদের মনোজগতে একটা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন মনোবৈকল্যের সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা।
আগে আমরা বাইরে বেরোলে দেখে নিতাম সঙ্গে চাবি, চশমা, মোবাইল ফোন আছে কি না। এখন দেখি পরিষ্কারক, মুখাবরণী ও দস্তানা আছে কি না। আগে মোবাইল ফোন বাড়িতে ফেলে গেলে যে রকম অসহায় বোধ করতাম, এখন পরিষ্কারক, মুখাবরণী আর দস্তানা ফেলে গেলে তেমনই বোধ করি। হাত হয়ে উঠেছে আমাদের সবচেয়ে সুযত্ন সংরক্ষিত অঙ্গ এবং হাত ও মুখের বিচ্ছেদের জন্য আমাদের বর্তমান সচেষ্ট থাকার প্রয়াস এখন রূপান্তরিত হয়েছে স্বাভাবিক অভ্যাসে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে করোনার অভিঘাত কী পড়বে? বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে করোনার অভিঘাত কী হবে? বলা বাহুল্য, বৈশ্বিক অভিঘাতের বিষয়গুলো বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব ফেলবে।
করোনার কারণে বাংলাদেশের এ পর্যন্ত অর্জিত অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়ন বিঘ্নিত হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
করোনার কারণে আরও অতিরিক্ত ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শতাংশের বিচারে বাংলাদেশেও গত তিন দশকে চরম দারিদ্র্যের হার ৪৪ থেকে ২১ শতাংশে নেমে এসেছিল। গত সাত বছরে ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে পেরেছে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন যে, করোনার ফলে এটা বেড়ে আবার ৪০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে।
করোনার কারণে বাংলাদেশে ১৬ লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে পারে। গত বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত পোশাকশিল্পে ৭০ হাজার কর্মসংস্থান হারিয়ে গেছে এবং এ বছরের শেষ পর্যন্ত আরও ১০ লাখ কর্মসংস্থান হারিয়ে যাবে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। করোনা অতিমারি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুরতাকে দৃশ্যমান করেছে এবং ভবিষ্যতে এ নাজুকতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাদান কাঠামো শিক্ষায় বর্তমান অসমতার ব্যাপ্তি ও গভীরতা আরও বাড়াতে পারে। কারণ, প্রযুক্তির লভ্যতা গ্রামীণ অঞ্চল ও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের কাছে অনেক কম হবে। সেই সঙ্গে এটাও সত্যি যে, আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে এবং গৃহাভ্যন্তরে নারীর ওপরে করোনার অসম প্রভাব পড়বে। আনুষ্ঠানিক খাতে নারীরা সবার আগে কর্মচ্যুত হয়েছে এবং যখন অর্থনীতি সচল হবে, তখন সবার শেষে নারীরা কর্মসুযোগ পাবে।
করোনা সংকটের কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে তিনটি প্রভাব পড়বে। প্রথমত, আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধির দুটো মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে পোশাক রপ্তানি ও বহির্বিশ্বে কর্মরত বাঙালি শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা সংকটের কারণে দুটো চালিকাশক্তির ওপরে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এর ফলে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার কমে আসবে এবং অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে। মন্দার কারণে কর্মসংস্থান কমে যাবে এবং বেকারত্ব বাড়বে। পোশাকশিল্পের হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে পড়বেন এবং বিদেশে কর্মরত অদক্ষ শ্রমিকেরা কর্মহীন অবস্থায় দেশে ফিরবেন। এসব জনগোষ্ঠী ও তাঁদের পরিবারের ওপরে বিরাট অর্থনৈতিক চাপ পড়বে। সেই সঙ্গে বর্তমানে তেলের দাম যে বাড়ছে, তার ফলে বাংলাদেশকে তেল আমদানির জন্য একদিকে যেমন অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে, তেমনি মূল্যস্ফীতিতে এটা একটা বিরাট ভূমিকা রাখবে। এ বছর যদি কৃষি খাতে কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়, তাহলে আগামী বছর কৃষি উৎপাদন কমে গিয়ে খাদ্যসামগ্রীর লভ্যতা হ্রাস পেতে পারে। এর ফলে খাদ্যসংকটের সেসব প্রভাবের কিছু কিছু তো এখনই দেখা যাচ্ছে। গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ হওয়ায় বহু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন বন্ধ। দোকান খোলা নেই, কারখানায় কাজ হচ্ছে না, লোকজন বাইরে বেরোচ্ছে না। ফলে যাঁরা ‘দিন আনে দিন খায়’ তাদের আয়ের পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছেন দিনমজুর, রিকশাচালক, বাজারের ক্ষুদ্র বিক্রেতা, যাঁরা রাস্তার পাশে বেসাতি সাজিয়ে বসতেন এবং এমন অজস্র মানুষ। বহু বাড়িতে সাহায্যকারী গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। অবরুদ্ধ জীবনের বিরূপ প্রভাবের ফলাফল এটি। ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী দেউলিয়া হয়ে যাবেন। দিনের পর দিন সেসব প্রতিষ্ঠান নিষ্ক্রিয় থাকায় সেগুলো সচল থাকতে পারবে না। তাদের এমন কোনো সঞ্চয় নেই যে, তারা ক্রমাগত লস দিয়েও টিকে থাকতে পারবে।
বাংলাদেশে সংকটের আর্থসামাজিক প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে নানা কথা উঠে এসেছে–কর্মসংস্থানের ঘাটতি, আয়ের অপ্রতুলতা, সামাজিক সেবার অনুপস্থিতি ইত্যাদি। তবে যে সমস্যা সবচেয়ে প্রকট বলে আবির্ভূত হয়েছে, তা হলো খাদ্য অনিরাপত্তা, বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। তাদের কাজ নেই, আয় নেই, সঞ্চয় নেই–তারা দিন আনে দিন খায়। ফলে আয় ও সঞ্চয়ের অভাবে তাদের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, দেশের ৩০ শতাংশ বা ৫ কোটি মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে প্রায় এক কোটি পরিবার খাদ্যসংকটের শিকার হবে।
করোনার কারণে বাংলাদেশে অসমতা বৃদ্ধি পেতে পারে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে, বঞ্চিত ও সুবিধাভোগীদের মধ্যে এবং গ্রাম ও নগরের মধ্যে। বৈষম্য শুধু বাড়বে ফলাফলে নয় (যেমন আয়ের ক্ষেত্রে), অসমতা বাড়বে সুযোগের ক্ষেত্রেও (যেমন শিক্ষাসেবার ক্ষেত্রে)। কতগুলো নাজুক জনগোষ্ঠী (যেমন বৃদ্ধ জনগোষ্ঠী) এই অসমতা ও বৈষম্যের সবচেয়ে বড় শিকার হবে।
করোনার কারণে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে অসমতা বৃদ্ধির একটি চালিকাশক্তি হবে কর্মসংস্থান ও আয়ের প্রক্রিয়া। করোনাকালে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যারা দিন আনে দিন খায়, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শ্রমিক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা। করোনা যখন সবাইকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে, সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন বিঘ্নিত হয়েছে, তখন এ-জাতীয় মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট হয়েছে, তাদের আয়ের পথ রুদ্ধ হয়েছে। বিত্তবানদের মতো তাদের কোনো সঞ্চয়ও নেই, যা তারা ব্যবহার করতে পারেন জীবনধারণের জন্য। করোনা থেকে উত্তরণের কালেও বিত্তবানরা যত দ্রুত সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ তা পারবে না। যেমন বলা হচ্ছে, করোনার কারণে ভারতের অনানুষ্ঠানিক খাতে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বহির্বিশ্বে চাহিদা সংকোচনের কারণে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে ২০ লাখ কর্মী, যার বেশির ভাগই নারী, কাজ হারাতে পারে। ফলে, আয় ও ভোগের অসমতা বৃদ্ধি পাবে। (চলবে)
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
২ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
২ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
২ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে