বিভুরঞ্জন সরকার
একটি পুরোনো ঘটনা দিয়েই শুরু করি। ১৯৯৩ সালের ঘটনা। বিএনপি ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরবে বলে আশা করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছেও বিস্ময়কর ছিল। কারণ, সাংগঠনিক শক্তির বিবেচনায় বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ এগিয়ে ছিল। ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতেই বিএনপিকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ওই নির্বাচনের ফলাফল স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেননি।
তিনি ওই নির্বাচনকে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র নির্বাচন বলে অভিহিত করেছিলেন। অন্যদিকে ওই নির্বাচন সম্পর্কে অপরাপর রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং পাবলিক পারসেপশন ছিল ভালো। মনে করা হচ্ছিল, নির্বাচনটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদ নির্বাচনব্যবস্থাকে তামাশায় পরিণত করেছিলেন, সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল বলে অনেকেই মনে করেছেন। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনের ফলাফলকে স্বাগত না জানানোর ফলে রাজনীতিতে যে অস্বস্তি এবং বিদ্বেষ ও অনৈক্যের সূচনা হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তা আর না কমে বরং নানা যুক্তিসংগত কারণে ক্রমাগত বেড়েছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি এখন এক বড় কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
ওই সময় আমি সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে একটি রাজনৈতিক প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য ধরে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছিলাম, যা আওয়ামী লীগের উগ্র সমর্থকদের পছন্দ হয়নি। একদিন সন্ধ্যায় যায়যায়দিন অফিসে একটি টেলিফোন কল আসে। আমিই রিসিভ করি। অপর প্রান্ত থেকে আমার পরিচয় জানতে চাওয়া হলে নাম বলতেই অত্যন্ত হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে অশ্লীল গালাগাল করে বলা হলো, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কিছু লেখা যাবে না।
প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হলেও দ্রুত সামলে নিয়ে আমার পক্ষে যতটুকু কঠোর হওয়া সম্ভব ততটুকু কঠোর কণ্ঠেই টেলিফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিই। তবে বিষয়টি আমার খারাপ লাগে। আমি আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। নিজের বিবেচনাবোধ থেকেই লেখালেখি করি। কোনো লেখা কোনো দলের বিরুদ্ধে গেলে সমর্থকেরা তেড়েফুঁড়ে ওঠেন, পক্ষে গেলে কেউ অবশ্য প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না।
অসহিষ্ণুতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ মনে করেন, এর জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী। আবার কেউ মনে করেন, বিএনপির কারণেই দেশে হিংসা-বিদ্বেষ বেড়েছে। আমার মনে হয়, বিএনপির দায় বেশি হলেও আওয়ামী লীগ দায়মুক্ত নয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে বিএনপি যতটা নির্দয়, নিষ্ঠুর; আওয়ামী লীগ ঠিক ততটা না হলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে সৌজন্য-শিষ্টাচার তিরোহিত হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের কোনোই ভূমিকা নেই–তা বলা যাবে না। আওয়ামী লীগ করে খুচরা অপরাধ, বদনাম হয় বেশি। বিএনপির অপরাধ পাইকারি; কিন্তু বদনাম কম। আমাদের জনমনস্তত্ত্বের এটা একটি বিশেষ দিক যে, আওয়ামী লীগের কাছে মানুষ ভালোটা বেশি চায়। বিএনপির কাছে প্রত্যাশা ভালো-মন্দ মিলিয়ে। বলা হয়, বিএনপি খারাপ করেছে বলে আওয়ামী লীগ কেন খারাপ করবে?
আওয়ামী লীগ যদি প্রতিহিংসা বা বিরোধী শক্তি নির্মূলের রাজনীতি করত, তাহলে আজ দেশে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। তার মানে, আমি বলতে চাই, আওয়ামী লীগের কেউ কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হলেও দলগতভাবে আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, সংঘবদ্ধ ঘাতক চক্রের ছাতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে–এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি দেওয়া যাবে না।
স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই যদি দেখা যায়, তাহলে কি এটা বলা যাবে যে, আওয়ামী লীগ কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিল? হত্যা-খুনের রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর আমলে কি আওয়ামী লীগ বেশি করেছে, না আওয়ামী লীগের বিরোধীরা বেশি করেছে? তখন বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। অথচ আওয়ামী লীগের এমপি-নেতারা খুন হয়েছেন একের পর এক। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলে, কী না হতে পারত তখন। কিন্তু তিনি উদারতা দেখিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তাই প্রতিহিংসা নয়, তিনি অনুসরণ করেছেন সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ। সংসদে তখন আওয়ামী লীগের ব্রুট মেজরিটি। অথচ প্রথম সংসদে ন্যাপের গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একাই বাধাহীনভাবে সংসদ কাঁপিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
কেউ হয়তো বলবেন বঙ্গবন্ধুর আমলে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের কথা। রক্ষীবাহিনী বাড়াবাড়ি করেনি–এটা বলা যাবে না। তবে সদ্য স্বাধীন দেশে যারা স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, যারা একের পর এক থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন দিয়ে দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তাদের দমনে নমনীয়তা দেখানোর সুযোগ ছিল কি? পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশ কি ফুল ছড়িয়ে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করে?
বঙ্গবন্ধুর আমলে ‘হাজার হাজার’ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষকে হত্যা করার যে ঢালাও অভিযোগ করা হয়, তাকে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক কলাম লিখেছেন সাংবাদিক মাহবুব কামাল, যিনি একসময় জাসদের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। তাঁর চ্যালেঞ্জ ছিল, মুজিব আমলে হাজার হাজার তো দূরের কথা, এক হাজার নিহত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর নাম-ঠিকানা কেউ দিতে পারলে তিনি যেকোনো শাস্তি মাথা পেতে নেবেন। কোনো রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক, গবেষক তাঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণে এগিয়ে আসেননি।
তার মানে কী এই যে, বঙ্গবন্ধুর আমলে কোনো অন্যায় এবং বাড়াবাড়ি হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে তখনকার তিনটি বড় অঘটন হলো:
এক. ১৯৭৩ সালের পয়লা জানুয়ারি ভিয়েতনামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে মতিউল-কাদেরের মৃত্যু এবং অনেকের আহত হওয়ার ঘটনা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যুবলীগ-ছাত্রলীগ কর্মীরা কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
দুই. ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলের কয়েকজন প্রার্থীকে বলপ্রয়োগ করে পরাজিত করার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ উঠেছিল। অন্যদিকে কুমিল্লার একটি আসন থেকে খন্দকার মোশতাক আহমদকে পরাজিত হতে থাকা সত্ত্বেও তাঁর ব্যালট বাক্স ঢাকায় এনে তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। এই ভুলের বড় মাশুল আওয়ামী লীগকে দিতে হয়েছে।
তিন. নকশাল নেতা সিরাজ সিকদার পুলিশি হেফাজতে নিহত হওয়ার ঘটনাটিও আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক ইমেজে কালি লেপন করেছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে তো শুধু আওয়ামী লীগের মার খাওয়ার ইতিহাস। আবারও বলি, খুচরা কিছু হত্যা বা সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ব্যাপক বদনামের ভাগীদার হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনি কিংবা প্রবল আওয়ামীবিরোধী কোনো ব্যক্তির গায়ে আওয়ামী লীগ কাঁটার আঁচড়ও দিতে পারেনি বা দেয়নি। বিএনপি এবং এরশাদ আমলে আওয়ামী লীগ যতটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে, তার বদলা যদি আওয়ামী লীগ নিতে চেষ্টা করত, তাহলে দেশে রক্তের গঙ্গা বয়ে যেত।
উল্টো দিকে, বিএনপির ইতিহাসটা কেমন? আওয়ামী লীগ ভক্ত টেলিফোনে আমাকে ঝাড়ি দিয়েছেন। আর বিএনপির এক পাতিনেতা আমার এক লেখার জন্য যায়যায়দিন অফিস থেকে আমাকে তুলে নিতে এসেছিলেন মাইক্রোবাসবোঝাই সশস্ত্র ক্যাডার নিয়ে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে-পরে ভয়াবহ সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে লেখার অপরাধে আমাকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত কী নৃশংস শাসন কায়েম করেছিল, আমরা তা দিব্যি ভুলে বসে আছি।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতারোহণ এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রতিটি ধাপই ছিল রক্তাক্ত। তিনি তাঁর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য কত মানুষকে হত্যা করেছেন, সেনাবাহিনীতে কার্যত গণহত্যা চালিয়েছেন–সেসব নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হতে দেখা যায় না।
খালেদা জিয়ার দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় নেতা হত্যার শিকার হয়েছেন। দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে। তারপর আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে জীবন দিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েছে?
হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী বাড়াবাড়ি করেন। ইদানীং বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গেও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের নাম জড়িত থাকার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলো অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হবে। আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ড বহু চোখ নজরদারিতে রেখেছে। আওয়ামী লীগের ভেতরেও আছে আওয়ামী লীগের শত্রু। তাই কেউ ফেসবুকে বা অন্য কোনো প্রচারমাধ্যমে সরকার বা সরকারি দলের কারও নিন্দা-সমালোচনা করলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ে, তাকে দেশছাড়া করার হুমকি না নিয়ে নিজেদের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করাই ভালো।
দেশটাকে কোনো দলই নিজেদের খাস তালুক না ভেবে যদি সব মানুষের নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে হয়তো অনেক বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। বিএনপি যে আজ বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বে ‘চিপায়’ পড়ে আছে, তার একটি বড় কারণ ক্ষমতার অপব্যবহার। মানুষকে ভয় দেখিয়ে, ক্ষমতার শক্তি দেখিয়ে জয় করার চেষ্টা কোনো কালেই সফল হয়নি। মানুষকে ভালোবাসার শক্তি এবং মানুষকে অতিরিক্ত ভালোবাসার দুর্বলতাই আসলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এখনো ‘জনগণমন অধিনায়ক’ করে রেখেছে। ভালোবাসা কেউ কারও কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে না, ছিনিয়ে নিতে পারে না। প্রতিহিংসা পরিহার করে মানুষকে ভালোবাসার ধারা দেশের রাজনীতির প্রধান ধারা হয়ে উঠুক–এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
একটি পুরোনো ঘটনা দিয়েই শুরু করি। ১৯৯৩ সালের ঘটনা। বিএনপি ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরবে বলে আশা করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছেও বিস্ময়কর ছিল। কারণ, সাংগঠনিক শক্তির বিবেচনায় বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ এগিয়ে ছিল। ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতেই বিএনপিকে হিমশিম খেতে হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ওই নির্বাচনের ফলাফল স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেননি।
তিনি ওই নির্বাচনকে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র নির্বাচন বলে অভিহিত করেছিলেন। অন্যদিকে ওই নির্বাচন সম্পর্কে অপরাপর রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং পাবলিক পারসেপশন ছিল ভালো। মনে করা হচ্ছিল, নির্বাচনটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদ নির্বাচনব্যবস্থাকে তামাশায় পরিণত করেছিলেন, সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল বলে অনেকেই মনে করেছেন। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনের ফলাফলকে স্বাগত না জানানোর ফলে রাজনীতিতে যে অস্বস্তি এবং বিদ্বেষ ও অনৈক্যের সূচনা হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তা আর না কমে বরং নানা যুক্তিসংগত কারণে ক্রমাগত বেড়েছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি এখন এক বড় কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
ওই সময় আমি সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে একটি রাজনৈতিক প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য ধরে সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছিলাম, যা আওয়ামী লীগের উগ্র সমর্থকদের পছন্দ হয়নি। একদিন সন্ধ্যায় যায়যায়দিন অফিসে একটি টেলিফোন কল আসে। আমিই রিসিভ করি। অপর প্রান্ত থেকে আমার পরিচয় জানতে চাওয়া হলে নাম বলতেই অত্যন্ত হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে অশ্লীল গালাগাল করে বলা হলো, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কিছু লেখা যাবে না।
প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হলেও দ্রুত সামলে নিয়ে আমার পক্ষে যতটুকু কঠোর হওয়া সম্ভব ততটুকু কঠোর কণ্ঠেই টেলিফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিই। তবে বিষয়টি আমার খারাপ লাগে। আমি আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। নিজের বিবেচনাবোধ থেকেই লেখালেখি করি। কোনো লেখা কোনো দলের বিরুদ্ধে গেলে সমর্থকেরা তেড়েফুঁড়ে ওঠেন, পক্ষে গেলে কেউ অবশ্য প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না।
অসহিষ্ণুতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ মনে করেন, এর জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী। আবার কেউ মনে করেন, বিএনপির কারণেই দেশে হিংসা-বিদ্বেষ বেড়েছে। আমার মনে হয়, বিএনপির দায় বেশি হলেও আওয়ামী লীগ দায়মুক্ত নয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে বিএনপি যতটা নির্দয়, নিষ্ঠুর; আওয়ামী লীগ ঠিক ততটা না হলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে সৌজন্য-শিষ্টাচার তিরোহিত হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের কোনোই ভূমিকা নেই–তা বলা যাবে না। আওয়ামী লীগ করে খুচরা অপরাধ, বদনাম হয় বেশি। বিএনপির অপরাধ পাইকারি; কিন্তু বদনাম কম। আমাদের জনমনস্তত্ত্বের এটা একটি বিশেষ দিক যে, আওয়ামী লীগের কাছে মানুষ ভালোটা বেশি চায়। বিএনপির কাছে প্রত্যাশা ভালো-মন্দ মিলিয়ে। বলা হয়, বিএনপি খারাপ করেছে বলে আওয়ামী লীগ কেন খারাপ করবে?
আওয়ামী লীগ যদি প্রতিহিংসা বা বিরোধী শক্তি নির্মূলের রাজনীতি করত, তাহলে আজ দেশে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। তার মানে, আমি বলতে চাই, আওয়ামী লীগের কেউ কেউ প্রতিহিংসাপরায়ণ হলেও দলগতভাবে আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, সংঘবদ্ধ ঘাতক চক্রের ছাতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে–এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি দেওয়া যাবে না।
স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই যদি দেখা যায়, তাহলে কি এটা বলা যাবে যে, আওয়ামী লীগ কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিল? হত্যা-খুনের রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর আমলে কি আওয়ামী লীগ বেশি করেছে, না আওয়ামী লীগের বিরোধীরা বেশি করেছে? তখন বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। অথচ আওয়ামী লীগের এমপি-নেতারা খুন হয়েছেন একের পর এক। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলে, কী না হতে পারত তখন। কিন্তু তিনি উদারতা দেখিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তাই প্রতিহিংসা নয়, তিনি অনুসরণ করেছেন সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ। সংসদে তখন আওয়ামী লীগের ব্রুট মেজরিটি। অথচ প্রথম সংসদে ন্যাপের গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একাই বাধাহীনভাবে সংসদ কাঁপিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
কেউ হয়তো বলবেন বঙ্গবন্ধুর আমলে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের কথা। রক্ষীবাহিনী বাড়াবাড়ি করেনি–এটা বলা যাবে না। তবে সদ্য স্বাধীন দেশে যারা স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, যারা একের পর এক থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন দিয়ে দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তাদের দমনে নমনীয়তা দেখানোর সুযোগ ছিল কি? পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশ কি ফুল ছড়িয়ে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করে?
বঙ্গবন্ধুর আমলে ‘হাজার হাজার’ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষকে হত্যা করার যে ঢালাও অভিযোগ করা হয়, তাকে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক কলাম লিখেছেন সাংবাদিক মাহবুব কামাল, যিনি একসময় জাসদের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। তাঁর চ্যালেঞ্জ ছিল, মুজিব আমলে হাজার হাজার তো দূরের কথা, এক হাজার নিহত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর নাম-ঠিকানা কেউ দিতে পারলে তিনি যেকোনো শাস্তি মাথা পেতে নেবেন। কোনো রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক, গবেষক তাঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণে এগিয়ে আসেননি।
তার মানে কী এই যে, বঙ্গবন্ধুর আমলে কোনো অন্যায় এবং বাড়াবাড়ি হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে তখনকার তিনটি বড় অঘটন হলো:
এক. ১৯৭৩ সালের পয়লা জানুয়ারি ভিয়েতনামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে মতিউল-কাদেরের মৃত্যু এবং অনেকের আহত হওয়ার ঘটনা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যুবলীগ-ছাত্রলীগ কর্মীরা কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
দুই. ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলের কয়েকজন প্রার্থীকে বলপ্রয়োগ করে পরাজিত করার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ উঠেছিল। অন্যদিকে কুমিল্লার একটি আসন থেকে খন্দকার মোশতাক আহমদকে পরাজিত হতে থাকা সত্ত্বেও তাঁর ব্যালট বাক্স ঢাকায় এনে তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। এই ভুলের বড় মাশুল আওয়ামী লীগকে দিতে হয়েছে।
তিন. নকশাল নেতা সিরাজ সিকদার পুলিশি হেফাজতে নিহত হওয়ার ঘটনাটিও আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক ইমেজে কালি লেপন করেছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে তো শুধু আওয়ামী লীগের মার খাওয়ার ইতিহাস। আবারও বলি, খুচরা কিছু হত্যা বা সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ব্যাপক বদনামের ভাগীদার হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনি কিংবা প্রবল আওয়ামীবিরোধী কোনো ব্যক্তির গায়ে আওয়ামী লীগ কাঁটার আঁচড়ও দিতে পারেনি বা দেয়নি। বিএনপি এবং এরশাদ আমলে আওয়ামী লীগ যতটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে, তার বদলা যদি আওয়ামী লীগ নিতে চেষ্টা করত, তাহলে দেশে রক্তের গঙ্গা বয়ে যেত।
উল্টো দিকে, বিএনপির ইতিহাসটা কেমন? আওয়ামী লীগ ভক্ত টেলিফোনে আমাকে ঝাড়ি দিয়েছেন। আর বিএনপির এক পাতিনেতা আমার এক লেখার জন্য যায়যায়দিন অফিস থেকে আমাকে তুলে নিতে এসেছিলেন মাইক্রোবাসবোঝাই সশস্ত্র ক্যাডার নিয়ে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে-পরে ভয়াবহ সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ে লেখার অপরাধে আমাকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত কী নৃশংস শাসন কায়েম করেছিল, আমরা তা দিব্যি ভুলে বসে আছি।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতারোহণ এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রতিটি ধাপই ছিল রক্তাক্ত। তিনি তাঁর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য কত মানুষকে হত্যা করেছেন, সেনাবাহিনীতে কার্যত গণহত্যা চালিয়েছেন–সেসব নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হতে দেখা যায় না।
খালেদা জিয়ার দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় নেতা হত্যার শিকার হয়েছেন। দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে। তারপর আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে জীবন দিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েছে?
হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী বাড়াবাড়ি করেন। ইদানীং বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গেও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের নাম জড়িত থাকার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলো অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হবে। আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ড বহু চোখ নজরদারিতে রেখেছে। আওয়ামী লীগের ভেতরেও আছে আওয়ামী লীগের শত্রু। তাই কেউ ফেসবুকে বা অন্য কোনো প্রচারমাধ্যমে সরকার বা সরকারি দলের কারও নিন্দা-সমালোচনা করলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ে, তাকে দেশছাড়া করার হুমকি না নিয়ে নিজেদের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করাই ভালো।
দেশটাকে কোনো দলই নিজেদের খাস তালুক না ভেবে যদি সব মানুষের নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে হয়তো অনেক বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। বিএনপি যে আজ বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বে ‘চিপায়’ পড়ে আছে, তার একটি বড় কারণ ক্ষমতার অপব্যবহার। মানুষকে ভয় দেখিয়ে, ক্ষমতার শক্তি দেখিয়ে জয় করার চেষ্টা কোনো কালেই সফল হয়নি। মানুষকে ভালোবাসার শক্তি এবং মানুষকে অতিরিক্ত ভালোবাসার দুর্বলতাই আসলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে এখনো ‘জনগণমন অধিনায়ক’ করে রেখেছে। ভালোবাসা কেউ কারও কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে না, ছিনিয়ে নিতে পারে না। প্রতিহিংসা পরিহার করে মানুষকে ভালোবাসার ধারা দেশের রাজনীতির প্রধান ধারা হয়ে উঠুক–এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
৪ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
৪ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
৪ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে