বিভুরঞ্জন সরকার
অতিমারি করোনাভাইরাসের মরণ থাবা মানবজাতির ওপর নগ্নভাবে চেপে না বসলে আমরা হয়তো বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের ত্রুটি-দুর্বলতাগুলোও এত প্রবলভাবে অনুধাবন করতে পারতাম না। আমাদের স্বাস্থ্য খাত যে এতটাই ভঙ্গুর, তা আমরা বুঝতে পারিনি। এখন আমরা স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক সংস্কার, মেরামতের কথা বলছি। বলছি, স্বাস্থ্য খাত, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চলল, এখনো আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারলাম না কেন?
একটা বড় কারণ হয়তো এই যে, আমরা আসলে আন্তরিকভাবে বড় কোনো পরিবর্তন চাইনি। আমরা যা করেছি, করছি সবই একধরনের জোড়াতালি দিয়ে। আমরা ঘরের ময়লা-আবর্জনা ঝেড়েমুছে সাফ করে বাইরে না ফেলে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছি। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী প্রশাসন দিয়ে স্বাধীন দেশের শাসনব্যবস্থা চালিয়ে নিয়েছি। যে ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানের জন্য ‘সার্ভিস’ দিয়েছেন, তিনি ১৭ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের খেদমতগার হয়ে গেলেন। তাঁর কাছ থেকে সাধারণ মানুষ কী খেদমত পাবেন–তা বুঝতে কী খুব কষ্ট হওয়ার কথা?
আমরা মানুষের মন না রাঙিয়ে বসন রাঙাতে চেয়েছি, আমরা সবকিছু বাইরে থেকে চাকচিক্যময় করে তুলতে গিয়ে ভেতরের অন্ধদশা আড়াল করেছি। আজ তাই, যেদিকে তাকাই সেদিকে অন্ধকার দেখতে পাই। এখন আমরা আমাদের ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর বিষয়টি আবার সামনে আনছি।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। স্বাধীনতার পরপর স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের বিষয়টি সামনে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-ই-খোদার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেছিল। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও একটি কমিশন গঠন করে শিক্ষানীতি কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল। শিক্ষানীতি নিয়ে একটি সেমিনার হয়েছিল টিএসসি মিলনায়তনে, সম্ভবত ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। ছাত্রনেতারা তাঁদের বক্তৃতায় শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা বলেছিলেন। প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. এনামুল হক বলেছিলেন, ঢেলে সাজানোর বিষয়টি ভালো এবং প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঢালবেটা কে আর সাজাবেই বা কে?
অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু আমরা আমলে নিইনি। ঢেলে সাজানোর জন্য যে উপযুক্ত মানুষের দরকার, দরকার পরিবর্তনকামী মনমানসিকতার, সেই বিষয়টি আমরা উপেক্ষা করেছি। মানুষের চিন্তার জগতে আপসেআপ কোনো পরিবর্তন আসে না। মনোজগতে পরিবর্তন রাতারাতি ঘটে না। এর জন্য দরকার সচেতন চর্চা ও অনুশীলন। মানস পরিবর্তনের জন্য চর্চা ও অনুশীলনের কাজটি যথাযথভাবে যথাসময়ে না করার খেসারত এখন আমাদের দিতে হচ্ছে।
আমরা রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। স্বাধীন দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি কীভাবে, কোন পথে চলবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বুঝ-বিবেচনা খুব স্পষ্ট ছিল বলে মনে হয় না। স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধ এত ঝোড়ো গতিতে এসে উপস্থিত হয় যে, স্বাধীন হলে দেশটা কেমনভাবে চলবে, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো হোমওয়ার্ক ছিল বলেও মনে হয় না। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় যে চার মূলনীতি–জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপক্ষতা ও সমাজতন্ত্র–ঘোষণা করা হয়েছিল, তা যতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, ততটা হয়তো পরিকল্পিত ছিল না। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। এখন আমরা তার পরিণতি ভোগ করছি।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে অবশ্যই আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে তা কতটুকু পরিকল্পিত এবং অগ্রাধিকার বিবেচনা করে, সে প্রশ্ন করাই যায়। স্বাস্থ্য খাতের উদাহরণই দেওয়া যাক। আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়নে যতটা মনোযোগী হয়েছি, দক্ষতা ও সেবার মান উন্নয়নে ততটা মনোযোগ যে দিইনি, করোনাকালে তা উদোম হয়ে ধরা দিল। হাসপাতাল ভবন তৈরি হয়েছে; কিন্তু অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব দূর করা হয়নি। চিকিৎসা উপকরণ কেনা হয়েছে; কিন্তু সেগুলো ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনশক্তির কথা ভাবা হয়নি।
আসলে মানুষকে সেবা দেওয়ার চেয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়াই ছিল লক্ষ্য। চোখ জুড়াতে গিয়ে আমরা মন ভরাতে পারিনি। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে হিসাবনিকাশ করে ব্যয় পরিকল্পনার দিকটি উপেক্ষা করা হয়েছে। সাশ্রয়ী ও সংযমী না হয়ে অপচয় ও দুর্নীতির দুয়ার উন্মুক্ত করা হয়েছে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। মোটা টাকা নয়ছয়ের ঘটনাও ঘটছে। যেকোনো উন্নয়নকাজেই মানুষের কিছু না কিছু উপকার হয়। অর্থের সরবরাহ মানুষের সামর্থ্যও বাড়ায়। তবে, আমাদের উন্নয়ন সুষম নয়। সম্পদ বাড়ছে একমুখী। ধনবৈষম্য প্রকট হয়ে উঠছে। কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার প্রবণতা কমানোর কোনো ন্যায়সংগত পরিকল্পনা নেই।
দোষারোপের সংস্কৃতি আমাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে যাচ্ছে। কেউ ব্যর্থতার দায় নিতে চাই না। একজনের দোষ আরেকজনের ওপর চাপিয়ে বাগ্বিতণ্ডা করে কার্যত অপরাধীকে দায়মুক্তি দিই। ফলে অপরাধ ক্রমাগত বাড়ে। অপরাধী জানে, তাকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য কেউ উদ্গ্রীব হয়ে বসে নেই।
আমাদের দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির যা কিছু খারাপ, তার জন্য সামরিক স্বৈরশাসকদের অভিযুক্ত করে নিজেরা দায়মুক্ত থাকতে চাই। এ কথা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতির গতিমুখ উল্টে দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমান রাজনীতিকে কেনাবেচার পণ্যে পরিণত করেছিলেন।
রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি ডিফিকাল্ট করে দিতে চেয়েছিলেন। দলছুট, নীতিভ্রষ্টদের জন্য রাজনীতির জায়গা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ক্ষমতার উচ্ছিষ্টলোভী সামরিক-বেসামরিক আমলাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। টাকা কোনো সমস্যা নয়–এই কথা বলে একটি লুটেরাশ্রেণি গড়ে তোলার যে ধারা চালু করেন জিয়া, পরে এরশাদও সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়েছেন। ব্যাংকের টাকা লুটপাটের সুযোগ দিয়ে রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুঃখের বিষয়, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরও রাজনীতিতে আর সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনার গরজ কেউ অনুভব করেননি। বিএনপি-জাতীয় পার্টি যে অসুস্থ ধারার রাজনীতির জন্ম দিয়েছে, দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থেকেও কেন রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে পারছে না–এই প্রশ্নের জবাব খোঁজা এখন জরুরি।
গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে সরকারের আমলানির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ। তিনি জেলার দায়িত্ব সচিবদের ওপর দেওয়ার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংসদ সদস্যের ওপর খবরদারি করার সুযোগ সচিবদের কে দিয়েছে? সচিবেরা নিশ্চয়ই নিজে থেকে এই দায়িত্ব নেননি। সরকারপ্রধান তাঁদের এই দায়িত্ব দিয়েছেন। একজন রাজনৈতিক সরকারের প্রধান হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কেন আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে? ঘাটতি কোথায়, গলদ কোথায়? দলের যেখানে সরকার চালানোর কথা, সেখানে সরকারের ওপর কেন দলকে ভরসা করতে হচ্ছে? কোথাও তো একটা বড় ধস নেমেছে। সেটা নিয়ে কি আওয়ামী লীগের দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা আছে? সংকট কাটিয়ে ওঠার কি কোনো ভাবনাচিন্তা দলের কোনো পর্যায়ে আছে? দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় যে বিপর্যয় ঘটেছে, মানুষের ভোট দেওয়া না-দেওয়া যখন আর নির্বাচনের বিষয় নেই, তখন জনপ্রতিনিধিদের আসলে কোনো নৈতিক জোর থাকে না। জবাবদিহির বিষয় যখন জনগণের ওপর থাকে না, তখন আর কোনো বৈধ কাঠামো দিয়ে কিছু নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত হয় না। যাঁরা নেপথ্য কলকাঠি নেড়ে ‘নির্বাচন’ করছেন, সরকার গঠনে ভূমিকা রাখছেন, সেই আমলাদের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলার বিকল্প কী? রাজনীতিবিদেরা স্বেচ্ছায় এই আত্মসমর্পণ মেনে নিয়েছেন। জেনেশুনে বিষপান করে সংসদে দাঁড়িয়ে আমলাদের দুষলে সেটা মানুষের মনে শুধু কৌতুকই জাগাবে।
আমলাতন্ত্রের সমালোচনা করতে অনেকে উৎসাহবোধ করলেও আমলা ছাড়া শাসনকাজ চালানোর কার্যকর উপায় আমরা বের করতে পারিনি। আমলাদের কাজের তদারকির জন্য সৎ, দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। আমলাদের জনগণের ‘বস’ না বানানোর কোনো চেষ্টা কি আমরা কখনো করেছি? অথবা আমলাদের মধ্যে যাঁরা একটু ব্যতিক্রমী, জনকল্যাণকামী তাঁদের কি রাষ্ট্র কোনো প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করার গরজ বোধ করে? ভালো কাজের
জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার–এই নীতি অনুসরণে ব্যত্যয় ঘটলে একজন ভালো কাজ করতে
যাবে কেন?
প্রশাসনে জনদরদি এবং রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গঠনে নিরুৎসাহী কর্মকর্তা নিশ্চয়ই আছেন। তাঁদের চিহ্নিত করে, এক জায়গায় করে ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব দেওয়ার কথা কি ভাবা যায় না? কার গোয়াল, কে দেবে ধোঁয়া–এভাবেই চলতে থাকলে আমরা মাঝেমধ্যে আক্ষেপ করব, হা-হুতাশ করব; কিন্তু ভালো কিছু অর্জন করতে পারব না।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের কালে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি নিয়ে গর্ব করার মতো উপাদান আমাদের অনেক আছে। তবে রাজনীতি নিয়ে তেমন আশাজাগানিয়া খবর নেই। রাজনীতির প্রতি আমাদের দেশের মানুষের যে সহজাত আগ্রহ, এখন তাতে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অথচ রাজনীতি নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় শাসকদের সব সময় শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে থাকে। রাজনীতিবিদেরা আবার যখন জনগণের কাছাকাছি যেতে পারবেন, রাজনীতি যখন আর ব্যবসা ও ব্যক্তিস্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার না হয়ে জনকল্যাণের ভরসাস্থল হয়ে উঠবে, তখন নিশ্চয়ই রাজনীতির কথা, রাজনীতিবিদদের কথা মানুষ আগ্রহ নিয়ে শুনবে। সেই সুদিনের অপেক্ষা আপাতত।
লেখক: সহকারী সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
অতিমারি করোনাভাইরাসের মরণ থাবা মানবজাতির ওপর নগ্নভাবে চেপে না বসলে আমরা হয়তো বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের ত্রুটি-দুর্বলতাগুলোও এত প্রবলভাবে অনুধাবন করতে পারতাম না। আমাদের স্বাস্থ্য খাত যে এতটাই ভঙ্গুর, তা আমরা বুঝতে পারিনি। এখন আমরা স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক সংস্কার, মেরামতের কথা বলছি। বলছি, স্বাস্থ্য খাত, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চলল, এখনো আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারলাম না কেন?
একটা বড় কারণ হয়তো এই যে, আমরা আসলে আন্তরিকভাবে বড় কোনো পরিবর্তন চাইনি। আমরা যা করেছি, করছি সবই একধরনের জোড়াতালি দিয়ে। আমরা ঘরের ময়লা-আবর্জনা ঝেড়েমুছে সাফ করে বাইরে না ফেলে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছি। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী প্রশাসন দিয়ে স্বাধীন দেশের শাসনব্যবস্থা চালিয়ে নিয়েছি। যে ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানের জন্য ‘সার্ভিস’ দিয়েছেন, তিনি ১৭ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের খেদমতগার হয়ে গেলেন। তাঁর কাছ থেকে সাধারণ মানুষ কী খেদমত পাবেন–তা বুঝতে কী খুব কষ্ট হওয়ার কথা?
আমরা মানুষের মন না রাঙিয়ে বসন রাঙাতে চেয়েছি, আমরা সবকিছু বাইরে থেকে চাকচিক্যময় করে তুলতে গিয়ে ভেতরের অন্ধদশা আড়াল করেছি। আজ তাই, যেদিকে তাকাই সেদিকে অন্ধকার দেখতে পাই। এখন আমরা আমাদের ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর বিষয়টি আবার সামনে আনছি।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। স্বাধীনতার পরপর স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের বিষয়টি সামনে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-ই-খোদার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেছিল। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও একটি কমিশন গঠন করে শিক্ষানীতি কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছিল। শিক্ষানীতি নিয়ে একটি সেমিনার হয়েছিল টিএসসি মিলনায়তনে, সম্ভবত ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। ছাত্রনেতারা তাঁদের বক্তৃতায় শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা বলেছিলেন। প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. এনামুল হক বলেছিলেন, ঢেলে সাজানোর বিষয়টি ভালো এবং প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঢালবেটা কে আর সাজাবেই বা কে?
অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু আমরা আমলে নিইনি। ঢেলে সাজানোর জন্য যে উপযুক্ত মানুষের দরকার, দরকার পরিবর্তনকামী মনমানসিকতার, সেই বিষয়টি আমরা উপেক্ষা করেছি। মানুষের চিন্তার জগতে আপসেআপ কোনো পরিবর্তন আসে না। মনোজগতে পরিবর্তন রাতারাতি ঘটে না। এর জন্য দরকার সচেতন চর্চা ও অনুশীলন। মানস পরিবর্তনের জন্য চর্চা ও অনুশীলনের কাজটি যথাযথভাবে যথাসময়ে না করার খেসারত এখন আমাদের দিতে হচ্ছে।
আমরা রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। স্বাধীন দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি কীভাবে, কোন পথে চলবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বুঝ-বিবেচনা খুব স্পষ্ট ছিল বলে মনে হয় না। স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধ এত ঝোড়ো গতিতে এসে উপস্থিত হয় যে, স্বাধীন হলে দেশটা কেমনভাবে চলবে, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো হোমওয়ার্ক ছিল বলেও মনে হয় না। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় যে চার মূলনীতি–জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপক্ষতা ও সমাজতন্ত্র–ঘোষণা করা হয়েছিল, তা যতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, ততটা হয়তো পরিকল্পিত ছিল না। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। এখন আমরা তার পরিণতি ভোগ করছি।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে অবশ্যই আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে তা কতটুকু পরিকল্পিত এবং অগ্রাধিকার বিবেচনা করে, সে প্রশ্ন করাই যায়। স্বাস্থ্য খাতের উদাহরণই দেওয়া যাক। আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়নে যতটা মনোযোগী হয়েছি, দক্ষতা ও সেবার মান উন্নয়নে ততটা মনোযোগ যে দিইনি, করোনাকালে তা উদোম হয়ে ধরা দিল। হাসপাতাল ভবন তৈরি হয়েছে; কিন্তু অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব দূর করা হয়নি। চিকিৎসা উপকরণ কেনা হয়েছে; কিন্তু সেগুলো ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনশক্তির কথা ভাবা হয়নি।
আসলে মানুষকে সেবা দেওয়ার চেয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়াই ছিল লক্ষ্য। চোখ জুড়াতে গিয়ে আমরা মন ভরাতে পারিনি। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে হিসাবনিকাশ করে ব্যয় পরিকল্পনার দিকটি উপেক্ষা করা হয়েছে। সাশ্রয়ী ও সংযমী না হয়ে অপচয় ও দুর্নীতির দুয়ার উন্মুক্ত করা হয়েছে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। মোটা টাকা নয়ছয়ের ঘটনাও ঘটছে। যেকোনো উন্নয়নকাজেই মানুষের কিছু না কিছু উপকার হয়। অর্থের সরবরাহ মানুষের সামর্থ্যও বাড়ায়। তবে, আমাদের উন্নয়ন সুষম নয়। সম্পদ বাড়ছে একমুখী। ধনবৈষম্য প্রকট হয়ে উঠছে। কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার প্রবণতা কমানোর কোনো ন্যায়সংগত পরিকল্পনা নেই।
দোষারোপের সংস্কৃতি আমাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে যাচ্ছে। কেউ ব্যর্থতার দায় নিতে চাই না। একজনের দোষ আরেকজনের ওপর চাপিয়ে বাগ্বিতণ্ডা করে কার্যত অপরাধীকে দায়মুক্তি দিই। ফলে অপরাধ ক্রমাগত বাড়ে। অপরাধী জানে, তাকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য কেউ উদ্গ্রীব হয়ে বসে নেই।
আমাদের দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির যা কিছু খারাপ, তার জন্য সামরিক স্বৈরশাসকদের অভিযুক্ত করে নিজেরা দায়মুক্ত থাকতে চাই। এ কথা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতির গতিমুখ উল্টে দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমান রাজনীতিকে কেনাবেচার পণ্যে পরিণত করেছিলেন।
রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি ডিফিকাল্ট করে দিতে চেয়েছিলেন। দলছুট, নীতিভ্রষ্টদের জন্য রাজনীতির জায়গা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ক্ষমতার উচ্ছিষ্টলোভী সামরিক-বেসামরিক আমলাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। টাকা কোনো সমস্যা নয়–এই কথা বলে একটি লুটেরাশ্রেণি গড়ে তোলার যে ধারা চালু করেন জিয়া, পরে এরশাদও সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়েছেন। ব্যাংকের টাকা লুটপাটের সুযোগ দিয়ে রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুঃখের বিষয়, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরও রাজনীতিতে আর সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনার গরজ কেউ অনুভব করেননি। বিএনপি-জাতীয় পার্টি যে অসুস্থ ধারার রাজনীতির জন্ম দিয়েছে, দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থেকেও কেন রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে পারছে না–এই প্রশ্নের জবাব খোঁজা এখন জরুরি।
গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে সরকারের আমলানির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ। তিনি জেলার দায়িত্ব সচিবদের ওপর দেওয়ার সমালোচনা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংসদ সদস্যের ওপর খবরদারি করার সুযোগ সচিবদের কে দিয়েছে? সচিবেরা নিশ্চয়ই নিজে থেকে এই দায়িত্ব নেননি। সরকারপ্রধান তাঁদের এই দায়িত্ব দিয়েছেন। একজন রাজনৈতিক সরকারের প্রধান হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কেন আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে? ঘাটতি কোথায়, গলদ কোথায়? দলের যেখানে সরকার চালানোর কথা, সেখানে সরকারের ওপর কেন দলকে ভরসা করতে হচ্ছে? কোথাও তো একটা বড় ধস নেমেছে। সেটা নিয়ে কি আওয়ামী লীগের দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা আছে? সংকট কাটিয়ে ওঠার কি কোনো ভাবনাচিন্তা দলের কোনো পর্যায়ে আছে? দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় যে বিপর্যয় ঘটেছে, মানুষের ভোট দেওয়া না-দেওয়া যখন আর নির্বাচনের বিষয় নেই, তখন জনপ্রতিনিধিদের আসলে কোনো নৈতিক জোর থাকে না। জবাবদিহির বিষয় যখন জনগণের ওপর থাকে না, তখন আর কোনো বৈধ কাঠামো দিয়ে কিছু নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত হয় না। যাঁরা নেপথ্য কলকাঠি নেড়ে ‘নির্বাচন’ করছেন, সরকার গঠনে ভূমিকা রাখছেন, সেই আমলাদের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলার বিকল্প কী? রাজনীতিবিদেরা স্বেচ্ছায় এই আত্মসমর্পণ মেনে নিয়েছেন। জেনেশুনে বিষপান করে সংসদে দাঁড়িয়ে আমলাদের দুষলে সেটা মানুষের মনে শুধু কৌতুকই জাগাবে।
আমলাতন্ত্রের সমালোচনা করতে অনেকে উৎসাহবোধ করলেও আমলা ছাড়া শাসনকাজ চালানোর কার্যকর উপায় আমরা বের করতে পারিনি। আমলাদের কাজের তদারকির জন্য সৎ, দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। আমলাদের জনগণের ‘বস’ না বানানোর কোনো চেষ্টা কি আমরা কখনো করেছি? অথবা আমলাদের মধ্যে যাঁরা একটু ব্যতিক্রমী, জনকল্যাণকামী তাঁদের কি রাষ্ট্র কোনো প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করার গরজ বোধ করে? ভালো কাজের
জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার–এই নীতি অনুসরণে ব্যত্যয় ঘটলে একজন ভালো কাজ করতে
যাবে কেন?
প্রশাসনে জনদরদি এবং রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গঠনে নিরুৎসাহী কর্মকর্তা নিশ্চয়ই আছেন। তাঁদের চিহ্নিত করে, এক জায়গায় করে ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব দেওয়ার কথা কি ভাবা যায় না? কার গোয়াল, কে দেবে ধোঁয়া–এভাবেই চলতে থাকলে আমরা মাঝেমধ্যে আক্ষেপ করব, হা-হুতাশ করব; কিন্তু ভালো কিছু অর্জন করতে পারব না।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের কালে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি নিয়ে গর্ব করার মতো উপাদান আমাদের অনেক আছে। তবে রাজনীতি নিয়ে তেমন আশাজাগানিয়া খবর নেই। রাজনীতির প্রতি আমাদের দেশের মানুষের যে সহজাত আগ্রহ, এখন তাতে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। অথচ রাজনীতি নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় শাসকদের সব সময় শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে থাকে। রাজনীতিবিদেরা আবার যখন জনগণের কাছাকাছি যেতে পারবেন, রাজনীতি যখন আর ব্যবসা ও ব্যক্তিস্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার না হয়ে জনকল্যাণের ভরসাস্থল হয়ে উঠবে, তখন নিশ্চয়ই রাজনীতির কথা, রাজনীতিবিদদের কথা মানুষ আগ্রহ নিয়ে শুনবে। সেই সুদিনের অপেক্ষা আপাতত।
লেখক: সহকারী সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১০ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১০ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১০ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে