শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
ইতিহাস বলে রোহিঙ্গারা আরাকানের ভূমিপুত্র। ১৭৮৫ সালের আগে আরাকান ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম অঞ্চল। ১৮২৬ সালের অ্যাঙ্গো-বার্মিজ যুদ্ধের পরই আরাকান ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত বার্মার অংশ হয়। কিন্তু ১৯৮৫ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে তৎকালীন সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব বাতিল করে। যদিও রোহিঙ্গা সংকটের শুরু তারও আগে।
২০১৬ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের নারকীয় গণহত্যা চালায় বার্মিজ ও রাখাইনরা। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই গণহত্যা শুরু হয়। এর আগে ২০১২ সালে এক রাখাইন নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে এসেছে প্রায় ৬-৭ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের ক্যাম্পে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। এর বাইরেও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নভাবে মিশে গেছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে, যার কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান বাংলাদেশ সরকারের কাছে নেই।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের মতো সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা জাহাজকে ফের ঠেলে দিতে পারেনি বাংলাদেশ। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল মানবিক বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানবিক আচরণ ও আশ্রয় সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু এখন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আশু জরুরি। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটা দেশের পক্ষে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার দীর্ঘ মেয়াদে চাপ সামাল দেওয়া অসম্ভব। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ধীরে ধীরে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ইস্যু হয়ে উঠছে। ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জোর দেওয়া দরকার।
আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো সেই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে আশানুরূপ সহযোগিতা করছে না। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর চলা জাতিগত নিধন নিয়ে সোচ্চার হলেও প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে প্রয়োজনীয় চাপ দিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিবৃতিতে সোচ্চার হলেও তাদের অর্থায়নে পরিচালিত সংগঠন আইএমএফ ঠিকই মিয়ানমারকে অর্থসহায়তা দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ইউরোপের দেশগুলো মিয়ানমারে বিনিয়োগ করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বরং বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর না করতে। এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একচোখা আচরণ।
কক্সবাজার বাংলাদেশের পর্যটন ও ব্যবসায়িকভাবে সম্ভাবনাময় অঞ্চল। দীর্ঘ মেয়াদে ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখানে রাখলে পর্যটন, পরিবেশ ও নিরাপত্তাজনিত হুমকি তৈরি হবে। প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক প্রয়াত তারেক শামসুর রেহমান টক শোতে ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, আমাদের ১টা নয়, ১১টা ভাসানচর দরকার। কেননা, রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে পাহাড় ও গাছ কাটার ফলে কক্সবাজারের পরিবেশ ও জলবায়ু দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। মাদক, নারী পাচার, খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
কক্সবাজার পুলিশ প্রশাসন বলছে, আগস্ট ২০১৭ থেকে মে ২০২০ এর মধ্যে ৫৮ হাজার রোহিঙ্গাকে ক্যাম্প থেকে পালানোর সময় গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া এই সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলছে, নানা অপরাধে আগস্ট ২০১৭ থেকে আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ১৬৬৪ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে ৭২৫টি মামলা হয় কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায়। এ ছাড়া এই সময়ে নারীসহ ১০৩ জন রোহিঙ্গা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, কক্সবাজার অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষাগত ও শারীরিক গঠনে মিল থাকায় ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তারা মিশে যাচ্ছে, যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ধরনের একটি সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় আমার একটি গবেষণা ছিল, ‘শরণার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া’ নিয়ে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় যেসব কেস স্টাডি পেয়েছিলাম, তার মধ্যে ধর্মীয় টান, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতিতে মিল, রোহিঙ্গাদের সস্তা শ্রম ও আগে থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোনোভাবে জায়গা করতে পারা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্য রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার মানসিকতা অন্যতম। অনেকেই ক্যাম্প থেকে বের হয়ে বা সরাসরি আরাকান থেকে চট্টগ্রামে ঢুকে পড়ে নানা কৌশলে আশ্রয় নিচ্ছে স্থানীয় মানুষের বাড়ি বা জনবসতিহীন পাহাড়ে।
এই বছরের শুরুতে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার জাতীয় পার্টির স্থানীয় এক নেতাকে রোহিঙ্গারা মেরে নর্দমায় ফেলে রেখে চলে যায়। ভদ্রলোক মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গা যুবককে তার খামারে কাজ দিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গা যুবকরাই তাকে মেরে ফেলল। রোহিঙ্গারা যেহেতু এ দেশের নাগরিক নয়, ফলে এ দেশের আইন দিয়ে বিচার করাও সম্ভব নয়। তা ছাড়া, নির্দিষ্ট স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় তারা এক জায়গায় অপরাধ সংঘটিত করে অন্য জায়গায় আশ্রয় নেয়। ভাষাগত, ধর্মীয় মিল ও সস্তা শ্রমের জন্য স্থানীয়রা নানাভাবে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে আশ্রয় দিচ্ছে। এভাবে ক্যাম্পের বাইরে তাদের আশ্রয় দেওয়া দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
গবেষণায় বুঝতে পেরেছিলাম, রোহিঙ্গারা নিজেদের জাতিভাইদের নিয়ে নিজস্ব নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকে সব সময়—ক্যাম্পে বা ক্যাম্পের বাইরে। ফলে তাদের এই মানসিকতা ও নেটওয়ার্ক স্থানীয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করলে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থায়ী অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া, রোহিঙ্গারা যেহেতু নির্যাতিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, দীর্ঘ মেয়াদে তারা এখানে থাকলে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়তে পারে। ফলে শান্ত চট্টগ্রামের পাহাড় আবার অশান্ত হয়ে ওঠার ঝুঁকি রয়েছে।
২০১৯ সালে সরকারি একটি হিসাবে ২০ মাসে ১ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর জন্মের কথা বলা হয়। সেভ দ্যা চিলড্রেন বলছে, প্রতিদিন ১৩০ রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। অর্থাৎ, প্রতিদিন রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়ছে। তার মানে, মিয়ানমার প্রতি মাসে ৫ হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিলেও রোহিঙ্গার সংখ্যা ক্যাম্পে সমান থাকবে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অধিক শিশু জন্মদানের প্রবণতা রয়েছে। কারণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে তাদের মধ্যে ট্যাবু ধারণা রয়েছে। এ ছাড়া, পরিবারের সদস্যসংখ্যার ওপর নির্ভর করে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দেওয়ার একটা পদ্ধতি রয়েছে।
ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, স্থানীয়দের সঙ্গে শরণার্থীদের মিশে যাওয়ার পাশাপাশি অধিক রোহিঙ্গা জন্মদানও একটা সংকট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই এনজিও বা বাংলাদেশ সরকারের উচিত বাল্যবিবাহ, কিশোরী প্রজননস্বাস্থ্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের সচেতন করা। নয়তো দিন দিন জ্যামিতিক হারে বাড়তেই থাকবে তাদের সংখ্যা। তবে সবার আগে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেই গুরুত্ব দিতে হবে। যদিও প্রত্যাবাসন নিয়ে আমাদের সামনে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো খবর নেই। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা আগালেও মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সে প্রক্রিয়াকে আবারও আটকে দিয়েছে। তবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। মিয়ানমারের প্রতিবেশী ও এশিয়ার দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারত ও চীন তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যথাযথ অবস্থান নিচ্ছে না।
ভারত-চীন-বাংলাদেশ-মিয়ানমারের জোট বিসিআইএমের ভবিষ্যৎ আটকে যাওয়ার পর ভারত এখন ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়ক নির্মাণে নজর দিচ্ছে। ভারত বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘পূর্বমুখী নীতি’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আসিয়ানের বাজার ধরতে চায়, সেই সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করতে চায় নয়াদিল্লি। আর সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ভূমি ব্যবহার ছাড়া বিকল্প নেই। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত চুপ রয়েছে। কারণ, তারা মিয়ানমারের ভূমি ও সমুদ্রপথ ব্যবহার করে কালাদান প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে চায়। এই কালাদান প্রজেক্ট ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে কলকাতা বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করবে। এর ফলে ভারতের ‘চিকেন নেক’ নির্ভরতা কমবে।
অন্যদিকে চীনের রয়েছে আরও বহুল ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। চীন মিয়ানমারের ওপর দিয়ে তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করছে। এ ছাড়া রাখাইন রাজ্যে নির্মাণ করছে গভীর সমুদ্রবন্দর। মিয়ানমারের ওপর দিয়ে যাচ্ছে চীনের বিআরই করিডর। মিয়ানমারের চীনের এসব প্রকল্প চীন তেল-গ্যাস আমদানির জন্য মালাক্কা প্রণালি ডিলেমা গোছাবে। নিজ নিজ ভূরাজনৈতিক স্বার্থে চীন ও ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের গণহত্যা নিয়ে একেবারে চুপ, উল্টো চীন জাতিসংঘের ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সামনের দিনে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রস্তুত হতে হবে বাংলাদেশকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সাউথ এশিয়ান (সার্ক) বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি।
ইতিহাস বলে রোহিঙ্গারা আরাকানের ভূমিপুত্র। ১৭৮৫ সালের আগে আরাকান ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম অঞ্চল। ১৮২৬ সালের অ্যাঙ্গো-বার্মিজ যুদ্ধের পরই আরাকান ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত বার্মার অংশ হয়। কিন্তু ১৯৮৫ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে তৎকালীন সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব বাতিল করে। যদিও রোহিঙ্গা সংকটের শুরু তারও আগে।
২০১৬ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের নারকীয় গণহত্যা চালায় বার্মিজ ও রাখাইনরা। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই গণহত্যা শুরু হয়। এর আগে ২০১২ সালে এক রাখাইন নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে এসেছে প্রায় ৬-৭ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের ক্যাম্পে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। এর বাইরেও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নভাবে মিশে গেছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে, যার কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান বাংলাদেশ সরকারের কাছে নেই।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের মতো সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা জাহাজকে ফের ঠেলে দিতে পারেনি বাংলাদেশ। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল মানবিক বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানবিক আচরণ ও আশ্রয় সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু এখন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আশু জরুরি। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ একটা দেশের পক্ষে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার দীর্ঘ মেয়াদে চাপ সামাল দেওয়া অসম্ভব। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ধীরে ধীরে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ইস্যু হয়ে উঠছে। ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জোর দেওয়া দরকার।
আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো সেই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে আশানুরূপ সহযোগিতা করছে না। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর চলা জাতিগত নিধন নিয়ে সোচ্চার হলেও প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে প্রয়োজনীয় চাপ দিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিবৃতিতে সোচ্চার হলেও তাদের অর্থায়নে পরিচালিত সংগঠন আইএমএফ ঠিকই মিয়ানমারকে অর্থসহায়তা দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ইউরোপের দেশগুলো মিয়ানমারে বিনিয়োগ করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বরং বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর না করতে। এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একচোখা আচরণ।
কক্সবাজার বাংলাদেশের পর্যটন ও ব্যবসায়িকভাবে সম্ভাবনাময় অঞ্চল। দীর্ঘ মেয়াদে ১১ লাখ রোহিঙ্গা এখানে রাখলে পর্যটন, পরিবেশ ও নিরাপত্তাজনিত হুমকি তৈরি হবে। প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক প্রয়াত তারেক শামসুর রেহমান টক শোতে ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, আমাদের ১টা নয়, ১১টা ভাসানচর দরকার। কেননা, রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে পাহাড় ও গাছ কাটার ফলে কক্সবাজারের পরিবেশ ও জলবায়ু দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। মাদক, নারী পাচার, খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
কক্সবাজার পুলিশ প্রশাসন বলছে, আগস্ট ২০১৭ থেকে মে ২০২০ এর মধ্যে ৫৮ হাজার রোহিঙ্গাকে ক্যাম্প থেকে পালানোর সময় গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া এই সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলছে, নানা অপরাধে আগস্ট ২০১৭ থেকে আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ১৬৬৪ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে ৭২৫টি মামলা হয় কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায়। এ ছাড়া এই সময়ে নারীসহ ১০৩ জন রোহিঙ্গা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, কক্সবাজার অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষাগত ও শারীরিক গঠনে মিল থাকায় ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তারা মিশে যাচ্ছে, যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ধরনের একটি সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় আমার একটি গবেষণা ছিল, ‘শরণার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া’ নিয়ে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় যেসব কেস স্টাডি পেয়েছিলাম, তার মধ্যে ধর্মীয় টান, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতিতে মিল, রোহিঙ্গাদের সস্তা শ্রম ও আগে থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোনোভাবে জায়গা করতে পারা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্য রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার মানসিকতা অন্যতম। অনেকেই ক্যাম্প থেকে বের হয়ে বা সরাসরি আরাকান থেকে চট্টগ্রামে ঢুকে পড়ে নানা কৌশলে আশ্রয় নিচ্ছে স্থানীয় মানুষের বাড়ি বা জনবসতিহীন পাহাড়ে।
এই বছরের শুরুতে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার জাতীয় পার্টির স্থানীয় এক নেতাকে রোহিঙ্গারা মেরে নর্দমায় ফেলে রেখে চলে যায়। ভদ্রলোক মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গা যুবককে তার খামারে কাজ দিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গা যুবকরাই তাকে মেরে ফেলল। রোহিঙ্গারা যেহেতু এ দেশের নাগরিক নয়, ফলে এ দেশের আইন দিয়ে বিচার করাও সম্ভব নয়। তা ছাড়া, নির্দিষ্ট স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় তারা এক জায়গায় অপরাধ সংঘটিত করে অন্য জায়গায় আশ্রয় নেয়। ভাষাগত, ধর্মীয় মিল ও সস্তা শ্রমের জন্য স্থানীয়রা নানাভাবে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে আশ্রয় দিচ্ছে। এভাবে ক্যাম্পের বাইরে তাদের আশ্রয় দেওয়া দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
গবেষণায় বুঝতে পেরেছিলাম, রোহিঙ্গারা নিজেদের জাতিভাইদের নিয়ে নিজস্ব নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকে সব সময়—ক্যাম্পে বা ক্যাম্পের বাইরে। ফলে তাদের এই মানসিকতা ও নেটওয়ার্ক স্থানীয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করলে ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্থায়ী অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া, রোহিঙ্গারা যেহেতু নির্যাতিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, দীর্ঘ মেয়াদে তারা এখানে থাকলে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়তে পারে। ফলে শান্ত চট্টগ্রামের পাহাড় আবার অশান্ত হয়ে ওঠার ঝুঁকি রয়েছে।
২০১৯ সালে সরকারি একটি হিসাবে ২০ মাসে ১ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর জন্মের কথা বলা হয়। সেভ দ্যা চিলড্রেন বলছে, প্রতিদিন ১৩০ রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। অর্থাৎ, প্রতিদিন রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়ছে। তার মানে, মিয়ানমার প্রতি মাসে ৫ হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিলেও রোহিঙ্গার সংখ্যা ক্যাম্পে সমান থাকবে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অধিক শিশু জন্মদানের প্রবণতা রয়েছে। কারণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে তাদের মধ্যে ট্যাবু ধারণা রয়েছে। এ ছাড়া, পরিবারের সদস্যসংখ্যার ওপর নির্ভর করে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দেওয়ার একটা পদ্ধতি রয়েছে।
ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, স্থানীয়দের সঙ্গে শরণার্থীদের মিশে যাওয়ার পাশাপাশি অধিক রোহিঙ্গা জন্মদানও একটা সংকট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই এনজিও বা বাংলাদেশ সরকারের উচিত বাল্যবিবাহ, কিশোরী প্রজননস্বাস্থ্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের সচেতন করা। নয়তো দিন দিন জ্যামিতিক হারে বাড়তেই থাকবে তাদের সংখ্যা। তবে সবার আগে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেই গুরুত্ব দিতে হবে। যদিও প্রত্যাবাসন নিয়ে আমাদের সামনে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো খবর নেই। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা আগালেও মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সে প্রক্রিয়াকে আবারও আটকে দিয়েছে। তবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভূরাজনৈতিক সমীকরণ। মিয়ানমারের প্রতিবেশী ও এশিয়ার দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারত ও চীন তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যথাযথ অবস্থান নিচ্ছে না।
ভারত-চীন-বাংলাদেশ-মিয়ানমারের জোট বিসিআইএমের ভবিষ্যৎ আটকে যাওয়ার পর ভারত এখন ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়ক নির্মাণে নজর দিচ্ছে। ভারত বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘পূর্বমুখী নীতি’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আসিয়ানের বাজার ধরতে চায়, সেই সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করতে চায় নয়াদিল্লি। আর সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ভূমি ব্যবহার ছাড়া বিকল্প নেই। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত চুপ রয়েছে। কারণ, তারা মিয়ানমারের ভূমি ও সমুদ্রপথ ব্যবহার করে কালাদান প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে চায়। এই কালাদান প্রজেক্ট ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে কলকাতা বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করবে। এর ফলে ভারতের ‘চিকেন নেক’ নির্ভরতা কমবে।
অন্যদিকে চীনের রয়েছে আরও বহুল ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। চীন মিয়ানমারের ওপর দিয়ে তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করছে। এ ছাড়া রাখাইন রাজ্যে নির্মাণ করছে গভীর সমুদ্রবন্দর। মিয়ানমারের ওপর দিয়ে যাচ্ছে চীনের বিআরই করিডর। মিয়ানমারের চীনের এসব প্রকল্প চীন তেল-গ্যাস আমদানির জন্য মালাক্কা প্রণালি ডিলেমা গোছাবে। নিজ নিজ ভূরাজনৈতিক স্বার্থে চীন ও ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের গণহত্যা নিয়ে একেবারে চুপ, উল্টো চীন জাতিসংঘের ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সামনের দিনে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রস্তুত হতে হবে বাংলাদেশকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সাউথ এশিয়ান (সার্ক) বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি।
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১৭ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১৮ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১৮ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ দিন আগে