ড. নাদির জুনাইদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হাফিজুর রহমান গত মাসে মারা যান। জানা যায়, তিনি এক ডাব বিক্রেতার দা কেড়ে নিয়ে নিজের গলায় নিজেই আঘাত করেছিলেন। এ ঘটনার আগে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে নিষিদ্ধ ড্রাগ এলএসডি সেবন করিয়েছিল—পুলিশের অনুসন্ধানে এই তথ্য বেরিয়ে আসে। মানুষের মগজে সেরোটনিন বলে একটি রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা মানুষকে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে এবং স্বাভাবিক আচরণ করতে সাহায্য করে। এলএসডি সেবন করলে তা কিছুক্ষণের জন্য মস্তিষ্কে সেরোটনিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যার ফলে মানুষের মনে তৈরি হয় এক মায়া আর বিভ্রমের অনুভূতি। কিছু সময়ের জন্য সুস্থভাবে চিন্তা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ, এই ড্রাগের প্রভাবে মানুষ চলে যায় ঘোরের মধ্যে। সে দেখতে পায় উদ্ভট, অবাস্তব দৃশ্য। এলএসডি সেবন এবং বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ প্রথমে গ্রেপ্তার করে তিনজনকে, পরে আরও পাঁচজনকে। তাঁরা সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জানা যায়, ঢাকায় প্রায় ১৫টি গ্রুপ আছে, যারা এলএসডি বিক্রি করছে।
পুলিশ সদস্যরা যখন পাঁচ ছাত্রের হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সেই ছাত্রদের মুখে লজ্জার সামান্যতম ছাপ ছিল না। ড্রাগ কেনাবেচার মতো নিন্দনীয় অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও পুলিশের গাড়িতে বসে সেই ছাত্ররা হাসছিল বেহায়ার মতো। এই দৃশ্য দেখে বিস্মিত এবং হতবাক হয়েছে বহু মানুষ। কতটা রুচিহীন হয়ে উঠেছে আমাদের সমাজেরই কিছু তরুণ—তা ভাবলে ব্যথিত হতে হয়। দেশে কিশোর গ্যাংয়ের নানা অপরাধ নিয়ে প্রায়ই সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। পাঁচ বছর আগে হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। সেই হামলায় নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিকার ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন কয়েকজন তরুণ। কম বয়সেই ধর্মান্ধ হয়ে ওঠা সেই তরুণেরা মনে করেছিলেন, সেই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা ধর্মের জন্য কাজ করছে এবং নিরীহ মানুষ হত্যা করার মাধ্যমে পাপ নয়, তাঁঁরা অর্জন করছেন পুণ্য। সেই তরুণেরাও ছাত্র ছিল; কিন্তু তাঁদের মনে কোনো বিবেচনাবোধ তৈরি হয়নি। যে কারণে ধর্মীয় উগ্রচিন্তার বক্তব্য
দিয়ে সহজেই তাঁদের মগজধোলাই করা সম্ভব হয়েছিল।
স্মার্টফোন সহজলভ্য হয়ে ওঠার এই সময়ে আমাদের সমাজে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে, ধর্ষণের ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য অপরাধের কথা। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কী করে সংহত করা যায়, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়, মানবাধিকার নিশ্চিত করা যায়, দূর করা যায় অর্থনৈতিক শোষণ আর দুর্নীতি—এমন বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রায়ই অনুষ্ঠিত হচ্ছে নানা ওয়েবিনার, লেখা হচ্ছে সংবাদপত্রের কলাম। কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ যে তরুণরা তাদের অনেকের মন এখন কতটা অন্ধ, অনুভূতিহীন এবং রুচি কতটা কুৎসিত হয়ে উঠেছে, তা যখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, তখন এই প্রশ্ন করাই জরুরি হয়ে ওঠে যে, দেশের বহু কম বয়সীর, এমনকি যারা রাজধানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে—এমন অনেক শিক্ষার্থীরও কি আদৌ রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে ভাবার মন তৈরি হয়েছে? তারা কি জানে, নিজ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং নিজ সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে? তারা কি অনুধাবন করছে, বিবেচনাবোধ আর সুরুচির গুরুত্ব?
কম বয়সীদের মন আর রুচি তৈরিতে শুধু পরিবার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ভূমিকা রাখে না, কম বয়সীদের মন গভীরভাবে প্রভাবিত হয় বিদ্যমান সাংস্কৃতিক পরিবেশের মাধ্যমে। এই সময়ে তরুণদের মন বহুলাংশে প্রভাবিত হচ্ছে সদাসর্বদা উপস্থিত মূলধারার গণমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ার উপাদান দ্বারা। মানুষের মনে গণমাধ্যমসৃষ্ট বার্তার প্রভাব যেহেতু প্রবল, তাই গণমাধ্যমের উপাদান দর্শকের চিন্তায় আর রুচিতে কী প্রভাব রাখবে—তা নিয়ে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রশ্ন করতে হয়, বাংলাদেশে গত এক দশকে যে চলচ্চিত্র এবং বিভিন্ন টেলিভিশন নাটক তৈরি হয়েছে, সেখানে কি সমাজের প্রকৃত বাস্তবতা এবং গুরুতর সমস্যাসমূহ ঢেকে রেখে হালকা বিনোদন উপস্থাপনের দিকটিই প্রাধান্য পায়নি? শুধু মূলধারার নাচ-গাননির্ভর বাণিজ্যিক ছবিতে নয়, মূলধারার ইন্ডাস্ট্রির বাইরে তৈরি করা বিভিন্ন ছবিতেও প্রাধান্য পেয়েছে চটক, চাকচিক্য এবং কখনো অবাস্তব কাহিনি। অথচ সংবাদপত্রে এই ধরনের ছবিরই প্রশংসা করা হয়েছে। ফলে, বহু দর্শকের মনে তৈরি হয়েছে এমন ধারণা—চলচ্চিত্র বিনোদনধর্মী একটি মাধ্যম।
দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত নাটকে তারল্যনির্ভর সংলাপ, লঘু বিনোদন, আর অগভীর গতানুগতিক কাহিনি দিন দিন এতটাই নিয়মিত হয়ে উঠেছে, যা আগে কখনোই দেখা যায়নি। ১৯৮০-র দশকে বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদ রচিত বিভিন্ন নাটকেও হাস্যরস ছিল। খুবই দর্শকপ্রিয় ধারাবাহিক ‘বহুব্রীহি’-তে আলী যাকের, আফজাল হোসেন, মাহমুদা খাতুন, আফজাল শরীফ, নাজমুল হুদা প্রমুখ শক্তিমান অভিনয়শিল্পীর মাধ্যমে যেভাবে বারবার হাস্যরস উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের। সেখানে রুচির দীনতা ছিল না; বরং ছিল কল্পনাশক্তির আকর্ষণীয় ব্যবহার। হাস্যরস এবং বিনোদনের রুচিশীল উপস্থাপন তখন আমরা দেখেছি আরও অনেক নাটকে। কিন্তু বর্তমান সময়ের বিভিন্ন টেলিভিশন নাটকেই হাস্যরস আর বিনোদন হয়ে উঠেছে স্থূলতাসর্বস্ব এবং চটুল। বর্তমান সময়ের বিভিন্ন নাটকের হালকা নামও নির্দেশ করে নাটকের বিষয়বস্তু কেমন হবে।
এমন নাটকের নিয়মিত প্রচার বহু দর্শকের চিন্তা এবং রুচি কীভাবে প্রভাবিত করছে, তা কি ভেবে দেখছি আমরা?
রূপকের মাধ্যমে শাসকের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের সমালোচনা তুলে ধরেছিলেন জহির রায়হান তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আর অন্ধচিন্তার সমালোচনা সাহসীভাবে তুলে ধরেছিলেন তারেক মাসুদ নিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’য়। আলমগীর কবির তাঁর ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘রূপালী সৈকতে’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে সমাজের নানা সমস্যা নিয়ে বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর ছবিতেও বিনোদন ছিল; কিন্তু বিনোদন প্রদানের পরিবর্তে মুখ্য হয়ে উঠেছিল বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার বিশ্লেষণ। সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর ‘ঘুড্ডি’ ছবিতেও তরুণ নায়ক-নায়িকার রোমান্টিক সম্পর্কের কাহিনি দেখানোর মধ্যে পরিচালক প্রকাশ করেছিলেন রাজনৈতিক বক্তব্য। ঠিক যেভাবে হুমায়ূন আহমেদ ‘বহুব্রীহি’ নাটকে একটি পরিবারের কাহিনি দেখানোর মধ্যেই প্রকাশ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংহত করার মতো বক্তব্য। এই নাটকেই ব্যবহৃত হয়েছিল ‘তুই রাজাকার’ কথাটি। মসিহউদ্দিন শাকের আর শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের কাহিনি প্রকাশ করেছিল শক্তিশালীভাবে। উল্লেখ্য, এই সব ছবিতেই নির্মাণশৈলী ছিল নান্দনিকভাবে নতুন এবং চিন্তাশীল। কখনো ব্যবহার করা হয়েছিল বিভিন্ন জটিল চলচ্চিত্র-কৌশল, যা দর্শকের রুচির মান এবং চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করেছে।
মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য প্রাধান্য দিয়ে দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য অগভীর, চটকদার উপাদান সেসব ছবিতে ব্যবহার করা হয়নি। বর্তমান সময়ের বহু তরুণ-তরুণী কি অতীতে আমাদের দেশে তৈরি রাজনৈতিক এবং শৈল্পিক দুই দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র আর নাটকগুলোর কথা জানে? তারা কি দেখেছে ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘লিবারেশন ফাইটার্স’, ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’, ‘মেজর খালেদ’স ওয়ার’, ‘মুক্তির গান’ প্রভৃতি তথ্যচিত্র? দেশের বহু কম বয়সী কি সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য বাঙালি চলচ্চিত্রকারের ছবির সঙ্গে পরিচিত? বর্তমান সময়ে দেশের খ্যাতিমান পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করার সময়ই দেখেছি বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়নরত বহু ছাত্রছাত্রীই এই ধরনের উঁচু মানের সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে পরিচিত নয়। অথচ বিনোদনধর্মী নাটক-চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাঁদের কাছে পরিচিত। কারণ, গণমাধ্যমে প্রচার বেশি পাচ্ছে তাঁরাই। বছরে শুধু কয়েকটি বিশেষ দিনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্র প্রচার করলে আর কদাচিৎ কোনো শক্তিশালী চলচ্চিত্র গণমাধ্যমে দেখালে দর্শক চিন্তাঋদ্ধ সাংস্কৃতিক উপাদান গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে না।
উঁচু মানের চলচ্চিত্র দেখা এখন অনেক সহজ। কারণ, ইউটিউবে এবং বিভিন্ন অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে অতীতে এবং বর্তমান সময়ে নির্মিত ভালো চলচ্চিত্র দেখা যায়। কিন্তু হালকা বিনোদনধর্মী উপাদান অত্যধিক প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে দর্শকের রুচি নিয়ন্ত্রিত করে ফেলা হলে দর্শকেরা ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্মেও শুধু বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্রই দেখবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনেক উপকারী দিক আছে। কিন্তু আমাদের দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই দেখা যায়, অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ পোস্ট। করা হয় অত্যন্ত অশালীন, অসহিষ্ণু এবং আক্রমণাত্মক মন্তব্য। কখনো আপলোড করা হয় কুরুচিপূর্ণ ছবি আর ভিডিও। যাঁরা লেখাপড়া জানেন, তাঁরাই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধরনের উপাদান নিয়মিত দেখার পর অনেক মানুষের রুচি আর চিন্তার নিম্নগামিতা সম্পর্কে আমাদের শঙ্কিত হতে হয়।
গণমাধ্যম-প্রভাবিত বর্তমান সময়ের সাংস্কৃতিক পরিবেশে সচেতনভাবে মানুষের মনে সুরুচি আর চিন্তাশীলতা তৈরির উদ্যোগ না নেওয়া হলে ধীরে ধীরে সমাজ এগিয়ে যাবে গভীর বিপদের দিকে। সেই বিপদের রূপ মাঝে মাঝেই স্পষ্ট হচ্ছে। আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ, চিন্তার এবং রুচির উন্নয়ন না ঘটলে সমাজের অন্য সব উন্নয়নই অর্থহীন হয়ে পড়বে।
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হাফিজুর রহমান গত মাসে মারা যান। জানা যায়, তিনি এক ডাব বিক্রেতার দা কেড়ে নিয়ে নিজের গলায় নিজেই আঘাত করেছিলেন। এ ঘটনার আগে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে নিষিদ্ধ ড্রাগ এলএসডি সেবন করিয়েছিল—পুলিশের অনুসন্ধানে এই তথ্য বেরিয়ে আসে। মানুষের মগজে সেরোটনিন বলে একটি রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা মানুষকে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে এবং স্বাভাবিক আচরণ করতে সাহায্য করে। এলএসডি সেবন করলে তা কিছুক্ষণের জন্য মস্তিষ্কে সেরোটনিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যার ফলে মানুষের মনে তৈরি হয় এক মায়া আর বিভ্রমের অনুভূতি। কিছু সময়ের জন্য সুস্থভাবে চিন্তা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ, এই ড্রাগের প্রভাবে মানুষ চলে যায় ঘোরের মধ্যে। সে দেখতে পায় উদ্ভট, অবাস্তব দৃশ্য। এলএসডি সেবন এবং বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ প্রথমে গ্রেপ্তার করে তিনজনকে, পরে আরও পাঁচজনকে। তাঁরা সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জানা যায়, ঢাকায় প্রায় ১৫টি গ্রুপ আছে, যারা এলএসডি বিক্রি করছে।
পুলিশ সদস্যরা যখন পাঁচ ছাত্রের হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সেই ছাত্রদের মুখে লজ্জার সামান্যতম ছাপ ছিল না। ড্রাগ কেনাবেচার মতো নিন্দনীয় অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও পুলিশের গাড়িতে বসে সেই ছাত্ররা হাসছিল বেহায়ার মতো। এই দৃশ্য দেখে বিস্মিত এবং হতবাক হয়েছে বহু মানুষ। কতটা রুচিহীন হয়ে উঠেছে আমাদের সমাজেরই কিছু তরুণ—তা ভাবলে ব্যথিত হতে হয়। দেশে কিশোর গ্যাংয়ের নানা অপরাধ নিয়ে প্রায়ই সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। পাঁচ বছর আগে হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। সেই হামলায় নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিকার ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন কয়েকজন তরুণ। কম বয়সেই ধর্মান্ধ হয়ে ওঠা সেই তরুণেরা মনে করেছিলেন, সেই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা ধর্মের জন্য কাজ করছে এবং নিরীহ মানুষ হত্যা করার মাধ্যমে পাপ নয়, তাঁঁরা অর্জন করছেন পুণ্য। সেই তরুণেরাও ছাত্র ছিল; কিন্তু তাঁদের মনে কোনো বিবেচনাবোধ তৈরি হয়নি। যে কারণে ধর্মীয় উগ্রচিন্তার বক্তব্য
দিয়ে সহজেই তাঁদের মগজধোলাই করা সম্ভব হয়েছিল।
স্মার্টফোন সহজলভ্য হয়ে ওঠার এই সময়ে আমাদের সমাজে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে, ধর্ষণের ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য অপরাধের কথা। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কী করে সংহত করা যায়, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়, মানবাধিকার নিশ্চিত করা যায়, দূর করা যায় অর্থনৈতিক শোষণ আর দুর্নীতি—এমন বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রায়ই অনুষ্ঠিত হচ্ছে নানা ওয়েবিনার, লেখা হচ্ছে সংবাদপত্রের কলাম। কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ যে তরুণরা তাদের অনেকের মন এখন কতটা অন্ধ, অনুভূতিহীন এবং রুচি কতটা কুৎসিত হয়ে উঠেছে, তা যখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, তখন এই প্রশ্ন করাই জরুরি হয়ে ওঠে যে, দেশের বহু কম বয়সীর, এমনকি যারা রাজধানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে—এমন অনেক শিক্ষার্থীরও কি আদৌ রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে ভাবার মন তৈরি হয়েছে? তারা কি জানে, নিজ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং নিজ সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে? তারা কি অনুধাবন করছে, বিবেচনাবোধ আর সুরুচির গুরুত্ব?
কম বয়সীদের মন আর রুচি তৈরিতে শুধু পরিবার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ভূমিকা রাখে না, কম বয়সীদের মন গভীরভাবে প্রভাবিত হয় বিদ্যমান সাংস্কৃতিক পরিবেশের মাধ্যমে। এই সময়ে তরুণদের মন বহুলাংশে প্রভাবিত হচ্ছে সদাসর্বদা উপস্থিত মূলধারার গণমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ার উপাদান দ্বারা। মানুষের মনে গণমাধ্যমসৃষ্ট বার্তার প্রভাব যেহেতু প্রবল, তাই গণমাধ্যমের উপাদান দর্শকের চিন্তায় আর রুচিতে কী প্রভাব রাখবে—তা নিয়ে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রশ্ন করতে হয়, বাংলাদেশে গত এক দশকে যে চলচ্চিত্র এবং বিভিন্ন টেলিভিশন নাটক তৈরি হয়েছে, সেখানে কি সমাজের প্রকৃত বাস্তবতা এবং গুরুতর সমস্যাসমূহ ঢেকে রেখে হালকা বিনোদন উপস্থাপনের দিকটিই প্রাধান্য পায়নি? শুধু মূলধারার নাচ-গাননির্ভর বাণিজ্যিক ছবিতে নয়, মূলধারার ইন্ডাস্ট্রির বাইরে তৈরি করা বিভিন্ন ছবিতেও প্রাধান্য পেয়েছে চটক, চাকচিক্য এবং কখনো অবাস্তব কাহিনি। অথচ সংবাদপত্রে এই ধরনের ছবিরই প্রশংসা করা হয়েছে। ফলে, বহু দর্শকের মনে তৈরি হয়েছে এমন ধারণা—চলচ্চিত্র বিনোদনধর্মী একটি মাধ্যম।
দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত নাটকে তারল্যনির্ভর সংলাপ, লঘু বিনোদন, আর অগভীর গতানুগতিক কাহিনি দিন দিন এতটাই নিয়মিত হয়ে উঠেছে, যা আগে কখনোই দেখা যায়নি। ১৯৮০-র দশকে বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদ রচিত বিভিন্ন নাটকেও হাস্যরস ছিল। খুবই দর্শকপ্রিয় ধারাবাহিক ‘বহুব্রীহি’-তে আলী যাকের, আফজাল হোসেন, মাহমুদা খাতুন, আফজাল শরীফ, নাজমুল হুদা প্রমুখ শক্তিমান অভিনয়শিল্পীর মাধ্যমে যেভাবে বারবার হাস্যরস উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের। সেখানে রুচির দীনতা ছিল না; বরং ছিল কল্পনাশক্তির আকর্ষণীয় ব্যবহার। হাস্যরস এবং বিনোদনের রুচিশীল উপস্থাপন তখন আমরা দেখেছি আরও অনেক নাটকে। কিন্তু বর্তমান সময়ের বিভিন্ন টেলিভিশন নাটকেই হাস্যরস আর বিনোদন হয়ে উঠেছে স্থূলতাসর্বস্ব এবং চটুল। বর্তমান সময়ের বিভিন্ন নাটকের হালকা নামও নির্দেশ করে নাটকের বিষয়বস্তু কেমন হবে।
এমন নাটকের নিয়মিত প্রচার বহু দর্শকের চিন্তা এবং রুচি কীভাবে প্রভাবিত করছে, তা কি ভেবে দেখছি আমরা?
রূপকের মাধ্যমে শাসকের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের সমালোচনা তুলে ধরেছিলেন জহির রায়হান তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আর অন্ধচিন্তার সমালোচনা সাহসীভাবে তুলে ধরেছিলেন তারেক মাসুদ নিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’য়। আলমগীর কবির তাঁর ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘রূপালী সৈকতে’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে সমাজের নানা সমস্যা নিয়ে বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর ছবিতেও বিনোদন ছিল; কিন্তু বিনোদন প্রদানের পরিবর্তে মুখ্য হয়ে উঠেছিল বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার বিশ্লেষণ। সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর ‘ঘুড্ডি’ ছবিতেও তরুণ নায়ক-নায়িকার রোমান্টিক সম্পর্কের কাহিনি দেখানোর মধ্যে পরিচালক প্রকাশ করেছিলেন রাজনৈতিক বক্তব্য। ঠিক যেভাবে হুমায়ূন আহমেদ ‘বহুব্রীহি’ নাটকে একটি পরিবারের কাহিনি দেখানোর মধ্যেই প্রকাশ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংহত করার মতো বক্তব্য। এই নাটকেই ব্যবহৃত হয়েছিল ‘তুই রাজাকার’ কথাটি। মসিহউদ্দিন শাকের আর শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের কাহিনি প্রকাশ করেছিল শক্তিশালীভাবে। উল্লেখ্য, এই সব ছবিতেই নির্মাণশৈলী ছিল নান্দনিকভাবে নতুন এবং চিন্তাশীল। কখনো ব্যবহার করা হয়েছিল বিভিন্ন জটিল চলচ্চিত্র-কৌশল, যা দর্শকের রুচির মান এবং চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করেছে।
মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য প্রাধান্য দিয়ে দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য অগভীর, চটকদার উপাদান সেসব ছবিতে ব্যবহার করা হয়নি। বর্তমান সময়ের বহু তরুণ-তরুণী কি অতীতে আমাদের দেশে তৈরি রাজনৈতিক এবং শৈল্পিক দুই দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র আর নাটকগুলোর কথা জানে? তারা কি দেখেছে ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘লিবারেশন ফাইটার্স’, ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’, ‘মেজর খালেদ’স ওয়ার’, ‘মুক্তির গান’ প্রভৃতি তথ্যচিত্র? দেশের বহু কম বয়সী কি সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য বাঙালি চলচ্চিত্রকারের ছবির সঙ্গে পরিচিত? বর্তমান সময়ে দেশের খ্যাতিমান পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করার সময়ই দেখেছি বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়নরত বহু ছাত্রছাত্রীই এই ধরনের উঁচু মানের সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে পরিচিত নয়। অথচ বিনোদনধর্মী নাটক-চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাঁদের কাছে পরিচিত। কারণ, গণমাধ্যমে প্রচার বেশি পাচ্ছে তাঁরাই। বছরে শুধু কয়েকটি বিশেষ দিনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্র প্রচার করলে আর কদাচিৎ কোনো শক্তিশালী চলচ্চিত্র গণমাধ্যমে দেখালে দর্শক চিন্তাঋদ্ধ সাংস্কৃতিক উপাদান গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে না।
উঁচু মানের চলচ্চিত্র দেখা এখন অনেক সহজ। কারণ, ইউটিউবে এবং বিভিন্ন অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে অতীতে এবং বর্তমান সময়ে নির্মিত ভালো চলচ্চিত্র দেখা যায়। কিন্তু হালকা বিনোদনধর্মী উপাদান অত্যধিক প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে দর্শকের রুচি নিয়ন্ত্রিত করে ফেলা হলে দর্শকেরা ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্মেও শুধু বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্রই দেখবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনেক উপকারী দিক আছে। কিন্তু আমাদের দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই দেখা যায়, অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ পোস্ট। করা হয় অত্যন্ত অশালীন, অসহিষ্ণু এবং আক্রমণাত্মক মন্তব্য। কখনো আপলোড করা হয় কুরুচিপূর্ণ ছবি আর ভিডিও। যাঁরা লেখাপড়া জানেন, তাঁরাই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধরনের উপাদান নিয়মিত দেখার পর অনেক মানুষের রুচি আর চিন্তার নিম্নগামিতা সম্পর্কে আমাদের শঙ্কিত হতে হয়।
গণমাধ্যম-প্রভাবিত বর্তমান সময়ের সাংস্কৃতিক পরিবেশে সচেতনভাবে মানুষের মনে সুরুচি আর চিন্তাশীলতা তৈরির উদ্যোগ না নেওয়া হলে ধীরে ধীরে সমাজ এগিয়ে যাবে গভীর বিপদের দিকে। সেই বিপদের রূপ মাঝে মাঝেই স্পষ্ট হচ্ছে। আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ, চিন্তার এবং রুচির উন্নয়ন না ঘটলে সমাজের অন্য সব উন্নয়নই অর্থহীন হয়ে পড়বে।
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১২ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১২ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১২ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে