গৌতম রায়
সম্প্রতি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো দুটি বিশ্ববিদ্যালয়–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যথাক্রমে ১০০ ও ৬৮ বছরপূর্তি উদযাপন করেছে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এটি কম সময় নয়। এ সময়ে প্রতিষ্ঠান দুটোর অর্জন যেমন অনেক, তেমনি তাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে ফারাকও রয়েছে ব্যাপক। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় দুটোর সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বহুমাত্রিক আলোচনাতেই তা স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয় দুটোর প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির পার্থক্যটুকু এই নিবন্ধটির মূল সুর হলেও মূল বক্তব্যগুলো বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই প্রযোজ্য।
বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণার মাত্রা ও মান নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় আশার চেয়ে হতাশার সুর বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর বাইরে নয়। প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৈরি বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থান পায় না বা পেলেও একেবারে শেষের দিকে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে; সমালোচনার তির যায় শিক্ষক ও প্রশাসকদের দিকে। শিক্ষা ও গবেষণায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমাবনতি আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে শিক্ষকদের যোগ্যতা, কর্মনিষ্ঠা ও উদাসীনতা, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণও এসব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অবস্থান উচ্চে রাখতে বিভিন্ন দেশ যখন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থায়ন করছে, তুলনায় বাংলাদেশের চিত্র বিপরীত। প্রতিবছর বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দেও তা সুস্পষ্ট।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমাবনতির সঙ্গে এর বিকাশের ধারা, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক এবং সমাজ-বাস্তবতা সরাসরি জড়িত। এই ভূখণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপটও এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। অবিভক্ত ভারতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ হিসেবে পরিচিত এ এলাকা শিক্ষা-দীক্ষা বা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যেমন ছিল, তেমনি সে সময়কার রাজনীতির মারপ্যাঁচে প্রয়োজনীয় অনেক প্রাপ্তি থেকেও এ জনপদ বঞ্চিত ছিল। ফলে ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর সময় থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি এ এলাকার উচ্চশিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মানুষের উচ্চশিক্ষার মূল গন্তব্য যখন ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ, সেই ধারাবাহিকতা ছেদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজ শক্তিতেই দ্রুত পূর্ববঙ্গের শিক্ষার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বাঙালির জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টি অচিরেই এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্র হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ কী? সাধারণভাবে বলা চলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে জ্ঞান উৎপাদন, জ্ঞান সংরক্ষণ ও জ্ঞান বিতরণ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টি একাডেমিক জগতের প্রতিষ্ঠিত চর্চাগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে শুরু থেকেই।
তৎকালীন উপাচার্যদের দক্ষ প্রশাসক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, যোগ্য শিক্ষকদের কর্মতৎপরতা এবং শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা–সব মিলিয়েই এটি সম্ভব হয়েছিল।
আস্তে আস্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হতে থাকে রাজনৈতিক আবহ। পৃথিবীতে বিভিন্ন রাষ্ট্র যেখানে তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে, এই ভূখণ্ডে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গঠনে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করেছে। এর আগে এ দেশের মানুষের মাতৃভাষার অধিকার আদায়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রের ভূমিকা পালন করেছে। সন্দেহ নেই, এমন ইতিহাস খুব কম পাওয়া যাবে।
জনসাধারণের জন্য একটি ভাষার অধিকার আদায় এবং একটি রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ–ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অবদান উল্লেখ করতে এ দুটো উদাহরণ দেওয়াই যথেষ্ট হবে। ভাষা আন্দোলনের পরের বছর জন্ম নেওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অপরাপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ–প্রতিটিই প্রয়োজনীয় সময়ে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করেছে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর নানা চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশ আজ যে অবস্থানে রয়েছে, তার পেছনে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান ইতিহাসে লিখিত। কিন্তু একাডেমিক বা জ্ঞানজগতে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান কোথায়? র্যাঙ্কিং বিচারে ভালো অবস্থানে নেই। অনেকে এসব র্যাঙ্কিং উপেক্ষা করতে চান; কিন্তু তাতে বাস্তবতা হারিয়ে যায় না। এসবের সুবাদেই জানা যাচ্ছে অন্যদের তুলনায় আমাদের অবস্থান ও ঘাটতির জায়গাগুলো। পাঠদান, গবেষণা, উদ্ভাবন–নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পশ্চাৎপদতা মানুষ উপলব্ধি করলেও ঠিক কতটুকু পিছিয়ে, র্যাঙ্কিংগুলো তা প্রতিনিয়তই দৃশ্যমান করে তুলছে। নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে বা পশ্চিমাদের তৈরি বলে এসব র্যাঙ্কিং উপেক্ষার যত চেষ্টা করা হয়, ব্যর্থতার করুণ বাস্তবতা তত বেশি দৃশ্যমান হতে থাকে। এমনকি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সচেতনভাবে নিজেকে র্যাঙ্কিংয়ে দেখতে না চাইলেও গবেষণা, শিক্ষার মান ইত্যাদি সূচকে যে পিছিয়ে, সেটি সম্ভবত অস্বীকার করতে পারবে না। পশ্চিমাদের রাজনীতি বা করপোরেট সংস্কৃতি বলেও এসব প্রতিযোগিতাকে উপেক্ষা করা যায় না। কারণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হিটেই অযোগ্য ঘোষিত হচ্ছে, মূল দৌড়ে থাকা তো স্বপ্নের মতো। এটা ঠিক, যেসব মানদণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়কে মাপ করা হয়, সেসব সূচকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করে, সেটি অনুপস্থিত। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি, চাকরি বা এ ধরনের অর্থনৈতিক বিষয় সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়ছে দিন দিন। শিক্ষার ক্ষেত্রে কনটেক্সট বা পরিপ্রেক্ষিতের সংযোগের কথা বলা হয় সত্যি; কিন্তু সম্ভবত এমন কোনো সূচক তৈরি করা যাবে না, যেখানে সব দেশের সব ধরনের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করা সম্ভব।
প্রতিষ্ঠার এত বছর পর–সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ আলোচনা থেকে আপাতত বাদ থাক–বাংলাদেশের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে মানুষের কি এটিই পাওনা ছিল? একাডেমিক বিচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যোজন যোজন পিছিয়ে। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংযুক্তিকে আমলে নিয়ে প্রশ্ন করা যায়, এখনো কি সময় আসেনি একাডেমিক অর্জনের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার? দেশের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তো কম সময় পার করেনি! যদিও একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরোনো বা নতুন বলে তার একাডেমিক মান বিচার করা অনুচিত; কিন্তু এই ঢাকা বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক বা তুলনামূলক কম বয়সী অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই নিজেদের অবস্থান সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
চায়নার সিংহুয়া ইউনিভার্সিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ডিয়েগোর বয়স রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কম। তাদের অবস্থান শীর্ষ চল্লিশের মধ্যে। তারা যদি পারে, আমরা কেন পারছি না?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্ষে বাড়ছে ঠিকই; কিন্তু সে অনুযায়ী গর্জে উঠতে পারছে না। এর দায় এককভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নয়। একটি সমাজ সার্বিক বৈশিষ্ট্যের বাইরে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেতে পারে না। রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারে না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নামতে সমর্থ হবে না কোনোকালেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের মধ্য থেকে নেতৃত্ব ও প্রশাসক নির্বাচন, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির কাঠামোতে আনয়ন, একাডেমিক ও প্রশাসনিক পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়কে বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত রাখা–এ রকম অনেকগুলো বিষয় একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক ও শিক্ষকদের একাডেমিক জগতের নৈতিক অবস্থানে দৃঢ় থাকা। সে ক্ষেত্রেই শুধু বয়সের সঙ্গে অর্জনের সংযোগ ঘটানো সম্ভব।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সম্প্রতি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো দুটি বিশ্ববিদ্যালয়–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যথাক্রমে ১০০ ও ৬৮ বছরপূর্তি উদযাপন করেছে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এটি কম সময় নয়। এ সময়ে প্রতিষ্ঠান দুটোর অর্জন যেমন অনেক, তেমনি তাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে ফারাকও রয়েছে ব্যাপক। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় দুটোর সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বহুমাত্রিক আলোচনাতেই তা স্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয় দুটোর প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির পার্থক্যটুকু এই নিবন্ধটির মূল সুর হলেও মূল বক্তব্যগুলো বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই প্রযোজ্য।
বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণার মাত্রা ও মান নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনায় আশার চেয়ে হতাশার সুর বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর বাইরে নয়। প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৈরি বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থান পায় না বা পেলেও একেবারে শেষের দিকে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে; সমালোচনার তির যায় শিক্ষক ও প্রশাসকদের দিকে। শিক্ষা ও গবেষণায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমাবনতি আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে শিক্ষকদের যোগ্যতা, কর্মনিষ্ঠা ও উদাসীনতা, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণও এসব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অবস্থান উচ্চে রাখতে বিভিন্ন দেশ যখন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থায়ন করছে, তুলনায় বাংলাদেশের চিত্র বিপরীত। প্রতিবছর বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দেও তা সুস্পষ্ট।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমাবনতির সঙ্গে এর বিকাশের ধারা, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক এবং সমাজ-বাস্তবতা সরাসরি জড়িত। এই ভূখণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপটও এ প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। অবিভক্ত ভারতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ হিসেবে পরিচিত এ এলাকা শিক্ষা-দীক্ষা বা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যেমন ছিল, তেমনি সে সময়কার রাজনীতির মারপ্যাঁচে প্রয়োজনীয় অনেক প্রাপ্তি থেকেও এ জনপদ বঞ্চিত ছিল। ফলে ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর সময় থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি এ এলাকার উচ্চশিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মানুষের উচ্চশিক্ষার মূল গন্তব্য যখন ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ, সেই ধারাবাহিকতা ছেদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজ শক্তিতেই দ্রুত পূর্ববঙ্গের শিক্ষার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বাঙালির জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টি অচিরেই এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্র হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ কী? সাধারণভাবে বলা চলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে জ্ঞান উৎপাদন, জ্ঞান সংরক্ষণ ও জ্ঞান বিতরণ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টি একাডেমিক জগতের প্রতিষ্ঠিত চর্চাগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে শুরু থেকেই।
তৎকালীন উপাচার্যদের দক্ষ প্রশাসক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, যোগ্য শিক্ষকদের কর্মতৎপরতা এবং শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা–সব মিলিয়েই এটি সম্ভব হয়েছিল।
আস্তে আস্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হতে থাকে রাজনৈতিক আবহ। পৃথিবীতে বিভিন্ন রাষ্ট্র যেখানে তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে, এই ভূখণ্ডে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গঠনে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করেছে। এর আগে এ দেশের মানুষের মাতৃভাষার অধিকার আদায়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রের ভূমিকা পালন করেছে। সন্দেহ নেই, এমন ইতিহাস খুব কম পাওয়া যাবে।
জনসাধারণের জন্য একটি ভাষার অধিকার আদায় এবং একটি রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ–ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অবদান উল্লেখ করতে এ দুটো উদাহরণ দেওয়াই যথেষ্ট হবে। ভাষা আন্দোলনের পরের বছর জন্ম নেওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অপরাপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ–প্রতিটিই প্রয়োজনীয় সময়ে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করেছে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর নানা চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশ আজ যে অবস্থানে রয়েছে, তার পেছনে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান ইতিহাসে লিখিত। কিন্তু একাডেমিক বা জ্ঞানজগতে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান কোথায়? র্যাঙ্কিং বিচারে ভালো অবস্থানে নেই। অনেকে এসব র্যাঙ্কিং উপেক্ষা করতে চান; কিন্তু তাতে বাস্তবতা হারিয়ে যায় না। এসবের সুবাদেই জানা যাচ্ছে অন্যদের তুলনায় আমাদের অবস্থান ও ঘাটতির জায়গাগুলো। পাঠদান, গবেষণা, উদ্ভাবন–নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পশ্চাৎপদতা মানুষ উপলব্ধি করলেও ঠিক কতটুকু পিছিয়ে, র্যাঙ্কিংগুলো তা প্রতিনিয়তই দৃশ্যমান করে তুলছে। নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে বা পশ্চিমাদের তৈরি বলে এসব র্যাঙ্কিং উপেক্ষার যত চেষ্টা করা হয়, ব্যর্থতার করুণ বাস্তবতা তত বেশি দৃশ্যমান হতে থাকে। এমনকি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সচেতনভাবে নিজেকে র্যাঙ্কিংয়ে দেখতে না চাইলেও গবেষণা, শিক্ষার মান ইত্যাদি সূচকে যে পিছিয়ে, সেটি সম্ভবত অস্বীকার করতে পারবে না। পশ্চিমাদের রাজনীতি বা করপোরেট সংস্কৃতি বলেও এসব প্রতিযোগিতাকে উপেক্ষা করা যায় না। কারণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হিটেই অযোগ্য ঘোষিত হচ্ছে, মূল দৌড়ে থাকা তো স্বপ্নের মতো। এটা ঠিক, যেসব মানদণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়কে মাপ করা হয়, সেসব সূচকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করে, সেটি অনুপস্থিত। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি, চাকরি বা এ ধরনের অর্থনৈতিক বিষয় সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়ছে দিন দিন। শিক্ষার ক্ষেত্রে কনটেক্সট বা পরিপ্রেক্ষিতের সংযোগের কথা বলা হয় সত্যি; কিন্তু সম্ভবত এমন কোনো সূচক তৈরি করা যাবে না, যেখানে সব দেশের সব ধরনের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করা সম্ভব।
প্রতিষ্ঠার এত বছর পর–সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ আলোচনা থেকে আপাতত বাদ থাক–বাংলাদেশের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে মানুষের কি এটিই পাওনা ছিল? একাডেমিক বিচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যোজন যোজন পিছিয়ে। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংযুক্তিকে আমলে নিয়ে প্রশ্ন করা যায়, এখনো কি সময় আসেনি একাডেমিক অর্জনের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার? দেশের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তো কম সময় পার করেনি! যদিও একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরোনো বা নতুন বলে তার একাডেমিক মান বিচার করা অনুচিত; কিন্তু এই ঢাকা বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক বা তুলনামূলক কম বয়সী অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই নিজেদের অবস্থান সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
চায়নার সিংহুয়া ইউনিভার্সিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ডিয়েগোর বয়স রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কম। তাদের অবস্থান শীর্ষ চল্লিশের মধ্যে। তারা যদি পারে, আমরা কেন পারছি না?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্ষে বাড়ছে ঠিকই; কিন্তু সে অনুযায়ী গর্জে উঠতে পারছে না। এর দায় এককভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নয়। একটি সমাজ সার্বিক বৈশিষ্ট্যের বাইরে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেতে পারে না। রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারে না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নামতে সমর্থ হবে না কোনোকালেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের মধ্য থেকে নেতৃত্ব ও প্রশাসক নির্বাচন, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির কাঠামোতে আনয়ন, একাডেমিক ও প্রশাসনিক পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়কে বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত রাখা–এ রকম অনেকগুলো বিষয় একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসক ও শিক্ষকদের একাডেমিক জগতের নৈতিক অবস্থানে দৃঢ় থাকা। সে ক্ষেত্রেই শুধু বয়সের সঙ্গে অর্জনের সংযোগ ঘটানো সম্ভব।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
২ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
২ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
২ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে