বিভুরঞ্জন সরকার
এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনার কারণে দেশে কার্যত কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে হেফাজতে ইসলাম নানা কারণে আলোচনায় থাকলেও অন্য কোনো দলের কোনো খবর নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকের ‘মাথাব্যথার কারণ’ যে জামায়াতে ইসলাম, তারও ‘বেখবর’ অবস্থা চলছে। তাহলে জামায়াত কি রাজনীতির মাঠ থেকে ‘নিশ্চিহ্ন’ হয়ে গেল, নাকি তলে তলে তলা গোছানোর কাজ করে চলেছে?
করোনা শুরুর আগে ঢাকার বাইরে একটি উপজেলা সদরে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় স্থানীয় প্রেসক্লাবে হলো এক জমজমাট আড্ডা। নানা বিষয়ে কথা। দেশের কথা। মানুষের কথা। রাজনীতির কথা। উন্নয়নের কথা। দুর্নীতির কথা। সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কথা। যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই স্থানীয়ভাবে বিশিষ্টজন। তারা বলতে চান কম, শুনতে চান বেশি। আমিও শুনতে চাই বেশি, বলতে চাই কম। একটি বিষয় লক্ষ করলাম, উপস্থিত প্রায় সবারই আগ্রহ ‘ভেতরের খবর’ জানার। তাদের ধারণা, আমি যেহেতু ঢাকায় থাকি, দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে আছি, সেহেতু সব ‘হাঁড়ির খবর’ আমার জানা। শেখ হাসিনার সরকার আর কয় মেয়াদে থাকবে, বিএনপির ভবিষ্যৎ কী, দেশে একটি কার্যকর বিরোধী দল গড়ে উঠবে কি না, নির্বাচনব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে কি না ইত্যাদি বিষয়ে জানার আগ্রহ সবার। কিন্তু কারও কৌতূহলই আমি মেটাতে পারি না। আমার কাছে এমন কোনো গোপন তথ্য নেই, যা অন্য কারও জানা নেই।
এক পর্যায়ে আমি জানতে চাই, ওই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা এবং অবস্থান কেমন। প্রায় সবাই একবাক্যে বললেন, এখন জামায়াতে ইসলামী সব থেকে ভালো অবস্থায় আছে। প্রকাশ্যে তারা নীরব; কিন্তু ভেতরে ভেতরে তলা গোছানোর কাজ তারা করছে অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে। জামায়াতের নারী কর্মীরা খুবই তৎপর। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা জামায়াতের রাজনীতি প্রচার করছে।
জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতিও করার কথা নয়। এই দলটি বাংলাদেশ চায়নি। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বাঙালির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। এরা ঘাতক, এরা দালাল। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর এরাও গর্তে লুকিয়েছিল। ছিল সময় ও সুযোগের অপেক্ষায়। তারা সুযোগ পায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করলে জামায়াত নেতা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগমুহূর্তে পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তানে থেকেও তিনি বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন জিয়া। জামায়াতকে তিনি রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। আওয়ামী লীগকে জব্দ করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই জিয়া গোলাম আযম-জামায়াত নিয়ে কৌশলের রাজনীতি করেছিলেন। কিন্তু তার কৌশল ফাল হয়ে উঠেছে দেশের জন্য, রাজনীতির জন্য। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, একাত্তরের এই ঘাতক-দালালরা এখন অনেক শক্তিশালী। তারা দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল। তারা রাজনীতিতে আছে। তাদের নিয়ে রাজনীতিও আছে। বাহ্যত জামায়াত সরকারি চাপের মুখে আছে। তাদের শীর্ষনেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। কয়েকজন কারাগারে আছেন। যারা বাইরে আছেন, তাঁরাও প্রেপ্তার আতঙ্কেই আছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এত কিছুর পরও জামায়াত আছে। জামায়াত আছে; কারণ, তাদের পেছনে বিএনপি আছে। বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় যেহেতু জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পেরেছে, সেহেতু তারা পরস্পরকে ভাই মনে করে। এক ভাইয়ের বিপদে আরেক ভাই বুক পেতে দেয়, পিঠ দেখায় না। রাজনৈতিক মহলের সমালোচনা, দেশের বাইরের বিভিন্ন মহলের চাপ—কোনো কিছুই বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে না।
মাঝে মাঝে আমাদের গণমাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে খবর বের হয়। কয়েক দিন নানা রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তারপর সব ঠিক। বিএনপি-জামায়াত কেউ কাউকে ছাড়ে না, ছাড়ার কথা ভাবে না; বরং বাইরের সমালোচনা তাদের আরও কাছে আনে, কাছে টানে। ভাইয়ে ভাইয়ে শরিকানা বিরোধের মতো কিছু বিরোধ তাদের হয়তো হয়; কিন্তু সেটা নিষ্পত্তি হয় নীরবে, সবার চোখের আড়ালে। আমার ধারণা, এই বিরোধের খবর জামায়াতের পক্ষ থেকেই গণমাধ্যমে দেওয়া হয়। মানুষকে, বিশেষ করে যারা জামায়াতবিরোধী, তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য এটা করা হয়। এ রকম খবর প্রচার হলে তাদের দিকে মনোযোগ কম থাকবে। তারা ঘর গোছানোয় অধিক তৎপর হতে পারবে। সব সময় প্রচারণায় থাকাও জামায়াতের একটি লক্ষ্য। নেগেটিভ-পজিটিভ যাই হোক না কেন, জামায়াত আলোচনায় থাকতে চায়। এতে জামায়াতের ব্যাপারে মানুষের কৌতূহল বাড়ে। রাজনৈতিক কৌশলে জামায়াত অনেক এগিয়ে, অন্তত বিএনপির তুলনায় তো বটেই। তাই বিএনপিকে জামায়াতীকরণ করার কাজ তারা এগিয়ে নিতে পেরেছে।
মাস কয়েক আগে খবর বের হয়েছে যে, জামায়াত আর বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। ২০-দলীয় জোটেও তারা সক্রিয় থাকবে না। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জামায়াত বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোট করেছে। ভোটে ভরাডুবির পর তাদের উপলব্ধি হয়েছে যে, ‘ওই জোট এখন প্রাসঙ্গিক নয়’। জামায়াত মনে করছে, ‘বিএনপি যেহেতু আরেকটা ফ্রন্টে এখন সক্রিয়, সেদিক থেকে ২০-দলীয় জোটকে অনেকটাই অকার্যকর দেখছে। এ রকম একটা অকার্যকর জোটে থাকা না-থাকার ব্যাপারে আগ্রহ নেই জামায়াতের। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, এটা জামায়াতের নীতিগত অবস্থান নয়, কৌশলগত। সমালোচকদের চোখে ধুলা দেওয়ার কৌশল নিয়েছে জামায়াত এবং বিএনপি। দুই দলই কিছু দিন সম্পর্কের সুতা আলগা করে পরিস্থিতি দেখতে চায়। তাদের মধ্যে একটি গোপন সমঝোতা হওয়াটাই স্বাভাবিক। সরকারকে কিছুটা বিভ্রান্ত করতে চায় এই দুই দল। এটা ঠিক যে, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই সরকার চায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিচ্ছেদ। সরকার বিএনপি এবং জামায়াত—দুই দলকেই শত্রু মনে করে।
দুই দলের সম্মিলিত শক্তি যতটা বিপজ্জনক, আলাদা হলে ততটা নয়। সরকার দুই শত্রুকেই দুর্বল করতে চায়। তবে সরকার জামায়াতের চেয়ে বিএনপিকেই আশু বড় বিপদ বলে মনে করে। এখন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী যতটা বিএনপি, ততটা জামায়াত নয়। তাই বিএনপিকে যতটা চাপে রাখতে চায়, জামায়াতকে হয়তো ততটা নয়। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল সরকারকে এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সুযোগ করে দিয়েছে। ভোটে জামায়াত জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। একটি আসনেও তারা জয় পায়নি। জামায়াতের জনসমর্থন নিয়ে যে মিথ তৈরি করা হচ্ছিল, সরকার তা সফলভাবে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জনপ্রিয় দাবিটি সরকার সম্ভবত রাজনৈতিক শক্তি-ভারসাম্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই আমলে নেয়নি। গত নির্বাচনে এদের ধরাশায়ী করার পর সরকার হয়তো জামায়াতকে আর ছাড় দেবে না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার একটি মামলা আদালতে আছে। মামলাটি এবার সচল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জামায়াতও সেটা বুঝতে পারছে। জামায়াত বুঝতে পারছে যে, এবার তারা রেহাই পাবে না। আইনি প্রক্রিয়ায় তারা নিষিদ্ধ হলে কোন কৌশলে এগোবে, সেটাই এখন তাদের ভাবনার বিষয়। সরকারের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়ার আশায় তারা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা বা দূরত্ব তৈরির গল্প বানাচ্ছে। জামায়াতের চিরকালের কৌশলই এটা যে, তারা বিপদ দেখলে শামুকের মতো গুটিয়ে যায়, আবার সুযোগ বুঝে ফণা তোলে। তবে জামায়াতকে এটা মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতিতে একই কৌশল বারবার ভালো ফল দেয় না।
নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কোন কৌশলে অগ্রসর হবে, তা নিয়ে দলটির ভেতরে আলোচনা, বিতর্ক শুরু হয়েছে। এক পক্ষ ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিয়ে সামাজিক সংগঠন হিসেবে বেশি করে সক্রিয় হওয়ার দিকে, অন্য পক্ষ নাম পাল্টিয়ে নতুনভাবে রাজনীতির মাঠে নামাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করছে। অন্য দলের ভেতরে ঢুকে কাজ করার চিন্তাও আছে। এখনো বিভিন্ন দলে জামায়াতের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আছে। জামায়াত যদি নতুন নামে পুনর্গঠিত হওয়ার কথা ভাবে, তাহলে হয়তো জামায়াতের একটি বড় অংশ বিএনপিতে বিলীন হবে। কারণ, বিএনপি হলো জামায়াতের স্বাভাবিক মিত্র। তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসও কাছাকাছি। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ প্রশ্নে দুই দলের অবস্থানে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও এখন তা কমে এসেছে। জামায়াত যদি বিএনপিতে লীন হতে চায়, তাহলে বিএনপি অখুশি হবে বলে মনে হয় না; বরং বিএনপি হয়তো তেমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে। অবশ্য জামায়াতের কারও কারও টার্গেট আওয়ামী লীগের দিকে থাকবে না, তা-ও বলা যায় না। দলে জামায়াতকে ঢোকানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের উদারতাও দেখা গেছে।
তবে এগুলো অনুমাননির্ভর আলোচনা। জামায়াত সত্যি নিষিদ্ধ হবে কি না, নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কী কৌশল নেবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যাই হোক না কেন, জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি এবং জামায়াতের রাজনীতি সহজে শেষ হচ্ছে না। জামায়াত মাঠ ছাড়বে না। তাদের আর্থিক বনিয়াদ যত দিন দুর্বল না হবে, তত দিন তাদের কৌশলের খেলা অব্যাহত থাকবে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক আজকের পত্রিকা
এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনার কারণে দেশে কার্যত কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে হেফাজতে ইসলাম নানা কারণে আলোচনায় থাকলেও অন্য কোনো দলের কোনো খবর নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকের ‘মাথাব্যথার কারণ’ যে জামায়াতে ইসলাম, তারও ‘বেখবর’ অবস্থা চলছে। তাহলে জামায়াত কি রাজনীতির মাঠ থেকে ‘নিশ্চিহ্ন’ হয়ে গেল, নাকি তলে তলে তলা গোছানোর কাজ করে চলেছে?
করোনা শুরুর আগে ঢাকার বাইরে একটি উপজেলা সদরে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় স্থানীয় প্রেসক্লাবে হলো এক জমজমাট আড্ডা। নানা বিষয়ে কথা। দেশের কথা। মানুষের কথা। রাজনীতির কথা। উন্নয়নের কথা। দুর্নীতির কথা। সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কথা। যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই স্থানীয়ভাবে বিশিষ্টজন। তারা বলতে চান কম, শুনতে চান বেশি। আমিও শুনতে চাই বেশি, বলতে চাই কম। একটি বিষয় লক্ষ করলাম, উপস্থিত প্রায় সবারই আগ্রহ ‘ভেতরের খবর’ জানার। তাদের ধারণা, আমি যেহেতু ঢাকায় থাকি, দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে আছি, সেহেতু সব ‘হাঁড়ির খবর’ আমার জানা। শেখ হাসিনার সরকার আর কয় মেয়াদে থাকবে, বিএনপির ভবিষ্যৎ কী, দেশে একটি কার্যকর বিরোধী দল গড়ে উঠবে কি না, নির্বাচনব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে কি না ইত্যাদি বিষয়ে জানার আগ্রহ সবার। কিন্তু কারও কৌতূহলই আমি মেটাতে পারি না। আমার কাছে এমন কোনো গোপন তথ্য নেই, যা অন্য কারও জানা নেই।
এক পর্যায়ে আমি জানতে চাই, ওই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা এবং অবস্থান কেমন। প্রায় সবাই একবাক্যে বললেন, এখন জামায়াতে ইসলামী সব থেকে ভালো অবস্থায় আছে। প্রকাশ্যে তারা নীরব; কিন্তু ভেতরে ভেতরে তলা গোছানোর কাজ তারা করছে অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে। জামায়াতের নারী কর্মীরা খুবই তৎপর। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা জামায়াতের রাজনীতি প্রচার করছে।
জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতিও করার কথা নয়। এই দলটি বাংলাদেশ চায়নি। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বাঙালির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। এরা ঘাতক, এরা দালাল। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর এরাও গর্তে লুকিয়েছিল। ছিল সময় ও সুযোগের অপেক্ষায়। তারা সুযোগ পায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করলে জামায়াত নেতা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগমুহূর্তে পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তানে থেকেও তিনি বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন জিয়া। জামায়াতকে তিনি রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। আওয়ামী লীগকে জব্দ করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই জিয়া গোলাম আযম-জামায়াত নিয়ে কৌশলের রাজনীতি করেছিলেন। কিন্তু তার কৌশল ফাল হয়ে উঠেছে দেশের জন্য, রাজনীতির জন্য। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, একাত্তরের এই ঘাতক-দালালরা এখন অনেক শক্তিশালী। তারা দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল। তারা রাজনীতিতে আছে। তাদের নিয়ে রাজনীতিও আছে। বাহ্যত জামায়াত সরকারি চাপের মুখে আছে। তাদের শীর্ষনেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। কয়েকজন কারাগারে আছেন। যারা বাইরে আছেন, তাঁরাও প্রেপ্তার আতঙ্কেই আছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এত কিছুর পরও জামায়াত আছে। জামায়াত আছে; কারণ, তাদের পেছনে বিএনপি আছে। বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় যেহেতু জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পেরেছে, সেহেতু তারা পরস্পরকে ভাই মনে করে। এক ভাইয়ের বিপদে আরেক ভাই বুক পেতে দেয়, পিঠ দেখায় না। রাজনৈতিক মহলের সমালোচনা, দেশের বাইরের বিভিন্ন মহলের চাপ—কোনো কিছুই বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে না।
মাঝে মাঝে আমাদের গণমাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে খবর বের হয়। কয়েক দিন নানা রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তারপর সব ঠিক। বিএনপি-জামায়াত কেউ কাউকে ছাড়ে না, ছাড়ার কথা ভাবে না; বরং বাইরের সমালোচনা তাদের আরও কাছে আনে, কাছে টানে। ভাইয়ে ভাইয়ে শরিকানা বিরোধের মতো কিছু বিরোধ তাদের হয়তো হয়; কিন্তু সেটা নিষ্পত্তি হয় নীরবে, সবার চোখের আড়ালে। আমার ধারণা, এই বিরোধের খবর জামায়াতের পক্ষ থেকেই গণমাধ্যমে দেওয়া হয়। মানুষকে, বিশেষ করে যারা জামায়াতবিরোধী, তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য এটা করা হয়। এ রকম খবর প্রচার হলে তাদের দিকে মনোযোগ কম থাকবে। তারা ঘর গোছানোয় অধিক তৎপর হতে পারবে। সব সময় প্রচারণায় থাকাও জামায়াতের একটি লক্ষ্য। নেগেটিভ-পজিটিভ যাই হোক না কেন, জামায়াত আলোচনায় থাকতে চায়। এতে জামায়াতের ব্যাপারে মানুষের কৌতূহল বাড়ে। রাজনৈতিক কৌশলে জামায়াত অনেক এগিয়ে, অন্তত বিএনপির তুলনায় তো বটেই। তাই বিএনপিকে জামায়াতীকরণ করার কাজ তারা এগিয়ে নিতে পেরেছে।
মাস কয়েক আগে খবর বের হয়েছে যে, জামায়াত আর বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। ২০-দলীয় জোটেও তারা সক্রিয় থাকবে না। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জামায়াত বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোট করেছে। ভোটে ভরাডুবির পর তাদের উপলব্ধি হয়েছে যে, ‘ওই জোট এখন প্রাসঙ্গিক নয়’। জামায়াত মনে করছে, ‘বিএনপি যেহেতু আরেকটা ফ্রন্টে এখন সক্রিয়, সেদিক থেকে ২০-দলীয় জোটকে অনেকটাই অকার্যকর দেখছে। এ রকম একটা অকার্যকর জোটে থাকা না-থাকার ব্যাপারে আগ্রহ নেই জামায়াতের। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, এটা জামায়াতের নীতিগত অবস্থান নয়, কৌশলগত। সমালোচকদের চোখে ধুলা দেওয়ার কৌশল নিয়েছে জামায়াত এবং বিএনপি। দুই দলই কিছু দিন সম্পর্কের সুতা আলগা করে পরিস্থিতি দেখতে চায়। তাদের মধ্যে একটি গোপন সমঝোতা হওয়াটাই স্বাভাবিক। সরকারকে কিছুটা বিভ্রান্ত করতে চায় এই দুই দল। এটা ঠিক যে, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই সরকার চায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিচ্ছেদ। সরকার বিএনপি এবং জামায়াত—দুই দলকেই শত্রু মনে করে।
দুই দলের সম্মিলিত শক্তি যতটা বিপজ্জনক, আলাদা হলে ততটা নয়। সরকার দুই শত্রুকেই দুর্বল করতে চায়। তবে সরকার জামায়াতের চেয়ে বিএনপিকেই আশু বড় বিপদ বলে মনে করে। এখন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী যতটা বিএনপি, ততটা জামায়াত নয়। তাই বিএনপিকে যতটা চাপে রাখতে চায়, জামায়াতকে হয়তো ততটা নয়। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল সরকারকে এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সুযোগ করে দিয়েছে। ভোটে জামায়াত জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। একটি আসনেও তারা জয় পায়নি। জামায়াতের জনসমর্থন নিয়ে যে মিথ তৈরি করা হচ্ছিল, সরকার তা সফলভাবে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জনপ্রিয় দাবিটি সরকার সম্ভবত রাজনৈতিক শক্তি-ভারসাম্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই আমলে নেয়নি। গত নির্বাচনে এদের ধরাশায়ী করার পর সরকার হয়তো জামায়াতকে আর ছাড় দেবে না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার একটি মামলা আদালতে আছে। মামলাটি এবার সচল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জামায়াতও সেটা বুঝতে পারছে। জামায়াত বুঝতে পারছে যে, এবার তারা রেহাই পাবে না। আইনি প্রক্রিয়ায় তারা নিষিদ্ধ হলে কোন কৌশলে এগোবে, সেটাই এখন তাদের ভাবনার বিষয়। সরকারের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়ার আশায় তারা বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা বা দূরত্ব তৈরির গল্প বানাচ্ছে। জামায়াতের চিরকালের কৌশলই এটা যে, তারা বিপদ দেখলে শামুকের মতো গুটিয়ে যায়, আবার সুযোগ বুঝে ফণা তোলে। তবে জামায়াতকে এটা মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতিতে একই কৌশল বারবার ভালো ফল দেয় না।
নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কোন কৌশলে অগ্রসর হবে, তা নিয়ে দলটির ভেতরে আলোচনা, বিতর্ক শুরু হয়েছে। এক পক্ষ ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিয়ে সামাজিক সংগঠন হিসেবে বেশি করে সক্রিয় হওয়ার দিকে, অন্য পক্ষ নাম পাল্টিয়ে নতুনভাবে রাজনীতির মাঠে নামাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করছে। অন্য দলের ভেতরে ঢুকে কাজ করার চিন্তাও আছে। এখনো বিভিন্ন দলে জামায়াতের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আছে। জামায়াত যদি নতুন নামে পুনর্গঠিত হওয়ার কথা ভাবে, তাহলে হয়তো জামায়াতের একটি বড় অংশ বিএনপিতে বিলীন হবে। কারণ, বিএনপি হলো জামায়াতের স্বাভাবিক মিত্র। তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসও কাছাকাছি। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ প্রশ্নে দুই দলের অবস্থানে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও এখন তা কমে এসেছে। জামায়াত যদি বিএনপিতে লীন হতে চায়, তাহলে বিএনপি অখুশি হবে বলে মনে হয় না; বরং বিএনপি হয়তো তেমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে। অবশ্য জামায়াতের কারও কারও টার্গেট আওয়ামী লীগের দিকে থাকবে না, তা-ও বলা যায় না। দলে জামায়াতকে ঢোকানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের উদারতাও দেখা গেছে।
তবে এগুলো অনুমাননির্ভর আলোচনা। জামায়াত সত্যি নিষিদ্ধ হবে কি না, নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কী কৌশল নেবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যাই হোক না কেন, জামায়াতকে নিয়ে রাজনীতি এবং জামায়াতের রাজনীতি সহজে শেষ হচ্ছে না। জামায়াত মাঠ ছাড়বে না। তাদের আর্থিক বনিয়াদ যত দিন দুর্বল না হবে, তত দিন তাদের কৌশলের খেলা অব্যাহত থাকবে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক আজকের পত্রিকা
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১৬ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১৬ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১৬ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ দিন আগে