অসীম মায়াময় সম্পর্ক

রুমা মোদক
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২১, ০৯: ২৫

প্রতিদিনই আগের দিনের রেকর্ড ভাঙা অতিমারি ক্লান্ত দিনে আমিও সহযাত্রী হলাম পরিসংখ্যানের। আক্রান্তের হারে পৃথিবীর হিসাবে যুক্ত হলাম আমিও। জ্বরের ঘোরে আমার বারবার বাবার মুখটা মনে পড়ে। আমি অসুস্থ হলে বাবা ঘুমাতেন না। এক অতিমানবিক শক্তিতে তিনি অফিস সেরে ক্লান্ত শরীরে সারা রাত আমার শুশ্রূষা করে আবার পরদিন অফিসে যেতেন। আমাদের তিন ভাইবোনের বেলায়ই এটা ঘটত, আর ব্যাপারটি আমাদের খুব অস্বাভাবিক মনে হতো না। আজ নিজে যখন মা হয়ে সন্তানের জন্য কখনো রাত জাগতে হয়, পরদিন টের পাই, কী কঠিন কাজটা বাবা করতেন হাসিমুখে অবলীলায়।

আয়নাবাজি ছবিটি দেখে ভাবছিলাম, পরিচালক এই থিম পেলেন কই! এ রকম কি এ দেশে হয়? নিশ্চয়ই এটা বিদেশি কোনো কাহিনির অনুকরণ। এই নিউজটা সামনে আসার আগে পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করিনি, এ দেশে সত্যি এটা ঘটে। একজনের হয়ে অন্যজন জেল খাটে। আমার অসুস্থতাজনিত শ্রান্তিকে আরও গভীর অমোচনীয় বিষাদে ঢেকে দিল চট্টগ্রামে ট্রাকচাপায় নিহত মিনু আক্তারের ঘটনাটি। আহারে, তিনটি সন্তানের তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তায় এক গর্ভধারিণী অনায়াসে বেছে নিলেন কারাজীবন। আহা! সন্তানের মুখে আহার তুলে দেওয়ার এই দায় তাঁকে কে দিয়েছে? এই সমাজ, সংসার, ব্যবস্থা? নাকি গর্ভে ধারণের জৈবিকতা? ইন্সটিংক্ট। যার থেকে মুক্তি নেই পৃথিবীর প্রাণিজগতের অধিকাংশ প্রাণীর। সৃষ্টির সেরা জীব দাবি করি নিজেদের; অথচ এখনো এমন সমাজ গড়ে তুলতে পারিনি, যে সমাজে সন্তান শুধু মায়ের নয়, সমাজের সম্পদ হয়। সন্তান শুধু মায়ের দায়িত্ব নয়, সমাজেরও দায়িত্ব। আমি নেটে ঘাঁটছিলাম, কোথাও এই সন্তানগুলোর পিতৃপরিচয় পাই কি না। না, পাইনি।

আমার ঘরের নবনিযুক্ত গৃহকর্মী মিনতি। তাঁর ছেলে নয়ন। বয়স ১০–১১। জিজ্ঞেস করলাম, নিজের নাম লিখতে পারো? না। স্কুলে যাওনি কোনো দিন? না। কী করো? চায়ের দোকানে কাজ করি। মাসে দুই হাজার টাকা আর এক বেলা ভাত। কী দিয়ে ভাত দেয়? এই মাছ, ডাল, সবজি—যা থাকে। সকালে কী খেয়ে দোকানে যাও? চা আর মুড়ি। রাতে ফিরে কী খাও? আলু ভর্তা আর ভাত। শোনো, লকডাউন উঠে গেলে মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন আসবে, আমি লিখতে-পড়তে শেখাব। মাথা নেড়ে সায় দিল ছেলেটি। জানতে চাইলাম, লেখাপড়া শিখে কী করবে? একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ছেলেটি জবাব দিল, ‘বাপরে গিয়া ধরুম।’ আমি থ মেরে তাকিয়ে থাকলাম ছেলেটির দিকে। আপাতনিরীহ, চুপচাপ, বিষণ্ন ছেলেটির ভেতরে কী তীব্র আগুন! মাত্র দুই বছরের ছেলেসহ মাকে বিদায় করে তার বাপ আরেকটা বিয়ে করেছে।

আমি কোভিড পজিটিভ জেনে নিউইয়র্ক থেকে ফোন করেছে জুহেনা। আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। বিয়ে করে ও আমাদের ছেড়ে গেছে প্রায় ত্রিশ বছর আগে। তখন স্কুলের পাট ফুরিয়েছে কি ফুরায়নি! তারপর সাকল্যে দেখা হয়েছে হয়তো বার দুয়েক। আমি যেবার নিউইয়র্কে গেলাম, সেবার ও পারিবারিক প্রোগ্রামে ফ্লোরিডায়। ফেসবুক থাকায় তবু দূরত্বটা দূরত্ব মনে হয় না ইদানীং। স্কুল লাগোয়া বাড়ি ওদের। সেই বালিকাবেলা থেকে দেখি জুহেনারা পরির মতো কয়েকজন বোন। ঘরে মা নেই। গেল বছর এমন দিনে, নিউইয়র্ক যখন লকডাউনে, জুহেনা গভীর রাতে ফোন দিত। ওর তখন সকাল। ওর আব্বার গল্প করছিল একদিন। বলছিল : ‘জানিস, আব্বা এখানে যখন ছিলেন, একদিন দেখি জায়নামাজে বসে কাঁদছেন। আমাকে বলছেন, “মা রে, আমারে মাফ করে দিস।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন আব্বা?” আব্বা বললেন, “ঘরে তোমাদের মা ছিল না। 
তোমরা অপূর্ব রূপবতী মেয়ে আমার। যদি ঠিকমতো দেখাশোনা করতে না পারি, ভয়ে সবাইকে কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। লেখাপড়া করাতে পারিনি বেশি।” জুহেনার আম্মা যখন মারা যান, তখন ওর আব্বার বয়স আটত্রিশ। ছয় বোন আর এক ভাইয়ের সংসার আগলে রেখেছেন মাতৃস্নেহেই। প্রায় নব্বই বছর বয়সে গত বছর তিনি মারা গেছেন। ‘আমার, বোনদের ছেলেমেয়েরা সব উচ্চশিক্ষিত—আব্বা দেখে গেছেন।’ বলতে বলতে কাঁদছিল জুহেনা।

শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, পিতৃত্ব কী অসীম মায়াময়, মানবিক এক সম্পর্ক। শুধু গড়তে জানলে। 
 (এখানে ব্যবহৃত সবই ছদ্মনাম) 

লেখক: সাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রংপুরে সাবেক দুই এমপিসহ আ.লীগ-জাতীয় পার্টির ৩৯ নেতা-কর্মীর নামে মামলা

‘এই দিন দিন না, আরও দিন আছে’, আদালতে বললেন কামরুল

ট্রেনে ঢিল ছোড়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করল তিতুমীরের শিক্ষার্থীরা

প্রথমবার ব্যর্থ, পরদিন ভোরে হাসপাতালের ১৬ তলা থেকে লাফিয়ে যুবকের আত্মহত্যা

রাজনৈতিক দলকে শাস্তির আওতায় আনতে আইন সংশোধন হচ্ছে: আসিফ নজরুল

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত