রজত কান্তি রায়
যত দূর দেখা যায়, চোখে পড়ে শুধু মাদারের বন। পুষ্পহীন মাদারের কচি পাতায় লেগে থাকা বৃষ্টিবিন্দু চাতকের ঠোঁট ছোঁবে না, সে জানা কথা। বিরান প্রান্তরে খুঁটিতে বাঁধা অসহায় কালো গাই, ঘুরতে থাকে বৃত্তাকার। বুড়ো বট কান খাড়া করে শোনে সিরাজুল হুদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়ানের ক্লাস থেকে ভেসে আসা ইসমাইল হোসেন স্যারের চিৎকার : এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই…। বুড়ো বটের আরও কিছু বয়স বাড়ে। কানে লেগে থাকে ইসমাইল হোসেন স্যারের পড়া ধারাপাত : তিন এক্কে তিন, চার এক্কে চার—একের ঘরের নামতা। জাম রঙের ভুসো কাগজে লেটার প্রেসে ছাপা সেই চটি বইয়ের নাম ছিল ‘ধারাপাত’। মাদারের বনে নামা নিবিড় বৃষ্টির মনোটনিক সাউন্ডের মতো বুড়ো বট শুনতে থাকে এক অপার্থিব সুর: পাঁচ এক্কে পাঁচ, ছয় এক্কে ছয়… দশ এক্কে দশ—একের ঘরের নামতা।
‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ করতে করতে ঠিক চল্লিশতম বর্ষা পেরিয়ে গেলাম আজ। ভাবতেই গা কেমন শিরশির করে ওঠে। এই বর্ষার সঙ্গে আমার এক অদ্ভূত সম্পর্ক আছে। সেটা ঠিক কদম ফুল পেড়ে আনার সম্পর্ক নয়; কিংবা নিছক ইলিশ-খিচুড়ির সম্পর্কও নয়। সিরাজুল হুদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইসমাইল হোসেন স্যারের একের ঘরের নামতার সম্পর্ক। বহুদিন পরে, বুড়ো বট যখন শুনেছিল, সিরাজুল হুদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইসমাইল স্যার সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এক অপার্থিব নির্জনতার দিকে হেঁটে গেছেন একাকী একান্তে, সেদিন বুড়ো বটের মনে পড়েছিল একের ঘরের নামতা। চল্লিশতম বর্ষার শেষে বুড়ো বটের মনে পড়ে, মানুষ স্মৃতিময় প্রাণী। স্মৃতিই তার সম্পদ, তার অভিজ্ঞতা।
চল্লিশতম আষাঢ় শেষ হওয়ার আগে একটা সিনেমা দেখছিলাম। সেখানে বেশ কিছু দৃশ্য আছে বৃষ্টির, যাকে বলে ঝুমবৃষ্টি। একটি দৃশ্যে দেখলাম, ১৯৭১ সালের বর্ষার প্রেক্ষাপটে এক দুঁদে গোয়েন্দা অফিসার ঝুমবৃষ্টিতে জানালা খুলে দিয়ে ভিজতে ভিজতে তার পরিকল্পনা কষছে। সিনেমা শেষে দেখা গেল সে সফল হয়েছে। এর মধ্যে আরও কিছু দৃশ্যে নায়িকা কল্পনামতো ভিজতে ভিজতে এ আর রাহমানের সুর ভাজছে আর আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। একচল্লিশতম বর্ষায় স্বাগত জানানোর কী অদ্ভূত উপায় প্রকৃতির!
আমাদের এই ব্যস্ত শহরে যখন বর্ষা নামে, কোনো এক দূর গ্যালাক্সির স্বাতি নক্ষত্র থেকে ধেয়ে আসা এক ফোঁটা জল মাথায় ছোঁয়ানোর জন্য মন ছটফট করে ওঠে। স্বাতি নক্ষত্রের জল মাথায় পড়লে মানুষ বড়লোক হয়, ধনী হয়। আমার খুব নেশা বড়লোক হওয়ার। সে জন্যই বর্ষা এলে আমি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে উঠি। দালানকোঠার জঙ্গলে নয়, এসব মহাজাগতিক ঘটনা যে প্রকৃতির মধ্যে ঘটে, সেটাও জানি। তার পরও যখন ভীষণ শহুরে হয়ে উঠেছি, জীবনের চল্লিশতম বর্ষা শেষে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, কংক্রিটের ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে কোনো একদিন আমার মাথায় স্বাতি নক্ষত্রের জল পড়বে। আর আমি বড়লোক হয়ে যাব এ শহরে। অথচ প্রায় দেড় দশক কেটে গেল, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ করতে করতে চল্লিশতম বর্ষাও পার হয়ে গেল জীবন থেকে। স্বাতি নক্ষত্রের জল মাথায় পড়ল না।
খেঁকশিয়ালের বিয়ে দেওয়া কৈশোর আর মিষ্টি বৃষ্টিতে নীলাম্বরী শাড়িভেজানো প্রথম যৌবনের কোনো এক সময়ে আমি যখন হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দৌড় শুরু করেছিলাম, কেউ কিন্তু পেছন থেকে বলেনি, রান ফরেস্ট, রান। কিন্তু ফরেস্ট দৌড়েছিল। যাকে বলে ক্যাটস অ্যান্ড ডগস, রংপুর অঞ্চলের স্থানীয় ভাষায় বলে ‘সাপট’—বৃষ্টি আর ঝড় একই সঙ্গে পৃথিবীর বুকে হামলে পড়া সেই সাপটে ফরেস্ট কেন হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দৌড়েছিল নিউজপ্রিন্টে ছাপা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। মানুষকে যেমন নিশিতে পায়, ফরেস্টকে হয়তো তখন বৃষ্টিতে পেয়েছিল। সে পরীক্ষার হল থেকে দেখতে পেয়েছিল, স্লো মোশনে পড়তে থাকা অপার্থিব বৃষ্টি তাকে ডেকে বলছে, কাম অন বেবি। কোনো দিকে না তাকিয়ে সে পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে সোজা দৌড় দিয়েছিল। প্রায় এক মাইল দৌড়ে ফরেস্ট যখন আবিষ্কার করল সে বাড়িতেই ফিরেছে, তখন তার আফসোস হয়েছিল। কী এমন হতো, এক শ গজ সামনে কিছু দেখতে না পাওয়া সাপটে দৌড়াতে দৌড়াতে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে? বুদ্ধও তো কোনো এক উথালপাতাল পূর্ণিমা রাতে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন! মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। সেই বর্ষায় ফরেস্টকে মন খারাপ করে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করতে হয়েছিল মায়ের কুটিল চোখের সামনে বসে।
তারপর কেটে গেছে প্রায় আড়াই দশক। বিরান প্রান্তরে কালো গাই তখন আর ঘোরে না বৃত্তাকার। জীবনের বৃত্তই তার বদলে গেছে কবে! কিন্তু নিয়ম করে বর্ষা আসে। মানুষ খিচুড়ি খায় ইলিশ দিয়ে। রঙিন ছাতা আর রেইনকোট গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে ব্যস্ত হয়ে। বৈচিত্র্যহীন দালানের ততোধিক বৈচিত্র্যহীন মানুষগুলো যখন বুকের ছাতি ফুলিয়ে জানান দেয় নিজের অস্তিত্ব, ভোরের মোরগের মতো, তখন কোনো এক বাদলা দিনে এই বৈচিত্র্যহীন শহরের কোনো এক খুপরি থেকে শোনা যায় প্রতীমা পাণ্ডে বড়ুয়ার গান : ‘ও জীবন রে,/জীবন ছাড়িয়া না যাইস মোকে/তুই জীবন ছাড়িয়ে গেইলে/আদর করবে কে জীবন রে…।’ এ শহরের ফুটপাতগুলো তখন নীরব। রাস্তা সুনসান। কুকুরগুলো ঠাঁই নিয়েছে গ্যারেজে। ঘোরলাগা বরষায় ভিজতে থাকে হলুদ নিয়ন আলো। তার নিচে বৃষ্টিভেজা গাছের পাতার ছায়া। সে ছায়ায় জবুথবু দাঁড়িয়ে থাকেন মাতাল গালিব। আর আমি শুনতে থাকি বৃষ্টির শব্দ। সেই শব্দ ভেদ করে ভেসে আসে শের, ‘ফানা তালিমে দরসে বেখুদি হুঁ উস যামানে সে/ কে মজনুঁ লাম আলিফ লিখতা থা দিওয়ারে দবিসতাঁ পর।’ (নিজেকে ভুলে যাওয়ার শিক্ষা আমার তখন থেকে/মজনুঁ যখন পাঠশালায় সবে শিখছে লায়লার নাম লেখা।—অনুবাদ জাভেদ হুসেন) শের কখনো বাঘ হয়ে থাবা বসায় না। ফলে বর্ষার রাতে, যখন সুনসান নীরবতা নামে এই বৈচিত্র্যহীন শহরে, যখন বৃষ্টিমুখর রাত উপভোগ করে এ শহরের ততোধিক বৈচিত্র্যহীন মানুষগুলো, তখন মাঝে মাঝে গালিব, প্রতিমা বড়ুয়া, বড়ে গুলাম আলীরা আসেন ঘুরতে আমাদের শহরে। সেই অপার্থিব সময়গুলো কেটে কেটে যায় ঘনঘোর বরষায়। বৃষ্টির জলে তখন রাস্তা ভেজে, গাছ ভেজে, বাড়ি ভেজে, দালান ভেজে, আমার জানালার কার্নিশ ভেজে, নীল অপরাজিতা ভেজে টবে, বেড়ে ওঠা রাধাচূড়ার গাছ ভিজতে ভিজতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, তুলসী ভেজে পূতপবিত্র হতে। আর আমি কেবল কোকিল পুরাণ লিখি।
কোকিল পুরাণ, সে এক প্যান্ডোরার বাক্স—শেষ মুহূর্তে যেখান থেকে বেরিয়ে আসে আশা। কিংবা কোকিল পুরাণ আমাদের বাক্সবদলের গল্প। বৃষ্টিতে কোকিল ডাকে না জানি। কাক ডাকে। কিন্তু লেখা যায় কোকিল পুরাণ।
চল্লিশতম বর্ষা পেরিয়ে এসে আমরা যারা কোকিল পুরাণের কথা ভাবি, তারা আসলে ভালোবাসার কথাই ভাবি। কোকিল মানে ভালোবাসা। কোকিল মানে আশা। কোকিল মানে যৌথতা। আর যৌথতা মানে শক্তি। চল্লিশতম বর্ষা পেরিয়ে এলে মানুষ যৌথতার কথা ভাবতে পারে। আশার কথা ভাবতে পারে। আর বুড়ো বট ঝুমবৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ভাবতে পারে একের ঘরের নামতা। একের ঘরের নামতা মানে শুরু, স্বপ্নের বুনন। ফলে চল্লিশতম বর্ষা আমার জীবনে বিশেষ, খিচুড়ির সঙ্গেই শুধু এর যোগাযোগ নয়।
আজ চল্লিশতম বর্ষা পেরিয়ে যাওয়া আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে ভীষণ মনে পড়ে ‘পাখিশাস্ত্রে’র কথা। মনে পড়ে সাদী তাইফ লিখেছিলেন : ‘বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ পাই,/ মেঘে মেঘে শুয়ে শুনি মেঘমল্লার।/ আহা তানসেন!/ বাজাও বাজাও!/ ইছামতি ভিজে যাক হঠাৎ বর্ষায়।’
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
যত দূর দেখা যায়, চোখে পড়ে শুধু মাদারের বন। পুষ্পহীন মাদারের কচি পাতায় লেগে থাকা বৃষ্টিবিন্দু চাতকের ঠোঁট ছোঁবে না, সে জানা কথা। বিরান প্রান্তরে খুঁটিতে বাঁধা অসহায় কালো গাই, ঘুরতে থাকে বৃত্তাকার। বুড়ো বট কান খাড়া করে শোনে সিরাজুল হুদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওয়ানের ক্লাস থেকে ভেসে আসা ইসমাইল হোসেন স্যারের চিৎকার : এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই…। বুড়ো বটের আরও কিছু বয়স বাড়ে। কানে লেগে থাকে ইসমাইল হোসেন স্যারের পড়া ধারাপাত : তিন এক্কে তিন, চার এক্কে চার—একের ঘরের নামতা। জাম রঙের ভুসো কাগজে লেটার প্রেসে ছাপা সেই চটি বইয়ের নাম ছিল ‘ধারাপাত’। মাদারের বনে নামা নিবিড় বৃষ্টির মনোটনিক সাউন্ডের মতো বুড়ো বট শুনতে থাকে এক অপার্থিব সুর: পাঁচ এক্কে পাঁচ, ছয় এক্কে ছয়… দশ এক্কে দশ—একের ঘরের নামতা।
‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ করতে করতে ঠিক চল্লিশতম বর্ষা পেরিয়ে গেলাম আজ। ভাবতেই গা কেমন শিরশির করে ওঠে। এই বর্ষার সঙ্গে আমার এক অদ্ভূত সম্পর্ক আছে। সেটা ঠিক কদম ফুল পেড়ে আনার সম্পর্ক নয়; কিংবা নিছক ইলিশ-খিচুড়ির সম্পর্কও নয়। সিরাজুল হুদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইসমাইল হোসেন স্যারের একের ঘরের নামতার সম্পর্ক। বহুদিন পরে, বুড়ো বট যখন শুনেছিল, সিরাজুল হুদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইসমাইল স্যার সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এক অপার্থিব নির্জনতার দিকে হেঁটে গেছেন একাকী একান্তে, সেদিন বুড়ো বটের মনে পড়েছিল একের ঘরের নামতা। চল্লিশতম বর্ষার শেষে বুড়ো বটের মনে পড়ে, মানুষ স্মৃতিময় প্রাণী। স্মৃতিই তার সম্পদ, তার অভিজ্ঞতা।
চল্লিশতম আষাঢ় শেষ হওয়ার আগে একটা সিনেমা দেখছিলাম। সেখানে বেশ কিছু দৃশ্য আছে বৃষ্টির, যাকে বলে ঝুমবৃষ্টি। একটি দৃশ্যে দেখলাম, ১৯৭১ সালের বর্ষার প্রেক্ষাপটে এক দুঁদে গোয়েন্দা অফিসার ঝুমবৃষ্টিতে জানালা খুলে দিয়ে ভিজতে ভিজতে তার পরিকল্পনা কষছে। সিনেমা শেষে দেখা গেল সে সফল হয়েছে। এর মধ্যে আরও কিছু দৃশ্যে নায়িকা কল্পনামতো ভিজতে ভিজতে এ আর রাহমানের সুর ভাজছে আর আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। একচল্লিশতম বর্ষায় স্বাগত জানানোর কী অদ্ভূত উপায় প্রকৃতির!
আমাদের এই ব্যস্ত শহরে যখন বর্ষা নামে, কোনো এক দূর গ্যালাক্সির স্বাতি নক্ষত্র থেকে ধেয়ে আসা এক ফোঁটা জল মাথায় ছোঁয়ানোর জন্য মন ছটফট করে ওঠে। স্বাতি নক্ষত্রের জল মাথায় পড়লে মানুষ বড়লোক হয়, ধনী হয়। আমার খুব নেশা বড়লোক হওয়ার। সে জন্যই বর্ষা এলে আমি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে উঠি। দালানকোঠার জঙ্গলে নয়, এসব মহাজাগতিক ঘটনা যে প্রকৃতির মধ্যে ঘটে, সেটাও জানি। তার পরও যখন ভীষণ শহুরে হয়ে উঠেছি, জীবনের চল্লিশতম বর্ষা শেষে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, কংক্রিটের ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে কোনো একদিন আমার মাথায় স্বাতি নক্ষত্রের জল পড়বে। আর আমি বড়লোক হয়ে যাব এ শহরে। অথচ প্রায় দেড় দশক কেটে গেল, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ করতে করতে চল্লিশতম বর্ষাও পার হয়ে গেল জীবন থেকে। স্বাতি নক্ষত্রের জল মাথায় পড়ল না।
খেঁকশিয়ালের বিয়ে দেওয়া কৈশোর আর মিষ্টি বৃষ্টিতে নীলাম্বরী শাড়িভেজানো প্রথম যৌবনের কোনো এক সময়ে আমি যখন হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দৌড় শুরু করেছিলাম, কেউ কিন্তু পেছন থেকে বলেনি, রান ফরেস্ট, রান। কিন্তু ফরেস্ট দৌড়েছিল। যাকে বলে ক্যাটস অ্যান্ড ডগস, রংপুর অঞ্চলের স্থানীয় ভাষায় বলে ‘সাপট’—বৃষ্টি আর ঝড় একই সঙ্গে পৃথিবীর বুকে হামলে পড়া সেই সাপটে ফরেস্ট কেন হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে দৌড়েছিল নিউজপ্রিন্টে ছাপা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। মানুষকে যেমন নিশিতে পায়, ফরেস্টকে হয়তো তখন বৃষ্টিতে পেয়েছিল। সে পরীক্ষার হল থেকে দেখতে পেয়েছিল, স্লো মোশনে পড়তে থাকা অপার্থিব বৃষ্টি তাকে ডেকে বলছে, কাম অন বেবি। কোনো দিকে না তাকিয়ে সে পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে সোজা দৌড় দিয়েছিল। প্রায় এক মাইল দৌড়ে ফরেস্ট যখন আবিষ্কার করল সে বাড়িতেই ফিরেছে, তখন তার আফসোস হয়েছিল। কী এমন হতো, এক শ গজ সামনে কিছু দেখতে না পাওয়া সাপটে দৌড়াতে দৌড়াতে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে? বুদ্ধও তো কোনো এক উথালপাতাল পূর্ণিমা রাতে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন! মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। সেই বর্ষায় ফরেস্টকে মন খারাপ করে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করতে হয়েছিল মায়ের কুটিল চোখের সামনে বসে।
তারপর কেটে গেছে প্রায় আড়াই দশক। বিরান প্রান্তরে কালো গাই তখন আর ঘোরে না বৃত্তাকার। জীবনের বৃত্তই তার বদলে গেছে কবে! কিন্তু নিয়ম করে বর্ষা আসে। মানুষ খিচুড়ি খায় ইলিশ দিয়ে। রঙিন ছাতা আর রেইনকোট গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে ব্যস্ত হয়ে। বৈচিত্র্যহীন দালানের ততোধিক বৈচিত্র্যহীন মানুষগুলো যখন বুকের ছাতি ফুলিয়ে জানান দেয় নিজের অস্তিত্ব, ভোরের মোরগের মতো, তখন কোনো এক বাদলা দিনে এই বৈচিত্র্যহীন শহরের কোনো এক খুপরি থেকে শোনা যায় প্রতীমা পাণ্ডে বড়ুয়ার গান : ‘ও জীবন রে,/জীবন ছাড়িয়া না যাইস মোকে/তুই জীবন ছাড়িয়ে গেইলে/আদর করবে কে জীবন রে…।’ এ শহরের ফুটপাতগুলো তখন নীরব। রাস্তা সুনসান। কুকুরগুলো ঠাঁই নিয়েছে গ্যারেজে। ঘোরলাগা বরষায় ভিজতে থাকে হলুদ নিয়ন আলো। তার নিচে বৃষ্টিভেজা গাছের পাতার ছায়া। সে ছায়ায় জবুথবু দাঁড়িয়ে থাকেন মাতাল গালিব। আর আমি শুনতে থাকি বৃষ্টির শব্দ। সেই শব্দ ভেদ করে ভেসে আসে শের, ‘ফানা তালিমে দরসে বেখুদি হুঁ উস যামানে সে/ কে মজনুঁ লাম আলিফ লিখতা থা দিওয়ারে দবিসতাঁ পর।’ (নিজেকে ভুলে যাওয়ার শিক্ষা আমার তখন থেকে/মজনুঁ যখন পাঠশালায় সবে শিখছে লায়লার নাম লেখা।—অনুবাদ জাভেদ হুসেন) শের কখনো বাঘ হয়ে থাবা বসায় না। ফলে বর্ষার রাতে, যখন সুনসান নীরবতা নামে এই বৈচিত্র্যহীন শহরে, যখন বৃষ্টিমুখর রাত উপভোগ করে এ শহরের ততোধিক বৈচিত্র্যহীন মানুষগুলো, তখন মাঝে মাঝে গালিব, প্রতিমা বড়ুয়া, বড়ে গুলাম আলীরা আসেন ঘুরতে আমাদের শহরে। সেই অপার্থিব সময়গুলো কেটে কেটে যায় ঘনঘোর বরষায়। বৃষ্টির জলে তখন রাস্তা ভেজে, গাছ ভেজে, বাড়ি ভেজে, দালান ভেজে, আমার জানালার কার্নিশ ভেজে, নীল অপরাজিতা ভেজে টবে, বেড়ে ওঠা রাধাচূড়ার গাছ ভিজতে ভিজতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, তুলসী ভেজে পূতপবিত্র হতে। আর আমি কেবল কোকিল পুরাণ লিখি।
কোকিল পুরাণ, সে এক প্যান্ডোরার বাক্স—শেষ মুহূর্তে যেখান থেকে বেরিয়ে আসে আশা। কিংবা কোকিল পুরাণ আমাদের বাক্সবদলের গল্প। বৃষ্টিতে কোকিল ডাকে না জানি। কাক ডাকে। কিন্তু লেখা যায় কোকিল পুরাণ।
চল্লিশতম বর্ষা পেরিয়ে এসে আমরা যারা কোকিল পুরাণের কথা ভাবি, তারা আসলে ভালোবাসার কথাই ভাবি। কোকিল মানে ভালোবাসা। কোকিল মানে আশা। কোকিল মানে যৌথতা। আর যৌথতা মানে শক্তি। চল্লিশতম বর্ষা পেরিয়ে এলে মানুষ যৌথতার কথা ভাবতে পারে। আশার কথা ভাবতে পারে। আর বুড়ো বট ঝুমবৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ভাবতে পারে একের ঘরের নামতা। একের ঘরের নামতা মানে শুরু, স্বপ্নের বুনন। ফলে চল্লিশতম বর্ষা আমার জীবনে বিশেষ, খিচুড়ির সঙ্গেই শুধু এর যোগাযোগ নয়।
আজ চল্লিশতম বর্ষা পেরিয়ে যাওয়া আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে ভীষণ মনে পড়ে ‘পাখিশাস্ত্রে’র কথা। মনে পড়ে সাদী তাইফ লিখেছিলেন : ‘বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ পাই,/ মেঘে মেঘে শুয়ে শুনি মেঘমল্লার।/ আহা তানসেন!/ বাজাও বাজাও!/ ইছামতি ভিজে যাক হঠাৎ বর্ষায়।’
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১৬ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১৬ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১৬ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ দিন আগে