শাওন মাহমুদ
বাংলাদেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কারও তেমন নজর দেওয়ার সময় নেই। জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে, নীতিনির্ধারণ হচ্ছে ধীরলয়ে, নির্ধারিত নীতির বাস্তব রূপায়ণে মন্থর মনোভাব। দুর্নীতির সূক্ষ্ম জালে জং ধরে গেছে মানবিক মূল্যায়নের নৈতিকতা। রাজধানীকেন্দ্রিক মানুষের চাপে উপচে পড়ছে বাসযোগ্যতার সব ক্ষেত্র। শিশুরা হয়েছে পড়াশোনায় অমনোযোগী, শিক্ষকেরা অস্থির, শিক্ষাব্যবস্থায় স্থায়ী ভাঙন ধরেছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক হওয়ার প্রবণতায় আধুনিকতাবাদে আছে শুধু শূন্যতার ছড়াছড়ি। নগর উন্নয়ন হয়েছে অধিক, নগরবাদে আসেনি কোনো পরিপক্বতা।
এমন সব সমস্যার একদম শেকড়ের কাছাকাছি গিয়ে যদি জানতে চাই, আগামী প্রজন্মের এত অধঃপতনের শুরুটা কোথায়! খুঁজে দেখা যাচ্ছে যে, শিশুদের জন্য পরিবারের পর সবচেয়ে জরুরি অবস্থানে থাকা শিক্ষকের ভূমিকায় এখন বিশাল শূন্যতার ছাপ।
একাত্তরের যুদ্ধ শেষে আমাদের মতো পরিবারকে কখনো ট্রমা-পরবর্তী কাউন্সেলিং করা হয়নি। বের করে আনা হয়নি সেই সব বিভীষিকাময় সময় থেকে। আমরা বের হতে পারিনি সেই সব ভয়াবহ ক্রমাগত দৃশ্যপটের ছোট ছোট মুহূর্ত থেকে। বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সেই সময়টার আফটার শক ট্রমায় আক্রান্ত আমি যখন প্রথম স্কুলের ক্লাসে ঢুকেছিলাম, তখন মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে যাওয়া এক ছোট্ট মানুষ। দিনের পর দিন আমাকে নিয়ে শিক্ষকদের কাউন্সেলিং—একপর্যায়ে অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করেছিল। এমনকি আমার জন্য সহপাঠীদের সঙ্গেও তাঁরা কথা বলতেন, বোঝাতেন সহজ করে চলার উপায়গুলো। সময় যত গড়িয়েছে তত বেশি সেসব শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এসেছে। যত দিন গেছে নিজের অবস্থান শক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তত বেশি করে দেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে শিখেছি। জানতে চেয়েছি।
আমি যে স্কুলে পড়েছি, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত একটা ক্লাসে ৫০ থেকে ঊর্ধ্বে ৬০ জন শিশু পড়াশোনা করত। প্রতিটা শিক্ষার্থীর নাম জানতেন শিক্ষকেরা। মানসিক এবং পারিবারিকবিষয়ক ফাইল রাখতেন। পড়াশোনায় দুর্বল, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ বা মৃত্যু, অর্থনৈতিক সমস্যায় শিক্ষকেরা এগিয়ে আসতেন। সমাধান করতেন, সময় ধরে। এমনকি টিফিনে সবাই কী খাচ্ছে বা খায়নি কেন—তা-ও তাঁরা খোঁজ নিতেন। শারীরিক পরিবর্তন এবং নিজের যত্ন নেওয়ার জন্য আলাদা করে কথা বলতেন। সিলেবাসের বাইরে খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা, লাইব্রেরি ওয়ার্ক, রিডিং প্র্যাকটিস, আর্ট ক্লাস বাধ্যতামূলক ছিল। অঢেল সময় ধরে শিক্ষকেরা ক্লাস রুটিন তৈরি করতেন, পড়াতেন এবং কারও কোনো বিষয়ে দুর্বলতা থাকলে তাদের আলাদা করে এক্সট্রা ক্লাস করাতেন। পরিবারের চেয়েও বেশি জানতেন তাঁরা আমাদের সম্পর্কে। এখন সেই স্কুলে দুটো শিফটে প্রতি ক্লাসের চার থেকে পাঁচটা সেকশনে ৯০-১২০টি শিশু পড়তে যায়। শিক্ষার্থীর নাম জানার বালাই নেই কোথাও। শিক্ষকেরা শিশুদের নাম জানতেও আর আগ্রহী নন। সেখানে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলার বা আলাদা সময় দেওয়ার প্রশ্নই আশা করা ঠিক নয়। গৎবাঁধা সিলেবাস, প্রশ্ন আর হ্যাঁ-না উত্তরে টিক দেওয়াতেই পড়াশোনা চলছে। গাইড বুক এবং কোচিং হচ্ছে এখনকার শিক্ষায় সব সমস্যার সমাধান।
বন্ধু সঙ্গীতা, সে একজন স্কুলশিক্ষক। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, গত কয়েক বছরের শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে শিক্ষাপদ্ধতি ভেঙে পড়াটা সময়ের ব্যাপার। ঘনঘন পরীক্ষার চাপ, সেশনজট, ভর্তি পরীক্ষার চাপ, হঠাৎ সিলেবাস শেষ করার নোটিশ, সপ্তাহে ছয়–সাত সেট খাতা দেখা, অ্যাসাইনমেন্টের জন্য প্রশ্নপত্র তৈরি, অভিভাবকদের উচ্চমাত্রার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি মিলিয়ে শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পাহাড়সম বোঝার ভার হয়ে আসছে প্রতিবছর। কোচিং করার এবং করোনোর প্রবণতা প্রবল হয়েছে। কোচিং না করলে ভালো ফল আসবে না, একেবারে নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। এ ছাড়াও বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডিতে রাজনৈতিক নেতা এবং বড় ব্যবসায়ীদের পদ দখল বাড়তি চাপ ফেলে শিক্ষার পরিবেশে। তাঁদের ইচ্ছেমতো শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কলুষিত করে ফেলেছে। শিক্ষকেরা যদিও-বা সাংস্কৃতিক বা দিবসভিত্তিক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন, তাতে বাধা হয়ে আসেন অভিভাবকেরা, গভর্নিং বডির পদ দখলকারীরা। সিলেবাসের বাইরে অন্য বই পড়ার সময় এখন আর শিশু–কিশোরেরা পায় না। তাই তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সুকুমার রায়ের ছড়া বা পথের পাঁচালীর মতো গল্প। স্কুলে খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। হারিয়ে গেছে স্কুলভিত্তিক খেলাধুলার আয়োজন আর প্রতিযোগিতা।
এদিকে শিক্ষকেরা নিজের সন্তানকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ানোর প্রতিযোগিতায় অর্থনৈতিক সমাধান খুঁজে বেড়ান। বিদেশে পড়ানোর তাগিদ সঙ্গে যোগ দেয়। নিজ অবস্থান থেকে বাড়তি আয়ের জন্য কোচিং সেন্টারে মন থাকে অনেক বেশি। নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মন দেওয়ার বিষয়টা একদম নেই হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রমোশন না হওয়ার ঝামেলা, শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি, সিনিয়রের পক্ষপাতিত্ব, বয়স্ক শিক্ষকদের কম্পিউটার ব্যবহারে অক্ষমতা, পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য জীবনে অশান্তি ছাড়াও যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম শিক্ষকেরা মানসিকভাবে সুস্থ স্বাস্থ্য নিয়ে জীবনযাপন করতে পারছেন না। করোনাকাল রোজকার বিষণ্নতায় আরও ভার হয়ে নেমে এসেছে
সবার ওপরেই।
শিশুদের মধ্যে যে অপরাধপ্রবণতা, তা বৃদ্ধি পেয়েছে ভয়াবহরূপে। বিশেষ করে পারিবারিক কলহ, একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন, সহজ নেশা, বাবা-মায়ের পারসোনালিটি ক্ল্যাশ, তাঁদের পরকীয়া, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, যৌন নির্যাতন শিশুদের মানসিক বিপর্যয়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। স্লিপ ডিজঅর্ডার, বিষণ্নতা, খাওয়ায় অনীহা, অমনোযোগী, মেজাজ করছে—এমন শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। শিশু–কিশোরেরা নেশায় আসক্ত হচ্ছে, বই ছেড়ে স্মার্টফোনে অভ্যস্ত হয়েছে, ইউটিউব, টিকটক, লাইকিতে সময় কাটাচ্ছে, কিশোর গ্যাং (যাদের বেশির ভাগই স্কুলে যায় না) অপহরণ থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত করছে।
সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর রাশিদুল হকের সঙ্গে প্রায় কথা বলি। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তথ্য-উপাত্ত জানতে তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করেন। আজও যখন কথা বলছিলাম, তখন তিনি অবাক হওয়া সব তথ্য জানালেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের ২০১৮-২০১৯ সালের সার্ভে অনুযায়ী আমাদের দেশে ৭ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত মানসিক রোগে ভুগছে এমন শিশুর সংখ্যা ১৪%। এ ছাড়া ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব গ্রামাঞ্চলে ১৬.২% এবং ১৮.৭% মানসিক রোগীর দেখা পাওয়া যায়। যেখানে আমাদের দেশে সাইকোলজিস্ট মাত্র ৩৫০ জন এবং সাইকিয়াট্রিস্টের সংখ্যা ৪০০।
এখানে বলে রাখতে চাই, দুই বিশেষজ্ঞ এক বিষয় নিয়ে কাজ করলেও কাজের ক্ষেত্রে পার্থক্যটা অনেকে জানেন না। সাইকিয়াট্রিক মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটধারী, সাইকোলজিস্ট তা নন। সাইকিয়াট্রিস্ট ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেন, সাইকোলজিস্ট দিতে পারেন না। সাইকিয়াট্রিস্ট পরীক্ষা করে আরোগ্য করেন এবং খুব জটিল মানসিক রোগের চিকিৎসায় জোগান দেন, সাইকোলজিস্ট মৌখিক থেরাপি, যাকে সাইকোথেরাপি বলা হয়, তার মাধ্যমে রোগীকে সাহায্য করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন সাইকোলজিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে বড় বড় দু-একটি স্কুল ছাড়া কোথাও তাঁদের দেখা মেলে না। কাউন্সেলিং করার জন্য আগে শিক্ষকেরাই হাত বাড়াতেন। এখন দু-একজন ছাড়া তেমন শিক্ষক নেই বললেই চলে।
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোয় কাউনসেলিং করার ব্যবস্থা থাকলেও যেখানে ৭ থেকে ১৭ বছরের শিশু–কিশোরদের ১৪% মানসিক রোগে ভুগছে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা করার পদ্ধতিটি রয়ে যায় দূরে।
আমরা ভালোবাসা প্রকাশ করছি না। সমালোচনায় এগিয়ে থাকছি। এখানে উগ্র মৌলবাদের আক্রমণে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে প্রকাশ্যে কান ধরিয়ে ওঠবস করানো অতীব রাজনৈতিক পরছায়া। প্রেমের প্রস্তাবে সম্মতি না দেওয়ায় স্কুলের সামনেই শিক্ষার্থী দিশাকে কুপিয়ে হত্যা করে এক দর্জি। নিজ সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে স্কুলের আঙিনায় সবার সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তুবার মাকে। এমন অজস্র পূতিময় ঘৃণা আর হিংসাঘেরা অঘটনের মুখোমুখি হচ্ছে প্রজন্ম, আমরা সবাই।
হঠাৎ করেই অতিধর্মীয় চাপ এসে পড়ে সামাজিকতায়। পাঠ্যপুস্তকে প্রভাব আসে মৌলবাদী শিক্ষার। পরিবারে এখন সন্তানেরা বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে না, আদরের জন্য আবদার করে না। বাবা, মা বা শিক্ষকের সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাদের। গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর শিক্ষা উবে যায়। পারিবারিক পরিবেশে চলমান সংবাদ নিয়ে আর আড্ডা হয় না।
ডিজিটাল যুগে এসে আমরা সবাই বাক্সবন্দী জীবনযাপন করছি। সেলফোন, ল্যাপটপ, টেলিভিশন জানালার মতো চার কোনা বাক্সে বন্দী। বিশাল আকাশে তারার খেলা দেখার জন্য কেউ আর আগ্রহী নয়। সবুজ ঘাসে মাথা রেখে রাজনৈতিক গল্প করার প্রয়োজন নেই কারও। শিক্ষকের হাত ধরে বৃক্ষের নাম জানার সুযোগ হয় না আর। বাক্সবন্দী জীবনে অভ্যস্ত আমরা এখন শিক্ষক বা শিক্ষা নিয়ে চিন্তিত নই। গুগল করলেই জানা হয়ে যায় সব। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের মতো করেই তরঙ্গনির্ভরতায় শেকড়বিহীন অন্তর্জালবলয়ে বড় হচ্ছে।
সবশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, যে দেশে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে সাহায্য করে না; যে দেশের পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রবেশ করানো হয়; যে দেশে শিক্ষকেরা কলুষিত রাজনীতি করে নিজেদের চরিত্রের স্খলন ঘটায়; যে দেশে শিক্ষকেরা ইতিহাস, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নিয়ে সচেতন নয়; যে দেশে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, নীতিনির্ধারক ও শিক্ষাব্যবস্থার মেলবন্ধনে মানসিক সামঞ্জস্য নেই; সে দেশ আগামীর পথ পাওনা থাকবে শুধু আঁধার।
লেখক: শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা
বাংলাদেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কারও তেমন নজর দেওয়ার সময় নেই। জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুতগতিতে, নীতিনির্ধারণ হচ্ছে ধীরলয়ে, নির্ধারিত নীতির বাস্তব রূপায়ণে মন্থর মনোভাব। দুর্নীতির সূক্ষ্ম জালে জং ধরে গেছে মানবিক মূল্যায়নের নৈতিকতা। রাজধানীকেন্দ্রিক মানুষের চাপে উপচে পড়ছে বাসযোগ্যতার সব ক্ষেত্র। শিশুরা হয়েছে পড়াশোনায় অমনোযোগী, শিক্ষকেরা অস্থির, শিক্ষাব্যবস্থায় স্থায়ী ভাঙন ধরেছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক হওয়ার প্রবণতায় আধুনিকতাবাদে আছে শুধু শূন্যতার ছড়াছড়ি। নগর উন্নয়ন হয়েছে অধিক, নগরবাদে আসেনি কোনো পরিপক্বতা।
এমন সব সমস্যার একদম শেকড়ের কাছাকাছি গিয়ে যদি জানতে চাই, আগামী প্রজন্মের এত অধঃপতনের শুরুটা কোথায়! খুঁজে দেখা যাচ্ছে যে, শিশুদের জন্য পরিবারের পর সবচেয়ে জরুরি অবস্থানে থাকা শিক্ষকের ভূমিকায় এখন বিশাল শূন্যতার ছাপ।
একাত্তরের যুদ্ধ শেষে আমাদের মতো পরিবারকে কখনো ট্রমা-পরবর্তী কাউন্সেলিং করা হয়নি। বের করে আনা হয়নি সেই সব বিভীষিকাময় সময় থেকে। আমরা বের হতে পারিনি সেই সব ভয়াবহ ক্রমাগত দৃশ্যপটের ছোট ছোট মুহূর্ত থেকে। বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সেই সময়টার আফটার শক ট্রমায় আক্রান্ত আমি যখন প্রথম স্কুলের ক্লাসে ঢুকেছিলাম, তখন মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে যাওয়া এক ছোট্ট মানুষ। দিনের পর দিন আমাকে নিয়ে শিক্ষকদের কাউন্সেলিং—একপর্যায়ে অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করেছিল। এমনকি আমার জন্য সহপাঠীদের সঙ্গেও তাঁরা কথা বলতেন, বোঝাতেন সহজ করে চলার উপায়গুলো। সময় যত গড়িয়েছে তত বেশি সেসব শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এসেছে। যত দিন গেছে নিজের অবস্থান শক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তত বেশি করে দেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে শিখেছি। জানতে চেয়েছি।
আমি যে স্কুলে পড়েছি, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত একটা ক্লাসে ৫০ থেকে ঊর্ধ্বে ৬০ জন শিশু পড়াশোনা করত। প্রতিটা শিক্ষার্থীর নাম জানতেন শিক্ষকেরা। মানসিক এবং পারিবারিকবিষয়ক ফাইল রাখতেন। পড়াশোনায় দুর্বল, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ বা মৃত্যু, অর্থনৈতিক সমস্যায় শিক্ষকেরা এগিয়ে আসতেন। সমাধান করতেন, সময় ধরে। এমনকি টিফিনে সবাই কী খাচ্ছে বা খায়নি কেন—তা-ও তাঁরা খোঁজ নিতেন। শারীরিক পরিবর্তন এবং নিজের যত্ন নেওয়ার জন্য আলাদা করে কথা বলতেন। সিলেবাসের বাইরে খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা, লাইব্রেরি ওয়ার্ক, রিডিং প্র্যাকটিস, আর্ট ক্লাস বাধ্যতামূলক ছিল। অঢেল সময় ধরে শিক্ষকেরা ক্লাস রুটিন তৈরি করতেন, পড়াতেন এবং কারও কোনো বিষয়ে দুর্বলতা থাকলে তাদের আলাদা করে এক্সট্রা ক্লাস করাতেন। পরিবারের চেয়েও বেশি জানতেন তাঁরা আমাদের সম্পর্কে। এখন সেই স্কুলে দুটো শিফটে প্রতি ক্লাসের চার থেকে পাঁচটা সেকশনে ৯০-১২০টি শিশু পড়তে যায়। শিক্ষার্থীর নাম জানার বালাই নেই কোথাও। শিক্ষকেরা শিশুদের নাম জানতেও আর আগ্রহী নন। সেখানে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলার বা আলাদা সময় দেওয়ার প্রশ্নই আশা করা ঠিক নয়। গৎবাঁধা সিলেবাস, প্রশ্ন আর হ্যাঁ-না উত্তরে টিক দেওয়াতেই পড়াশোনা চলছে। গাইড বুক এবং কোচিং হচ্ছে এখনকার শিক্ষায় সব সমস্যার সমাধান।
বন্ধু সঙ্গীতা, সে একজন স্কুলশিক্ষক। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, গত কয়েক বছরের শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে শিক্ষাপদ্ধতি ভেঙে পড়াটা সময়ের ব্যাপার। ঘনঘন পরীক্ষার চাপ, সেশনজট, ভর্তি পরীক্ষার চাপ, হঠাৎ সিলেবাস শেষ করার নোটিশ, সপ্তাহে ছয়–সাত সেট খাতা দেখা, অ্যাসাইনমেন্টের জন্য প্রশ্নপত্র তৈরি, অভিভাবকদের উচ্চমাত্রার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি মিলিয়ে শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পাহাড়সম বোঝার ভার হয়ে আসছে প্রতিবছর। কোচিং করার এবং করোনোর প্রবণতা প্রবল হয়েছে। কোচিং না করলে ভালো ফল আসবে না, একেবারে নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। এ ছাড়াও বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডিতে রাজনৈতিক নেতা এবং বড় ব্যবসায়ীদের পদ দখল বাড়তি চাপ ফেলে শিক্ষার পরিবেশে। তাঁদের ইচ্ছেমতো শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কলুষিত করে ফেলেছে। শিক্ষকেরা যদিও-বা সাংস্কৃতিক বা দিবসভিত্তিক অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন, তাতে বাধা হয়ে আসেন অভিভাবকেরা, গভর্নিং বডির পদ দখলকারীরা। সিলেবাসের বাইরে অন্য বই পড়ার সময় এখন আর শিশু–কিশোরেরা পায় না। তাই তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সুকুমার রায়ের ছড়া বা পথের পাঁচালীর মতো গল্প। স্কুলে খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। হারিয়ে গেছে স্কুলভিত্তিক খেলাধুলার আয়োজন আর প্রতিযোগিতা।
এদিকে শিক্ষকেরা নিজের সন্তানকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ানোর প্রতিযোগিতায় অর্থনৈতিক সমাধান খুঁজে বেড়ান। বিদেশে পড়ানোর তাগিদ সঙ্গে যোগ দেয়। নিজ অবস্থান থেকে বাড়তি আয়ের জন্য কোচিং সেন্টারে মন থাকে অনেক বেশি। নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মন দেওয়ার বিষয়টা একদম নেই হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রমোশন না হওয়ার ঝামেলা, শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি, সিনিয়রের পক্ষপাতিত্ব, বয়স্ক শিক্ষকদের কম্পিউটার ব্যবহারে অক্ষমতা, পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য জীবনে অশান্তি ছাড়াও যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম শিক্ষকেরা মানসিকভাবে সুস্থ স্বাস্থ্য নিয়ে জীবনযাপন করতে পারছেন না। করোনাকাল রোজকার বিষণ্নতায় আরও ভার হয়ে নেমে এসেছে
সবার ওপরেই।
শিশুদের মধ্যে যে অপরাধপ্রবণতা, তা বৃদ্ধি পেয়েছে ভয়াবহরূপে। বিশেষ করে পারিবারিক কলহ, একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন, সহজ নেশা, বাবা-মায়ের পারসোনালিটি ক্ল্যাশ, তাঁদের পরকীয়া, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, যৌন নির্যাতন শিশুদের মানসিক বিপর্যয়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। স্লিপ ডিজঅর্ডার, বিষণ্নতা, খাওয়ায় অনীহা, অমনোযোগী, মেজাজ করছে—এমন শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। শিশু–কিশোরেরা নেশায় আসক্ত হচ্ছে, বই ছেড়ে স্মার্টফোনে অভ্যস্ত হয়েছে, ইউটিউব, টিকটক, লাইকিতে সময় কাটাচ্ছে, কিশোর গ্যাং (যাদের বেশির ভাগই স্কুলে যায় না) অপহরণ থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত করছে।
সাইকিয়াট্রিস্ট অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর রাশিদুল হকের সঙ্গে প্রায় কথা বলি। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তথ্য-উপাত্ত জানতে তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করেন। আজও যখন কথা বলছিলাম, তখন তিনি অবাক হওয়া সব তথ্য জানালেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের ২০১৮-২০১৯ সালের সার্ভে অনুযায়ী আমাদের দেশে ৭ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত মানসিক রোগে ভুগছে এমন শিশুর সংখ্যা ১৪%। এ ছাড়া ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব গ্রামাঞ্চলে ১৬.২% এবং ১৮.৭% মানসিক রোগীর দেখা পাওয়া যায়। যেখানে আমাদের দেশে সাইকোলজিস্ট মাত্র ৩৫০ জন এবং সাইকিয়াট্রিস্টের সংখ্যা ৪০০।
এখানে বলে রাখতে চাই, দুই বিশেষজ্ঞ এক বিষয় নিয়ে কাজ করলেও কাজের ক্ষেত্রে পার্থক্যটা অনেকে জানেন না। সাইকিয়াট্রিক মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটধারী, সাইকোলজিস্ট তা নন। সাইকিয়াট্রিস্ট ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেন, সাইকোলজিস্ট দিতে পারেন না। সাইকিয়াট্রিস্ট পরীক্ষা করে আরোগ্য করেন এবং খুব জটিল মানসিক রোগের চিকিৎসায় জোগান দেন, সাইকোলজিস্ট মৌখিক থেরাপি, যাকে সাইকোথেরাপি বলা হয়, তার মাধ্যমে রোগীকে সাহায্য করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন সাইকোলজিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে বড় বড় দু-একটি স্কুল ছাড়া কোথাও তাঁদের দেখা মেলে না। কাউন্সেলিং করার জন্য আগে শিক্ষকেরাই হাত বাড়াতেন। এখন দু-একজন ছাড়া তেমন শিক্ষক নেই বললেই চলে।
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোয় কাউনসেলিং করার ব্যবস্থা থাকলেও যেখানে ৭ থেকে ১৭ বছরের শিশু–কিশোরদের ১৪% মানসিক রোগে ভুগছে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা করার পদ্ধতিটি রয়ে যায় দূরে।
আমরা ভালোবাসা প্রকাশ করছি না। সমালোচনায় এগিয়ে থাকছি। এখানে উগ্র মৌলবাদের আক্রমণে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে প্রকাশ্যে কান ধরিয়ে ওঠবস করানো অতীব রাজনৈতিক পরছায়া। প্রেমের প্রস্তাবে সম্মতি না দেওয়ায় স্কুলের সামনেই শিক্ষার্থী দিশাকে কুপিয়ে হত্যা করে এক দর্জি। নিজ সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে স্কুলের আঙিনায় সবার সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তুবার মাকে। এমন অজস্র পূতিময় ঘৃণা আর হিংসাঘেরা অঘটনের মুখোমুখি হচ্ছে প্রজন্ম, আমরা সবাই।
হঠাৎ করেই অতিধর্মীয় চাপ এসে পড়ে সামাজিকতায়। পাঠ্যপুস্তকে প্রভাব আসে মৌলবাদী শিক্ষার। পরিবারে এখন সন্তানেরা বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে না, আদরের জন্য আবদার করে না। বাবা, মা বা শিক্ষকের সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাদের। গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর শিক্ষা উবে যায়। পারিবারিক পরিবেশে চলমান সংবাদ নিয়ে আর আড্ডা হয় না।
ডিজিটাল যুগে এসে আমরা সবাই বাক্সবন্দী জীবনযাপন করছি। সেলফোন, ল্যাপটপ, টেলিভিশন জানালার মতো চার কোনা বাক্সে বন্দী। বিশাল আকাশে তারার খেলা দেখার জন্য কেউ আর আগ্রহী নয়। সবুজ ঘাসে মাথা রেখে রাজনৈতিক গল্প করার প্রয়োজন নেই কারও। শিক্ষকের হাত ধরে বৃক্ষের নাম জানার সুযোগ হয় না আর। বাক্সবন্দী জীবনে অভ্যস্ত আমরা এখন শিক্ষক বা শিক্ষা নিয়ে চিন্তিত নই। গুগল করলেই জানা হয়ে যায় সব। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের মতো করেই তরঙ্গনির্ভরতায় শেকড়বিহীন অন্তর্জালবলয়ে বড় হচ্ছে।
সবশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, যে দেশে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে সাহায্য করে না; যে দেশের পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রবেশ করানো হয়; যে দেশে শিক্ষকেরা কলুষিত রাজনীতি করে নিজেদের চরিত্রের স্খলন ঘটায়; যে দেশে শিক্ষকেরা ইতিহাস, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নিয়ে সচেতন নয়; যে দেশে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, নীতিনির্ধারক ও শিক্ষাব্যবস্থার মেলবন্ধনে মানসিক সামঞ্জস্য নেই; সে দেশ আগামীর পথ পাওনা থাকবে শুধু আঁধার।
লেখক: শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১১ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১২ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১২ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে