সেলিম জাহান
‘বাবার মৃত্যুর পর আমার ওপর থেকে একমাত্র অভিভাবকের ছায়া সরে গেল,’ ভদ্রলোকের কথা বেদনার্ত শোনায়। আমার এক সহকর্মীর বন্ধু তিনি। মোবাইল ফোনে কথা বলছিলাম। তিনি গল্প করছিলেন কলকাতায় তাঁর বড় হয়ে ওঠা, তাঁর কাজ, পরিবার ও বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে। গল্পের পরতে পরতে তাঁর কণ্ঠে কখনো কখনো উচ্ছ্বাসের সুর, কখনো কখনো চমকের আন্দোলন, কখনো বেদনার আভাস। শুনতে শুনতে দুটো শব্দ আমার করোটিতে কেন যেন ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ কথা কচ্ছিল–‘একমাত্র’ এবং ‘অভিভাবক’। আমি লেখার টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই।
‘আমার জীবনে কি বাবাই একমাত্র অভিভাবক ছিলেন? কিংবা মা?’ নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি আমি। নিজের মনেই উত্তর পেয়ে যাই–না, ছেলেবেলায় আমার অভিভাবক একজন ছিলেন না এবং সত্যিকার অর্থে আমার মা-বাবা ‘আমার বহু অভিভাবকের’ একজন ছিলেন মাত্র। ‘আমার অভিভাবকেরা’ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন নানান রূপে, নানান জায়গায়, নানাভাবে ঘরে-বাইরে, স্কুল-কলেজে, পথে-ঘাটে।
ঘরের মধ্যে মা-বাবা তো ছিলেন, তারপর ছিলেন আমাদের রহিমন বু; মায়ের রান্নাবাড়ার সহায়তাকারী এবং রহম আলী ভাই, যিনি বাবার বাগানের কাজের সহকারী ছিলেন। ঘরের মধ্যে উঠতে-বসতে, খেতে-শুতে রহিমন বু-র খবরদারিতে কাটত। ‘খাইতে বসার আগে হাত ধুইয়া আসো বাজান,’ ‘অতো চা খাইয়ো না, শইর কইষ্যা যাইব,’ ‘অতো রাইত জাগো ক্যান? আল্লাহ পাক রাইত বানাইছে ঘুমানের লাইগ্যা’–এমন শত শত খবরদারি চলত রাতদিন।
রহম আলী ভাই ছিলেন আরও এক কাঠি সরেস। সারা দিনের সব দুষ্টুমির খবর দিনের শেষে বাবার কানে পৌঁছানোই ছিল তাঁর প্রধানতম কাজ। খেলতে গিয়ে বাগানে গাছ মাড়িয়েছি কি না, পাশের বাড়ির জানালায় ঢিল ছুড়েছি কি না, বাড়ির পোষা বেড়াল ‘পুষির’ লেজে দড়ি দিয়ে খালি টিন বেঁধেছি কি না–সারা দিন বাড়ি না থেকেও বাবা সব জানতেন সন্ধ্যা নাগাদ।
কলেজগেটের মোড়ে ছিলেন আমার আর দুজন অভিভাবক। ‘ভাই-ভাই কেবিনের’ জলিল ভাইয়ের ছিল শ্যেনদৃষ্টি। কার কার সঙ্গে মিশছি, পথেঘাটে কোনো তথাকথিত ‘অন্যায্য কাজ’ (তাঁর ভাষায়) করা যেত না জলিল ভাইয়ের চোখ এড়িয়ে। আমার সব অন্যায্য কাজের বিবরণই তিনি সযত্নে পেশ করতেন আমার বাবার দরবারে। সুন্দর চা বানাতেন জলিল ভাই–শরীফ মিয়ার ‘মাল্লাই চায়ের’ সঙ্গেই শুধু সে চায়ের তুলনা চলে। নিজেকে কেউকেটা প্রমাণ করতে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিন বন্ধুকে নিয়ে ‘ভাই-ভাই কেবিনে’ ঢুকেছিলাম চা পানের জন্য। না, মোটেই ভ্রাতৃসুলভ ব্যবহার করেননি জলিল ভাই। রেস্টুরেন্টে বসার বয়স আমার হয়নি, এই একটি কথা বলে তিনি আমাকে পত্রপাঠ বিদায় করেন।
জলিল ভাইয়ের ‘ভাই-ভাই কেবিনের’ কয়েক ঘর পরেই ছিল অশ্বিনীদার (অশ্বিনী মিস্ত্রির) কাঠের দোকান। মাঝবয়সী এই মানুষটি আমার মাকে ‘মা’ ডাকতেন এবং সেই সূত্রেই তিনি আমার অগ্রজের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মুখের এবং স্বরের কোনো বাঁধন ছিল না। সুতরাং সুযোগ পেলেই তিনি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আমার দুষ্কর্মের বিবরণ দিয়ে আমাকে শাসাতেন। জনসমক্ষে অমন বেকায়দায় আমি জীবনে বড় একটা আর পড়েছি বলে মনে পড়ে না। তারপর মায়ের কাছে নালিশের ফিরিস্তি তো আছেই।
কিন্তু একটি দিনের কথা খুব মনে আছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে, বরিশালের বর্ষা বলে কথা। আমরা কয়েকজন বন্ধু ভিজতে ভিজতে এবং একে অন্যকে ভেজাতে ভেজাতে বাড়ি ফিরছি। হাতের ছোট্ট ছাতাকে তরবারির মতো ব্যবহার করে একে অন্যকে আক্রমণ করছি–জুতো ভেজাচ্ছি রাস্তায় জমে যাওয়া জলে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, সামনেই অশ্বিনীদা দাঁড়িয়ে। বন্ধুরা ততক্ষণে হাওয়া।
‘বড়লোক হইয়া গ্যাছ, না? জুতা ভিজাইয়া নষ্ট করলে অসুবিধা কী? বাপে রাইত-দিন খাইট্টা কিন্না দিব। তোমার চিন্তা কী?’ বর্ষার মুষলধারার সঙ্গে
তাল মিলিয়ে আমাকে বকতে বকতে আর আমার মাথার ওপরে ছাতা ধরে আধা ঘণ্টা পরে তিনি যখন আমাকে আমাদের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন, তখন আমার শরীরে কোনো বৃষ্টির ফোঁটা তিনি পড়তে দেননি; কিন্তু হাঁপানির রোগী অশ্বিনীদার শরীরের কোনো অংশ আর শুকনো ছিল না।
‘এ্যাই...ই... ই’ বজ্রকণ্ঠের হুংকার। বেশ আনন্দে কয়েকজন বন্ধু মিলে বরিশাল জিলা স্কুলের পাশের রাস্তার বিজলি বাতিটা ঢিল ছুড়ে ছুড়ে তাক করছিলাম। প্রতিযোগিতা হচ্ছে—কে ওটা প্রথম ভাঙতে পারে। বেশ কষেই ঢিলটা ছুড়েছিলাম। লেগেও গেল।
খান খান শব্দে বাতিটা ভেঙে যাওয়ার শব্দে স্কুলঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ওই বজ্রকণ্ঠের অধিকারী মানুষটি, স্কুলঘরের খবরদারি যিনি করেন, তিনি। মনসুর নানা—আমাদের সবার ‘নানা’। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে বরিশাল জিলা স্কুলে যাঁরাই ছাত্র ছিলেন, তাঁরাই ‘নানাকে’ চিনবেন।
আমার এই বিপদকালেও ‘বেইমান’ বন্ধুরা আমাকে ফেলে দৌড় দিল—কাপুরুষ আর কাকে বলে! নানা এসেই খপ করে আমার কবজি ধরলেন শক্ত হাতে। বুঝলাম, ভীষণ রেগেছেন তিনি। ভয়ে আমি তখন আধমরা। আমার ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর বোধ হয় মায়া হলো। নরম গলায় বললেন, ‘বাত্তি ভাঙাটা তোমাগো কাছে খেলা। কিন্তু রাইতে কত্তো মানু এই পথ দিয়া বাড়ি যাইব। চিন্তা করছ, আন্ধাইরা রাইতে হেগো কী কষ্ট হইবে?’ জীবনে সেই শিক্ষা আমি ভুলিনি।
আমার এই সব অভিভাবক আমাকে শুধু ‘মানুষ’ হতে সাহায্য করেননি, বিভিন্ন সময়ে আমাকে নিয়ে গর্বিত হয়েছেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পর জিলা স্কুলে আমাকে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সেখানে মনসুর নানার গর্বিত মুখ আমি দেখেছি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পর নিজের বড়শিতে ধরা বিরাট এক রুই মাছ কাঁধে করে বয়ে এনেছেন অশ্বিনীদা। অত বড় মাছটি আমার মায়ের পায়ের কাছে নামিয়ে বলেছেন: ‘মা, মাথাডা অরে দিয়েন।’ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল বেরোলে রহম আলী ভাই লোকের কাছে বলে বেড়াতেন আমার কথা। উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যাওয়ার সময় রহিমন বু-র ক্রন্দন আমি ভুলিনি। আমাকে নিয়ে তাঁদের ছিল একবুক অহংকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বিএম কলেজে গিয়েছিলাম বহিরাগত পরীক্ষক হয়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে। ঢুকেছিলাম ‘ভাই-ভাই কেবিনে’ একদিন। জলিল ভাইয়ের আনন্দ কে দেখে! সবাইকে সরিয়ে দিয়ে তিনি আমাকে সাদরে বসতে দিয়েছেন, নিজ হাতে চা বানিয়ে আমার সামনে ধরেছেন। সেই অমৃতের সোয়াদ এখনো মুখে লেগে আছে।
আমার এসব অভিভাবকের কেউই নেই এখন। স্কুল ছাড়ার পর মনসুর নানার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে অশ্বিনীদাকে আমি নিজে আটঘর-কুরিয়ানায় পৌঁছে দিয়েছিলাম। সত্তরের দশকের শেষাশেষি তিনি কলকাতায় দেহত্যাগ করেছেন বলে শুনেছি। আশির দশকে জলিল ভাই, রহিমন বু আর রহম আলী ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বড় মনে হয় তাঁদের কথা।
নিজেই এখন বহু মানুষের অভিভাবক হয়েছি। নানান জন আমাকে তাঁদের আস্থার জায়গা মনে করেন। কিন্তু তবু একবার আক্ষেপ করেছিলাম প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে: ‘আমার ছায়ারা সব সরে যাচ্ছে, স্যার।’ তিনি শান্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘তোমার আর ছায়ার প্রয়োজন নেই। তুমিই এখন অন্যকে ছায়া দেবে।’ হয়তো তাই। কিন্তু তবু আমার সব ‘অভিভাবকের’ অবর্তমানে প্রায়ই নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
‘বাবার মৃত্যুর পর আমার ওপর থেকে একমাত্র অভিভাবকের ছায়া সরে গেল,’ ভদ্রলোকের কথা বেদনার্ত শোনায়। আমার এক সহকর্মীর বন্ধু তিনি। মোবাইল ফোনে কথা বলছিলাম। তিনি গল্প করছিলেন কলকাতায় তাঁর বড় হয়ে ওঠা, তাঁর কাজ, পরিবার ও বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে। গল্পের পরতে পরতে তাঁর কণ্ঠে কখনো কখনো উচ্ছ্বাসের সুর, কখনো কখনো চমকের আন্দোলন, কখনো বেদনার আভাস। শুনতে শুনতে দুটো শব্দ আমার করোটিতে কেন যেন ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ কথা কচ্ছিল–‘একমাত্র’ এবং ‘অভিভাবক’। আমি লেখার টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই।
‘আমার জীবনে কি বাবাই একমাত্র অভিভাবক ছিলেন? কিংবা মা?’ নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি আমি। নিজের মনেই উত্তর পেয়ে যাই–না, ছেলেবেলায় আমার অভিভাবক একজন ছিলেন না এবং সত্যিকার অর্থে আমার মা-বাবা ‘আমার বহু অভিভাবকের’ একজন ছিলেন মাত্র। ‘আমার অভিভাবকেরা’ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন নানান রূপে, নানান জায়গায়, নানাভাবে ঘরে-বাইরে, স্কুল-কলেজে, পথে-ঘাটে।
ঘরের মধ্যে মা-বাবা তো ছিলেন, তারপর ছিলেন আমাদের রহিমন বু; মায়ের রান্নাবাড়ার সহায়তাকারী এবং রহম আলী ভাই, যিনি বাবার বাগানের কাজের সহকারী ছিলেন। ঘরের মধ্যে উঠতে-বসতে, খেতে-শুতে রহিমন বু-র খবরদারিতে কাটত। ‘খাইতে বসার আগে হাত ধুইয়া আসো বাজান,’ ‘অতো চা খাইয়ো না, শইর কইষ্যা যাইব,’ ‘অতো রাইত জাগো ক্যান? আল্লাহ পাক রাইত বানাইছে ঘুমানের লাইগ্যা’–এমন শত শত খবরদারি চলত রাতদিন।
রহম আলী ভাই ছিলেন আরও এক কাঠি সরেস। সারা দিনের সব দুষ্টুমির খবর দিনের শেষে বাবার কানে পৌঁছানোই ছিল তাঁর প্রধানতম কাজ। খেলতে গিয়ে বাগানে গাছ মাড়িয়েছি কি না, পাশের বাড়ির জানালায় ঢিল ছুড়েছি কি না, বাড়ির পোষা বেড়াল ‘পুষির’ লেজে দড়ি দিয়ে খালি টিন বেঁধেছি কি না–সারা দিন বাড়ি না থেকেও বাবা সব জানতেন সন্ধ্যা নাগাদ।
কলেজগেটের মোড়ে ছিলেন আমার আর দুজন অভিভাবক। ‘ভাই-ভাই কেবিনের’ জলিল ভাইয়ের ছিল শ্যেনদৃষ্টি। কার কার সঙ্গে মিশছি, পথেঘাটে কোনো তথাকথিত ‘অন্যায্য কাজ’ (তাঁর ভাষায়) করা যেত না জলিল ভাইয়ের চোখ এড়িয়ে। আমার সব অন্যায্য কাজের বিবরণই তিনি সযত্নে পেশ করতেন আমার বাবার দরবারে। সুন্দর চা বানাতেন জলিল ভাই–শরীফ মিয়ার ‘মাল্লাই চায়ের’ সঙ্গেই শুধু সে চায়ের তুলনা চলে। নিজেকে কেউকেটা প্রমাণ করতে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিন বন্ধুকে নিয়ে ‘ভাই-ভাই কেবিনে’ ঢুকেছিলাম চা পানের জন্য। না, মোটেই ভ্রাতৃসুলভ ব্যবহার করেননি জলিল ভাই। রেস্টুরেন্টে বসার বয়স আমার হয়নি, এই একটি কথা বলে তিনি আমাকে পত্রপাঠ বিদায় করেন।
জলিল ভাইয়ের ‘ভাই-ভাই কেবিনের’ কয়েক ঘর পরেই ছিল অশ্বিনীদার (অশ্বিনী মিস্ত্রির) কাঠের দোকান। মাঝবয়সী এই মানুষটি আমার মাকে ‘মা’ ডাকতেন এবং সেই সূত্রেই তিনি আমার অগ্রজের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মুখের এবং স্বরের কোনো বাঁধন ছিল না। সুতরাং সুযোগ পেলেই তিনি আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আমার দুষ্কর্মের বিবরণ দিয়ে আমাকে শাসাতেন। জনসমক্ষে অমন বেকায়দায় আমি জীবনে বড় একটা আর পড়েছি বলে মনে পড়ে না। তারপর মায়ের কাছে নালিশের ফিরিস্তি তো আছেই।
কিন্তু একটি দিনের কথা খুব মনে আছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে, বরিশালের বর্ষা বলে কথা। আমরা কয়েকজন বন্ধু ভিজতে ভিজতে এবং একে অন্যকে ভেজাতে ভেজাতে বাড়ি ফিরছি। হাতের ছোট্ট ছাতাকে তরবারির মতো ব্যবহার করে একে অন্যকে আক্রমণ করছি–জুতো ভেজাচ্ছি রাস্তায় জমে যাওয়া জলে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, সামনেই অশ্বিনীদা দাঁড়িয়ে। বন্ধুরা ততক্ষণে হাওয়া।
‘বড়লোক হইয়া গ্যাছ, না? জুতা ভিজাইয়া নষ্ট করলে অসুবিধা কী? বাপে রাইত-দিন খাইট্টা কিন্না দিব। তোমার চিন্তা কী?’ বর্ষার মুষলধারার সঙ্গে
তাল মিলিয়ে আমাকে বকতে বকতে আর আমার মাথার ওপরে ছাতা ধরে আধা ঘণ্টা পরে তিনি যখন আমাকে আমাদের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন, তখন আমার শরীরে কোনো বৃষ্টির ফোঁটা তিনি পড়তে দেননি; কিন্তু হাঁপানির রোগী অশ্বিনীদার শরীরের কোনো অংশ আর শুকনো ছিল না।
‘এ্যাই...ই... ই’ বজ্রকণ্ঠের হুংকার। বেশ আনন্দে কয়েকজন বন্ধু মিলে বরিশাল জিলা স্কুলের পাশের রাস্তার বিজলি বাতিটা ঢিল ছুড়ে ছুড়ে তাক করছিলাম। প্রতিযোগিতা হচ্ছে—কে ওটা প্রথম ভাঙতে পারে। বেশ কষেই ঢিলটা ছুড়েছিলাম। লেগেও গেল।
খান খান শব্দে বাতিটা ভেঙে যাওয়ার শব্দে স্কুলঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ওই বজ্রকণ্ঠের অধিকারী মানুষটি, স্কুলঘরের খবরদারি যিনি করেন, তিনি। মনসুর নানা—আমাদের সবার ‘নানা’। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে বরিশাল জিলা স্কুলে যাঁরাই ছাত্র ছিলেন, তাঁরাই ‘নানাকে’ চিনবেন।
আমার এই বিপদকালেও ‘বেইমান’ বন্ধুরা আমাকে ফেলে দৌড় দিল—কাপুরুষ আর কাকে বলে! নানা এসেই খপ করে আমার কবজি ধরলেন শক্ত হাতে। বুঝলাম, ভীষণ রেগেছেন তিনি। ভয়ে আমি তখন আধমরা। আমার ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর বোধ হয় মায়া হলো। নরম গলায় বললেন, ‘বাত্তি ভাঙাটা তোমাগো কাছে খেলা। কিন্তু রাইতে কত্তো মানু এই পথ দিয়া বাড়ি যাইব। চিন্তা করছ, আন্ধাইরা রাইতে হেগো কী কষ্ট হইবে?’ জীবনে সেই শিক্ষা আমি ভুলিনি।
আমার এই সব অভিভাবক আমাকে শুধু ‘মানুষ’ হতে সাহায্য করেননি, বিভিন্ন সময়ে আমাকে নিয়ে গর্বিত হয়েছেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পর জিলা স্কুলে আমাকে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সেখানে মনসুর নানার গর্বিত মুখ আমি দেখেছি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পর নিজের বড়শিতে ধরা বিরাট এক রুই মাছ কাঁধে করে বয়ে এনেছেন অশ্বিনীদা। অত বড় মাছটি আমার মায়ের পায়ের কাছে নামিয়ে বলেছেন: ‘মা, মাথাডা অরে দিয়েন।’ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল বেরোলে রহম আলী ভাই লোকের কাছে বলে বেড়াতেন আমার কথা। উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যাওয়ার সময় রহিমন বু-র ক্রন্দন আমি ভুলিনি। আমাকে নিয়ে তাঁদের ছিল একবুক অহংকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বিএম কলেজে গিয়েছিলাম বহিরাগত পরীক্ষক হয়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে। ঢুকেছিলাম ‘ভাই-ভাই কেবিনে’ একদিন। জলিল ভাইয়ের আনন্দ কে দেখে! সবাইকে সরিয়ে দিয়ে তিনি আমাকে সাদরে বসতে দিয়েছেন, নিজ হাতে চা বানিয়ে আমার সামনে ধরেছেন। সেই অমৃতের সোয়াদ এখনো মুখে লেগে আছে।
আমার এসব অভিভাবকের কেউই নেই এখন। স্কুল ছাড়ার পর মনসুর নানার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে অশ্বিনীদাকে আমি নিজে আটঘর-কুরিয়ানায় পৌঁছে দিয়েছিলাম। সত্তরের দশকের শেষাশেষি তিনি কলকাতায় দেহত্যাগ করেছেন বলে শুনেছি। আশির দশকে জলিল ভাই, রহিমন বু আর রহম আলী ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বড় মনে হয় তাঁদের কথা।
নিজেই এখন বহু মানুষের অভিভাবক হয়েছি। নানান জন আমাকে তাঁদের আস্থার জায়গা মনে করেন। কিন্তু তবু একবার আক্ষেপ করেছিলাম প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে: ‘আমার ছায়ারা সব সরে যাচ্ছে, স্যার।’ তিনি শান্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘তোমার আর ছায়ার প্রয়োজন নেই। তুমিই এখন অন্যকে ছায়া দেবে।’ হয়তো তাই। কিন্তু তবু আমার সব ‘অভিভাবকের’ অবর্তমানে প্রায়ই নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
৮ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
৮ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
৮ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে