মর্তুজা হাসান সৈকত
করোনাভাইরাস মহামারির পর এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট সম্ভবত ধর্মের নামে রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা। ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলো হেফাজতে ইসলাম নামের একটি কথিত অরাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে এক ছাতার নিচে জড়ো হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনায় কুঠারাঘাত করতে চেয়েছিল। সরকার তাদের সেই পরিকল্পনা ধূলিসাৎ করে দিলে সাপের খোলস পাল্টানোর মতো আত্মরক্ষার্থে সংগঠনটি তাদের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
কমিটি বাতিলের এক দিন আগে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রচলিত সব ধরনের রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে সম্প্রতি বিলুপ্তির দেড় মাসের মাথায় কওমি মাদ্রাসার সেই শিক্ষকদের রেখেই ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করে হেফাজতে ইসলাম। কমিটির অবশিষ্টদের পরে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আগের কমিটির প্রায় ৯০ শতাংশ নেতা বর্তমান কমিটিতে বাদ পড়লেও আমির পদে জুনায়েদ বাবুনগরী এবং মহাসচিব পদে নুরুল ইসলাম জিহাদী বহাল রয়েছেন। সদ্যঘোষিত এই কমিটিতে বিতর্কিত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীর আত্মীয়স্বজন ও অনুসারীদের জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নাশকতা-তাণ্ডবে মদতদাতা হিসেবে চিহ্নিত অনেকেই স্থান পেয়েছেন। মানে অনেকটা ‘যেই লাউ সেই কদু’ টাইপের কমিটি। নতুন কমিটিতে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানীকে লোক দেখানো কারণে স্থান দেওয়া হলেও তাঁর অনুসারীদের কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর সমর্থকেরা কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
হেফাজতের জন্ম নারীবিদ্বেষ দিয়ে। সরকার ২০০৯ সালে নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করলে প্রথমবারের মতো হেফাজত তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। তবে তারা প্রথম আলোচনায় আসে সাত বছর আগে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রগতিশীল ছাত্র-জনতা শাহবাগে আন্দোলনে নামলে আহমেদ শফীর নেতৃত্বে তাদের বিরুদ্ধে ১৩ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে নামে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। একপর্যায়ে ৫ মে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে শাপলা চত্বরে লাখো মানুষ জমায়েত করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সেদিন তাদের মিত্র ছিল সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। তখন হেফাজতের তৎকালীন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ হয়েছিল বলেও খবর এসেছে। খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন, হেফাজতি অভ্যুত্থান দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যাবে। এ জন্য তারা হেফাজতকে সব রকমের সাহায্য–সহযোগিতা করে। কিন্তু সরকারের পতন ঘটেনি। গভীর রাতে পুলিশ হেফাজত কর্মীদের ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে। তখন বিএনপি ও হেফাজত উভয় নেতৃত্বই নিরাশ হয়েছিল।
তবে শাপলা চত্বরের নাশকতার পর হেফাজতের সঙ্গে সরকারের একটি গোপন সমঝোতা হয় বলে অনেকেই মনে করেন। সেই সমঝোতার পেছনে নানা লেনদেন, জমি বরাদ্দের কথাও প্রচলিত আছে। পাশাপাশি তাদের এমন কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা হয়, কওমি সনদকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আবেগে গদগদ হয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফী বিশাল সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেন। তিনি মঞ্চে উঠে শেখ হাসিনার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়াও চেয়েছিলেন ওই সময়।
তবে গত বছর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় রীতিমতো ক্যু করে জুনায়েদ বাবুনগরী–মামুনুল হকরা ক্ষমতা দখল করলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। হেফাজতের সরকারবিরোধী অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আহমদ শফীর অনুসারীদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। নতুন আমির হিসেবে নিয়ে আসা হয় আহমদ শফী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি জুনায়েদ বাবুনগরীকে। বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে জড়িতদের প্রাধান্য দেওয়া হয় কমিটিতে। হেফাজত সরকারবিরোধী অবস্থান দৃশ্যমান করে তোলে। যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ আরও কয়েকজন উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হেফাজতের নেতৃত্বে এসে ওয়াজ মাহফিলের নামে দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালাতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য আসে। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার আস্ফালনও তোলে। সরকার দোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে পিছিয়ে এলে হেফাজত আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। অতঃপর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করতে নেমে ২৬ মার্চ থেকে দেশে যে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালায়, সেটি ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বর, বায়তুল মোকাররম, পল্টনে ঘটে যাওয়া তাণ্ডবের কথা আবার দেশবাসীকে মনে করিয়ে দেয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের আড়ালে ফের সক্রিয় হচ্ছিল জঙ্গিরা। নেপথ্যে এসবের কলকাঠি নেড়েছে জামায়াতে ইসলামী। আর এই সময়ে হেফাজতে ইসলামের অর্থের প্রধান জোগানদাতা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জামায়াত। গত বছর সংবাদ সম্মেলন করে প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর একদল অনুসারী দাবি করেছিলেন, সংগঠনটির নেতৃত্ব জামায়াত-বিএনপির প্রেসক্রিপশনে চলছে। তদুপরি হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে ব্যাংককে বিএনপি নেতাদের গোপন বৈঠক ও নাশকতার ষড়যন্ত্রও ফাঁস হয়েছে। আরও জানা গেছে, ব্যাংকক ষড়যন্ত্রের ছক কষা হয়েছিল লন্ডন থেকে। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য হেফাজতের নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সহিংস সন্ত্রাসের তাণ্ডব চালানো হবে।
এই সবকিছুর ইক্যুয়েশন বলছে, হেফাজতকে এবার আর ছাড় দেওয়ার অবস্থা নেই। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে সরকারও কেবল গ্রেপ্তার করেই বসে থাকেনি, টান দিয়েছে হেফাজতের শক্তির আসল উৎস ধরে। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। মামুনুলের ব্যাংক হিসাবে এক বছরে ৬ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। একজন মাদ্রাসাশিক্ষক কীভাবে, কোত্থেকে এত টাকা পান? তদুপরি হেফাজতে ইসলামকে বিভিন্ন সময়ে অর্থের জোগান দিয়ে সহযোগিতা করেছেন এমন ৩১৩ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এসব টাকা মামুনুল হকের দুই ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে। এর পাশাপাশি জুনায়েদ বাবুনগরীসহ বিলুপ্ত কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের ৪৬ নেতা–কর্মীর সম্পদের তথ্য চেয়ে সরকারের চারটি দপ্তরে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অজ্ঞাত উৎস থেকে অর্থপ্রাপ্তি, পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগসহ যেসব তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পেয়েছে, গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তার ভিত্তিতে সরকার কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেটাই এখন দেখার বিষয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার তার অবস্থান ধরে রাখলে হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কমিটির যেসব নেতা সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে নানা সন্ত্রাসী কাজে সংশ্লিষ্ট থেকেছেন, ভিন্ন দেশ থেকে টাকাসহ সমর্থন পেয়ে বাংলাদেশবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে গেছেন, তাঁরা এবার শাস্তি এড়াতে পারবেন না।
বিশ্বে ওআইসির সদস্যভুক্ত ৫৭টি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আছে। কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর আফগানিস্তান ছাড়া অন্য কোনো দেশে ইসলামের নামে এমন সন্ত্রাস করা হয় না। সেখানে এমন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর কোনো কওমি মাদ্রাসা নেই। তদুপরি বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোকে হেফাজতে ইসলাম নামধারী সংগঠনটি যেভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছে, এ রকম নজিরও পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
এই মাদ্রাসাগুলোতে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। বলতে গেলে রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র। তারা জাতীয় সংগীত মানে না, সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত মানে না। কিন্তু সেখানে বলাৎকার, ধর্ষণের মতো ভয়ংকর গুনাহের কাজ চলে দেদার। হেফাজত নেতারা দুনিয়ার সব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালেও নিজেদের এসব দোষ চোখে দেখতে পান না। তাঁরা বাংলাদেশকে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ উল্লেখ করে কথায় কথায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কটাক্ষ করেন।
অথচ তাঁদের কে বোঝাবে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) তো শুধু আল্লাহর নবী ছিলেন না, তিনি রাষ্ট্রপ্রধানও ছিলেন। তাঁর রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস ছিল। তিনি কখনো তাঁর শাসিত রাষ্ট্রকে ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেননি বা অন্য ধর্মাবলম্বীর ধর্ম পালনে বাধা দেননি।
বর্তমানে সরকার হার্ডলাইনে থাকার কারণে হেফাজত কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তবে এতে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। কারণ, মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতাবিরোধী এই অপশক্তি সুযোগ পেলে আবারও ছোবল দেবে। বিপদে পড়েছে বলেই এখন তাদের সুর নরম। চাপের মুখে তারা কৌশল বদল করলেও বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। এদের উদ্দেশ্য ইসলামের হেফাজত নয়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। তাই এই কুচক্রীদের অশুভ তৎপরতা এখনই বন্ধ করতে হবে। সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে এই সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানপন্থীদের মোকাবিলা করতে হবে, অন্যথায় বিপদ অনিবার্য।
লেখক: কবি, কলামিস্ট
করোনাভাইরাস মহামারির পর এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট সম্ভবত ধর্মের নামে রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা। ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলো হেফাজতে ইসলাম নামের একটি কথিত অরাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে এক ছাতার নিচে জড়ো হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনায় কুঠারাঘাত করতে চেয়েছিল। সরকার তাদের সেই পরিকল্পনা ধূলিসাৎ করে দিলে সাপের খোলস পাল্টানোর মতো আত্মরক্ষার্থে সংগঠনটি তাদের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে।
কমিটি বাতিলের এক দিন আগে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রচলিত সব ধরনের রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে সম্প্রতি বিলুপ্তির দেড় মাসের মাথায় কওমি মাদ্রাসার সেই শিক্ষকদের রেখেই ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করে হেফাজতে ইসলাম। কমিটির অবশিষ্টদের পরে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আগের কমিটির প্রায় ৯০ শতাংশ নেতা বর্তমান কমিটিতে বাদ পড়লেও আমির পদে জুনায়েদ বাবুনগরী এবং মহাসচিব পদে নুরুল ইসলাম জিহাদী বহাল রয়েছেন। সদ্যঘোষিত এই কমিটিতে বিতর্কিত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীর আত্মীয়স্বজন ও অনুসারীদের জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নাশকতা-তাণ্ডবে মদতদাতা হিসেবে চিহ্নিত অনেকেই স্থান পেয়েছেন। মানে অনেকটা ‘যেই লাউ সেই কদু’ টাইপের কমিটি। নতুন কমিটিতে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানীকে লোক দেখানো কারণে স্থান দেওয়া হলেও তাঁর অনুসারীদের কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর সমর্থকেরা কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
হেফাজতের জন্ম নারীবিদ্বেষ দিয়ে। সরকার ২০০৯ সালে নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করলে প্রথমবারের মতো হেফাজত তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। তবে তারা প্রথম আলোচনায় আসে সাত বছর আগে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রগতিশীল ছাত্র-জনতা শাহবাগে আন্দোলনে নামলে আহমেদ শফীর নেতৃত্বে তাদের বিরুদ্ধে ১৩ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে নামে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। একপর্যায়ে ৫ মে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে শাপলা চত্বরে লাখো মানুষ জমায়েত করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সেদিন তাদের মিত্র ছিল সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। তখন হেফাজতের তৎকালীন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ হয়েছিল বলেও খবর এসেছে। খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন, হেফাজতি অভ্যুত্থান দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যাবে। এ জন্য তারা হেফাজতকে সব রকমের সাহায্য–সহযোগিতা করে। কিন্তু সরকারের পতন ঘটেনি। গভীর রাতে পুলিশ হেফাজত কর্মীদের ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে। তখন বিএনপি ও হেফাজত উভয় নেতৃত্বই নিরাশ হয়েছিল।
তবে শাপলা চত্বরের নাশকতার পর হেফাজতের সঙ্গে সরকারের একটি গোপন সমঝোতা হয় বলে অনেকেই মনে করেন। সেই সমঝোতার পেছনে নানা লেনদেন, জমি বরাদ্দের কথাও প্রচলিত আছে। পাশাপাশি তাদের এমন কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা হয়, কওমি সনদকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আবেগে গদগদ হয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফী বিশাল সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেন। তিনি মঞ্চে উঠে শেখ হাসিনার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়াও চেয়েছিলেন ওই সময়।
তবে গত বছর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় রীতিমতো ক্যু করে জুনায়েদ বাবুনগরী–মামুনুল হকরা ক্ষমতা দখল করলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। হেফাজতের সরকারবিরোধী অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আহমদ শফীর অনুসারীদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। নতুন আমির হিসেবে নিয়ে আসা হয় আহমদ শফী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি জুনায়েদ বাবুনগরীকে। বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে জড়িতদের প্রাধান্য দেওয়া হয় কমিটিতে। হেফাজত সরকারবিরোধী অবস্থান দৃশ্যমান করে তোলে। যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ আরও কয়েকজন উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হেফাজতের নেতৃত্বে এসে ওয়াজ মাহফিলের নামে দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালাতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য আসে। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার আস্ফালনও তোলে। সরকার দোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে পিছিয়ে এলে হেফাজত আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। অতঃপর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করতে নেমে ২৬ মার্চ থেকে দেশে যে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালায়, সেটি ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বর, বায়তুল মোকাররম, পল্টনে ঘটে যাওয়া তাণ্ডবের কথা আবার দেশবাসীকে মনে করিয়ে দেয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের আড়ালে ফের সক্রিয় হচ্ছিল জঙ্গিরা। নেপথ্যে এসবের কলকাঠি নেড়েছে জামায়াতে ইসলামী। আর এই সময়ে হেফাজতে ইসলামের অর্থের প্রধান জোগানদাতা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জামায়াত। গত বছর সংবাদ সম্মেলন করে প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর একদল অনুসারী দাবি করেছিলেন, সংগঠনটির নেতৃত্ব জামায়াত-বিএনপির প্রেসক্রিপশনে চলছে। তদুপরি হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে ব্যাংককে বিএনপি নেতাদের গোপন বৈঠক ও নাশকতার ষড়যন্ত্রও ফাঁস হয়েছে। আরও জানা গেছে, ব্যাংকক ষড়যন্ত্রের ছক কষা হয়েছিল লন্ডন থেকে। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য হেফাজতের নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সহিংস সন্ত্রাসের তাণ্ডব চালানো হবে।
এই সবকিছুর ইক্যুয়েশন বলছে, হেফাজতকে এবার আর ছাড় দেওয়ার অবস্থা নেই। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে সরকারও কেবল গ্রেপ্তার করেই বসে থাকেনি, টান দিয়েছে হেফাজতের শক্তির আসল উৎস ধরে। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। মামুনুলের ব্যাংক হিসাবে এক বছরে ৬ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। একজন মাদ্রাসাশিক্ষক কীভাবে, কোত্থেকে এত টাকা পান? তদুপরি হেফাজতে ইসলামকে বিভিন্ন সময়ে অর্থের জোগান দিয়ে সহযোগিতা করেছেন এমন ৩১৩ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এসব টাকা মামুনুল হকের দুই ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে। এর পাশাপাশি জুনায়েদ বাবুনগরীসহ বিলুপ্ত কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের ৪৬ নেতা–কর্মীর সম্পদের তথ্য চেয়ে সরকারের চারটি দপ্তরে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অজ্ঞাত উৎস থেকে অর্থপ্রাপ্তি, পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগসহ যেসব তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পেয়েছে, গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তার ভিত্তিতে সরকার কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেটাই এখন দেখার বিষয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার তার অবস্থান ধরে রাখলে হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কমিটির যেসব নেতা সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে নানা সন্ত্রাসী কাজে সংশ্লিষ্ট থেকেছেন, ভিন্ন দেশ থেকে টাকাসহ সমর্থন পেয়ে বাংলাদেশবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে গেছেন, তাঁরা এবার শাস্তি এড়াতে পারবেন না।
বিশ্বে ওআইসির সদস্যভুক্ত ৫৭টি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আছে। কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর আফগানিস্তান ছাড়া অন্য কোনো দেশে ইসলামের নামে এমন সন্ত্রাস করা হয় না। সেখানে এমন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর কোনো কওমি মাদ্রাসা নেই। তদুপরি বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোকে হেফাজতে ইসলাম নামধারী সংগঠনটি যেভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছে, এ রকম নজিরও পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
এই মাদ্রাসাগুলোতে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। বলতে গেলে রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র। তারা জাতীয় সংগীত মানে না, সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত মানে না। কিন্তু সেখানে বলাৎকার, ধর্ষণের মতো ভয়ংকর গুনাহের কাজ চলে দেদার। হেফাজত নেতারা দুনিয়ার সব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালেও নিজেদের এসব দোষ চোখে দেখতে পান না। তাঁরা বাংলাদেশকে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ উল্লেখ করে কথায় কথায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কটাক্ষ করেন।
অথচ তাঁদের কে বোঝাবে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) তো শুধু আল্লাহর নবী ছিলেন না, তিনি রাষ্ট্রপ্রধানও ছিলেন। তাঁর রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস ছিল। তিনি কখনো তাঁর শাসিত রাষ্ট্রকে ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেননি বা অন্য ধর্মাবলম্বীর ধর্ম পালনে বাধা দেননি।
বর্তমানে সরকার হার্ডলাইনে থাকার কারণে হেফাজত কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তবে এতে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। কারণ, মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতাবিরোধী এই অপশক্তি সুযোগ পেলে আবারও ছোবল দেবে। বিপদে পড়েছে বলেই এখন তাদের সুর নরম। চাপের মুখে তারা কৌশল বদল করলেও বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। এদের উদ্দেশ্য ইসলামের হেফাজত নয়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। তাই এই কুচক্রীদের অশুভ তৎপরতা এখনই বন্ধ করতে হবে। সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে এই সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানপন্থীদের মোকাবিলা করতে হবে, অন্যথায় বিপদ অনিবার্য।
লেখক: কবি, কলামিস্ট
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১৬ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১৬ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১৬ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ দিন আগে