চিররঞ্জন সরকার
করোনা নয়, আপাতত ঘরে ঘরে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে গরু। কারণ কোরবানির ঈদ। কেমন গরু কোরবানি করা হবে, সেই গরু কোত্থেকে সংগ্রহ করা হবে, তার দাম কী রকম হবে, সেই টাকা কোথা থেকে আসবে, এককভাবে কোরবানি দেওয়া হবে, নাকি ভাগে দেওয়া হবে, কোরবানির পশুর হাটে গরু কিনতে গেলে গরুর সঙ্গে করোনা আসবে কি না—এসব নিয়ে এখন বাংলার ঘরে ঘরে আলোচনা, গবেষণা। আসলে কোরবানির ঈদ এলে বোঝা যায় গরু কতটা উপকারী প্রাণী এবং এর গুরুত্ব কত।
গরু কেবল লাথি কিংবা গুঁতোই দেয় না; বরং দুধ দেয়, মাংসও দেয়। অনেকটা শিল্পপতিদের মতো। তারা কেবল ‘শ্রম শোষণ’ই করে না, জীবিকা দেয়, মজুরি দেয়, যা দিয়ে গরিব মানুষ বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে। গরু আমাদের আরও অনেক কিছুই দেয়। হাম্বা দেয়, হাড়, লেজ, গোবর, চামড়াও দেয়। গোমূত্র জমিকে উর্বর করে। কোনো কোনো দেশে তা পবিত্রতার প্রতীক। ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যদিও গোমূত্র বা গোচোনা অনেক ‘বিধ্বংসী’ ক্ষমতার অধিকারী। কথায় আছে, ‘সোয়া মণ দুধ নষ্ট করে এক ফোঁটা গোচোনা।’ এর মর্মার্থ হলো, সোয়া এক মণ দুধের মধ্যে এক ফোঁটা চোনা, মানে গরুর এক ফোঁটা মূত্র পড়লে তা নষ্ট হয়ে যায়, খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না।
মাদের জীবনযাত্রা অর্থনীতির সঙ্গে গরুর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ছোটবেলায় গরু নিয়ে রচনা লেখেনি এমন মানুষ নেই বললেই চলে। বাবা-মা কিংবা শিক্ষক-অভিভাবক-প্রেয়সীর কাছে গরু সম্বোধন শোনেনি এমন হতভাগ্য বাঙালিও বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মানুষের জীবনে এমন কোনো ক্ষেত্র পাওয়া দুষ্কর, যেখানে গরুর ভূমিকা নেই। তাই গরু হলো এই পৃথিবীর সব মানুষের কাছে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গৃহপালিত পশু। সবচেয়ে সম্মানিত প্রাণীও বটে। কোনো কোনো সম্প্রদায় গরুকে ‘মাতা’ বলে সম্মান করে।
বলদ, ষাঁড়, গাভি, বাছুর, দেশি, বিদেশি ইত্যাদি নানা ধরনের গরু আছে। তবে সুসাহিত্যিক সুকুমার রায় এক আজব গুরুর কথা লিখেছিলেন, তার নাম ‘ট্যাশ গরু’। ‘ট্যাঁশ গরু গরু নয়, আসলে তে পাখি সে; যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে।’ তবে বিভিন্ন অফিস-আদালতে এমন বিচিত্র গরুর অভাব নেই। সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দিতে গেলে চাকরি থাকবে?
গরু হারালে মানুষের নাকি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। কথিত আছে, গ্রামের এক লোকের গরু হারালে সে সকালে খুঁজতে বেরিয়ে দুপুরে শুষ্ক মুখে বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের পর পুত্রকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে এক গ্লাস পানি আনতে বলেন। এটা শুনে স্ত্রী বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? ছেলেকে কেউ ভাই বলে? ‘এর জবাবে নাকি লোকটি বলেছিল, ‘গরু হারালে এমনই হয়, মা।’
গরুরা নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করতে পছন্দ করে। বিশেষ করে বলদ বা ষাঁড় শ্রেণির গরুরা। আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজেও তেমন প্রবণতা আছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেন না। পারলে গুঁতিয়ে প্রাণ সংহার করেন। এমনকি এই উপকারী প্রাণীটির বানান নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে। ‘গরু’ না ‘গোরু’—এ নিয়ে অনেক পণ্ডিতের মধ্যে রয়েছে সংশয়। ২০১৬ সালের আগেও আমাদের দেশে অকাতরে নির্দ্বিধায় লেখা হয়েছে গরু। কিন্তু এরপর অভিধানে আকস্মিক ‘গোরু’ লেখা শুরু হয়।
কোনো কোনো পণ্ডিত প্রাচীন বই-পুস্তক ঘেঁটে বলেন, ৫০টি চর্যাপদের মধ্যে ‘গরু’ শব্দ নেই। ১৪৫০-১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে বড়ু চণ্ডীদাস লিখেছেন গরু, গরূ, গোরো এবং বিদ্যাপতি লিখেছেন ‘গরুঅ’। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে মালাধর বসু লিখেছেন ‘গোরু’, ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে মুকুন্দ দাস লিখেছেন ‘গোরু’ এবং ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘গোরু’। ১৯২৯–৩০ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের লেখায়ও ‘গোরু’ বানান দেখা যায়। যদিও পরে তিনি ‘গরু’ লিখতে শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গেও সেই সূত্রে গরু প্রচলিত হয়ে যায়।
গো (সংস্কৃত, গম+ও) /গোরু/গরু (সংস্কৃত, গরূপ) অর্থ হলো: জ্ঞান, ঐশ্বর্য, ধনু, গাভি, ষাঁড়, বৃষ, নিরেট বোকা/মূর্খ প্রভৃতি।
বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি উচ্চারণ অভিধান ও ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ‘গরু’ লেখা হয়েছে। কারণ সংবৃত অ-ধ্বনির পরে ই/ঈ/উ/ঊ-কার থাকলে অ-ধ্বনি ও-ধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন: গরু>গোরু। জামিল চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি অধুনিক বাংলা অভিধান’ (২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ) লিখেছে ‘গোরু’।
পণ্ডিতদের মধ্যে বানান নিয়ে দলাদলি থাকলেও গরুর কিন্তু এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের তো জন্ম হয়েছে জবাই ও কোরবানি হওয়ার জন্য! সমাজে ও পরিবারে উপকারী ব্যক্তিরা যেমনটি হয়।
তবে সব মানুষই কিন্তু প্রকারান্তরে গরু হতে চেষ্টা করে। এ কারণেই পৃথিবীভর্তি ভালোমানুষকে গো-বেচারা বলা হয়!
লেখক: গবেষক ও রম্যলেখক
করোনা নয়, আপাতত ঘরে ঘরে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে গরু। কারণ কোরবানির ঈদ। কেমন গরু কোরবানি করা হবে, সেই গরু কোত্থেকে সংগ্রহ করা হবে, তার দাম কী রকম হবে, সেই টাকা কোথা থেকে আসবে, এককভাবে কোরবানি দেওয়া হবে, নাকি ভাগে দেওয়া হবে, কোরবানির পশুর হাটে গরু কিনতে গেলে গরুর সঙ্গে করোনা আসবে কি না—এসব নিয়ে এখন বাংলার ঘরে ঘরে আলোচনা, গবেষণা। আসলে কোরবানির ঈদ এলে বোঝা যায় গরু কতটা উপকারী প্রাণী এবং এর গুরুত্ব কত।
গরু কেবল লাথি কিংবা গুঁতোই দেয় না; বরং দুধ দেয়, মাংসও দেয়। অনেকটা শিল্পপতিদের মতো। তারা কেবল ‘শ্রম শোষণ’ই করে না, জীবিকা দেয়, মজুরি দেয়, যা দিয়ে গরিব মানুষ বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে। গরু আমাদের আরও অনেক কিছুই দেয়। হাম্বা দেয়, হাড়, লেজ, গোবর, চামড়াও দেয়। গোমূত্র জমিকে উর্বর করে। কোনো কোনো দেশে তা পবিত্রতার প্রতীক। ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যদিও গোমূত্র বা গোচোনা অনেক ‘বিধ্বংসী’ ক্ষমতার অধিকারী। কথায় আছে, ‘সোয়া মণ দুধ নষ্ট করে এক ফোঁটা গোচোনা।’ এর মর্মার্থ হলো, সোয়া এক মণ দুধের মধ্যে এক ফোঁটা চোনা, মানে গরুর এক ফোঁটা মূত্র পড়লে তা নষ্ট হয়ে যায়, খাওয়ার উপযুক্ত থাকে না।
মাদের জীবনযাত্রা অর্থনীতির সঙ্গে গরুর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ছোটবেলায় গরু নিয়ে রচনা লেখেনি এমন মানুষ নেই বললেই চলে। বাবা-মা কিংবা শিক্ষক-অভিভাবক-প্রেয়সীর কাছে গরু সম্বোধন শোনেনি এমন হতভাগ্য বাঙালিও বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মানুষের জীবনে এমন কোনো ক্ষেত্র পাওয়া দুষ্কর, যেখানে গরুর ভূমিকা নেই। তাই গরু হলো এই পৃথিবীর সব মানুষের কাছে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গৃহপালিত পশু। সবচেয়ে সম্মানিত প্রাণীও বটে। কোনো কোনো সম্প্রদায় গরুকে ‘মাতা’ বলে সম্মান করে।
বলদ, ষাঁড়, গাভি, বাছুর, দেশি, বিদেশি ইত্যাদি নানা ধরনের গরু আছে। তবে সুসাহিত্যিক সুকুমার রায় এক আজব গুরুর কথা লিখেছিলেন, তার নাম ‘ট্যাশ গরু’। ‘ট্যাঁশ গরু গরু নয়, আসলে তে পাখি সে; যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে।’ তবে বিভিন্ন অফিস-আদালতে এমন বিচিত্র গরুর অভাব নেই। সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দিতে গেলে চাকরি থাকবে?
গরু হারালে মানুষের নাকি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। কথিত আছে, গ্রামের এক লোকের গরু হারালে সে সকালে খুঁজতে বেরিয়ে দুপুরে শুষ্ক মুখে বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের পর পুত্রকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে এক গ্লাস পানি আনতে বলেন। এটা শুনে স্ত্রী বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? ছেলেকে কেউ ভাই বলে? ‘এর জবাবে নাকি লোকটি বলেছিল, ‘গরু হারালে এমনই হয়, মা।’
গরুরা নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করতে পছন্দ করে। বিশেষ করে বলদ বা ষাঁড় শ্রেণির গরুরা। আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজেও তেমন প্রবণতা আছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেন না। পারলে গুঁতিয়ে প্রাণ সংহার করেন। এমনকি এই উপকারী প্রাণীটির বানান নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে। ‘গরু’ না ‘গোরু’—এ নিয়ে অনেক পণ্ডিতের মধ্যে রয়েছে সংশয়। ২০১৬ সালের আগেও আমাদের দেশে অকাতরে নির্দ্বিধায় লেখা হয়েছে গরু। কিন্তু এরপর অভিধানে আকস্মিক ‘গোরু’ লেখা শুরু হয়।
কোনো কোনো পণ্ডিত প্রাচীন বই-পুস্তক ঘেঁটে বলেন, ৫০টি চর্যাপদের মধ্যে ‘গরু’ শব্দ নেই। ১৪৫০-১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে বড়ু চণ্ডীদাস লিখেছেন গরু, গরূ, গোরো এবং বিদ্যাপতি লিখেছেন ‘গরুঅ’। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে মালাধর বসু লিখেছেন ‘গোরু’, ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে মুকুন্দ দাস লিখেছেন ‘গোরু’ এবং ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘গোরু’। ১৯২৯–৩০ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের লেখায়ও ‘গোরু’ বানান দেখা যায়। যদিও পরে তিনি ‘গরু’ লিখতে শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গেও সেই সূত্রে গরু প্রচলিত হয়ে যায়।
গো (সংস্কৃত, গম+ও) /গোরু/গরু (সংস্কৃত, গরূপ) অর্থ হলো: জ্ঞান, ঐশ্বর্য, ধনু, গাভি, ষাঁড়, বৃষ, নিরেট বোকা/মূর্খ প্রভৃতি।
বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি উচ্চারণ অভিধান ও ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ‘গরু’ লেখা হয়েছে। কারণ সংবৃত অ-ধ্বনির পরে ই/ঈ/উ/ঊ-কার থাকলে অ-ধ্বনি ও-ধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন: গরু>গোরু। জামিল চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমি অধুনিক বাংলা অভিধান’ (২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ) লিখেছে ‘গোরু’।
পণ্ডিতদের মধ্যে বানান নিয়ে দলাদলি থাকলেও গরুর কিন্তু এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের তো জন্ম হয়েছে জবাই ও কোরবানি হওয়ার জন্য! সমাজে ও পরিবারে উপকারী ব্যক্তিরা যেমনটি হয়।
তবে সব মানুষই কিন্তু প্রকারান্তরে গরু হতে চেষ্টা করে। এ কারণেই পৃথিবীভর্তি ভালোমানুষকে গো-বেচারা বলা হয়!
লেখক: গবেষক ও রম্যলেখক
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
৪ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
৪ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
৪ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে