রাশেদা রওনক খান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজ আমাদের গ্রামের সৈয়দাবাদ সরকারি কলেজের ছাত্র ছিল! এই কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা আমার চাচা মরহুম এ বি এম সিদ্দিক, যাঁর একটাই আশা ছিল, একদিন এই গ্রাম ও আশপাশের এলাকার ছেলেমেয়েরা এই কলেজ থেকে শিক্ষা লাভ করে দেশের সব বড় বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হবে। সংগত কারণেই হাফিজের মৃত্যুর ঘটনাটি আমাকে যারপরনাই ভাবাচ্ছে। একটা বড় কারণ, শিক্ষক হিসেবে ওর মতো শিক্ষার্থীদের আমরা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। অন্যদিকে নিজেদের কলেজ থেকে পাস করা ছাত্র ও কলেজের শিক্ষকদের এক দুজনকে ফোন দিয়ে ওর সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তাঁদের তথ্যমতে, হাফিজ ২০১৪ সালে এই কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিল। পরিবারে সচ্ছলতা ছিল না ঠিকই, ছিল ছেলেটির মেধার ওপর পরিবারের অগাধ বিশ্বাস, আস্থা ও ভরসা। অনেক কষ্ট করে ওর এত দূর যাওয়া।
আচ্ছা, কেউ কি বলতে পারেন—এই এত কষ্ট করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে যাওয়া দরিদ্র পরিবারের একমাত্র বাতিঘর হয়ে ওঠা সন্তানদের কারা কীভাবে কেন এভাবে শেষ করে দিচ্ছে? আসলে কেউ কি কাউকে শেষ করে দিতে পারে এভাবে, যদি নিজে থেকে শেষ হতে না চায়? না কি পারে? এই যে খবরে প্রকাশ পেল, আইবিএ পড়া ছেলেরা এসবের ব্যবসা করছে, নিজেরাও নেশা করছে, কেন? সমাজের চোখে, পরিবারের চোখে তো ওরা মেধাবী! তবে কোথায় সূত্র মেলে না অঙ্কের?
কীভাবে প্রথম বর্ষ বা দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রটি ধীরে ধীরে মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে যায়—দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে তা খুব কাছ থেকে চোখে দেখা আমার। সেসব গল্প নিশ্চয়ই কখনো না কখনো করব। রুমে বসে কতজনকে যে কাউন্সেলিং করেছি, কত কারণে। এই যেমন প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়া, মা–বাবার বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার চাপ, হয় পরিবারের নয় সমাজের চাপ, পিয়ার গ্রুপের প্রেশার, হলের বড় ভাইদের রাজনীতি, রুমের আড্ডার কারণে পড়তে সমস্যা, অর্থনৈতিক সংকট, প্রেমিকার পরিবার থেকে হুমকি-ধমকি, পড়ালেখা ভালো না লাগা ইত্যাদি আরও বহু কারণ। ঢাকা বনাম মফস্বলের দ্বি–বিভাজন। ঢাকার ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্বে কারও কারও জায়গা না হওয়া গ্রাম কিংবা মফস্বল থেকে আসার কারণে, বন্ধুর জন্মদিনে গিফট কেনা নিয়ে সংকোচ—অনেকেই এসব আমার সঙ্গে শেয়ার করত। আমিও চেষ্টা করতাম আমার সাধ্যের মধ্যে তাদের এসব সংকোচ থেকে বের হয়ে আসার জন্য। আমার ক্লাসের প্রথম দিন আমি ঢাকা বনাম মফস্বল কিংবা গ্রামের বন্ধুত্ব নিয়ে একটা কিছু বলবই, তা এত দিনে আমার শিক্ষার্থীরা জেনে গেছে। বন্ধুত্ব হবে কেবল আত্মার সঙ্গে আত্মার, সেখানে কে কোথা হতে এল, গেল, জন্মাল—এসব তুচ্ছ বিষয় কারা কীভাবে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়, তা এখন আর অপরিষ্কার নয়। তবু যারা বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে, তাদের মাথা থেকে এই চিন্তা বের করে দেওয়ার একটা চেষ্টা চালাই, কিছু হয়তো কাজ হয়, কিছু হয়তো হয় না!
যা হোক, মাদক ছাড়া অন্য ইস্যুগুলোতে কারও কারও দুশ্চিন্তা দূর করতে কিছুটা সফল হলেও, মাদকের বেলায় যেন হেরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। মাদকের সঙ্গে হয়তো অন্যান্য অনুষঙ্গ যুক্ত থাকে, আবার অনেক ক্ষেত্রে থাকেও না। এই সমস্যা ছেলেমেয়ে উভয় ক্ষেত্রেই আছে, কিছু ক্ষেত্রে ছেলেদের বেশি, কিছু ক্ষেত্রে মেয়েদের। আমার ফেসবুকে বহু শিক্ষার্থী আছে, যারা তাদের যেকোনো সমস্যা নিয়ে এখনো ইনবক্সে আলাপ করে। ইনবক্সে আর কারও উত্তর দিই কিংবা না দিই, শিক্ষার্থীদের কোনো সংকট নিয়ে মেসেজ দেখলে তার উত্তর দেওয়া আমি ফরজ কাজ মনে করি, তা সে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষার্থীই হোক না কেন! কেবল তাদের ঈদ মোবারক বা জন্মদিন টাইপ শুভেচ্ছার উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না, কিন্তু কেউ কখনো কোনো সমস্যা নিয়ে আমাকে নক করবে, আমি তা শুনব না—এই উদাহরণ খুব কম। ফলে তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগটা বেশ সহজ ও সরল। সেই যোগাযোগ থেকেও তাদের মনোজাগতিক সমস্যাগুলো কিছুটা আঁচ করার চেষ্টা করি।
সর্বশেষ যে ছাত্রটিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক চেষ্টা করেছিলাম তাকে ইয়াবার নেশা থেকে বের করতে, বিভাগে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করে সেও আজ অন্ধ জগতে বুঁদ হয়ে আছে হয়তো বা! অথচ মা–বাবা জানেনই না যে তাদের ছেলে এই জগতে চলে গেছে! ছেলেটি প্রথম দু–তিন বছর যখন ক্লাসে আলোচনা করত, তার চিন্তাজগতের গভীরতা অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন মনে হতো, একটি বিষয়কে নানাভাবে দেখার ও বোঝার চিন্তার জাগতিক মনন ছিল তার, যা আমাকে অভিভূত করত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে ক্লাসরুমে সবচেয়ে আনন্দদায়ক হচ্ছে, যখন শিক্ষক বুঝতে পারেন যে তাঁর শিক্ষার্থীরা পাঠের সঙ্গে চিন্তাজগতের যোগসূত্র স্থাপন করতে পারছে। সে ছিল তেমনই একজন, রেজাল্টও ভালো করছিল, হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পরিবর্তন! ক্লাসে আসে, কিন্তু ঝিম মেরে বসে থাকে। প্রশ্ন করলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে যেন সে অন্য জগতের বাসিন্দা, এই মাত্রই ফিরল অন্য ভুবন ঘুরে! বুঝতে পারলাম, কিছু একটা হয়েছে। ওর বন্ধুদের ডাকলাম, তথ্য জোগাড় করে জানতে পারলাম, ও খুব ভালোভাবেই নেশায় ঝুঁকে পড়েছে। আমার মাথায় হাত! বলে কে! তোমরা কিছুই করতে পারোনি? ওদের উত্তর, না ম্যাম, ও এখন নেশায় চলে গেছে, কেউ কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। আমি ওকে পরের সপ্তাহে ক্লাস থেকে বের হওয়ার পর করিডরে ডাক দিলাম, ওর বন্ধুরা সব থমকে গেল, ভাবল—আমি বোধ হয় ওকে সবার সামনেই কিছু বলব। না, আমি কেবল ওকে ডেকে বললাম, তুমি পাঁচ মিনিট পর আমার রুমে আসো। ও বুঝতে পেরেছে কি না কে জানে, আমাকে এড়ানোর জন্য বলল, ‘ম্যাম দুপুরের পর আসি?’ আমি বললাম, না এখনই এসো। ও এল রুমে। আমি টের পাচ্ছি, ওর বন্ধুরা আমার রুমের পাশে ঘুরঘুর করছে টেনশনে। আমি দরজা খুলে বের হতেই সব ধুপধাপ করে দৌড়!
জানতে চাইলাম, কী হয়েছে তোমার, বলো?
ও চুপ করে থাকে।
কিছু একটা তো হয়েছেই! সেটা কী ? ছ্যাঁকা খেয়েছ?
ছেলেটি মাথা নিচু করে আছে, হাতের আঙুলগুলো কিছুটা কাঁপছে।
আমি বললাম, কেন নেশা ধরেছ? আমাকে জানাও।
এবার সে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, এই বুঝি দৌড় দেবে রুম থেকে। ও কল্পনাও করেনি আমি এভাবে ওকে বলে বসতে পারি!
আমি শান্ত চোখে বললাম, বসো। পালাতে হবে না। আমি তোমার কাছ থেকে যা জানতে চাইছি তার উত্তর দাও।
ও দাঁড়িয়ে থাকে, বসে না। আমি আবার বলি, বসো। বুঝলাম, ওকে সহজ করতে হবে। আগেই এনে রাখা সিঙারার প্লেট থেকে নিজে একটা নিয়ে বাকি দুটো ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, এটা খাও, চা দিচ্ছে, চা খাও। তোমার শরীর কাঁপছে, ক্ষুধায় হয়তো না, কিন্তু তবু খাও। তারপর আমাকে বুঝিয়ে বলো, কেন এভাবে নিজের জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছ? আমার জানতে হবে, কেন কী হয়েছিল যে এই বিপদ ডেকে আনলে। ও কথা বলে না, অস্বীকার করছে আমার কথা, তাও না।
বুঝলাম, ও ভয় পাচ্ছে একজন শিক্ষকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে যে ও মাদক নেয়।
আমি ওকে অভয় দিয়ে বললাম, আমি তোমার মুখ থেকে উত্তর না শুনে তোমাকে এই রুম থেকে যেতে দিচ্ছি না। তুমি যদি বলো যে আমাকে বলবে না বা আমার তোমাকে জোর করে জানার কোনো অধিকার নেই, তবু আমি বলব, আমার আছে। আমি তোমার শিক্ষক, আমার সেই অধিকার আছে। আমি এটাও জানি, তুমি যদি কাউকে বিষয়টি খুলে বলতে চাও বা পারো, সেটা আমি।
এবার সে অনেকটাই আশ্বস্ত হয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে বলে, ‘আমি জানি না আমি কীভাবে জড়িয়ে গেছি। ওরা আমার হলের বড় ভাই, বন্ধুর মতো। একসময় মিশতে মিশতে তাদের মতো করে আমিও মাদক নেওয়া শুরু করি।’ তারপর পুরোনো প্রেম, নতুন প্রেম, সম্পর্কের ঝামেলা, রাজনৈতিক ঝামেলা, পদ–পদবি, হলে সিট পাওয়া, নেতা হয়ে ওঠা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হতে থাকে। আমি শুনছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম, সেদিনের ফার্স্ট ইয়ারে আসা বাচ্চা ছেলেটি একলা একলা কত কিছু বয়ে বেড়াচ্ছে! পরিবার কি তা জানে! সে নিজেও কি জানে এতটুকুন বয়সে যেখানে কেবল তার পরিসর হওয়ার কথা ছিল ক্যাম্পাস আর পড়ালেখার জগৎ, সেখানে এতসব কোথা থেকে তার ওপর ভর করে বসেছে? কেন? এগুলো কি একান্তই তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত না কি কেউ চাপিয়ে দিচ্ছে তাকে? এই সমাজ কিংবা পরিবার কিংবা ক্যাম্পাস? নাকি সে নিজেই?
আরেকটি ঘটনা বলি। একবার এক মাদকাসক্ত ছাত্রের প্রেমিকার অনুরোধে সেই ছাত্রের মায়ের নম্বরে ফোন দিয়ে আলাপ করতেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন, ‘কী বলেন ম্যাডাম? আমি তো ভাবতেই পারছি না, আমার তো শেষ সব!’ তাঁর গলা কাঁপছিল, নিশ্বাস নিচ্ছিলেন জোরে জোরে। আমি কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে গেলাম, বললাম, আচ্ছা আমি দেখছি, আপনি শান্ত হন। উনি যত না ছেলের এই দশা নিয়ে চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি ছেলের বাবা তাঁকে মেরে ফেলবেন, সেই ভয়ে অস্থির হচ্ছিলেন! আমি অবাক হইনি, এ আমাদের ঘরে ঘরে বাবাদের ধারণা—ছেলেমেয়ে বিপথে যাওয়ার পেছনে একমাত্র মা–ই দায়ী; অন্য যে হাজারো কারণ থাকতে পারে, তা তাঁরা এড়িয়ে যান। এমনকি সন্তানেরা যে ভিন্ন কোনো মনোজগতে বাস করতে পারে, সে ভাবনাও তাঁদের মাঝে কাজ করে না। প্রেমিকার কাছ থেকে জানতে পারি ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই ডিপ্রেশনে ভুগছে, অথচ পরিবারের কেউ তা টেরই পায়নি! যাই হোক, আমি বেশ হতাশ হলাম ছেলেটির মায়ের পরবর্তী কাজকারবার দেখে। বুঝলাম, আমাদের সহজ–সরল মায়েরা এমন বোকাই হয়। বাবার ভয়ে সন্তানের খারাপ অভ্যাসের কথা লুকিয়ে গিলে ফেলেন আমাদের অনেক মা। ছেলে সন্তানদের নিয়ে তাঁদের পাহাড়সমান আশা-ভরসার জায়গায় এমন কিছু তাঁরা কল্পনাতেও আনতে পারেন না। আর যখন কল্পনা থেকে বাস্তবে নেমে আসেন, তত দিনে সন্তান তলিয়ে গেছে গভীর সমুদ্রে, যেখান থেকে আর টেনে তোলা যায় না। এমনকি মেয়েটি তার গভীর ভালোবাসা দিয়েও ছেলেটিকে ফেরাতে পারেনি।
শেষ একটা ঘটনা বলি। একবার এক ডাক্তার মা আমাকে ফোন দিলেন, তাঁর মেয়েকে নিয়ে তিনি চিন্তিত। তাঁদের টাকার কোনো অভাব নেই, এত বিত্তবৈভব, দেশের বাইরে নিয়ম করে বছরে এক–দুবার ঘুরতে যান, প্রেম করতে কোনো বাধা–নিষেধ নেই, বাসায় বন্ধুবান্ধব আসে-যায়, গাড়ি আছে, ড্রাইভার আছে, বাসায় কয়েকজন হেলপার আছে, মেয়ের কি অভাব রেখেছেন তিনি, যে মেয়েকে নেশা করতে হবে! মা অনেকটাই বাধ্য হয়ে আমাকে ফোন দিয়েছেন। সরাসরি দিতে লজ্জা বা সংকোচ হচ্ছিল, দিয়েছেন আমার এক পরিচিত মানুষের মাধ্যমে, যিনি তাঁর কলিগ। আমাকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, যার আমার উত্তর জানা নেই। তবু চুপ করে মায়ের কান্না শুনছি, এই শোনাটাও জরুরি ওই মুহূর্তে, তাতে যদি মায়ের দীর্ঘশ্বাস কিছুটা হালকা হয়! কিন্তু তাই কি আর হয়! আমার ফোন নম্বর মেয়ের একটি ডায়েরিতে পেয়েছেন, সেখানে নাকি আমার সঙ্গে করিডরে কিংবা রুমে তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের অনেক বর্ণনা আছে। আমাকে ফোন করার একটাই কারণ—মেয়ে যখন এসব নেশায় ছিল না, যখন প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়, তখন মেয়েটি বাসায় গিয়ে আমার গল্প করত। সেই মেয়েটি কী করে এমন হয়ে গেল, এবার পাল্টা প্রশ্ন মাকেই করলাম। তখন শেয়ার করত, এখন কেন আর করে না, তা কি কখনো জানতে চেয়েছেন ওর কাছে? কীভাবে দূরে সরে গেল আপনার কাছ থেকে, কখন? উনি ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন, আমি কান্না শুনে চলছি। একপর্যায়ে আমারও নিশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছিল, আমি চুপ হয়ে থাকি, ওই প্রান্তের এক অসহায় মায়ের সামনে আমি এক অসহায় শিক্ষক!
কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আমরা চাইলেই খুব ব্যক্তিগতভাবে শাসন করতে পারি না। অসহায় লাগে যখন দেখি, ওদের সঙ্গে আমাদের একটা অদৃশ্য দেয়াল আছে, সেই দেয়াল যেখানে মা–বাবাই ভাঙতে পারেন না, আমরা কী করে পারব? তবু এই মায়ের আবেদন ফেলতে পারিনি, কী হয়েছিল আমাদের মাঝে কয়েক মাস, তা না হয় না–ই বললাম। তবে মেয়েটি এখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। কিন্তু সেই অদৃশ্য দেয়ালের কারণে জানতে চাইতে পারি না—তুমি আমাকে যে কথা দিয়েছিলে, তা কি এখনো মেনে চলছো? কোথায় যেন সংকোচ হয়, পাছে ও আমায় মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়!
তবে এটুকু বুঝি, আমাদের এই মানবসমাজে সবাই এক নয়, কারও কারও মনোরোগ আছে, চিন্তায় জটিলতা আছে, শূন্যতা আছে, হাহাকার আছে—এগুলো বিত্তবৈভব কিংবা দারিদ্র্য—কোনো কিছুর সঙ্গেই যুক্ত নয়। এগুলো পাওয়া কিংবা না পাওয়ার সঙ্গেও অনেকটা বিযুক্ত। এ ধরনের সমস্যায় একমাত্র উপায় কাউন্সেলিং করানো। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া। এগুলো থেকে রক্ষার আসলে খুব একক সহজ পথ নেই। আমরা সহজেই বলে ফেলি, কী অভাব ছিল তার, কেন সে এ রকম একটা কাজ করল? ও তো খুব ভালো রেজাল্ট করছিল, ওকে নিয়ে আমাদের এত সব স্বপ্ন, ও অমুক হবে, তমুক হবে—কেন হঠাৎ এ রকম হয়ে গেল? কিন্তু একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিমানুষের যে কী অভাব তা সে নিজেই অনেক সময় জানে না, আপনি-আমি জানব কীভাবে? পরিবারের সদস্য হিসেবে অন্যের দোষ খুঁজি, হয়তো বা নিজের দায়িত্বকে এড়ানোর জন্য।
সচ্ছল কিংবা অসচ্ছল পরিবারের এই সন্তানদের কারা কীভাবে মাদকের হাতছানিতে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, তা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি! হাফিজের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি, বন্ধুর সঙ্গকে যদি দোষ দিই—তাহলে মেয়েটির ক্ষেত্রে তো এই বাস্তবতা ছিল না। প্রতিবছর যে লাখো ছাত্র বের হচ্ছে, সবাই তো এই অন্ধকার জগতে ডুবে যাচ্ছে না। খেলার মাঠ নেই, ফ্ল্যাট কালচারে একাকী বড় হওয়া, আগের মতো সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা নেই—এগুলো তো হাফিজের সঙ্গে মেলে না। ও সংস্কৃতিমান একজন মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি অঙ্গন ওর পদচারণে মুখরিত ছিল, মূকাভিনয় করত, খেলাধুলা করত, গ্রামের সবুজ ঘাসের গন্ধে যার বেড়ে ওঠা—তার কেন এএমডির মতো মাদকের ঘ্রাণ নেওয়ার সাধ জাগে? এই প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে?
বিষয়গুলো কি আমরা পরিবারের মানুষজন একটু ভেবে দেখব? একজন ১৮ বছরের অধিক বয়সী মানুষের আত্মহত্যা করার পেছনে অন্য অনেক কিছুর সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু যে সম্পর্ক সবচেয়ে আগে আমাদের বিবেচনা করা দরকার, তা হলো, পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক! পারিবারিক বন্ধন! পরিবারে একসঙ্গে এক ছাদে বেড়ে উঠলেই যে একজন মানুষ পারিবারিক মানুষ, তা কিন্তু নয়; হয়তো আমাদের অগোচরেই সে তার এক নিজস্ব জগৎ গড়ে তুলেছে, যেখানে সে শূন্যতাকে খোঁজে, আশকারা দেয়, শূন্যতাকে উপভোগ করে! সেই শূন্যতা ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে, সেখানে অন্য যেকোনো কিছু তুচ্ছ মনে হয়—প্রেম, ভালোবাসা, মা–বাবার স্নেহ, ভাইবোনের ভালোবাসা, পরীক্ষা, রেজাল্ট, মা–বাবার স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব—সবকিছুই তার কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ মনে হয়! কিন্তু আমরা পরিবারের লোকজন ভাবছি, সে কখন বিসিএস অফিসার হবে, শিক্ষক হবে, চাকরি পাবে, বিয়ে করবে, সন্তান হবে, সমাজের ধরিয়ে দেওয়া আপনার-আমার এই সামাজিক-পারিবারিক অঙ্কের সঙ্গে ওরা হয়তো কোনো দিন সূত্র মেলাতেই চায়নি, চেয়েছে অন্য কিছু, যা আপনি আমি আমরা পরিবারের মানুষজন কোনো দিন অনুধাবনই করিনি—কিংবা করতে চাইওনি!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজ আমাদের গ্রামের সৈয়দাবাদ সরকারি কলেজের ছাত্র ছিল! এই কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা আমার চাচা মরহুম এ বি এম সিদ্দিক, যাঁর একটাই আশা ছিল, একদিন এই গ্রাম ও আশপাশের এলাকার ছেলেমেয়েরা এই কলেজ থেকে শিক্ষা লাভ করে দেশের সব বড় বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হবে। সংগত কারণেই হাফিজের মৃত্যুর ঘটনাটি আমাকে যারপরনাই ভাবাচ্ছে। একটা বড় কারণ, শিক্ষক হিসেবে ওর মতো শিক্ষার্থীদের আমরা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। অন্যদিকে নিজেদের কলেজ থেকে পাস করা ছাত্র ও কলেজের শিক্ষকদের এক দুজনকে ফোন দিয়ে ওর সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তাঁদের তথ্যমতে, হাফিজ ২০১৪ সালে এই কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিল। পরিবারে সচ্ছলতা ছিল না ঠিকই, ছিল ছেলেটির মেধার ওপর পরিবারের অগাধ বিশ্বাস, আস্থা ও ভরসা। অনেক কষ্ট করে ওর এত দূর যাওয়া।
আচ্ছা, কেউ কি বলতে পারেন—এই এত কষ্ট করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে যাওয়া দরিদ্র পরিবারের একমাত্র বাতিঘর হয়ে ওঠা সন্তানদের কারা কীভাবে কেন এভাবে শেষ করে দিচ্ছে? আসলে কেউ কি কাউকে শেষ করে দিতে পারে এভাবে, যদি নিজে থেকে শেষ হতে না চায়? না কি পারে? এই যে খবরে প্রকাশ পেল, আইবিএ পড়া ছেলেরা এসবের ব্যবসা করছে, নিজেরাও নেশা করছে, কেন? সমাজের চোখে, পরিবারের চোখে তো ওরা মেধাবী! তবে কোথায় সূত্র মেলে না অঙ্কের?
কীভাবে প্রথম বর্ষ বা দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রটি ধীরে ধীরে মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে যায়—দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে তা খুব কাছ থেকে চোখে দেখা আমার। সেসব গল্প নিশ্চয়ই কখনো না কখনো করব। রুমে বসে কতজনকে যে কাউন্সেলিং করেছি, কত কারণে। এই যেমন প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়া, মা–বাবার বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার চাপ, হয় পরিবারের নয় সমাজের চাপ, পিয়ার গ্রুপের প্রেশার, হলের বড় ভাইদের রাজনীতি, রুমের আড্ডার কারণে পড়তে সমস্যা, অর্থনৈতিক সংকট, প্রেমিকার পরিবার থেকে হুমকি-ধমকি, পড়ালেখা ভালো না লাগা ইত্যাদি আরও বহু কারণ। ঢাকা বনাম মফস্বলের দ্বি–বিভাজন। ঢাকার ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্বে কারও কারও জায়গা না হওয়া গ্রাম কিংবা মফস্বল থেকে আসার কারণে, বন্ধুর জন্মদিনে গিফট কেনা নিয়ে সংকোচ—অনেকেই এসব আমার সঙ্গে শেয়ার করত। আমিও চেষ্টা করতাম আমার সাধ্যের মধ্যে তাদের এসব সংকোচ থেকে বের হয়ে আসার জন্য। আমার ক্লাসের প্রথম দিন আমি ঢাকা বনাম মফস্বল কিংবা গ্রামের বন্ধুত্ব নিয়ে একটা কিছু বলবই, তা এত দিনে আমার শিক্ষার্থীরা জেনে গেছে। বন্ধুত্ব হবে কেবল আত্মার সঙ্গে আত্মার, সেখানে কে কোথা হতে এল, গেল, জন্মাল—এসব তুচ্ছ বিষয় কারা কীভাবে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়, তা এখন আর অপরিষ্কার নয়। তবু যারা বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে, তাদের মাথা থেকে এই চিন্তা বের করে দেওয়ার একটা চেষ্টা চালাই, কিছু হয়তো কাজ হয়, কিছু হয়তো হয় না!
যা হোক, মাদক ছাড়া অন্য ইস্যুগুলোতে কারও কারও দুশ্চিন্তা দূর করতে কিছুটা সফল হলেও, মাদকের বেলায় যেন হেরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। মাদকের সঙ্গে হয়তো অন্যান্য অনুষঙ্গ যুক্ত থাকে, আবার অনেক ক্ষেত্রে থাকেও না। এই সমস্যা ছেলেমেয়ে উভয় ক্ষেত্রেই আছে, কিছু ক্ষেত্রে ছেলেদের বেশি, কিছু ক্ষেত্রে মেয়েদের। আমার ফেসবুকে বহু শিক্ষার্থী আছে, যারা তাদের যেকোনো সমস্যা নিয়ে এখনো ইনবক্সে আলাপ করে। ইনবক্সে আর কারও উত্তর দিই কিংবা না দিই, শিক্ষার্থীদের কোনো সংকট নিয়ে মেসেজ দেখলে তার উত্তর দেওয়া আমি ফরজ কাজ মনে করি, তা সে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষার্থীই হোক না কেন! কেবল তাদের ঈদ মোবারক বা জন্মদিন টাইপ শুভেচ্ছার উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না, কিন্তু কেউ কখনো কোনো সমস্যা নিয়ে আমাকে নক করবে, আমি তা শুনব না—এই উদাহরণ খুব কম। ফলে তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগটা বেশ সহজ ও সরল। সেই যোগাযোগ থেকেও তাদের মনোজাগতিক সমস্যাগুলো কিছুটা আঁচ করার চেষ্টা করি।
সর্বশেষ যে ছাত্রটিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক চেষ্টা করেছিলাম তাকে ইয়াবার নেশা থেকে বের করতে, বিভাগে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করে সেও আজ অন্ধ জগতে বুঁদ হয়ে আছে হয়তো বা! অথচ মা–বাবা জানেনই না যে তাদের ছেলে এই জগতে চলে গেছে! ছেলেটি প্রথম দু–তিন বছর যখন ক্লাসে আলোচনা করত, তার চিন্তাজগতের গভীরতা অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন মনে হতো, একটি বিষয়কে নানাভাবে দেখার ও বোঝার চিন্তার জাগতিক মনন ছিল তার, যা আমাকে অভিভূত করত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে ক্লাসরুমে সবচেয়ে আনন্দদায়ক হচ্ছে, যখন শিক্ষক বুঝতে পারেন যে তাঁর শিক্ষার্থীরা পাঠের সঙ্গে চিন্তাজগতের যোগসূত্র স্থাপন করতে পারছে। সে ছিল তেমনই একজন, রেজাল্টও ভালো করছিল, হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পরিবর্তন! ক্লাসে আসে, কিন্তু ঝিম মেরে বসে থাকে। প্রশ্ন করলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে যেন সে অন্য জগতের বাসিন্দা, এই মাত্রই ফিরল অন্য ভুবন ঘুরে! বুঝতে পারলাম, কিছু একটা হয়েছে। ওর বন্ধুদের ডাকলাম, তথ্য জোগাড় করে জানতে পারলাম, ও খুব ভালোভাবেই নেশায় ঝুঁকে পড়েছে। আমার মাথায় হাত! বলে কে! তোমরা কিছুই করতে পারোনি? ওদের উত্তর, না ম্যাম, ও এখন নেশায় চলে গেছে, কেউ কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। আমি ওকে পরের সপ্তাহে ক্লাস থেকে বের হওয়ার পর করিডরে ডাক দিলাম, ওর বন্ধুরা সব থমকে গেল, ভাবল—আমি বোধ হয় ওকে সবার সামনেই কিছু বলব। না, আমি কেবল ওকে ডেকে বললাম, তুমি পাঁচ মিনিট পর আমার রুমে আসো। ও বুঝতে পেরেছে কি না কে জানে, আমাকে এড়ানোর জন্য বলল, ‘ম্যাম দুপুরের পর আসি?’ আমি বললাম, না এখনই এসো। ও এল রুমে। আমি টের পাচ্ছি, ওর বন্ধুরা আমার রুমের পাশে ঘুরঘুর করছে টেনশনে। আমি দরজা খুলে বের হতেই সব ধুপধাপ করে দৌড়!
জানতে চাইলাম, কী হয়েছে তোমার, বলো?
ও চুপ করে থাকে।
কিছু একটা তো হয়েছেই! সেটা কী ? ছ্যাঁকা খেয়েছ?
ছেলেটি মাথা নিচু করে আছে, হাতের আঙুলগুলো কিছুটা কাঁপছে।
আমি বললাম, কেন নেশা ধরেছ? আমাকে জানাও।
এবার সে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, এই বুঝি দৌড় দেবে রুম থেকে। ও কল্পনাও করেনি আমি এভাবে ওকে বলে বসতে পারি!
আমি শান্ত চোখে বললাম, বসো। পালাতে হবে না। আমি তোমার কাছ থেকে যা জানতে চাইছি তার উত্তর দাও।
ও দাঁড়িয়ে থাকে, বসে না। আমি আবার বলি, বসো। বুঝলাম, ওকে সহজ করতে হবে। আগেই এনে রাখা সিঙারার প্লেট থেকে নিজে একটা নিয়ে বাকি দুটো ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, এটা খাও, চা দিচ্ছে, চা খাও। তোমার শরীর কাঁপছে, ক্ষুধায় হয়তো না, কিন্তু তবু খাও। তারপর আমাকে বুঝিয়ে বলো, কেন এভাবে নিজের জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছ? আমার জানতে হবে, কেন কী হয়েছিল যে এই বিপদ ডেকে আনলে। ও কথা বলে না, অস্বীকার করছে আমার কথা, তাও না।
বুঝলাম, ও ভয় পাচ্ছে একজন শিক্ষকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে যে ও মাদক নেয়।
আমি ওকে অভয় দিয়ে বললাম, আমি তোমার মুখ থেকে উত্তর না শুনে তোমাকে এই রুম থেকে যেতে দিচ্ছি না। তুমি যদি বলো যে আমাকে বলবে না বা আমার তোমাকে জোর করে জানার কোনো অধিকার নেই, তবু আমি বলব, আমার আছে। আমি তোমার শিক্ষক, আমার সেই অধিকার আছে। আমি এটাও জানি, তুমি যদি কাউকে বিষয়টি খুলে বলতে চাও বা পারো, সেটা আমি।
এবার সে অনেকটাই আশ্বস্ত হয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে বলে, ‘আমি জানি না আমি কীভাবে জড়িয়ে গেছি। ওরা আমার হলের বড় ভাই, বন্ধুর মতো। একসময় মিশতে মিশতে তাদের মতো করে আমিও মাদক নেওয়া শুরু করি।’ তারপর পুরোনো প্রেম, নতুন প্রেম, সম্পর্কের ঝামেলা, রাজনৈতিক ঝামেলা, পদ–পদবি, হলে সিট পাওয়া, নেতা হয়ে ওঠা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হতে থাকে। আমি শুনছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম, সেদিনের ফার্স্ট ইয়ারে আসা বাচ্চা ছেলেটি একলা একলা কত কিছু বয়ে বেড়াচ্ছে! পরিবার কি তা জানে! সে নিজেও কি জানে এতটুকুন বয়সে যেখানে কেবল তার পরিসর হওয়ার কথা ছিল ক্যাম্পাস আর পড়ালেখার জগৎ, সেখানে এতসব কোথা থেকে তার ওপর ভর করে বসেছে? কেন? এগুলো কি একান্তই তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত না কি কেউ চাপিয়ে দিচ্ছে তাকে? এই সমাজ কিংবা পরিবার কিংবা ক্যাম্পাস? নাকি সে নিজেই?
আরেকটি ঘটনা বলি। একবার এক মাদকাসক্ত ছাত্রের প্রেমিকার অনুরোধে সেই ছাত্রের মায়ের নম্বরে ফোন দিয়ে আলাপ করতেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন, ‘কী বলেন ম্যাডাম? আমি তো ভাবতেই পারছি না, আমার তো শেষ সব!’ তাঁর গলা কাঁপছিল, নিশ্বাস নিচ্ছিলেন জোরে জোরে। আমি কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে গেলাম, বললাম, আচ্ছা আমি দেখছি, আপনি শান্ত হন। উনি যত না ছেলের এই দশা নিয়ে চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি ছেলের বাবা তাঁকে মেরে ফেলবেন, সেই ভয়ে অস্থির হচ্ছিলেন! আমি অবাক হইনি, এ আমাদের ঘরে ঘরে বাবাদের ধারণা—ছেলেমেয়ে বিপথে যাওয়ার পেছনে একমাত্র মা–ই দায়ী; অন্য যে হাজারো কারণ থাকতে পারে, তা তাঁরা এড়িয়ে যান। এমনকি সন্তানেরা যে ভিন্ন কোনো মনোজগতে বাস করতে পারে, সে ভাবনাও তাঁদের মাঝে কাজ করে না। প্রেমিকার কাছ থেকে জানতে পারি ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই ডিপ্রেশনে ভুগছে, অথচ পরিবারের কেউ তা টেরই পায়নি! যাই হোক, আমি বেশ হতাশ হলাম ছেলেটির মায়ের পরবর্তী কাজকারবার দেখে। বুঝলাম, আমাদের সহজ–সরল মায়েরা এমন বোকাই হয়। বাবার ভয়ে সন্তানের খারাপ অভ্যাসের কথা লুকিয়ে গিলে ফেলেন আমাদের অনেক মা। ছেলে সন্তানদের নিয়ে তাঁদের পাহাড়সমান আশা-ভরসার জায়গায় এমন কিছু তাঁরা কল্পনাতেও আনতে পারেন না। আর যখন কল্পনা থেকে বাস্তবে নেমে আসেন, তত দিনে সন্তান তলিয়ে গেছে গভীর সমুদ্রে, যেখান থেকে আর টেনে তোলা যায় না। এমনকি মেয়েটি তার গভীর ভালোবাসা দিয়েও ছেলেটিকে ফেরাতে পারেনি।
শেষ একটা ঘটনা বলি। একবার এক ডাক্তার মা আমাকে ফোন দিলেন, তাঁর মেয়েকে নিয়ে তিনি চিন্তিত। তাঁদের টাকার কোনো অভাব নেই, এত বিত্তবৈভব, দেশের বাইরে নিয়ম করে বছরে এক–দুবার ঘুরতে যান, প্রেম করতে কোনো বাধা–নিষেধ নেই, বাসায় বন্ধুবান্ধব আসে-যায়, গাড়ি আছে, ড্রাইভার আছে, বাসায় কয়েকজন হেলপার আছে, মেয়ের কি অভাব রেখেছেন তিনি, যে মেয়েকে নেশা করতে হবে! মা অনেকটাই বাধ্য হয়ে আমাকে ফোন দিয়েছেন। সরাসরি দিতে লজ্জা বা সংকোচ হচ্ছিল, দিয়েছেন আমার এক পরিচিত মানুষের মাধ্যমে, যিনি তাঁর কলিগ। আমাকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, যার আমার উত্তর জানা নেই। তবু চুপ করে মায়ের কান্না শুনছি, এই শোনাটাও জরুরি ওই মুহূর্তে, তাতে যদি মায়ের দীর্ঘশ্বাস কিছুটা হালকা হয়! কিন্তু তাই কি আর হয়! আমার ফোন নম্বর মেয়ের একটি ডায়েরিতে পেয়েছেন, সেখানে নাকি আমার সঙ্গে করিডরে কিংবা রুমে তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের অনেক বর্ণনা আছে। আমাকে ফোন করার একটাই কারণ—মেয়ে যখন এসব নেশায় ছিল না, যখন প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়, তখন মেয়েটি বাসায় গিয়ে আমার গল্প করত। সেই মেয়েটি কী করে এমন হয়ে গেল, এবার পাল্টা প্রশ্ন মাকেই করলাম। তখন শেয়ার করত, এখন কেন আর করে না, তা কি কখনো জানতে চেয়েছেন ওর কাছে? কীভাবে দূরে সরে গেল আপনার কাছ থেকে, কখন? উনি ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন, আমি কান্না শুনে চলছি। একপর্যায়ে আমারও নিশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছিল, আমি চুপ হয়ে থাকি, ওই প্রান্তের এক অসহায় মায়ের সামনে আমি এক অসহায় শিক্ষক!
কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আমরা চাইলেই খুব ব্যক্তিগতভাবে শাসন করতে পারি না। অসহায় লাগে যখন দেখি, ওদের সঙ্গে আমাদের একটা অদৃশ্য দেয়াল আছে, সেই দেয়াল যেখানে মা–বাবাই ভাঙতে পারেন না, আমরা কী করে পারব? তবু এই মায়ের আবেদন ফেলতে পারিনি, কী হয়েছিল আমাদের মাঝে কয়েক মাস, তা না হয় না–ই বললাম। তবে মেয়েটি এখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। কিন্তু সেই অদৃশ্য দেয়ালের কারণে জানতে চাইতে পারি না—তুমি আমাকে যে কথা দিয়েছিলে, তা কি এখনো মেনে চলছো? কোথায় যেন সংকোচ হয়, পাছে ও আমায় মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়!
তবে এটুকু বুঝি, আমাদের এই মানবসমাজে সবাই এক নয়, কারও কারও মনোরোগ আছে, চিন্তায় জটিলতা আছে, শূন্যতা আছে, হাহাকার আছে—এগুলো বিত্তবৈভব কিংবা দারিদ্র্য—কোনো কিছুর সঙ্গেই যুক্ত নয়। এগুলো পাওয়া কিংবা না পাওয়ার সঙ্গেও অনেকটা বিযুক্ত। এ ধরনের সমস্যায় একমাত্র উপায় কাউন্সেলিং করানো। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া। এগুলো থেকে রক্ষার আসলে খুব একক সহজ পথ নেই। আমরা সহজেই বলে ফেলি, কী অভাব ছিল তার, কেন সে এ রকম একটা কাজ করল? ও তো খুব ভালো রেজাল্ট করছিল, ওকে নিয়ে আমাদের এত সব স্বপ্ন, ও অমুক হবে, তমুক হবে—কেন হঠাৎ এ রকম হয়ে গেল? কিন্তু একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিমানুষের যে কী অভাব তা সে নিজেই অনেক সময় জানে না, আপনি-আমি জানব কীভাবে? পরিবারের সদস্য হিসেবে অন্যের দোষ খুঁজি, হয়তো বা নিজের দায়িত্বকে এড়ানোর জন্য।
সচ্ছল কিংবা অসচ্ছল পরিবারের এই সন্তানদের কারা কীভাবে মাদকের হাতছানিতে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, তা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি! হাফিজের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি, বন্ধুর সঙ্গকে যদি দোষ দিই—তাহলে মেয়েটির ক্ষেত্রে তো এই বাস্তবতা ছিল না। প্রতিবছর যে লাখো ছাত্র বের হচ্ছে, সবাই তো এই অন্ধকার জগতে ডুবে যাচ্ছে না। খেলার মাঠ নেই, ফ্ল্যাট কালচারে একাকী বড় হওয়া, আগের মতো সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা নেই—এগুলো তো হাফিজের সঙ্গে মেলে না। ও সংস্কৃতিমান একজন মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি অঙ্গন ওর পদচারণে মুখরিত ছিল, মূকাভিনয় করত, খেলাধুলা করত, গ্রামের সবুজ ঘাসের গন্ধে যার বেড়ে ওঠা—তার কেন এএমডির মতো মাদকের ঘ্রাণ নেওয়ার সাধ জাগে? এই প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে?
বিষয়গুলো কি আমরা পরিবারের মানুষজন একটু ভেবে দেখব? একজন ১৮ বছরের অধিক বয়সী মানুষের আত্মহত্যা করার পেছনে অন্য অনেক কিছুর সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু যে সম্পর্ক সবচেয়ে আগে আমাদের বিবেচনা করা দরকার, তা হলো, পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক! পারিবারিক বন্ধন! পরিবারে একসঙ্গে এক ছাদে বেড়ে উঠলেই যে একজন মানুষ পারিবারিক মানুষ, তা কিন্তু নয়; হয়তো আমাদের অগোচরেই সে তার এক নিজস্ব জগৎ গড়ে তুলেছে, যেখানে সে শূন্যতাকে খোঁজে, আশকারা দেয়, শূন্যতাকে উপভোগ করে! সেই শূন্যতা ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে, সেখানে অন্য যেকোনো কিছু তুচ্ছ মনে হয়—প্রেম, ভালোবাসা, মা–বাবার স্নেহ, ভাইবোনের ভালোবাসা, পরীক্ষা, রেজাল্ট, মা–বাবার স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব—সবকিছুই তার কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ মনে হয়! কিন্তু আমরা পরিবারের লোকজন ভাবছি, সে কখন বিসিএস অফিসার হবে, শিক্ষক হবে, চাকরি পাবে, বিয়ে করবে, সন্তান হবে, সমাজের ধরিয়ে দেওয়া আপনার-আমার এই সামাজিক-পারিবারিক অঙ্কের সঙ্গে ওরা হয়তো কোনো দিন সূত্র মেলাতেই চায়নি, চেয়েছে অন্য কিছু, যা আপনি আমি আমরা পরিবারের মানুষজন কোনো দিন অনুধাবনই করিনি—কিংবা করতে চাইওনি!
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
২০ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
২০ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
২১ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ দিন আগে