বিজন সাহা
দুবনায় সামার খুব একটা দীর্ঘ নয়। সাধারণত জুনের ১৪ থেকে আগস্টের ১৪। এর আগে বা পরে দিনে গরম হলেও রাতের তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। তাই এ সময় মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে রৌদ্রস্নানে আর ভোলগায় সাঁতার কাটতে। আমি রাশিয়ার দুবনায় ১৯৯৪ সাল থেকে। ছোটবেলায় বাচ্চাদের নিয়ে নদীতে গেলেও তখন সাঁতার কাটা হয়নি। ওদের দেখভাল করতেই সময় কেটে গেছে। তা ছাড়া, শহরের সৈকত বাসা থেকে বেশ দূরে, তাই যাওয়া মানেই বিশাল আয়োজন। শহরের অন্য পারে বিশাল সৈকত মস্কো সাগরে। কিন্তু আবার সেই যাতায়াতের সমস্যা। আমাদের বাসার পাশের বিচটা ওয়াইল্ড বিচ। নামলেই পাথর, বেশ পানি। আমি কয়েক বছর ধরে যাতায়াত শুরু করেছি এখানে। সাধারণত জুনের শুরুতেই ওদিক দিয়ে হেঁটে অফিসে যাই। কাউকে সাঁতার কাটতে দেখলে জিজ্ঞেস করি:
–এ জলে কী চা ভিজবে?
–না না, এখনো ঠান্ডা।
এভাবেই কেটে যায় জুনের প্রথমদিক। তারপর পানির তাপমাত্রা যখন ২০ ডিগ্রির কাছাকাছি হয়, একদিন নেমে পড়ি সাঁতার কাটতে। ওরা বলে:
–ভোলগা বেশ পরিষ্কার। তোমাদের গঙ্গার মতো নোংরা নয়।
–সেটা ঠিক, তবে গঙ্গা সবার পাপস্খলন করে, ভোলগা সেটা পারে না। কে জানে, বিলিয়ন লোকের পাপ ধুয়েই গঙ্গা এত নোংরা কি না।
সবাই হাসি। আমি ওদের শোনাই কালীগঙ্গার গল্প। বলি:
–আমার ছোটবেলায় কালীগঙ্গা দুবনার ভোলগার দেড় গুণ চওড়া ছিল আর ঢেউ ছিল প্রায় মানুষসমান।
ওরা হাসলে বলি:
–বিশ্বাস হয় না?
কথাটা কিন্তু শতভাগ সত্যি। মানুষটা শুধু তখন ছোট ছিল। হাসির রোল পড়ে যায় নদীর ধারে। মাঝেমধ্যে ওরা যখন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, কে কবে স্নানের সিজন ওপেন করেছে, সুযোগ পেয়ে বলি:
–আমি কিন্তু সারা বছরই রৌদ্রস্নান করি।
ওদের চোখ আবার ছানাবড়া। ভাবখানা এই, বলে কী? আমরা রুশরা পর্যন্ত সাহস পাই না, আর এ নাকি সারা বছর সানবাথ করে। আমি আবার এগিয়ে আসি ওদের সাহায্যে।
নিজের কালো হাত ওদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলি:
–তোমরাই বলো, সারা বছর কেউ রোদে না পুড়লে কি চামড়ার রং এমন সুন্দর হয়?
সেদিন ঘাটে গিয়ে দেখি সিঁড়ির রেলিংয়ের একটা তক্তা পড়ে গেছে। ইতিমধ্যে সত্তর বছর বয়সী এক ভদ্রলোক বাসা থেকে ড্রিল, স্ক্রু আর স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে এসেছেন রেলিংটা ঠিক করবেন বলে। আমি সাঁতার কাটছিলাম। এসে বললাম, ‘আমাকে দিন, আমি করছি।’ তারপর দুজনে মিলে শুধু রেলিং নয়, আরও কিছু তক্তা এদিক-সেদিক করে সিঁড়িটা ঠিক করলাম। জায়গাটা একটু পিছল বলে অনেকেই পাশ দিয়ে নামেন। সেখানে পাথরটা ছোট্ট।
–এই পাথরটা সরিয়ে অন্য একটা বড় পাথর বসালে মন্দ হয় না।
আমার এ প্রস্তাবে নারীরা সায় দিলেন। একটা উপযুক্ত পাথর পাওয়া গেল। বেশ দূরে। সবাই বললেন, একটু পরে বা কাল যখন আরও বেশি লোক থাকবে, তখন যেন আমরা পাথরটা বদলে দিই। উনি রাজি হলেন না। শুরু হলো দুজনার পাথর সরানোর কাজ। কিছুদূর নিয়ে দেখি কাজটা অসাধ্য না হলেও শ্রমসাধ্য।
তাই বললাম:
–চলুন, অন্যদের জন্য অপেক্ষা করি।
কে জানে, উনি হয়তো ভেবেছেন, বয়স্ক বলে আমি তাঁকে আগলে রাখতে চাইছি। বললেন:
–কোনো ব্যাপার না। আমরাই ঠিক করতে পারব।
রুশ নাগরিক হলেও আমার রং, উচ্চারণভঙ্গী–এসব বলে দেয় আমি বিদেশি। আমারও জেদ চাপল। বিদেশি বলে হেরে গেলে চলবে না। তাই দাঁতে দাঁত চেপে পাথরটা ঠিক জায়গামতো বসিয়ে দিলাম। আরও কিছু টুকিটাকি কাজ করে ঘাটটাকে যাকে বলে ভদ্র বানালাম। ঘাটে থাকা নারীরা আমাদের ঘিরে ধরে ধন্যবাদের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে শুরু করলেন। যতই বলি এটা তো আমরা নিজেদের জন্যই করেছি, কে শোনে কার কথা।
–তোমাদের ঋণ আমরা শোধ করতে পারব না।
–ইশ, আমি সাধারণ পদার্থবিদ, ব্যাংকার নই। ঋণ দেব কোত্থেকে?
যাই হোক, এক ব্যাগভর্তি স্পাসিবা নিয়ে ফিরে এলাম বাসায়। পরের দিন বৃষ্টি থাকায় তেমন কেউ নদীতে যায়নি। তার পরের দিন ঘাটে গিয়ে দেখি হাউসফুল। আমাকে দেখেই নারীরা এগিয়ে এলেন।
–আমরা সবাইকে বলেছি, কে আমাদের ঘাট ঠিক করে দিয়েছে।
–তাই? তা কী বললেন?
–বাংলাদেশ!
লেখক: গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা, রাশিয়া
দুবনায় সামার খুব একটা দীর্ঘ নয়। সাধারণত জুনের ১৪ থেকে আগস্টের ১৪। এর আগে বা পরে দিনে গরম হলেও রাতের তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। তাই এ সময় মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে রৌদ্রস্নানে আর ভোলগায় সাঁতার কাটতে। আমি রাশিয়ার দুবনায় ১৯৯৪ সাল থেকে। ছোটবেলায় বাচ্চাদের নিয়ে নদীতে গেলেও তখন সাঁতার কাটা হয়নি। ওদের দেখভাল করতেই সময় কেটে গেছে। তা ছাড়া, শহরের সৈকত বাসা থেকে বেশ দূরে, তাই যাওয়া মানেই বিশাল আয়োজন। শহরের অন্য পারে বিশাল সৈকত মস্কো সাগরে। কিন্তু আবার সেই যাতায়াতের সমস্যা। আমাদের বাসার পাশের বিচটা ওয়াইল্ড বিচ। নামলেই পাথর, বেশ পানি। আমি কয়েক বছর ধরে যাতায়াত শুরু করেছি এখানে। সাধারণত জুনের শুরুতেই ওদিক দিয়ে হেঁটে অফিসে যাই। কাউকে সাঁতার কাটতে দেখলে জিজ্ঞেস করি:
–এ জলে কী চা ভিজবে?
–না না, এখনো ঠান্ডা।
এভাবেই কেটে যায় জুনের প্রথমদিক। তারপর পানির তাপমাত্রা যখন ২০ ডিগ্রির কাছাকাছি হয়, একদিন নেমে পড়ি সাঁতার কাটতে। ওরা বলে:
–ভোলগা বেশ পরিষ্কার। তোমাদের গঙ্গার মতো নোংরা নয়।
–সেটা ঠিক, তবে গঙ্গা সবার পাপস্খলন করে, ভোলগা সেটা পারে না। কে জানে, বিলিয়ন লোকের পাপ ধুয়েই গঙ্গা এত নোংরা কি না।
সবাই হাসি। আমি ওদের শোনাই কালীগঙ্গার গল্প। বলি:
–আমার ছোটবেলায় কালীগঙ্গা দুবনার ভোলগার দেড় গুণ চওড়া ছিল আর ঢেউ ছিল প্রায় মানুষসমান।
ওরা হাসলে বলি:
–বিশ্বাস হয় না?
কথাটা কিন্তু শতভাগ সত্যি। মানুষটা শুধু তখন ছোট ছিল। হাসির রোল পড়ে যায় নদীর ধারে। মাঝেমধ্যে ওরা যখন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, কে কবে স্নানের সিজন ওপেন করেছে, সুযোগ পেয়ে বলি:
–আমি কিন্তু সারা বছরই রৌদ্রস্নান করি।
ওদের চোখ আবার ছানাবড়া। ভাবখানা এই, বলে কী? আমরা রুশরা পর্যন্ত সাহস পাই না, আর এ নাকি সারা বছর সানবাথ করে। আমি আবার এগিয়ে আসি ওদের সাহায্যে।
নিজের কালো হাত ওদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলি:
–তোমরাই বলো, সারা বছর কেউ রোদে না পুড়লে কি চামড়ার রং এমন সুন্দর হয়?
সেদিন ঘাটে গিয়ে দেখি সিঁড়ির রেলিংয়ের একটা তক্তা পড়ে গেছে। ইতিমধ্যে সত্তর বছর বয়সী এক ভদ্রলোক বাসা থেকে ড্রিল, স্ক্রু আর স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে এসেছেন রেলিংটা ঠিক করবেন বলে। আমি সাঁতার কাটছিলাম। এসে বললাম, ‘আমাকে দিন, আমি করছি।’ তারপর দুজনে মিলে শুধু রেলিং নয়, আরও কিছু তক্তা এদিক-সেদিক করে সিঁড়িটা ঠিক করলাম। জায়গাটা একটু পিছল বলে অনেকেই পাশ দিয়ে নামেন। সেখানে পাথরটা ছোট্ট।
–এই পাথরটা সরিয়ে অন্য একটা বড় পাথর বসালে মন্দ হয় না।
আমার এ প্রস্তাবে নারীরা সায় দিলেন। একটা উপযুক্ত পাথর পাওয়া গেল। বেশ দূরে। সবাই বললেন, একটু পরে বা কাল যখন আরও বেশি লোক থাকবে, তখন যেন আমরা পাথরটা বদলে দিই। উনি রাজি হলেন না। শুরু হলো দুজনার পাথর সরানোর কাজ। কিছুদূর নিয়ে দেখি কাজটা অসাধ্য না হলেও শ্রমসাধ্য।
তাই বললাম:
–চলুন, অন্যদের জন্য অপেক্ষা করি।
কে জানে, উনি হয়তো ভেবেছেন, বয়স্ক বলে আমি তাঁকে আগলে রাখতে চাইছি। বললেন:
–কোনো ব্যাপার না। আমরাই ঠিক করতে পারব।
রুশ নাগরিক হলেও আমার রং, উচ্চারণভঙ্গী–এসব বলে দেয় আমি বিদেশি। আমারও জেদ চাপল। বিদেশি বলে হেরে গেলে চলবে না। তাই দাঁতে দাঁত চেপে পাথরটা ঠিক জায়গামতো বসিয়ে দিলাম। আরও কিছু টুকিটাকি কাজ করে ঘাটটাকে যাকে বলে ভদ্র বানালাম। ঘাটে থাকা নারীরা আমাদের ঘিরে ধরে ধন্যবাদের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে শুরু করলেন। যতই বলি এটা তো আমরা নিজেদের জন্যই করেছি, কে শোনে কার কথা।
–তোমাদের ঋণ আমরা শোধ করতে পারব না।
–ইশ, আমি সাধারণ পদার্থবিদ, ব্যাংকার নই। ঋণ দেব কোত্থেকে?
যাই হোক, এক ব্যাগভর্তি স্পাসিবা নিয়ে ফিরে এলাম বাসায়। পরের দিন বৃষ্টি থাকায় তেমন কেউ নদীতে যায়নি। তার পরের দিন ঘাটে গিয়ে দেখি হাউসফুল। আমাকে দেখেই নারীরা এগিয়ে এলেন।
–আমরা সবাইকে বলেছি, কে আমাদের ঘাট ঠিক করে দিয়েছে।
–তাই? তা কী বললেন?
–বাংলাদেশ!
লেখক: গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা, রাশিয়া
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১০ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১০ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১০ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে