রোবায়েত ফেরদৌস
‘নোবেল পুরস্কারজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুস সালামকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশে কেনো বিশ্বমানের গবেষণা হয় না?” মাত্র এক বাক্যের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “রিসার্চ ইজ এক্সপেনসিভ”।’
বিপুল ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতীক আমাদের এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জাতির মনন আর বুদ্ধিবৃত্তিক গড়ন তৈরিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনপনেয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় এককভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা রেখেছে, তার নজির বোধকরি পুরো পৃথিবীতেই বিরল। এসব মেনে ও মনে নিয়েও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত দু-তিন দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান ক্রমশ নিম্নগামী হয়েছে এবং এই অবনতির বিষয়টি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে যেসব গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে, তাঁদের মান ঠিক আশানুরূপ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান, শিক্ষাদান পদ্ধতি কিংবা গবেষণার গুণগত দিক কয়েক দশক থেকেই ভীষণ উপেক্ষিত। এখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিসম্পন্ন গবেষকের সংখ্যা দারুণভাবে কমে গেছে এবং খুব কমসংখ্যক শিক্ষকের লেখাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত জার্নাল ও সাময়িকীতে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন জার্নালে যেসব গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, তার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। আন্তর্জাতিক জার্নালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লেখা প্রকাশের হার যে একেবারেই কমে গেছে, এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও গবেষণার মূল্যায়ন শীর্ষক রিপোর্টসমূহে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক মূল্যায়নের যে বিভাগ দুটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে হতাশাজনক স্কোর করে তা হলো: এক. বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাসংক্রান্ত বিভাগ এবং দুই. শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকর্ম সম্পাদনসংক্রান্ত বিভাগ। প্রথমোক্ত বিভাগে খারাপ স্কোর করার অনেক যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য কারণ উল্লেখ করা সম্ভব হলেও যেমন, আর্থিক সংকট এবং কম্পিউটার ব্যবহারের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব, দ্বিতীয়টির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষকদের বাস্তবতা বিশ্লেষণের পাশাপাশি আত্মমূল্যায়নেরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে আশার খবর, গেল কয়েক বছরে সরকারের ডিজিটাল রেভলুশনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে; তবে এই বৃদ্ধির পেছনে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের অবদানও অনেকখানি; কিন্তু এখনো এই ব্যবহারের হার ইউরোপ বা এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক পেছনে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এখানে অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়ার দরকার রয়েছে। তবে এটাও খেয়ালে রাখা জরুরি যে, ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাটি ছাত্রছাত্রীরা কী কাজে ব্যবহার করছে–নিছক ফেসবুকিং আর সস্তা বিনোদনধর্মী চ্যাট করছে, না বিশ্বের বৃহত্তর জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার কাজে ব্যবহার করছে। আর দ্বিতীয় পয়েন্টের ক্ষেত্রে বলা যায়, আন্তর্জাতিক মানের মৌলিক ও সৃজনশীল গবেষণা পরিচালনায় আজকাল শিক্ষকদের আর আগের মতো উৎসাহী হতে দেখা যায় না। এর কারণ হিসেবে আমরা কি বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের মেধা ও মননশীলতাকেই প্রশ্নের মুখোমুখি করব? বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে বরাদ্দকৃত গবেষণা ফান্ডের অপ্রতুলতাকে অনেকেই গবেষণামানের নিম্নগামিতার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে চান। এখানে আমরা জোরের সঙ্গেই বলতে চাই , গুণগত মানের বিচারে ভালো গবেষণা ও তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি গবেষণায় বিনিয়োগকৃত অর্থের সঙ্গে অবধারিতভাবেই সম্পর্কিত। তবে এটাও ঠিক যে, একজন গবেষকের মেধা, মননশীলতা ও দক্ষতাকে যদি একত্রে ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে স্বল্পব্যয়ে অধিক মূল্যবান এবং কার্যকরী গবেষণা পরিচালনা করা সম্ভব। এর জন্য দরকার গবেষণা-সংবেদনশীল-সংস্কৃতি–এরকম একটি পরিবেশ, যেখানে গবেষণাকে উৎসাহিত করা হবে, গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাংলাদেশের মতো একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে যতটুকু অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে এদেশের উচ্চশিক্ষিত মানুষ, এ ক্ষেত্রে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী, পর্যায়ক্রমে ব্যর্থ হচ্ছেন বললে বড় বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। সৃজনশীল এবং প্রায়োগিক জ্ঞান সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই যে সীমাহীন অনীহা, তার সত্যিকারের কারণ আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। কারণ, শিক্ষা এবং গবেষণায় এদেশকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য এটা খুবই জরুরি।
কেন এই অবনতি?
মৌলিক ও ঋদ্ধ গবেষণা পেপার লেখার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই অনীহার কারণ মূলত দুটি। এক. এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক কিংবা ভালো গবেষণা নিবন্ধের যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। দুই. বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রক্রিয়াটি এখন খুব সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর চাকরির অভিজ্ঞতা আর গুটিকয়েক লেখা প্রকাশ করতে পারলে যেকোনো শিক্ষক এখানে পদোন্নতি পেয়ে যান। প্রকাশিত নিবন্ধের মৌলিকত্ব বা গুণগত দিক বিবেচনা করা হয় না একেবারেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নিয়োগ কিংবা পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা বা যোগ্যতার দিকটি অনেক সময়ই উপেক্ষিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে অধ্যাপকের সংখ্যাই বেশি এবং এটা দুঃখজনক যে, তাদের বেশির ভাগেরই মৌলিক কিংবা ঋদ্ধ কোনো গবেষণাকর্ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মাঝে একাডেমিক দক্ষতা অর্জনের কোনো সুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায় না। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রতিহিংসা আছে পুরোমাত্রায়। শিক্ষকদের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ক্রমশ অসুস্থ করে তুলছে। এর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ শনাক্ত করা যায়। যেমন: পাবলিক পরীক্ষায় নকল, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার আশঙ্কাজনক অবনতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী টানাপোড়েন ইত্যাদি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকেরা ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের বাড়তি সময় প্রদানে অনাগ্রহ দেখান। অনেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কনসালটেন্সি, পার্টটাইম চাকরি কিংবা অন্য কাজে সময় দিতে থাকেন। ফলে একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে গড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময়ও পায় না। এসবের পেছনে শিক্ষকেরা যে যুক্তি দাঁড় করান তা হলো, সামাজিক অবস্থান এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা প্রদান করা হয় না।
সবই কি শেষ হয়ে গেছে?
গবেষণা এবং একাডেমিক ক্ষেত্রে হতাশাজনক কয়েকটি বিষয় নিয়ে ওপরে আমরা কথা বললাম। কিন্তু এটাই কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ চিত্র? না, মোটেও তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো বেশকিছু শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা সত্যিকারের জ্ঞানচর্চায় ব্যাপৃত কিংবা জ্ঞানচর্চা করতে আগ্রহী। নিজ নিজ ক্ষেত্রে এঁদের পাণ্ডিত্য, গবেষণা আর চিন্তার মৌলিকত্ব সত্যিই প্রশংসনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধি এবং সামনের সময়ে বাকি বিশ্বের জ্ঞানচর্চার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাল মিলিয়ে চলার বিষয়টি নিয়ে এঁরা ভাবনা-চিন্তা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু, সুন্দর ও কাম্য পরিবেশ তৈরির জন্য এঁরা আন্তরিকভাবে কিছু করতে চান। ঠিক যে, উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব হয়ে গেছে। তবু আমরা মনে করি, এখনো যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া যায়, নিঃসন্দেহে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা ফলদায়ক হবে। এ লেখায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে আমরা স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে সুনির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রম চিহ্নিত করেছি। এর মধ্যে শিক্ষকদের আত্ম-উন্নয়ন থেকে শুরু করে কার্যকর শিক্ষাদান পদ্ধতির বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত আছে।
এক. শিক্ষকদের মূল্যায়ন
শিক্ষকেরা ক্লাসরুমে নিজেদের পাঠদান পদ্ধতির মূল্যায়ন করাতে পারেন। এ মূল্যায়ন করবে শিক্ষার্থীরা। কারণ, একজন শিক্ষকের পাঠদান প্রক্রিয়ার যথার্থ মূল্যায়ন কেবল শিক্ষার্থীরাই করতে পারে। এর মাধ্যমে শিক্ষকেরা নিজেদের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও করতে পারবেন। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মসমালোচনা ও পরমতসহিষ্ণুতার এক নয়া সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে। শিক্ষকেরাও যাতে এ প্রক্রিয়া আরম্ভ করতে পারেন, সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।
দুই. ভালোর প্রচার
যেসব শিক্ষক সফলভাবে উচ্চমানের গবেষণা করেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তাদের ইমেজ তুলে ধরতে হবে। বিস্তৃত আকারে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ ও প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য বছরে দুটি বুলেটিন প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিতদের দিয়ে গবেষণাকর্মের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করাতে হবে।
তিন. নয়া শিক্ষাদান পদ্ধতি
সনাতনী শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তন করে একটি নতুন, কার্যকর ও সুসংহত শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। যেমন, শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের ক্লাস শিডিউল ও কোর্সের কন্টেন্ট দিয়ে দিতে হবে। তাদের বিভিন্ন বিষয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রেফারেন্স সরবরাহ করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, শিক্ষক যদি কোর্সের শুরুতে শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত রেফারেন্সসহ একটি কোর্স-প্যাকেট দিতে পারেন।
চার. নতুন প্রযুক্তি
ক্লাসরুমে বক্তৃতা, মডেল, সারণি বা ফিগার পরিবেশন আরও আকর্ষণীয় করার জন্য সব ক্লাসে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার চালু করা যায়। আশার কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের সীমিত ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং তা থেকে আশাপ্রদ ফলও পাওয়া যাচ্ছে। কোনো জটিল বিষয় স্পষ্ট ও সহজ করে বোঝার ক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার ফলপ্রসূ। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর অর্থবহ চাপ তৈরি করতে হবে।
পাঁচ. শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন
অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল ধরে যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে, তা খুব বেশি কার্যকর নয়। এ জন্য শিক্ষার্থী মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি আমরা প্রস্তাব করতে চাই। তিন স্তরবিশিষ্ট এই নয়া মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রথম স্তরে থাকবে অবজেকটিভ প্রশ্নমালা। বিশ্লেষণাত্মক ও প্রবলেম সলভিং ধরনের প্রশ্ন নিয়ে হবে দ্বিতীয় স্তর এবং তৃতীয় পর্যায়ের প্রশ্ন থাকবে কনসেপচুয়াল সমস্যাসংশ্লিষ্ট। এর ফলে শিক্ষার্থীদের তথ্যগত ও বিষয়বস্তুগত জ্ঞানস্তর যেমন পরিমাপ করা যাবে, তেমনি তাদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও সমস্যা সমাধানে তাদের সামর্থ্যের বিষয়টিও উপলব্ধি করা যাবে।
ছয়. মিথস্ক্রিয়া
শিক্ষকদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতার ওপরও আমরা গুরুত্বারোপ করতে চাই। ব্যক্তিগত ও অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্র, গবেষণাকর্ম কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া বা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাপারে শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া থাকতে হবে।
সাত. ক্লাসরুম টেস্ট
ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখার কিংবা তাদের উপস্থিতি নিয়মিত করার লক্ষ্যে আগাম ঘোষণা না দিয়ে মাঝে মাঝে ক্লাস টেস্ট নেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ইস্যুতে ক্লাসরুমে বিতর্কের আয়োজন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের দিয়ে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
আট. শিক্ষক নিয়োগে নিরপেক্ষতা
শিক্ষক নিয়োগ যাতে মেধার ভিত্তিতে হয় এবং সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিই যেন শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, দলীয় আনুগত্য বা স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে উচ্চকিত থাকতে হবে।
নয়. শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক সহজ, সুন্দর করতে হবে। বলা বাহুল্য, তথ্যের আদান-প্রদান বা মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একটি চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা খুবই জরুরি।
দশ. সৃজনশীলতার চর্চা
অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক মান বাড়ানোর লক্ষ্যে তাদেরকে সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিতে হবে। গান, আবৃত্তি-বিতর্ক, খেলাধুলা বা নাট্যচর্চায় উৎসাহিত করতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক আর অসাম্প্রদায়িক মানসগঠনে এসবের চর্চা অনস্বীকার্য। জঙ্গিবাদ মোকাবিলার ক্ষেত্রেও এ উদ্যোগ কাজে দেবে বলে আমরা মনে করি।
এগারো. গবেষণা খাতে বাজেট বৃদ্ধি
দুঃখজনক যে, কোনো সরকারই গবেষণার বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না; অথচ সরকারের যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় গবেষণাভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত-সিদ্ধান্তের কোনো বিকল্প নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাটের জিন গবেষণার ক্ষেত্রে সরকারের সামান্য আগ্রহ কত বড় ফল বয়ে এনেছিল—তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আমরা আন্তর্জাতিক মামলায় সমুদ্রের বিস্তৃত জলরাশির ওপর আমাদের অধিকার ফিরে পেয়েছি; কিন্তু সমুদ্র নিয়ে কার্যকর কোনো গবেষণা হচ্ছে না। অথচ পৃথিবী বলছে, ব্লু ইকোনমির যুতসই ব্যবহার বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি পাল্টে দিতে পারে; কিন্তু আমাদের সেদিকে মনোযোগ নেই। আমরা বিশ্বাস করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষককে গড়ে বছরে ১৫-২০ লাখ টাকার বরাদ্দ দেওয়া হোক, বছর শেষে দেখবেন, তারা প্রত্যেকে নিজ বিষয়ে টেক্সট বই লিখেছেন কিংবা নিবিষ্ট মনে নিজ নিজ ক্ষেত্রে গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করছেন। এখানে বাইরের কনাসালটেন্সি বা বাইরের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণা করার কাজকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়–এ মানসিকতা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। বরং এ বিষয়টিকে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে একজন অধ্যাপক বাইরে থেকে গবেষণা ফান্ড এনে সিনিয়র শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন। এর বাইরে আমরা মনে করি, প্রাইভেট সেক্টর, করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং বড় ব্যবসায়ীদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার অর্থায়নে এগিয়ে আসা উচিত।
আরও দুটি নির্দোষ প্রস্তাব
এটা মানি যে, আগের প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আছে এবং দু-একটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভেতর থেকেই কেউ কেউ বাধা দিতে পারেন; যেমন, শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের পাঠদানের মূল্যায়ন; যদিও পৃথিবীজুড়ে এবং বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই চর্চাটি করা হয়; এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, যাঁরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন, তাঁদেরও কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আসতে হয়। এবারে তাই এমন দুটি প্রস্তাব উপস্থাপন করতে চাই, যা খুবই নির্দোষ প্রকৃতির। এতে কেউ কোনো আপত্তি তুলবে না; বরং সমর্থন জোগাবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রভাব হবে খুবই দৃশ্যমান ও সুদূরপ্রসারী।
এক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও অনুষদের আওতায় যতগুলো ক্লাসরুম আছে, শুরুতেই এর একটি জরিপ করতে হবে। বর্তমানে কোন ক্লাসরুমের কী অবস্থা, সেটি চিহ্নিত করতে হবে। এরপর প্রতিটি ক্লাসরুমকে আধুনিক, বিশ্বমানের ও ডিজিটালাইজড করতে হবে। এর মানে প্রতিটি ক্লাসরুমে থাকতে হবে: ক) স্মার্টবোর্ড ও ডিজিটাল পেন; খ) বিল্ট-ইন সাউন্ড সিস্টেম; গ) সাউন্ডপ্রুফ ক্লাসরুম–যাতে বাইরের শব্দ ক্লাসে ব্যাঘাত না ঘটায়; ঘ) স্টেট অব দি আর্ট কম্পিউটার কনফিগারেশন; ঙ) সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সংযোগ; চ) এসি ক্লাসরুম (বি.দ্র. এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘এটুআই প্রকল্প’ অথবা ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়’ থেকে অর্থ প্রাপ্তি সম্ভব)।
দুই. শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য সবুজ, নির্মল ও স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ অপরিহার্য। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে এবং যেখানে-সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার দোকান চালু করা হচ্ছে। সার্বিক শিক্ষা পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের জন্য যা খুবই ক্ষতিকর। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থে ইস্যুটিকে খুব সিরিয়াসলি গ্রহণ করা জরুরি। এ থেকে উত্তরণের জন্য ‘গ্রিন ক্যাম্পাস : ক্লিন ক্যাম্পাস’ থিমকে সামনে নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোর টয়লেট ও বাথরুমগুলো সার্বক্ষণিক পরিষ্কার ও ঝকঝকে রাখতে হবে। এ জন্য মেইনটেনেন্সের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কারণ, আমরা দেখেছি, নতুন বাথরুম তৈরি করা হয় ঠিকই; কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কয়েক মাস পরেই তা নষ্ট হয়ে যায়। ‘গ্রিন ক্যাম্পাস : ক্লিন ক্যাম্পাস’-এর জন্য বাড়তি কোনো জনবলের দরকার নেই; বিদ্যমান জনবল দিয়েই এর বাস্তবায়ন সম্ভব। দরকার শুধু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও জোর তদারকি। ক্যাম্পাস এমন সবুজ, স্নিগ্ধ আর পরিষ্কার হবে যে, কেউ কোথাও ময়লা-আবর্জনা ফেলতেই তখন দ্বিধাবোধ করবে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে অব্যাহতভাবে সচেতনতামূলক পরিবেশ ক্যাম্পেইন চালাতে হবে।
আমি মনে করি, উপরের দুটি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা গেলে, ‘প্রশাসন এই করেছে সেই করেছে’ বলে কোনো দাবি করতে হবে না। এর প্রভাব এতটাই দৃশ্যমান হবে যে, সবাই তা দেখতে পাবে; ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনের প্রতি দ্রুত সবার ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে।
শেষে বলতে চাই, এসব তালিকাই শেষ নয়। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যে হতাশাজনক অবস্থা বিরাজ করছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার একটি আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা থেকেই এসব প্রস্তাব পেশ করছি। শিক্ষকতা পেশার যে দায়িত্বশীলতা, সে প্রশ্নে আমরা যদি আপস না করি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ ফিরিয়ে আনা খুব কষ্টসাধ্য নয়।
লেখক, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
‘নোবেল পুরস্কারজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুস সালামকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশে কেনো বিশ্বমানের গবেষণা হয় না?” মাত্র এক বাক্যের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “রিসার্চ ইজ এক্সপেনসিভ”।’
বিপুল ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতীক আমাদের এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জাতির মনন আর বুদ্ধিবৃত্তিক গড়ন তৈরিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনপনেয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় এককভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা রেখেছে, তার নজির বোধকরি পুরো পৃথিবীতেই বিরল। এসব মেনে ও মনে নিয়েও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত দু-তিন দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান ক্রমশ নিম্নগামী হয়েছে এবং এই অবনতির বিষয়টি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে যেসব গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে, তাঁদের মান ঠিক আশানুরূপ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান, শিক্ষাদান পদ্ধতি কিংবা গবেষণার গুণগত দিক কয়েক দশক থেকেই ভীষণ উপেক্ষিত। এখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিসম্পন্ন গবেষকের সংখ্যা দারুণভাবে কমে গেছে এবং খুব কমসংখ্যক শিক্ষকের লেখাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত জার্নাল ও সাময়িকীতে নিয়মিত প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন জার্নালে যেসব গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, তার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। আন্তর্জাতিক জার্নালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লেখা প্রকাশের হার যে একেবারেই কমে গেছে, এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও গবেষণার মূল্যায়ন শীর্ষক রিপোর্টসমূহে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক মূল্যায়নের যে বিভাগ দুটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে হতাশাজনক স্কোর করে তা হলো: এক. বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাসংক্রান্ত বিভাগ এবং দুই. শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকর্ম সম্পাদনসংক্রান্ত বিভাগ। প্রথমোক্ত বিভাগে খারাপ স্কোর করার অনেক যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য কারণ উল্লেখ করা সম্ভব হলেও যেমন, আর্থিক সংকট এবং কম্পিউটার ব্যবহারের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব, দ্বিতীয়টির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষকদের বাস্তবতা বিশ্লেষণের পাশাপাশি আত্মমূল্যায়নেরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে আশার খবর, গেল কয়েক বছরে সরকারের ডিজিটাল রেভলুশনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে; তবে এই বৃদ্ধির পেছনে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত উদ্যোগের অবদানও অনেকখানি; কিন্তু এখনো এই ব্যবহারের হার ইউরোপ বা এশিয়ার উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক পেছনে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এখানে অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়ার দরকার রয়েছে। তবে এটাও খেয়ালে রাখা জরুরি যে, ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাটি ছাত্রছাত্রীরা কী কাজে ব্যবহার করছে–নিছক ফেসবুকিং আর সস্তা বিনোদনধর্মী চ্যাট করছে, না বিশ্বের বৃহত্তর জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার কাজে ব্যবহার করছে। আর দ্বিতীয় পয়েন্টের ক্ষেত্রে বলা যায়, আন্তর্জাতিক মানের মৌলিক ও সৃজনশীল গবেষণা পরিচালনায় আজকাল শিক্ষকদের আর আগের মতো উৎসাহী হতে দেখা যায় না। এর কারণ হিসেবে আমরা কি বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের মেধা ও মননশীলতাকেই প্রশ্নের মুখোমুখি করব? বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে বরাদ্দকৃত গবেষণা ফান্ডের অপ্রতুলতাকে অনেকেই গবেষণামানের নিম্নগামিতার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে চান। এখানে আমরা জোরের সঙ্গেই বলতে চাই , গুণগত মানের বিচারে ভালো গবেষণা ও তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি গবেষণায় বিনিয়োগকৃত অর্থের সঙ্গে অবধারিতভাবেই সম্পর্কিত। তবে এটাও ঠিক যে, একজন গবেষকের মেধা, মননশীলতা ও দক্ষতাকে যদি একত্রে ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে স্বল্পব্যয়ে অধিক মূল্যবান এবং কার্যকরী গবেষণা পরিচালনা করা সম্ভব। এর জন্য দরকার গবেষণা-সংবেদনশীল-সংস্কৃতি–এরকম একটি পরিবেশ, যেখানে গবেষণাকে উৎসাহিত করা হবে, গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাংলাদেশের মতো একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে যতটুকু অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে এদেশের উচ্চশিক্ষিত মানুষ, এ ক্ষেত্রে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী, পর্যায়ক্রমে ব্যর্থ হচ্ছেন বললে বড় বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। সৃজনশীল এবং প্রায়োগিক জ্ঞান সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই যে সীমাহীন অনীহা, তার সত্যিকারের কারণ আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। কারণ, শিক্ষা এবং গবেষণায় এদেশকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য এটা খুবই জরুরি।
কেন এই অবনতি?
মৌলিক ও ঋদ্ধ গবেষণা পেপার লেখার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই অনীহার কারণ মূলত দুটি। এক. এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক কিংবা ভালো গবেষণা নিবন্ধের যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। দুই. বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রক্রিয়াটি এখন খুব সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর চাকরির অভিজ্ঞতা আর গুটিকয়েক লেখা প্রকাশ করতে পারলে যেকোনো শিক্ষক এখানে পদোন্নতি পেয়ে যান। প্রকাশিত নিবন্ধের মৌলিকত্ব বা গুণগত দিক বিবেচনা করা হয় না একেবারেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নিয়োগ কিংবা পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা বা যোগ্যতার দিকটি অনেক সময়ই উপেক্ষিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে অধ্যাপকের সংখ্যাই বেশি এবং এটা দুঃখজনক যে, তাদের বেশির ভাগেরই মৌলিক কিংবা ঋদ্ধ কোনো গবেষণাকর্ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মাঝে একাডেমিক দক্ষতা অর্জনের কোনো সুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায় না। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রতিহিংসা আছে পুরোমাত্রায়। শিক্ষকদের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ক্রমশ অসুস্থ করে তুলছে। এর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ শনাক্ত করা যায়। যেমন: পাবলিক পরীক্ষায় নকল, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার আশঙ্কাজনক অবনতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী টানাপোড়েন ইত্যাদি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকেরা ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের বাড়তি সময় প্রদানে অনাগ্রহ দেখান। অনেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কনসালটেন্সি, পার্টটাইম চাকরি কিংবা অন্য কাজে সময় দিতে থাকেন। ফলে একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে গড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময়ও পায় না। এসবের পেছনে শিক্ষকেরা যে যুক্তি দাঁড় করান তা হলো, সামাজিক অবস্থান এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা প্রদান করা হয় না।
সবই কি শেষ হয়ে গেছে?
গবেষণা এবং একাডেমিক ক্ষেত্রে হতাশাজনক কয়েকটি বিষয় নিয়ে ওপরে আমরা কথা বললাম। কিন্তু এটাই কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ চিত্র? না, মোটেও তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো বেশকিছু শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা সত্যিকারের জ্ঞানচর্চায় ব্যাপৃত কিংবা জ্ঞানচর্চা করতে আগ্রহী। নিজ নিজ ক্ষেত্রে এঁদের পাণ্ডিত্য, গবেষণা আর চিন্তার মৌলিকত্ব সত্যিই প্রশংসনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধি এবং সামনের সময়ে বাকি বিশ্বের জ্ঞানচর্চার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাল মিলিয়ে চলার বিষয়টি নিয়ে এঁরা ভাবনা-চিন্তা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু, সুন্দর ও কাম্য পরিবেশ তৈরির জন্য এঁরা আন্তরিকভাবে কিছু করতে চান। ঠিক যে, উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব হয়ে গেছে। তবু আমরা মনে করি, এখনো যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া যায়, নিঃসন্দেহে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা ফলদায়ক হবে। এ লেখায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে আমরা স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে সুনির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রম চিহ্নিত করেছি। এর মধ্যে শিক্ষকদের আত্ম-উন্নয়ন থেকে শুরু করে কার্যকর শিক্ষাদান পদ্ধতির বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত আছে।
এক. শিক্ষকদের মূল্যায়ন
শিক্ষকেরা ক্লাসরুমে নিজেদের পাঠদান পদ্ধতির মূল্যায়ন করাতে পারেন। এ মূল্যায়ন করবে শিক্ষার্থীরা। কারণ, একজন শিক্ষকের পাঠদান প্রক্রিয়ার যথার্থ মূল্যায়ন কেবল শিক্ষার্থীরাই করতে পারে। এর মাধ্যমে শিক্ষকেরা নিজেদের দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানতে পারবেন এবং তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও করতে পারবেন। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মসমালোচনা ও পরমতসহিষ্ণুতার এক নয়া সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে। শিক্ষকেরাও যাতে এ প্রক্রিয়া আরম্ভ করতে পারেন, সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।
দুই. ভালোর প্রচার
যেসব শিক্ষক সফলভাবে উচ্চমানের গবেষণা করেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তাদের ইমেজ তুলে ধরতে হবে। বিস্তৃত আকারে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ ও প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য বছরে দুটি বুলেটিন প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিতদের দিয়ে গবেষণাকর্মের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করাতে হবে।
তিন. নয়া শিক্ষাদান পদ্ধতি
সনাতনী শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তন করে একটি নতুন, কার্যকর ও সুসংহত শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। যেমন, শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের ক্লাস শিডিউল ও কোর্সের কন্টেন্ট দিয়ে দিতে হবে। তাদের বিভিন্ন বিষয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রেফারেন্স সরবরাহ করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, শিক্ষক যদি কোর্সের শুরুতে শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত রেফারেন্সসহ একটি কোর্স-প্যাকেট দিতে পারেন।
চার. নতুন প্রযুক্তি
ক্লাসরুমে বক্তৃতা, মডেল, সারণি বা ফিগার পরিবেশন আরও আকর্ষণীয় করার জন্য সব ক্লাসে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার চালু করা যায়। আশার কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের সীমিত ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং তা থেকে আশাপ্রদ ফলও পাওয়া যাচ্ছে। কোনো জটিল বিষয় স্পষ্ট ও সহজ করে বোঝার ক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার ফলপ্রসূ। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর অর্থবহ চাপ তৈরি করতে হবে।
পাঁচ. শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন
অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল ধরে যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে, তা খুব বেশি কার্যকর নয়। এ জন্য শিক্ষার্থী মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি আমরা প্রস্তাব করতে চাই। তিন স্তরবিশিষ্ট এই নয়া মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রথম স্তরে থাকবে অবজেকটিভ প্রশ্নমালা। বিশ্লেষণাত্মক ও প্রবলেম সলভিং ধরনের প্রশ্ন নিয়ে হবে দ্বিতীয় স্তর এবং তৃতীয় পর্যায়ের প্রশ্ন থাকবে কনসেপচুয়াল সমস্যাসংশ্লিষ্ট। এর ফলে শিক্ষার্থীদের তথ্যগত ও বিষয়বস্তুগত জ্ঞানস্তর যেমন পরিমাপ করা যাবে, তেমনি তাদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও সমস্যা সমাধানে তাদের সামর্থ্যের বিষয়টিও উপলব্ধি করা যাবে।
ছয়. মিথস্ক্রিয়া
শিক্ষকদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতার ওপরও আমরা গুরুত্বারোপ করতে চাই। ব্যক্তিগত ও অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্র, গবেষণাকর্ম কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া বা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাপারে শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া থাকতে হবে।
সাত. ক্লাসরুম টেস্ট
ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখার কিংবা তাদের উপস্থিতি নিয়মিত করার লক্ষ্যে আগাম ঘোষণা না দিয়ে মাঝে মাঝে ক্লাস টেস্ট নেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ইস্যুতে ক্লাসরুমে বিতর্কের আয়োজন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের দিয়ে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
আট. শিক্ষক নিয়োগে নিরপেক্ষতা
শিক্ষক নিয়োগ যাতে মেধার ভিত্তিতে হয় এবং সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিই যেন শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, দলীয় আনুগত্য বা স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে উচ্চকিত থাকতে হবে।
নয়. শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক সহজ, সুন্দর করতে হবে। বলা বাহুল্য, তথ্যের আদান-প্রদান বা মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একটি চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা খুবই জরুরি।
দশ. সৃজনশীলতার চর্চা
অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক মান বাড়ানোর লক্ষ্যে তাদেরকে সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিতে হবে। গান, আবৃত্তি-বিতর্ক, খেলাধুলা বা নাট্যচর্চায় উৎসাহিত করতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক আর অসাম্প্রদায়িক মানসগঠনে এসবের চর্চা অনস্বীকার্য। জঙ্গিবাদ মোকাবিলার ক্ষেত্রেও এ উদ্যোগ কাজে দেবে বলে আমরা মনে করি।
এগারো. গবেষণা খাতে বাজেট বৃদ্ধি
দুঃখজনক যে, কোনো সরকারই গবেষণার বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না; অথচ সরকারের যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনায় গবেষণাভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত-সিদ্ধান্তের কোনো বিকল্প নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাটের জিন গবেষণার ক্ষেত্রে সরকারের সামান্য আগ্রহ কত বড় ফল বয়ে এনেছিল—তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আমরা আন্তর্জাতিক মামলায় সমুদ্রের বিস্তৃত জলরাশির ওপর আমাদের অধিকার ফিরে পেয়েছি; কিন্তু সমুদ্র নিয়ে কার্যকর কোনো গবেষণা হচ্ছে না। অথচ পৃথিবী বলছে, ব্লু ইকোনমির যুতসই ব্যবহার বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি পাল্টে দিতে পারে; কিন্তু আমাদের সেদিকে মনোযোগ নেই। আমরা বিশ্বাস করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষককে গড়ে বছরে ১৫-২০ লাখ টাকার বরাদ্দ দেওয়া হোক, বছর শেষে দেখবেন, তারা প্রত্যেকে নিজ বিষয়ে টেক্সট বই লিখেছেন কিংবা নিবিষ্ট মনে নিজ নিজ ক্ষেত্রে গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করছেন। এখানে বাইরের কনাসালটেন্সি বা বাইরের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণা করার কাজকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়–এ মানসিকতা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। বরং এ বিষয়টিকে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে একজন অধ্যাপক বাইরে থেকে গবেষণা ফান্ড এনে সিনিয়র শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন। এর বাইরে আমরা মনে করি, প্রাইভেট সেক্টর, করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং বড় ব্যবসায়ীদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার অর্থায়নে এগিয়ে আসা উচিত।
আরও দুটি নির্দোষ প্রস্তাব
এটা মানি যে, আগের প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আছে এবং দু-একটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভেতর থেকেই কেউ কেউ বাধা দিতে পারেন; যেমন, শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের পাঠদানের মূল্যায়ন; যদিও পৃথিবীজুড়ে এবং বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই চর্চাটি করা হয়; এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, যাঁরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন, তাঁদেরও কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আসতে হয়। এবারে তাই এমন দুটি প্রস্তাব উপস্থাপন করতে চাই, যা খুবই নির্দোষ প্রকৃতির। এতে কেউ কোনো আপত্তি তুলবে না; বরং সমর্থন জোগাবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রভাব হবে খুবই দৃশ্যমান ও সুদূরপ্রসারী।
এক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও অনুষদের আওতায় যতগুলো ক্লাসরুম আছে, শুরুতেই এর একটি জরিপ করতে হবে। বর্তমানে কোন ক্লাসরুমের কী অবস্থা, সেটি চিহ্নিত করতে হবে। এরপর প্রতিটি ক্লাসরুমকে আধুনিক, বিশ্বমানের ও ডিজিটালাইজড করতে হবে। এর মানে প্রতিটি ক্লাসরুমে থাকতে হবে: ক) স্মার্টবোর্ড ও ডিজিটাল পেন; খ) বিল্ট-ইন সাউন্ড সিস্টেম; গ) সাউন্ডপ্রুফ ক্লাসরুম–যাতে বাইরের শব্দ ক্লাসে ব্যাঘাত না ঘটায়; ঘ) স্টেট অব দি আর্ট কম্পিউটার কনফিগারেশন; ঙ) সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সংযোগ; চ) এসি ক্লাসরুম (বি.দ্র. এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘এটুআই প্রকল্প’ অথবা ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়’ থেকে অর্থ প্রাপ্তি সম্ভব)।
দুই. শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য সবুজ, নির্মল ও স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ অপরিহার্য। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে এবং যেখানে-সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার দোকান চালু করা হচ্ছে। সার্বিক শিক্ষা পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের জন্য যা খুবই ক্ষতিকর। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সরল মনে হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থে ইস্যুটিকে খুব সিরিয়াসলি গ্রহণ করা জরুরি। এ থেকে উত্তরণের জন্য ‘গ্রিন ক্যাম্পাস : ক্লিন ক্যাম্পাস’ থিমকে সামনে নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোর টয়লেট ও বাথরুমগুলো সার্বক্ষণিক পরিষ্কার ও ঝকঝকে রাখতে হবে। এ জন্য মেইনটেনেন্সের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কারণ, আমরা দেখেছি, নতুন বাথরুম তৈরি করা হয় ঠিকই; কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কয়েক মাস পরেই তা নষ্ট হয়ে যায়। ‘গ্রিন ক্যাম্পাস : ক্লিন ক্যাম্পাস’-এর জন্য বাড়তি কোনো জনবলের দরকার নেই; বিদ্যমান জনবল দিয়েই এর বাস্তবায়ন সম্ভব। দরকার শুধু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও জোর তদারকি। ক্যাম্পাস এমন সবুজ, স্নিগ্ধ আর পরিষ্কার হবে যে, কেউ কোথাও ময়লা-আবর্জনা ফেলতেই তখন দ্বিধাবোধ করবে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের মাঝে অব্যাহতভাবে সচেতনতামূলক পরিবেশ ক্যাম্পেইন চালাতে হবে।
আমি মনে করি, উপরের দুটি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা গেলে, ‘প্রশাসন এই করেছে সেই করেছে’ বলে কোনো দাবি করতে হবে না। এর প্রভাব এতটাই দৃশ্যমান হবে যে, সবাই তা দেখতে পাবে; ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনের প্রতি দ্রুত সবার ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে।
শেষে বলতে চাই, এসব তালিকাই শেষ নয়। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যে হতাশাজনক অবস্থা বিরাজ করছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার একটি আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা থেকেই এসব প্রস্তাব পেশ করছি। শিক্ষকতা পেশার যে দায়িত্বশীলতা, সে প্রশ্নে আমরা যদি আপস না করি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ ফিরিয়ে আনা খুব কষ্টসাধ্য নয়।
লেখক, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১০ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১০ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১০ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে