আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আজকের পত্রিকার জন্য লিখতে বসেই একটা অনুরোধ পেলাম। বাংলাদেশে মুজিববর্ষে ৯ লাখ গৃহহীন পরিবারকে গৃহ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির পরিণতি এবং এই পরিণতির জন্য কারা দায়ী, সে সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য এই অনুরোধ।
এ প্রসঙ্গ নিয়ে ঢাকার আর একটি দৈনিকে আমি আগেই লিখেছি। নতুন করে লেখার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অন্য দৈনিকে আমার এই আশ্রয়ণ সম্পর্কে লেখাটি পাঠ করে কিছু পাঠক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নতুন কিছু তথ্য দিয়েছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর গৃহহীনদের গৃহদান প্রকল্প সম্পর্কে নতুন করে এই কলাম লিখতে হচ্ছে।
২০২০ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘দেশের একটি মানুষও গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না।’ এই ঘোষণা অনুযায়ী গৃহহীন ও ভূমিহীনদের তালিকা প্রস্তুত হয় এবং মুজিববর্ষে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬৬২টি পরিবারকে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকার। প্রতিটি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকেই দেওয়ার ব্যবস্থা হয় দুর্যোগসহনীয় সেমিপাকা ঘর এবং ২ শতাংশ জমি। ঘরগুলো রঙিন টিনশেডের। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন মনিটরিংয়ের দায়িত্ব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে স্লোগান যুক্ত করা হয়েছে তা হলো, ‘আশ্রয়ণের অধিকার শেখ হাসিনার উপহার’।
প্রধানমন্ত্রীর নাম যুক্ত এই মহাপরিকল্পনায় বড় রকমের কেলেঙ্কারি যুক্ত হয়েছে। মাত্র আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকায় নির্মিত সেমিপাকা ঘরের বহু স্থান ধসে পড়েছে। যে গৃহহীনদের ঘর দেওয়া হয়েছিল, তাদের কেউ কেউ ঘরচাপা পড়ে আহত হয়ে হাসপাতালে গেছেন। অনেক জায়গায় বাড়ির দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে। টিনের ছাদ দিয়ে বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। অর্থাৎ, বাড়িগুলো তৈরি হতে না হতেই বাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, গৃহনির্মাণ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত একশ্রেণির অফিসার, নির্বাহী কর্মকর্তা, ঠিকাদার দুই হাতে টাকা চুরি করেছেন। জানা গেছে, এরা আবার সবাই আওয়ামী লীগদলীয়। সুতরাং দলীয় তদন্তে এদের চুরি ধরাও পড়বে না। দুষ্কৃতকারীরা সাজাও পাবে না। সব কেলেঙ্কারি বর্তাবে প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে। নির্বাচন এলে এটা বিএনপি–জামায়াতের নির্বাচন প্রচারণায় একটা বড় মূলধন হবে। সে জন্যই এই কেলেঙ্কারিটা ধামাচাপা না দিয়ে এবং দোষী আমলারা যাতে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে না পারে, তার কঠোর ব্যবস্থা হওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ভেঙে পড়া ঘরগুলো ত্বরিত মেরামত হচ্ছে। তবু আগের ঘরগুলো নির্মাণের সঙ্গে জড়িত সব ব্যক্তিকে নিরপেক্ষ তদন্তের আওতায় আনা দরকার এবং কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা উচিত। নইলে গৃহহীনদের ভাঙা ঘর মেরামত হবে, কিন্তু সরকারের কলঙ্ক দূর হবে না।
ঢাকা থেকে আমার কিছু বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, প্রধানমন্ত্রীর এই গৃহনির্মাণ প্রকল্পে কেলেঙ্কারি যুক্ত করার পেছনে শুধু দুর্নীতি নয়, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রও ছিল। কিন্তু তদন্তে এই ষড়যন্ত্র বেরিয়ে আসতে দেয়নি আমলারা। ষড়যন্ত্রটা হলো, আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারের একমাত্র মূলধন হলেন শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সংগঠনের দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছে। সরকারকেও নানা অনিয়ম–অব্যবস্থাপনার জন্য অভিযুক্ত করতে পেরেছে, কিন্তু শেখ হাসিনার গায়ে এ পর্যন্ত কোনো কালির আঁচড় লাগাতে পারেনি। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, শেখ হাসিনা যোগ্য শাসক এবং সৎ শাসকও। মানুষ ভোট দেয় শেখ হাসিনাকে, আওয়ামী লীগকে নয়। সুতরাং এখন চক্রান্তকারীদের টার্গেট শেখ হাসিনা। তাঁর চরিত্র হনন করা গেলে বর্তমান সরকারকে হয়তো সহজে উচ্ছেদ করা যাবে। ইতিপূর্বে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাসহ বহুবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। এই হত্যার প্রচেষ্টা//// ব্যর্থ হওয়ায় এবং ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ায় এখন শুরু হয়েছে তার চরিত্র হননের এই চেষ্টা। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যে পরিকল্পনার মনিটরিং করেছেন, সেই পরিকল্পনার দুর্নীতি? তাহলে ব্যাপারটা কী?
এই চক্রান্তকারীদের সঙ্গে একশ্রেণির আমলারও যোগাযোগ আছে বলে আমার বন্ধুরা মনে করেন। আমি কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে যখন বঙ্গবন্ধু আমলের ’৭৪ ও ’৭৫ সালের ঘটনাবলির সাদৃশ্য দেখি, তখন একটু সতর্কতার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে তেমন খাদ্যাভাব ছিল না। বন্যা ও প্লাবনে যেটুকু খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছিল, আমেরিকার সঙ্গে খাদ্যচুক্তি করে বঙ্গবন্ধু সেটুকু খাদ্যাভাব পূরণ করার ব্যবস্থা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। এ সময় শুরু হয় অবিশ্বাস্য ষড়যন্ত্র। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্য লুকিয়ে ফেলে কৃত্রিম খাদ্যাভাব সৃষ্টি করে। আমেরিকা যথাসময়ে চুক্তি মোতাবেক খাদ্য না পাঠিয়ে হাই সিতে খাদ্যবাহী জাহাজগুলো ঘোরাতে থাকে। প্রচণ্ড বন্যা ও প্লাবনে দেশের দুর্গত এলাকায় রিলিফ পাঠানো যাচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধু বন্যাপ্লাবিত এলাকায় হেলিকপ্টারে রিলিফ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই রিলিফ নদীর পানিতে ভেসে যেতে দেখা গেছে, বন্যার্তদের হাতে পৌঁছায়নি। কোথা থেকে এ সময় একজন ‘ম্যান সেরুমিয়ার’ আবির্ভাব হয়, সেই অদৃশ্য দুষ্কৃতির ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে আমলা চক্র ও ষড়যন্ত্রকারীরা মিলে দেশে এমন এক দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে, যাতে দুই লাখ নর-নারীর অসহায় মৃত্যু হয়।
এখন মার্কিন পত্রপত্রিকায় স্বীকার করা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য এই খাদ্যাভাব ঘটানো ছিল মার্কিন চক্রান্ত।
বর্তমানে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্তর্জাতিক চক্রান্ত আছে বলে মনে হয় না। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের আগের আধিপত্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন নেই। স্নায়ুযুদ্ধও এখন নেই। আছে এশিয়ায় প্রভুত্বের বিস্তার নিয়ে ভারত–চীনের মধ্যে আঞ্চলিক স্নায়ুযুদ্ধ। হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি এই আঞ্চলিক স্নায়ুযুদ্ধের কবল থেকে বাংলাদেশকে অনেকটাই মুক্ত রেখেছে। সৌদি আরব, চীনও বাংলাদেশের মিত্র। ভারতের মোদি সরকার তো বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের পরম মিত্র। একমাত্র পাকিস্তান, তাদের ষড়যন্ত্রের দাঁতও ভোঁতা হয়ে গেছে। পাকিস্তানের জনগণ বাংলাদেশকে এখন বন্ধু মনে করে। তাদের টক শোতে বলা হয়, পাকিস্তানে হাসিনার মতো নেতা দরকার।
বলতে গেলে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের জন্য বড় ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হয় না। আমেরিকার সাবেক ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা বর্তমান বাইডেন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নানা কারণে হাসিনা সরকারের খুব নিকট বন্ধু না হলেও শত্রু নয়। বরং মার্কিন নেতারাও এখন মনে করেন, বাংলাদেশে হাসিনার বিকল্প কোনো নেতা নেই। এই মুহূর্তে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরালে শুধু বাংলাদেশেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস হবে না, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে। আফগানিস্তানের মৌলবাদী উগ্রতা বাংলাদেশকে ছেয়ে ফেলবে।
এই সত্যটা মৌলবাদী জামায়াত-হেফাজত এবং আধা মৌলবাদী বিএনপি মানতে রাজি নয়। মানতে রাজি নয়, এই রাজনৈতিক চক্রের সহযোগী দেশের সুশীল সমাজ। এই সুশীল সমাজের নেতা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের এখন কোনো পাত্তা নেই। তাঁর বন্ধু ড. কামাল হোসেন এতকাল লাপাত্তা থাকার পরে সম্প্রতি মুখ খুলে বলেছেন, ‘সরকার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।’ ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশও করোনা নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত সক্ষম হয়নি। তাই বলে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বড় বিরোধীরা বলেননি সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আমাদের সুশীল সমাজের নেতা তাঁর দেশ সম্পর্কে সে কথা বলেছেন। তাঁকে দেশের মানুষ একবারও ভোট দেয়নি।
আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনা সরকারের দৃশ্যমান বিপদ না থাকলেও, দেশে অদৃশ্য ষড়যন্ত্র একটা নয়, একটার পর একটা বাড়ছে। ইংরেজিতে স্যাবোটাজ বা নাশকতা বলে একটা কথা আছে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে এখন এই স্যাবোটাজ বেড়েছে, নইলে একটি-দুটি নয়; শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের এতগুলো ঘর নির্মাণের দুই মাসের মধ্যে সামান্য বৃষ্টির পানিতে এমনভাবে ভেঙে পড়ত না। এর পেছনে বড় ধরনের চুরি-বাটপারি তো আছেই, আবার একশ্রেণির আমলা ও ঠিকাদারের চুরির সঙ্গে শেখ হাসিনার সুনাম নষ্ট করার জন্য রাজনৈতিক স্যাবোটাজ যুক্ত হয়ে থাকলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
এই রাজনৈতিক স্যাবোটাজ চালানোর জন্য লন্ডনে যুবরাজের মতো আরাম-আয়েশে বসবাসরত তারেক রহমান অ্যান্ড কোং একটার পর একটা ঘুঁটি চেলে চলেছেন। কখনো মা খালেদা জিয়াকে রুগ্ণ বানিয়ে, তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার নামে পাঠানোর দাবি তুলে, একটা রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে দেশে রাজনৈতিক গোলযোগ পাকানোর চেষ্টা, কখনো জামায়াতি–হেফাজতি এজেন্ট দ্বারা ভাস্কর্য নির্মাণ ইসলামবিরোধী—এ কথা প্রচার করে জাতির পিতার ভাস্কর্যের অবমাননা ইত্যাদি নাশকতামূলক কাজে বিরতি নেই। তারা প্রধানমন্ত্রীর নামে আশ্রয়ণের যে পরিকল্পনা, তাতে অসাধু আমলা এবং ঠিকাদার, যে ঠিকাদারেরা আবার আওয়ামী দলীয়, তাদের সাহায্যে এই ভয়ানক নাশকতামূলক কাজটি করে থাকলে বিস্ময়ের কিছু নেই।
সরকার সময় থাকতে সতর্ক হোক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ’৭৪ ও ’৭৫–এর আলামত দেখা দিয়েছে কি না, তা সতর্কভাবে বিবেচনা করে দেখুক। আশ্রয়ণ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত দোষী আমলা ও ঠিকাদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিক। তারা ঘরের লোক হলেও যেন শাস্তি এড়াতে না পারে। তদুপরি, এই দুর্নীতির সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক স্যাবোটাজ যুক্ত কি না, তা সতর্কতার সঙ্গে বিচার করে ছাই থেকে আগুন জ্বলে ওঠার আগেই তা নিভিয়ে ফেলার ব্যবস্থা নিক।
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
আজকের পত্রিকার জন্য লিখতে বসেই একটা অনুরোধ পেলাম। বাংলাদেশে মুজিববর্ষে ৯ লাখ গৃহহীন পরিবারকে গৃহ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির পরিণতি এবং এই পরিণতির জন্য কারা দায়ী, সে সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য এই অনুরোধ।
এ প্রসঙ্গ নিয়ে ঢাকার আর একটি দৈনিকে আমি আগেই লিখেছি। নতুন করে লেখার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অন্য দৈনিকে আমার এই আশ্রয়ণ সম্পর্কে লেখাটি পাঠ করে কিছু পাঠক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নতুন কিছু তথ্য দিয়েছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর গৃহহীনদের গৃহদান প্রকল্প সম্পর্কে নতুন করে এই কলাম লিখতে হচ্ছে।
২০২০ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘দেশের একটি মানুষও গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না।’ এই ঘোষণা অনুযায়ী গৃহহীন ও ভূমিহীনদের তালিকা প্রস্তুত হয় এবং মুজিববর্ষে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬৬২টি পরিবারকে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকার। প্রতিটি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারকেই দেওয়ার ব্যবস্থা হয় দুর্যোগসহনীয় সেমিপাকা ঘর এবং ২ শতাংশ জমি। ঘরগুলো রঙিন টিনশেডের। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন মনিটরিংয়ের দায়িত্ব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে স্লোগান যুক্ত করা হয়েছে তা হলো, ‘আশ্রয়ণের অধিকার শেখ হাসিনার উপহার’।
প্রধানমন্ত্রীর নাম যুক্ত এই মহাপরিকল্পনায় বড় রকমের কেলেঙ্কারি যুক্ত হয়েছে। মাত্র আড়াই ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকায় নির্মিত সেমিপাকা ঘরের বহু স্থান ধসে পড়েছে। যে গৃহহীনদের ঘর দেওয়া হয়েছিল, তাদের কেউ কেউ ঘরচাপা পড়ে আহত হয়ে হাসপাতালে গেছেন। অনেক জায়গায় বাড়ির দেয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়েছে। টিনের ছাদ দিয়ে বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। অর্থাৎ, বাড়িগুলো তৈরি হতে না হতেই বাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, গৃহনির্মাণ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত একশ্রেণির অফিসার, নির্বাহী কর্মকর্তা, ঠিকাদার দুই হাতে টাকা চুরি করেছেন। জানা গেছে, এরা আবার সবাই আওয়ামী লীগদলীয়। সুতরাং দলীয় তদন্তে এদের চুরি ধরাও পড়বে না। দুষ্কৃতকারীরা সাজাও পাবে না। সব কেলেঙ্কারি বর্তাবে প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে। নির্বাচন এলে এটা বিএনপি–জামায়াতের নির্বাচন প্রচারণায় একটা বড় মূলধন হবে। সে জন্যই এই কেলেঙ্কারিটা ধামাচাপা না দিয়ে এবং দোষী আমলারা যাতে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে না পারে, তার কঠোর ব্যবস্থা হওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ভেঙে পড়া ঘরগুলো ত্বরিত মেরামত হচ্ছে। তবু আগের ঘরগুলো নির্মাণের সঙ্গে জড়িত সব ব্যক্তিকে নিরপেক্ষ তদন্তের আওতায় আনা দরকার এবং কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা উচিত। নইলে গৃহহীনদের ভাঙা ঘর মেরামত হবে, কিন্তু সরকারের কলঙ্ক দূর হবে না।
ঢাকা থেকে আমার কিছু বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, প্রধানমন্ত্রীর এই গৃহনির্মাণ প্রকল্পে কেলেঙ্কারি যুক্ত করার পেছনে শুধু দুর্নীতি নয়, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রও ছিল। কিন্তু তদন্তে এই ষড়যন্ত্র বেরিয়ে আসতে দেয়নি আমলারা। ষড়যন্ত্রটা হলো, আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারের একমাত্র মূলধন হলেন শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সংগঠনের দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছে। সরকারকেও নানা অনিয়ম–অব্যবস্থাপনার জন্য অভিযুক্ত করতে পেরেছে, কিন্তু শেখ হাসিনার গায়ে এ পর্যন্ত কোনো কালির আঁচড় লাগাতে পারেনি। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, শেখ হাসিনা যোগ্য শাসক এবং সৎ শাসকও। মানুষ ভোট দেয় শেখ হাসিনাকে, আওয়ামী লীগকে নয়। সুতরাং এখন চক্রান্তকারীদের টার্গেট শেখ হাসিনা। তাঁর চরিত্র হনন করা গেলে বর্তমান সরকারকে হয়তো সহজে উচ্ছেদ করা যাবে। ইতিপূর্বে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাসহ বহুবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। এই হত্যার প্রচেষ্টা//// ব্যর্থ হওয়ায় এবং ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ায় এখন শুরু হয়েছে তার চরিত্র হননের এই চেষ্টা। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যে পরিকল্পনার মনিটরিং করেছেন, সেই পরিকল্পনার দুর্নীতি? তাহলে ব্যাপারটা কী?
এই চক্রান্তকারীদের সঙ্গে একশ্রেণির আমলারও যোগাযোগ আছে বলে আমার বন্ধুরা মনে করেন। আমি কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে যখন বঙ্গবন্ধু আমলের ’৭৪ ও ’৭৫ সালের ঘটনাবলির সাদৃশ্য দেখি, তখন একটু সতর্কতার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে তেমন খাদ্যাভাব ছিল না। বন্যা ও প্লাবনে যেটুকু খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছিল, আমেরিকার সঙ্গে খাদ্যচুক্তি করে বঙ্গবন্ধু সেটুকু খাদ্যাভাব পূরণ করার ব্যবস্থা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। এ সময় শুরু হয় অবিশ্বাস্য ষড়যন্ত্র। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্য লুকিয়ে ফেলে কৃত্রিম খাদ্যাভাব সৃষ্টি করে। আমেরিকা যথাসময়ে চুক্তি মোতাবেক খাদ্য না পাঠিয়ে হাই সিতে খাদ্যবাহী জাহাজগুলো ঘোরাতে থাকে। প্রচণ্ড বন্যা ও প্লাবনে দেশের দুর্গত এলাকায় রিলিফ পাঠানো যাচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধু বন্যাপ্লাবিত এলাকায় হেলিকপ্টারে রিলিফ পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই রিলিফ নদীর পানিতে ভেসে যেতে দেখা গেছে, বন্যার্তদের হাতে পৌঁছায়নি। কোথা থেকে এ সময় একজন ‘ম্যান সেরুমিয়ার’ আবির্ভাব হয়, সেই অদৃশ্য দুষ্কৃতির ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে আমলা চক্র ও ষড়যন্ত্রকারীরা মিলে দেশে এমন এক দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে, যাতে দুই লাখ নর-নারীর অসহায় মৃত্যু হয়।
এখন মার্কিন পত্রপত্রিকায় স্বীকার করা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য এই খাদ্যাভাব ঘটানো ছিল মার্কিন চক্রান্ত।
বর্তমানে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্তর্জাতিক চক্রান্ত আছে বলে মনে হয় না। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের আগের আধিপত্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন নেই। স্নায়ুযুদ্ধও এখন নেই। আছে এশিয়ায় প্রভুত্বের বিস্তার নিয়ে ভারত–চীনের মধ্যে আঞ্চলিক স্নায়ুযুদ্ধ। হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি এই আঞ্চলিক স্নায়ুযুদ্ধের কবল থেকে বাংলাদেশকে অনেকটাই মুক্ত রেখেছে। সৌদি আরব, চীনও বাংলাদেশের মিত্র। ভারতের মোদি সরকার তো বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের পরম মিত্র। একমাত্র পাকিস্তান, তাদের ষড়যন্ত্রের দাঁতও ভোঁতা হয়ে গেছে। পাকিস্তানের জনগণ বাংলাদেশকে এখন বন্ধু মনে করে। তাদের টক শোতে বলা হয়, পাকিস্তানে হাসিনার মতো নেতা দরকার।
বলতে গেলে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের জন্য বড় ধরনের কোনো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হয় না। আমেরিকার সাবেক ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা বর্তমান বাইডেন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নানা কারণে হাসিনা সরকারের খুব নিকট বন্ধু না হলেও শত্রু নয়। বরং মার্কিন নেতারাও এখন মনে করেন, বাংলাদেশে হাসিনার বিকল্প কোনো নেতা নেই। এই মুহূর্তে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরালে শুধু বাংলাদেশেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস হবে না, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে। আফগানিস্তানের মৌলবাদী উগ্রতা বাংলাদেশকে ছেয়ে ফেলবে।
এই সত্যটা মৌলবাদী জামায়াত-হেফাজত এবং আধা মৌলবাদী বিএনপি মানতে রাজি নয়। মানতে রাজি নয়, এই রাজনৈতিক চক্রের সহযোগী দেশের সুশীল সমাজ। এই সুশীল সমাজের নেতা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের এখন কোনো পাত্তা নেই। তাঁর বন্ধু ড. কামাল হোসেন এতকাল লাপাত্তা থাকার পরে সম্প্রতি মুখ খুলে বলেছেন, ‘সরকার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।’ ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশও করোনা নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত সক্ষম হয়নি। তাই বলে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বড় বিরোধীরা বলেননি সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আমাদের সুশীল সমাজের নেতা তাঁর দেশ সম্পর্কে সে কথা বলেছেন। তাঁকে দেশের মানুষ একবারও ভোট দেয়নি।
আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনা সরকারের দৃশ্যমান বিপদ না থাকলেও, দেশে অদৃশ্য ষড়যন্ত্র একটা নয়, একটার পর একটা বাড়ছে। ইংরেজিতে স্যাবোটাজ বা নাশকতা বলে একটা কথা আছে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে এখন এই স্যাবোটাজ বেড়েছে, নইলে একটি-দুটি নয়; শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের এতগুলো ঘর নির্মাণের দুই মাসের মধ্যে সামান্য বৃষ্টির পানিতে এমনভাবে ভেঙে পড়ত না। এর পেছনে বড় ধরনের চুরি-বাটপারি তো আছেই, আবার একশ্রেণির আমলা ও ঠিকাদারের চুরির সঙ্গে শেখ হাসিনার সুনাম নষ্ট করার জন্য রাজনৈতিক স্যাবোটাজ যুক্ত হয়ে থাকলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
এই রাজনৈতিক স্যাবোটাজ চালানোর জন্য লন্ডনে যুবরাজের মতো আরাম-আয়েশে বসবাসরত তারেক রহমান অ্যান্ড কোং একটার পর একটা ঘুঁটি চেলে চলেছেন। কখনো মা খালেদা জিয়াকে রুগ্ণ বানিয়ে, তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার নামে পাঠানোর দাবি তুলে, একটা রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়ে দেশে রাজনৈতিক গোলযোগ পাকানোর চেষ্টা, কখনো জামায়াতি–হেফাজতি এজেন্ট দ্বারা ভাস্কর্য নির্মাণ ইসলামবিরোধী—এ কথা প্রচার করে জাতির পিতার ভাস্কর্যের অবমাননা ইত্যাদি নাশকতামূলক কাজে বিরতি নেই। তারা প্রধানমন্ত্রীর নামে আশ্রয়ণের যে পরিকল্পনা, তাতে অসাধু আমলা এবং ঠিকাদার, যে ঠিকাদারেরা আবার আওয়ামী দলীয়, তাদের সাহায্যে এই ভয়ানক নাশকতামূলক কাজটি করে থাকলে বিস্ময়ের কিছু নেই।
সরকার সময় থাকতে সতর্ক হোক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ’৭৪ ও ’৭৫–এর আলামত দেখা দিয়েছে কি না, তা সতর্কভাবে বিবেচনা করে দেখুক। আশ্রয়ণ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত দোষী আমলা ও ঠিকাদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিক। তারা ঘরের লোক হলেও যেন শাস্তি এড়াতে না পারে। তদুপরি, এই দুর্নীতির সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক স্যাবোটাজ যুক্ত কি না, তা সতর্কতার সঙ্গে বিচার করে ছাই থেকে আগুন জ্বলে ওঠার আগেই তা নিভিয়ে ফেলার ব্যবস্থা নিক।
লেখক: বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
৬ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
৬ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
৬ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে