অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন
গত তিন দশকে দুর্যোগের মাত্রা ও পরিমাণ বেড়েছে। এতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী দুর্যোগজনিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫২০ কোটি মার্কিন ডলার। দুর্যোগের কারণে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়। আশির দশক থেকে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগকে উন্নত বিশ্বের ‘উন্নয়ন মডেল’-এ আপদের ঝুঁকি সৃষ্টির অনুষঙ্গ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি দুর্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে নব্বইয়ের দশক থেকে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে।
দুর্যোগাক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। বিশেষত, ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য দেশটির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। দুর্যোগের কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেটে নির্ধারিত বরাদ্দের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয় সরকারকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে নির্বাচনী প্রচার স্থগিত করে এই ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত এলাকার জন্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে উদ্বোধন করেছিলেন ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি/সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম), যা বিশ্বব্যাপী আজ সফল কর্মসূচি। দুর্যোগে মানুষ, পশু ও গবাদি সম্পদ রক্ষার জন্য উঁচু স্থান নির্মাণ করেছিলেন, যাকে জনগণ ভালোবেসে নাম দিয়েছিল ‘মুজিব কিল্লা’। আক্ষেপের বিষয়, সদ্য স্বাধীন দেশে গৃহীত এসব পদক্ষেপ পরবর্তী সময়ে অব্যাহত ছিল না। যার ফলে ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের উপর্যুপরি ভয়াবহ বন্যা এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে মানুষ, সম্পদ, অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে সময়ে বাংলাদেশের সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অভাব বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রবর্তিত স্থায়ী আদেশাবলি (এসওডি) ২০১০ ও ২০১৯ সালে চাহিদা অনুযায়ী হালনাগাদ করা হয়। রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ‘রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্বনেতারা। দুর্যোগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বসবাসের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ এ দেশের মানুষের লৌকিক জ্ঞান এবং গত এক দশকের কিছুটা বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপ এই স্বীকৃতির মূলে কাজ করেছে। দুর্যোগকে নিয়ন্ত্রণ করা নয়; বরং ‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে’ বাংলাদেশের ‘আদিকল্প’ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনগুলো এসেছে। আজকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তাই শুধু ত্রাণনির্ভর নয়; বরং সমন্বিত একটি প্রয়াস। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দুর্যোগের প্রস্তুতিকে সুদৃঢ় করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানো বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম লক্ষ্য।
২০১১ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালায় প্রথমবারের মতো ‘দুর্যোগে নারী ও শিশু’ শীর্ষক একটি অধ্যায় সংযুক্ত হয়েছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং ঝুঁকি হ্রাস আলোচনায় নারী-পুরুষের অভিযোজন কৌশলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগের প্রভাব সব মানুষের ওপর সমানভাবে পড়ে না। তাই দুর্যোগসংক্রান্ত নীতিমালা, আইন ও পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। লিঙ্গ, বয়স, শ্রেণি, নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনাগুলো বিশেষজ্ঞ মতামত অনুযায়ী বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
অগ্রসরমাণ অর্থনীতির চাকা এগিয়ে নেওয়ার জন্য দুর্যোগ সহনশীল গৃহ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বলয় বৃদ্ধি, ‘মুজিব কিল্লা’ পুনর্নির্মাণ ও ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। সবজি ও গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান উচ্চস্থানে ও মৎস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্বের ১০টি সবুজবান্ধব কারখানার (গ্রিন অ্যাপারেল ফ্যাক্টরি) মধ্যে ৩টি বাংলাদেশে।
২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে রেজিলিয়েন্ট বা সহনশীল শিল্পায়ন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও প্রসারের সঙ্গেও রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উল্লেখযোগ্য উত্তরণ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল গঠন ও বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোয় বাংলাদেশের রয়েছে সরব উপস্থিতি ও অবদান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘প্লানেট ৫০: ৫০’, ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ জলবায়ু অভিযোজন প্ল্যাটফর্মে এবং আন্তসরকারের জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেলে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জীববৈচিত্র্য, বিশেষত, সুন্দরবন রক্ষায় গত ১০ বছরে নেওয়া গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। আমরা জানি, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও কার্বন নিঃসরণের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলো দায়ী। তাই এদের গৃহীত পদক্ষেপের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব রোধ বহুলাংশে নির্ভরশীল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার হয়তো এ বিষয়ে কিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জলবায়ু পরিবর্তন–সম্পর্কিত বিশ্বনেতাদের সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যা গুরুত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে নানাবিধ আইনি কাঠামো ও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জলাবদ্ধতা, দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অভিযোজন কৌশলকে টেকসই করার জন্য সুনির্দিষ্ট ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ প্রয়োজন।
উন্নয়নশীল বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নির্ভর করছে গত এক দশকে তিল তিল করে গড়ে ওঠা অর্জনকে ধরে রাখার ওপর। দুর্যোগ প্রতিনিয়তই এই অর্জনকে ব্যাহত করে। সবশেষে বলা যায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কথা। ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে তেমনটি আঘাত করেনি; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত করেছে উপকূলীয় বাঁধগুলো। সেখানকার বাঁধগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্মাণ না করায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা পিছু ছাড়ছে না।
ত্রুটিপূর্ণ বাঁধের বিষয়ে নেওয়া প্রকল্পগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে। যেমন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি, আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণসহ বিভিন্ন ঝুঁকি নিরসনমূলক কাজ করে থাকে। আর বাঁধের দায়িত্ব পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছে অবকাঠামোগত, বিশেষত রাস্তাঘাট নির্মাণের বিষয়টি। তিনটি মন্ত্রণালয় সম্মিলিতভাবে কাজ করার ওপর দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস অনেকাংশেই নির্ভরশীল। উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে দুর্যোগজনিত ঝুঁকি কমানো ও ক্ষতি হ্রাসে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নতিও কোভিড-১৯ মোকাবিলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোভিড মহামারির প্রভাব বিভিন্ন পেশাজীবীর ওপর সমানুপাতিক হারে পড়ছে না। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক বা ইনফরমাল খাত। এখানে কর্মহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ৯২ শতাংশই নারী। রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে যাঁরা কাজ করছেন, তার শতকরা ৮০ ভাগ নারী। শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত। হতাশা, মানসিক অসুস্থতা, শারীরিক অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বয়স ও লিঙ্গভেদে সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহের হার বেড়ে যাওয়া। দুর্যোগাক্রান্ত এলাকায় যা সবচেয়ে বেশি।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, নারী কিংবা পুরুষ তাঁদের কর্মসংস্থান বা উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রণোদনা প্রাপ্তির সুযোগ প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে তোলার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্যোগাক্রান্ত এলাকায় শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে এই তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হবে। করোনা অর্থনীতির ওপর যে আঘাত হেনেছে, তা মোকাবিলায় সর্বস্তরের পরামর্শ পর্যালোচনাপূর্বক একটি খাতওয়ারি রোডম্যাপ থাকা প্রয়োজন, যা পঞ্চবার্ষিক ও ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে বাংলাদেশের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা (প্রযুক্তিনির্ভর), খাদ্য, পানি, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জলাবদ্ধতা দূর করা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ, দুর্যোগ উন্নয়নকে ব্যাহত করে।
লেখক: অধ্যাপক ও পরিচালক ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ
গত তিন দশকে দুর্যোগের মাত্রা ও পরিমাণ বেড়েছে। এতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী দুর্যোগজনিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫২০ কোটি মার্কিন ডলার। দুর্যোগের কারণে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়। আশির দশক থেকে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগকে উন্নত বিশ্বের ‘উন্নয়ন মডেল’-এ আপদের ঝুঁকি সৃষ্টির অনুষঙ্গ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি দুর্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে নব্বইয়ের দশক থেকে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে।
দুর্যোগাক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। বিশেষত, ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য দেশটির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। দুর্যোগের কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেটে নির্ধারিত বরাদ্দের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয় সরকারকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে নির্বাচনী প্রচার স্থগিত করে এই ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত এলাকার জন্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে উদ্বোধন করেছিলেন ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি/সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম), যা বিশ্বব্যাপী আজ সফল কর্মসূচি। দুর্যোগে মানুষ, পশু ও গবাদি সম্পদ রক্ষার জন্য উঁচু স্থান নির্মাণ করেছিলেন, যাকে জনগণ ভালোবেসে নাম দিয়েছিল ‘মুজিব কিল্লা’। আক্ষেপের বিষয়, সদ্য স্বাধীন দেশে গৃহীত এসব পদক্ষেপ পরবর্তী সময়ে অব্যাহত ছিল না। যার ফলে ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের উপর্যুপরি ভয়াবহ বন্যা এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে মানুষ, সম্পদ, অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে সময়ে বাংলাদেশের সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অভাব বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রবর্তিত স্থায়ী আদেশাবলি (এসওডি) ২০১০ ও ২০১৯ সালে চাহিদা অনুযায়ী হালনাগাদ করা হয়। রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ‘রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্বনেতারা। দুর্যোগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বসবাসের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ এ দেশের মানুষের লৌকিক জ্ঞান এবং গত এক দশকের কিছুটা বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপ এই স্বীকৃতির মূলে কাজ করেছে। দুর্যোগকে নিয়ন্ত্রণ করা নয়; বরং ‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে’ বাংলাদেশের ‘আদিকল্প’ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনগুলো এসেছে। আজকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তাই শুধু ত্রাণনির্ভর নয়; বরং সমন্বিত একটি প্রয়াস। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দুর্যোগের প্রস্তুতিকে সুদৃঢ় করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানো বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম লক্ষ্য।
২০১১ সালে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালায় প্রথমবারের মতো ‘দুর্যোগে নারী ও শিশু’ শীর্ষক একটি অধ্যায় সংযুক্ত হয়েছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং ঝুঁকি হ্রাস আলোচনায় নারী-পুরুষের অভিযোজন কৌশলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগের প্রভাব সব মানুষের ওপর সমানভাবে পড়ে না। তাই দুর্যোগসংক্রান্ত নীতিমালা, আইন ও পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। লিঙ্গ, বয়স, শ্রেণি, নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনাগুলো বিশেষজ্ঞ মতামত অনুযায়ী বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
অগ্রসরমাণ অর্থনীতির চাকা এগিয়ে নেওয়ার জন্য দুর্যোগ সহনশীল গৃহ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বলয় বৃদ্ধি, ‘মুজিব কিল্লা’ পুনর্নির্মাণ ও ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। সবজি ও গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান উচ্চস্থানে ও মৎস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্বের ১০টি সবুজবান্ধব কারখানার (গ্রিন অ্যাপারেল ফ্যাক্টরি) মধ্যে ৩টি বাংলাদেশে।
২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে রেজিলিয়েন্ট বা সহনশীল শিল্পায়ন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও প্রসারের সঙ্গেও রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উল্লেখযোগ্য উত্তরণ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল গঠন ও বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোয় বাংলাদেশের রয়েছে সরব উপস্থিতি ও অবদান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘প্লানেট ৫০: ৫০’, ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’সহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ জলবায়ু অভিযোজন প্ল্যাটফর্মে এবং আন্তসরকারের জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেলে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জীববৈচিত্র্য, বিশেষত, সুন্দরবন রক্ষায় গত ১০ বছরে নেওয়া গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। আমরা জানি, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও কার্বন নিঃসরণের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলো দায়ী। তাই এদের গৃহীত পদক্ষেপের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব রোধ বহুলাংশে নির্ভরশীল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার হয়তো এ বিষয়ে কিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জলবায়ু পরিবর্তন–সম্পর্কিত বিশ্বনেতাদের সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যা গুরুত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে নানাবিধ আইনি কাঠামো ও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জলাবদ্ধতা, দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অভিযোজন কৌশলকে টেকসই করার জন্য সুনির্দিষ্ট ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ প্রয়োজন।
উন্নয়নশীল বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নির্ভর করছে গত এক দশকে তিল তিল করে গড়ে ওঠা অর্জনকে ধরে রাখার ওপর। দুর্যোগ প্রতিনিয়তই এই অর্জনকে ব্যাহত করে। সবশেষে বলা যায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কথা। ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে তেমনটি আঘাত করেনি; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত করেছে উপকূলীয় বাঁধগুলো। সেখানকার বাঁধগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্মাণ না করায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা পিছু ছাড়ছে না।
ত্রুটিপূর্ণ বাঁধের বিষয়ে নেওয়া প্রকল্পগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে। যেমন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি, আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণসহ বিভিন্ন ঝুঁকি নিরসনমূলক কাজ করে থাকে। আর বাঁধের দায়িত্ব পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছে অবকাঠামোগত, বিশেষত রাস্তাঘাট নির্মাণের বিষয়টি। তিনটি মন্ত্রণালয় সম্মিলিতভাবে কাজ করার ওপর দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস অনেকাংশেই নির্ভরশীল। উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে দুর্যোগজনিত ঝুঁকি কমানো ও ক্ষতি হ্রাসে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নতিও কোভিড-১৯ মোকাবিলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোভিড মহামারির প্রভাব বিভিন্ন পেশাজীবীর ওপর সমানুপাতিক হারে পড়ছে না। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক বা ইনফরমাল খাত। এখানে কর্মহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ৯২ শতাংশই নারী। রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে যাঁরা কাজ করছেন, তার শতকরা ৮০ ভাগ নারী। শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত। হতাশা, মানসিক অসুস্থতা, শারীরিক অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বয়স ও লিঙ্গভেদে সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহের হার বেড়ে যাওয়া। দুর্যোগাক্রান্ত এলাকায় যা সবচেয়ে বেশি।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, নারী কিংবা পুরুষ তাঁদের কর্মসংস্থান বা উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রণোদনা প্রাপ্তির সুযোগ প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে তোলার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্যোগাক্রান্ত এলাকায় শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে এই তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হবে। করোনা অর্থনীতির ওপর যে আঘাত হেনেছে, তা মোকাবিলায় সর্বস্তরের পরামর্শ পর্যালোচনাপূর্বক একটি খাতওয়ারি রোডম্যাপ থাকা প্রয়োজন, যা পঞ্চবার্ষিক ও ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে বাংলাদেশের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা (প্রযুক্তিনির্ভর), খাদ্য, পানি, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জলাবদ্ধতা দূর করা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ, দুর্যোগ উন্নয়নকে ব্যাহত করে।
লেখক: অধ্যাপক ও পরিচালক ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
৮ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
৮ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
৮ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে