আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
পত্রিকা প্লাবিত বাংলাদেশে ‘আজকের পত্রিকা’ নামে একটি নতুন দৈনিক নতুনভাবে দেখা দিল। প্রশ্ন, আমাদের কি আরেকটি নতুন দৈনিকের প্রয়োজন আছে? আমার ধারণা, আছে। এই শ্রেণিবিভাজিত সমাজে সকল শ্রেণির কথা বলার একটি সংবাদপত্র আছে কি? জবাব, নেই। ব্রিটিশ আমলে যখন ধনতন্ত্র বাংলাদেশে শক্তিশালী ছিল না, ধনী–দরিদ্র এই মোটা রেখায় দেশের মানুষ বিভাজিত ছিল তখন গ্রামের মানুষ, যারা সংখ্যায় ছিল গরিষ্ঠ এবং চাষবাস ছিল তাদের প্রধান জীবিকা, তখন এই বিরাট জনসংখ্যা শহরের সংবাদপত্রে উপেক্ষিত ছিল। শহরের কাগজে প্রথম পাতায় বিদেশি খবর প্রাধান্য পেত। দেশের খবর ও শহুরে সাহেব-বাবুদের বক্তৃতা-বিবৃতি, খবরাখবরে প্রথম পাতা ভরা থাকত।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে অবশ্য অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি, বাংলা সকল দৈনিকেরই প্রথম পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপনে ভর্তি থাকত। পত্রিকার পৃষ্ঠাসংখ্যাও ছিল অনেক কম। দেশে নিউজপ্রিন্ট তৈরি হতো না। বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। যুদ্ধের সময় বিদেশ থেকে নিউজপ্রিন্ট আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পত্রিকাগুলোর পৃষ্ঠাসংখ্যা কমানো হয়। খবর ছাপানো প্রথম পাতায় চলে আসে। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
যুদ্ধের সময় সকল বাংলা দৈনিকেরই প্রথম পৃষ্ঠায় খবর বলতে মহাযুদ্ধের খবর ছাপা হতো। হিটলারের সৈন্যবাহিনী রাশিয়ার স্ট্যালিনগ্রাদ শহর অবরোধ করেছে। জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে হাতাহাতি যুদ্ধ চলছে ইত্যাদি খবর। তারপরই গুরুত্ব পেত দেশের রাজনীতির খবর। গান্ধী ও নেহরু কী বলেছেন, জিন্নাহ কী বলেছেন ইত্যাদি। দেশের বিরাট জনসংখ্যা যেখানে বাস করে তাদের খবরাখবর প্রকাশের জন্য পত্রিকার মাত্র এক পৃষ্ঠা (ভেতরের পৃষ্ঠা) বরাদ্দ ছিল। ওপরে লেখা থাকত ‘মফস্বল সংবাদ’।
সেই ব্রিটিশ আমলে দেশের গরিব কৃষিজীবী মানুষের খবর, রাজ বিদ্রোহী তরুণদের খবরাখবর ছাপার জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘লাঙল’ ও ‘গণবাণী’ নামে দুটি সাপ্তাহিক কাগজ বের করেছিলেন। বেশি দিন টেকেনি। নজরুলের সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ কাগজে রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ জানিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের স্বার্থ সুবিধা দেখার জন্য ফজলুল হক ব্রিটিশ আমলে নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কুষ্টিয়ার জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক নেতা শামসুদ্দীন আহমেদ। তিনি কলকাতার ক্রিক রো (পুরোনো নাম) থেকে বের করেন ‘দৈনিক কৃষক’। প্রথমে কিছুদিন কাগজটি সাপ্তাহিক ছিল।
দৈনিক কৃষক–এ গ্রামবাংলার খবর কিছুটা গুরুত্ব পেলেও এই পত্রিকাও খবর প্রকাশে অন্যান্য দৈনিকের প্রথাই অনুসরণ করে। ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করে কৃষকদের অনেক উপকার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পার্টি কৃষকদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে উঠতে পারেনি। এটা করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। তারা কৃষকদের আলাদা সংগঠন গড়ে তোলে। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতা খবর প্রকাশের ধারা পাল্টে দেয়। দেশের কৃষক–শ্রমিক এবং তাদের সংগঠনের কার্যকলাপের খবর প্রকাশকে ‘স্বাধীনতা’ অগ্রাধিকার দিত। কমিউনিস্ট পার্টি মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী হিসেবে বিভক্ত হওয়ার পর ‘স্বাধীনতা’ বন্ধ হয়ে যায়।
অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসি। পাকিস্তান আমলে শ্রমিকনেতা ও এমপি মাহবুবুল হক সাপ্তাহিক ‘পল্লীবার্তা’ নামে একটি কাগজ প্রকাশ করেছিলেন। তাতে গ্রামীণ খবর বেশি প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটি পরে ‘পূর্বদেশ’ নামে দৈনিকে পরিণত হয় এবং জাতীয় দৈনিকের পর্যায়ে উঠে আসে। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে দলীয় বিভাজন ছিল। কোনোটি আওয়ামী লীগের পত্রিকা, কোনোটি মুসলিম লীগের পত্রিকা–এভাবে পত্রিকাগুলোর পরিচিতি ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা তখনো ভেঙে পড়েনি, পত্রিকাগুলোতেও প্রচণ্ডভাবে সামন্তবাদী রাজনীতির প্রভাব ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রকৃত শিল্লোন্নতি শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ গঠন ও অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু দেশের নব্য পুঁজিবাদী এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে। তারা পশ্চিমা পচনশীল এবং দুর্নীতিযুক্ত পুঁজিবাদী অর্থনীতি, বাজার অর্থনীতির ধারা অনুসরণ করতে শুরু করে। বাংলাদেশে শিগগিরই অত্যন্ত ক্ষমতাশালী নব্য পুঁজিবাদী শিল্পপতি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এত দিন মিডিয়া ছিল রাজনৈতিক দলের বা মালিকের দখলে। এখন বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানায় এসে মিডিয়ার চরিত্র বদলে গেছে। মিডিয়া আগে ছিল আদর্শবাদী, এখন বাণিজ্যমুখী।
শুধু মিডিয়া নয়, রাজনীতি, জাতীয় সংসদের সদস্যপদ–সবই ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যায়। তাতে শহর-বন্দরের চেহারা পাল্টে যায়। নানা রংবেরঙের শপিং মলের মতো শিল্পপতিদের মালিকানাধীন সংবাদপত্রের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায়। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর এখন রঙে, বর্ণে, গুণে ও মানে আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের সঙ্গে তুলনা হতে পারে। পুঁজিবাদের বিকাশের ধারায় বাংলাদেশের সমাজজীবনের বিকাশ এবং বিভাগ দুই-ই এসেছে। বাংলাদেশিদের সমাজ এখন আগের মতো ধনী–গরিব শ্রেণিতে বিভাজিত নয়। ধনিকশ্রেণির মধ্যেও বিভাজন এসেছে। বিভাজন এসেছে গরিবশ্রেণির মধ্যেও। এই বিভাজন এখন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত–এই দুই ভাগেও মোটা দাগ টেনে দেখানো যাবে না।
যে উচ্চবিত্তকে আমরা বুর্জোয়া বলি, তাদের মধ্যে শ্রেণিবিভাজন ঘটে পাতি বুর্জোয়া, উঠতি বুর্জোয়া ও পতিত বুর্জোয়া শ্রেণি তৈরি হয়েছে। তাদের সামাজিক কালচার আলাদা। মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেও ভাগ হয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত, পেশাদার মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত। বিলাতেও বড়লোক মালিকশ্রেণির মধ্যে যেমন শ্রেণিবিভাজন হয়েছে, তেমনি হয়েছে ওয়ার্কিং ক্লাসের মধ্যে। হাতে খাটা শ্রমিকেরা এখনো ওল্ড লেবার ক্লাস। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারকারী হোয়াইট কলার ওয়ার্কিং ক্লাস গড়ে উঠেছে। এই ওয়ার্কিং ক্লাসের কাগজ মিরর, সান, স্টার প্রভৃতি। মধ্যবিত্তের কাগজ গার্ডিয়ান, অবজারভার প্রভৃতি। অ্যারস্টোক্রাট ক্লাসের কাগজ টাইমস, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি।
বাংলাদেশেও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির যত বিকাশ ঘটেছে, সমাজও ধনতান্ত্রিক ঘড়ির কাঁটা ধরে তত ভাগে বিভক্ত হয়েছে। বারিধারা ও গুলশান, ধানমন্ডি, বনানীর অভিজাত শ্রেণির মধ্যে যেমন বিভাজন আছে, তেমনি বিভাজন ঘটেছে কৃষিশ্রমিক ও কলকারখানার শ্রমিকদের মধ্যে। শিক্ষা বিস্তারের ফলে শিক্ষিত শ্রমিকশ্রেণিও গড়ে উঠেছে। ব্রিটিশ আমলে দেখা যেত বাঙালি মুসলমানের ঘরে ঘরে দৈনিক আজাদ পত্রিকার একাধিপত্য। আজাদের প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা থাকত ‘মুসলিম বঙ্গ ও আসামের একমাত্র দৈনিক’।
তা সত্ত্বেও গ্রামবাংলার মুসলমানদের দৈনিক পত্রিকা রাখার সংগতি ছিল না। আজাদ পত্রিকা হাউসের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘মোহাম্মদী’র ছিল ব্যাপক প্রচার। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আজাদ ও মোহাম্মদী পত্রিকা তাদের একচেটিয়া প্রভাব ধরে রাখতে পারেনি। মুসলিম জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে মুসলিম মধ্যবিত্তের যে ঐক্য ছিল, তা ভেঙে যায়। এই মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ বুঝতে পারে ধর্ম দ্বারা জাতি গঠন বা রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে ধর্মের নামে শঠতা, প্রতারণা, বঞ্চনা ও বৈষম্যকে কেন্দ্র করে।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠিত হলো। তাঁর সঙ্গে জুটলেন এক তরুণ উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁদের সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে এসে জুটলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। প্রকাশিত হলো প্রথমে সাপ্তাহিক, পরে দৈনিক ইত্তেফাক। আজাদের একচেটিয়া প্রভাব আর রইল না। আওয়ামী লীগও ‘মুসলিম’ শব্দটির খোলস ত্যাগ করে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘ইত্তেফাক’। পাঠকদের শ্রেণিভেদ ভেঙে দিয়েছিল পত্রিকাটি। চাপরাশি থেকে চিফ জাস্টিস–সকলেই পাঠক ছিলেন ইত্তেফাকের।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুব দ্রুত নব্য ধনিকশ্রেণি গড়ে উঠল। দেশে জাতির পিতা ও জাতীয় নেতাদের হত্যা করে সামরিক শাসন, পরে স্বৈরাচারী শাসন প্রবর্তিত হলো। ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাংবাদিকতায় একটা বিরাট যুগ পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার বরপুত্র আমি বলব সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শফিক রেহমানকে। ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাংবাদিকতায় তিনি আধুনিক ও মতামতনির্ভর সাংবাদিকতার প্রবর্তক। তাঁর এই ‘মতামত’ ছিল সামরিক শাসনের কঠোর সমালোচক। অন্যদিকে তরুণসমাজের চোখে তারুণ্যের রং লাগানো সাপ্তাহিক। পরে কাগজটি দৈনিক হলেও আগের রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব আর ধরে রাখতে পারেনি।
শফিক রেহমান যদি পরবর্তীকালে ব্যক্তিগতভাবে সুবিধাবাদী ও সাংবাদিক হিসেবে আত্মবিক্রীত না হতেন, তাহলে আজ বাংলাদেশের সাংবাদিকদের তরুণ প্রজন্মের কাছে শিক্ষাগুরু হয়ে থাকতে পারতেন। বর্তমানে যে দৈনিকটি বিলাতের টাইমস ও সানডে টাইমসের মতো বাংলাদেশের এলিট ও অভিজাত শ্রেণির মুখপত্র, সেই দৈনিকটি শফিক রেহমান দ্বারা প্রবর্তিত সাংবাদিকতার অনুসারী। তবে চালাকির দ্বারা এলিট ক্লাসের স্বার্থ ও সুবিধা রক্ষার সংবাদপত্র।
বিলাতের টাইমস, সানডে টাইমস অত্যন্ত অভিজাত দৈনিক। অভিজাতদের ঘরে এ দুটি পত্রিকাই চোখে পড়ে বটে। কিন্তু জনসমর্থন গঠনের জন্য ‘স্ট্রিট নিউজপেপার’ হিসেবে গণ্য ডেইলি সান এবং মিরর-এর প্রভাব অনেক বেশি। এ দুটি কাগজই ওয়ার্কিং ক্লাসের কাগজ। ঢাকাতেও এলিট ক্লাস ও সুবিধাবাদী শ্রেণির দৈনিকটির পাশাপাশি ওয়ার্কিং ক্লাসের দৈনিকটির প্রচারসংখ্যা অধিক বা বেশি।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনেক মেধাবী মুখের এখন আবির্ভাব হয়েছে। হয়তো তাদের তারুণ্যদীপ্ত লেখা দেখব ‘আজকের পত্রিকা’য়। নাম যখন দৈনিক আজকের পত্রিকা, তখন কাগজটি নিশ্চয়ই গত দিনের গত চিন্তা–চেতনার কাগজ হবে না। তবে এই শ্রেণি বিভাজিত, সংবাদপত্র প্লাবিত দেশে ‘আজকের পত্রিকা’কে তার একটি নিজস্ব অবস্থান, নির্দিষ্ট অবস্থান ঠিক করে নিতে হবে। এই অবস্থানটি নিশ্চয়ই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে। স্বাধীনতার শত্রু ও সাম্প্রদায়িক চক্র এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের আজকের সাংবাদিকতাকে তরুণ প্রজন্মের জন্য অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ শিক্ষাদানের শিক্ষক হয়ে উঠতে হবে। দেশি ও বিদেশি সুবিধাবাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে।
শহুরে পথভ্রষ্ট তরুণ প্রজন্মের সামনে সঠিক পথের দিশা দেখাতে হবে। গ্রামবাংলায় যে বিশাল তরুণসমাজ, শিক্ষিত বেকার সমাজ অন্ধ ভিক্ষুকের মতো দিশাহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের চোখে আলো দিতে হবে। সমাজে নারীর শুধু তথাকথিত ক্ষমতায়ন নয়, সমাজে তাকে সম্মানের আসনে বসানোর আন্দোলনে নামাতে হবে। ‘আজকের পত্রিকা’র সামনে এই লক্ষ্যগুলো যেন থাকে।
‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত বলেছিলেন, পশ্চাৎপদ সমাজে সংবাদপত্র শুধু সংবাদের বাহক নয়, শুধু সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতির ধারক নয়, সমাজের সুস্থ মানস গঠনের সংস্কারক এবং তরুণদের জন্য শিক্ষার আলোক। ঈশ্বর গুপ্ত কথাটা বলেছিলেন উনিশ শতকের গোড়ায়। আমরা যত আধুনিক ও উন্নত হয়ে থাকি, এই একুশ শতকেও কথাটা সত্যি।
করোনা মহামারির চেয়েও আমাদের বড় শত্রু সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা। একমাত্র সংবাদপত্রই পারে এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে। এই কমার্শিয়াল জার্নালিজমের যুগে আইডিয়ালিজম বা আদর্শবাদিতাকে আর ফিরিয়ে আনতে বলি না, কিন্তু হারিয়ে যাওয়া পেশাগত সততাকে আবার ফিরিয়ে আনতে বলি। ‘আজকের পত্রিকা’ আমাদের সৎ সাংবাদিকতা ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে যদি অংশ নেয়, তাহলে এই পত্রিকা প্রকাশের একটা বড় সার্থকতা দেখতে পাচ্ছি।
পত্রিকা প্লাবিত বাংলাদেশে ‘আজকের পত্রিকা’ জোয়ারে ভাসা কচুরিপানা না হয়ে সুস্থ সমাজ গঠনের পলিমাটি বহন করুক–এটা আমার প্রার্থনা। দেশে পত্রিকা তো আছে অনেক, হলুদ পত্রিকার সংখ্যাই বেশি। আজকের পত্রিকা হোক সেখানে সব শ্রেণির মানুষের মনের কথা বলার সাহসী কাগজ। শুধু কসমোপলিটন সিটির মানুষ নয়, বাংলাদেশের যে বিশালসংখ্যক মানুষ গ্রামে বাস করে, ‘আজকের পত্রিকা’ তাদেরও প্রকৃত মুখপত্র হওয়ার দায়িত্ব বহন করুক। হোক এগিয়ে যাওয়া দেশের মুখপত্র।
লন্ডন, ১০ জুন ২০২১।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
পত্রিকা প্লাবিত বাংলাদেশে ‘আজকের পত্রিকা’ নামে একটি নতুন দৈনিক নতুনভাবে দেখা দিল। প্রশ্ন, আমাদের কি আরেকটি নতুন দৈনিকের প্রয়োজন আছে? আমার ধারণা, আছে। এই শ্রেণিবিভাজিত সমাজে সকল শ্রেণির কথা বলার একটি সংবাদপত্র আছে কি? জবাব, নেই। ব্রিটিশ আমলে যখন ধনতন্ত্র বাংলাদেশে শক্তিশালী ছিল না, ধনী–দরিদ্র এই মোটা রেখায় দেশের মানুষ বিভাজিত ছিল তখন গ্রামের মানুষ, যারা সংখ্যায় ছিল গরিষ্ঠ এবং চাষবাস ছিল তাদের প্রধান জীবিকা, তখন এই বিরাট জনসংখ্যা শহরের সংবাদপত্রে উপেক্ষিত ছিল। শহরের কাগজে প্রথম পাতায় বিদেশি খবর প্রাধান্য পেত। দেশের খবর ও শহুরে সাহেব-বাবুদের বক্তৃতা-বিবৃতি, খবরাখবরে প্রথম পাতা ভরা থাকত।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে অবশ্য অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি, বাংলা সকল দৈনিকেরই প্রথম পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপনে ভর্তি থাকত। পত্রিকার পৃষ্ঠাসংখ্যাও ছিল অনেক কম। দেশে নিউজপ্রিন্ট তৈরি হতো না। বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। যুদ্ধের সময় বিদেশ থেকে নিউজপ্রিন্ট আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পত্রিকাগুলোর পৃষ্ঠাসংখ্যা কমানো হয়। খবর ছাপানো প্রথম পাতায় চলে আসে। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
যুদ্ধের সময় সকল বাংলা দৈনিকেরই প্রথম পৃষ্ঠায় খবর বলতে মহাযুদ্ধের খবর ছাপা হতো। হিটলারের সৈন্যবাহিনী রাশিয়ার স্ট্যালিনগ্রাদ শহর অবরোধ করেছে। জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে হাতাহাতি যুদ্ধ চলছে ইত্যাদি খবর। তারপরই গুরুত্ব পেত দেশের রাজনীতির খবর। গান্ধী ও নেহরু কী বলেছেন, জিন্নাহ কী বলেছেন ইত্যাদি। দেশের বিরাট জনসংখ্যা যেখানে বাস করে তাদের খবরাখবর প্রকাশের জন্য পত্রিকার মাত্র এক পৃষ্ঠা (ভেতরের পৃষ্ঠা) বরাদ্দ ছিল। ওপরে লেখা থাকত ‘মফস্বল সংবাদ’।
সেই ব্রিটিশ আমলে দেশের গরিব কৃষিজীবী মানুষের খবর, রাজ বিদ্রোহী তরুণদের খবরাখবর ছাপার জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘লাঙল’ ও ‘গণবাণী’ নামে দুটি সাপ্তাহিক কাগজ বের করেছিলেন। বেশি দিন টেকেনি। নজরুলের সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ কাগজে রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ জানিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের স্বার্থ সুবিধা দেখার জন্য ফজলুল হক ব্রিটিশ আমলে নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কুষ্টিয়ার জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক নেতা শামসুদ্দীন আহমেদ। তিনি কলকাতার ক্রিক রো (পুরোনো নাম) থেকে বের করেন ‘দৈনিক কৃষক’। প্রথমে কিছুদিন কাগজটি সাপ্তাহিক ছিল।
দৈনিক কৃষক–এ গ্রামবাংলার খবর কিছুটা গুরুত্ব পেলেও এই পত্রিকাও খবর প্রকাশে অন্যান্য দৈনিকের প্রথাই অনুসরণ করে। ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করে কৃষকদের অনেক উপকার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পার্টি কৃষকদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে উঠতে পারেনি। এটা করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। তারা কৃষকদের আলাদা সংগঠন গড়ে তোলে। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতা খবর প্রকাশের ধারা পাল্টে দেয়। দেশের কৃষক–শ্রমিক এবং তাদের সংগঠনের কার্যকলাপের খবর প্রকাশকে ‘স্বাধীনতা’ অগ্রাধিকার দিত। কমিউনিস্ট পার্টি মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী হিসেবে বিভক্ত হওয়ার পর ‘স্বাধীনতা’ বন্ধ হয়ে যায়।
অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসি। পাকিস্তান আমলে শ্রমিকনেতা ও এমপি মাহবুবুল হক সাপ্তাহিক ‘পল্লীবার্তা’ নামে একটি কাগজ প্রকাশ করেছিলেন। তাতে গ্রামীণ খবর বেশি প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটি পরে ‘পূর্বদেশ’ নামে দৈনিকে পরিণত হয় এবং জাতীয় দৈনিকের পর্যায়ে উঠে আসে। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে দলীয় বিভাজন ছিল। কোনোটি আওয়ামী লীগের পত্রিকা, কোনোটি মুসলিম লীগের পত্রিকা–এভাবে পত্রিকাগুলোর পরিচিতি ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা তখনো ভেঙে পড়েনি, পত্রিকাগুলোতেও প্রচণ্ডভাবে সামন্তবাদী রাজনীতির প্রভাব ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রকৃত শিল্লোন্নতি শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ গঠন ও অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু দেশের নব্য পুঁজিবাদী এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে। তারা পশ্চিমা পচনশীল এবং দুর্নীতিযুক্ত পুঁজিবাদী অর্থনীতি, বাজার অর্থনীতির ধারা অনুসরণ করতে শুরু করে। বাংলাদেশে শিগগিরই অত্যন্ত ক্ষমতাশালী নব্য পুঁজিবাদী শিল্পপতি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এত দিন মিডিয়া ছিল রাজনৈতিক দলের বা মালিকের দখলে। এখন বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানায় এসে মিডিয়ার চরিত্র বদলে গেছে। মিডিয়া আগে ছিল আদর্শবাদী, এখন বাণিজ্যমুখী।
শুধু মিডিয়া নয়, রাজনীতি, জাতীয় সংসদের সদস্যপদ–সবই ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যায়। তাতে শহর-বন্দরের চেহারা পাল্টে যায়। নানা রংবেরঙের শপিং মলের মতো শিল্পপতিদের মালিকানাধীন সংবাদপত্রের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায়। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর এখন রঙে, বর্ণে, গুণে ও মানে আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের সঙ্গে তুলনা হতে পারে। পুঁজিবাদের বিকাশের ধারায় বাংলাদেশের সমাজজীবনের বিকাশ এবং বিভাগ দুই-ই এসেছে। বাংলাদেশিদের সমাজ এখন আগের মতো ধনী–গরিব শ্রেণিতে বিভাজিত নয়। ধনিকশ্রেণির মধ্যেও বিভাজন এসেছে। বিভাজন এসেছে গরিবশ্রেণির মধ্যেও। এই বিভাজন এখন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত–এই দুই ভাগেও মোটা দাগ টেনে দেখানো যাবে না।
যে উচ্চবিত্তকে আমরা বুর্জোয়া বলি, তাদের মধ্যে শ্রেণিবিভাজন ঘটে পাতি বুর্জোয়া, উঠতি বুর্জোয়া ও পতিত বুর্জোয়া শ্রেণি তৈরি হয়েছে। তাদের সামাজিক কালচার আলাদা। মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেও ভাগ হয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত, পেশাদার মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত। বিলাতেও বড়লোক মালিকশ্রেণির মধ্যে যেমন শ্রেণিবিভাজন হয়েছে, তেমনি হয়েছে ওয়ার্কিং ক্লাসের মধ্যে। হাতে খাটা শ্রমিকেরা এখনো ওল্ড লেবার ক্লাস। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারকারী হোয়াইট কলার ওয়ার্কিং ক্লাস গড়ে উঠেছে। এই ওয়ার্কিং ক্লাসের কাগজ মিরর, সান, স্টার প্রভৃতি। মধ্যবিত্তের কাগজ গার্ডিয়ান, অবজারভার প্রভৃতি। অ্যারস্টোক্রাট ক্লাসের কাগজ টাইমস, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি।
বাংলাদেশেও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির যত বিকাশ ঘটেছে, সমাজও ধনতান্ত্রিক ঘড়ির কাঁটা ধরে তত ভাগে বিভক্ত হয়েছে। বারিধারা ও গুলশান, ধানমন্ডি, বনানীর অভিজাত শ্রেণির মধ্যে যেমন বিভাজন আছে, তেমনি বিভাজন ঘটেছে কৃষিশ্রমিক ও কলকারখানার শ্রমিকদের মধ্যে। শিক্ষা বিস্তারের ফলে শিক্ষিত শ্রমিকশ্রেণিও গড়ে উঠেছে। ব্রিটিশ আমলে দেখা যেত বাঙালি মুসলমানের ঘরে ঘরে দৈনিক আজাদ পত্রিকার একাধিপত্য। আজাদের প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা থাকত ‘মুসলিম বঙ্গ ও আসামের একমাত্র দৈনিক’।
তা সত্ত্বেও গ্রামবাংলার মুসলমানদের দৈনিক পত্রিকা রাখার সংগতি ছিল না। আজাদ পত্রিকা হাউসের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘মোহাম্মদী’র ছিল ব্যাপক প্রচার। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আজাদ ও মোহাম্মদী পত্রিকা তাদের একচেটিয়া প্রভাব ধরে রাখতে পারেনি। মুসলিম জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে মুসলিম মধ্যবিত্তের যে ঐক্য ছিল, তা ভেঙে যায়। এই মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ বুঝতে পারে ধর্ম দ্বারা জাতি গঠন বা রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে ধর্মের নামে শঠতা, প্রতারণা, বঞ্চনা ও বৈষম্যকে কেন্দ্র করে।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠিত হলো। তাঁর সঙ্গে জুটলেন এক তরুণ উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁদের সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে এসে জুটলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। প্রকাশিত হলো প্রথমে সাপ্তাহিক, পরে দৈনিক ইত্তেফাক। আজাদের একচেটিয়া প্রভাব আর রইল না। আওয়ামী লীগও ‘মুসলিম’ শব্দটির খোলস ত্যাগ করে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘ইত্তেফাক’। পাঠকদের শ্রেণিভেদ ভেঙে দিয়েছিল পত্রিকাটি। চাপরাশি থেকে চিফ জাস্টিস–সকলেই পাঠক ছিলেন ইত্তেফাকের।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুব দ্রুত নব্য ধনিকশ্রেণি গড়ে উঠল। দেশে জাতির পিতা ও জাতীয় নেতাদের হত্যা করে সামরিক শাসন, পরে স্বৈরাচারী শাসন প্রবর্তিত হলো। ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাংবাদিকতায় একটা বিরাট যুগ পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার বরপুত্র আমি বলব সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শফিক রেহমানকে। ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সাংবাদিকতায় তিনি আধুনিক ও মতামতনির্ভর সাংবাদিকতার প্রবর্তক। তাঁর এই ‘মতামত’ ছিল সামরিক শাসনের কঠোর সমালোচক। অন্যদিকে তরুণসমাজের চোখে তারুণ্যের রং লাগানো সাপ্তাহিক। পরে কাগজটি দৈনিক হলেও আগের রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব আর ধরে রাখতে পারেনি।
শফিক রেহমান যদি পরবর্তীকালে ব্যক্তিগতভাবে সুবিধাবাদী ও সাংবাদিক হিসেবে আত্মবিক্রীত না হতেন, তাহলে আজ বাংলাদেশের সাংবাদিকদের তরুণ প্রজন্মের কাছে শিক্ষাগুরু হয়ে থাকতে পারতেন। বর্তমানে যে দৈনিকটি বিলাতের টাইমস ও সানডে টাইমসের মতো বাংলাদেশের এলিট ও অভিজাত শ্রেণির মুখপত্র, সেই দৈনিকটি শফিক রেহমান দ্বারা প্রবর্তিত সাংবাদিকতার অনুসারী। তবে চালাকির দ্বারা এলিট ক্লাসের স্বার্থ ও সুবিধা রক্ষার সংবাদপত্র।
বিলাতের টাইমস, সানডে টাইমস অত্যন্ত অভিজাত দৈনিক। অভিজাতদের ঘরে এ দুটি পত্রিকাই চোখে পড়ে বটে। কিন্তু জনসমর্থন গঠনের জন্য ‘স্ট্রিট নিউজপেপার’ হিসেবে গণ্য ডেইলি সান এবং মিরর-এর প্রভাব অনেক বেশি। এ দুটি কাগজই ওয়ার্কিং ক্লাসের কাগজ। ঢাকাতেও এলিট ক্লাস ও সুবিধাবাদী শ্রেণির দৈনিকটির পাশাপাশি ওয়ার্কিং ক্লাসের দৈনিকটির প্রচারসংখ্যা অধিক বা বেশি।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনেক মেধাবী মুখের এখন আবির্ভাব হয়েছে। হয়তো তাদের তারুণ্যদীপ্ত লেখা দেখব ‘আজকের পত্রিকা’য়। নাম যখন দৈনিক আজকের পত্রিকা, তখন কাগজটি নিশ্চয়ই গত দিনের গত চিন্তা–চেতনার কাগজ হবে না। তবে এই শ্রেণি বিভাজিত, সংবাদপত্র প্লাবিত দেশে ‘আজকের পত্রিকা’কে তার একটি নিজস্ব অবস্থান, নির্দিষ্ট অবস্থান ঠিক করে নিতে হবে। এই অবস্থানটি নিশ্চয়ই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে। স্বাধীনতার শত্রু ও সাম্প্রদায়িক চক্র এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের আজকের সাংবাদিকতাকে তরুণ প্রজন্মের জন্য অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ শিক্ষাদানের শিক্ষক হয়ে উঠতে হবে। দেশি ও বিদেশি সুবিধাবাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে।
শহুরে পথভ্রষ্ট তরুণ প্রজন্মের সামনে সঠিক পথের দিশা দেখাতে হবে। গ্রামবাংলায় যে বিশাল তরুণসমাজ, শিক্ষিত বেকার সমাজ অন্ধ ভিক্ষুকের মতো দিশাহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের চোখে আলো দিতে হবে। সমাজে নারীর শুধু তথাকথিত ক্ষমতায়ন নয়, সমাজে তাকে সম্মানের আসনে বসানোর আন্দোলনে নামাতে হবে। ‘আজকের পত্রিকা’র সামনে এই লক্ষ্যগুলো যেন থাকে।
‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত বলেছিলেন, পশ্চাৎপদ সমাজে সংবাদপত্র শুধু সংবাদের বাহক নয়, শুধু সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতির ধারক নয়, সমাজের সুস্থ মানস গঠনের সংস্কারক এবং তরুণদের জন্য শিক্ষার আলোক। ঈশ্বর গুপ্ত কথাটা বলেছিলেন উনিশ শতকের গোড়ায়। আমরা যত আধুনিক ও উন্নত হয়ে থাকি, এই একুশ শতকেও কথাটা সত্যি।
করোনা মহামারির চেয়েও আমাদের বড় শত্রু সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা। একমাত্র সংবাদপত্রই পারে এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে। এই কমার্শিয়াল জার্নালিজমের যুগে আইডিয়ালিজম বা আদর্শবাদিতাকে আর ফিরিয়ে আনতে বলি না, কিন্তু হারিয়ে যাওয়া পেশাগত সততাকে আবার ফিরিয়ে আনতে বলি। ‘আজকের পত্রিকা’ আমাদের সৎ সাংবাদিকতা ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে যদি অংশ নেয়, তাহলে এই পত্রিকা প্রকাশের একটা বড় সার্থকতা দেখতে পাচ্ছি।
পত্রিকা প্লাবিত বাংলাদেশে ‘আজকের পত্রিকা’ জোয়ারে ভাসা কচুরিপানা না হয়ে সুস্থ সমাজ গঠনের পলিমাটি বহন করুক–এটা আমার প্রার্থনা। দেশে পত্রিকা তো আছে অনেক, হলুদ পত্রিকার সংখ্যাই বেশি। আজকের পত্রিকা হোক সেখানে সব শ্রেণির মানুষের মনের কথা বলার সাহসী কাগজ। শুধু কসমোপলিটন সিটির মানুষ নয়, বাংলাদেশের যে বিশালসংখ্যক মানুষ গ্রামে বাস করে, ‘আজকের পত্রিকা’ তাদেরও প্রকৃত মুখপত্র হওয়ার দায়িত্ব বহন করুক। হোক এগিয়ে যাওয়া দেশের মুখপত্র।
লন্ডন, ১০ জুন ২০২১।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১৪ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১৪ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১৪ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ দিন আগে