জাহীদ রেজা নূর
ফকির আলমগীর মারা গেলে আমরা বহুদূরের এক জগতে চলে যাই। সে জগতে ছায়ার মতো দুলতে থাকে পাঁচটি মূর্তি। বাস্তবে ফিরে এলে দেখি, একা ফেরদৌস ওয়াহিদ পাহারা দিচ্ছেন সেই সময়কে। বাকি চারজন—আজম খান, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, আর ফকির আলমগীর ছায়া হয়েই থেকে যান আমাদের কতিপয় হৃদয়ে। এবং সেখানেই প্রগাঢ় ছায়া দিতে থাকেন।
দুই.
সত্তরের দশকের শুরুর ঢাকা এখন স্বপ্নের মতো। কল্পনায় ধরা দেয় সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য। কংক্রিটের বস্তি তখনো এভাবে গড়ে ওঠেনি। ছোট ছোট একতলা, দোতলা বাড়িই বেশি। সরু রাস্তায় যানবাহন কম। রাস্তাঘাটে নিরন্ন মানুষের পাশাপাশি ফুলেফেঁপে অস্থির মানুষেরাও দৃশ্যমান।
কিছুদিন আগে, ১৬ ডিসেম্বর, ফাঁকা গুলির আওয়াজ জানান দিয়েছিল দেশ স্বাধীন হয়েছে। দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরছিলেন দেশে। স্টেনগান শোনাচ্ছিল মধুর সংগীত। আমাকে কোলে নিয়ে চামেলিবাগের মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক ভাই এক হাতে স্টেনগানের গুলি ছুড়েছিলেন নারকেল গাছ লক্ষ্য করে। কাঁদি ছিঁড়ে সে গাছের ডাব ছিটকে পড়েছিল আমাদের সামনে—মনে পড়ে। এবং তখনই একদিন দেখতে পাই একটা নতুন গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িবারান্দার কোল ঘেঁষে। সে গাড়িতে করে আমাদের ঢাকার রাস্তা ঘুরিয়েও আনেন একজন। পরে শুনতে পাই, এ গাড়ি হাইজ্যাক করে আনা হয়েছে।
গ্রামের চাষা–মজুর যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, তারা কোনো কিছুর লোভ না করেই অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে গিয়েছিল যে যার কাজে। শহুরে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ হাইজ্যাক, লুটতরাজ করছিল। দেশ তখন ভঙ্গুর। পাকিস্তানিরা এ দেশের শস্যক্ষেত্র জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেতু পুড়িয়ে দিয়েছে, গাড়ি নষ্ট করেছে এবং মানুষ মেরেছে। বিধ্বস্ত এ দেশ তখন একটু একটু করে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সবার পেট থেকে খিদে তাড়ানো যাচ্ছিল না। সে কী ভয়াবহ খিদে!
সে রকম একটা সময়েই অন্যরকম এক সুর ভেসে উঠল। আমরা অবাক হয়ে শুনলাম, আজম খান গাইছেন—‘রেললাইনের ওই বস্তিতে, জন্মেছিল একটি ছেলে, মা তাঁর কাঁদে, ছেলেটি মরে গেছে…!’
আমরা অন্য ঘরে অন্য স্বর শুনতে পেলাম। সে স্বর ক্রমশই হয়ে উঠতে থাকল নাগরিক জীবনের প্রবল সত্যের প্রকাশ।
তিন.
আমাদের পপ জামানার শুরুর কথা বলতে গেলে আজম খানের কাছে ফিরে যেতে হয় বারবার। ঢ্যাঙা, লম্বা, মেদহীন এক শরীর থেকে যখন বেরিয়ে আসত শব্দ, তখন মনে হতো, এ যেন আমারই কথা বলছেন তিনি। খুবই সহজ–সরল লিরিক, কোনো গভীর কথাও ঠেসে দেওয়া নেই ‘আলাল দুলাল’ নামের গানটিতে, কিংবা ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে’ গানগুলোয়। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন তা আত্মার আত্মীয় হয়ে পড়ে। জীবনের যে পাঠ নিজেকে চিনতে শেখায়, এই অস্থির গানগুলো যেন সেদিকেই নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু কোনো এক অচেনা পথে।
সুশীল মানুষেরা একটু খেপে ওঠেন। তাঁরা বলার চেষ্টা করেন, ‘সংগীতের বারোটা বাজাচ্ছে এরা। আমাদের দেশের সংগীতের খোলনলচে পাল্টে দেওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়!’
ধন্য হই এ কথা ভেবে যে, এই ধরনের সমালোচনায় পিছিয়ে যাননি তাঁরা। আমরা যেন এলভিস প্রিসলির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিটলস হয়ে সংগীতের একটা খোলা ময়দান পেয়ে যাই ঢাকা শহরেই। ‘উচ্চারণ’ নামে নিজের দল গড়লেন আজম খান, আর আমরা দেখতে পেলাম গড়ে উঠেছে স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী—আমাদেরই নিউ ইস্কাটনে। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। এ ব্যান্ড দলটি গড়ে তোলার মূল কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু–পুত্র শেখ কামাল।
চার.
স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর বাড়িটা এখনো চোখে ভাসে। দোতলা বাড়ি। বাইরে ছোট একটা সাইনবোর্ড—স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী। মৌচাক মার্কেটের কাছে সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকে যখন হেঁটে হেঁটে নিউ ইস্কাটনের বাড়িতে ফিরতাম, তখনই গিটার কিংবা বঙ্গ বা কঙ্গোর আওয়াজ শুনতে পেতাম। খুব লোভ হতো একবার সেখানে গিয়ে মহড়া শুনে আসতে। সাহসে কুলাত না। জানতাম, এখানেই আসেন ফিরোজ সাঁই, আর ফেরদৌস ওয়াহিদ। লাকী আকান্দ আর হ্যাপী আকান্দকে তখনো সেভাবে চিনতাম না। অনেক পরে লাকি ভাই একদিন ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমাকে কত কোলে নিয়ে বেড়িয়েছি, তোমার মনে নাই?’
আর আজম খান? আজম ভাই তো আমাদের স্কুলের ছাত্র! আমরা আট ভাই সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকেই পাস করেছি এসএসসি, আজম ভাইও সে স্কুল থেকেই পেয়েছিলেন এসএসসির সনদ।
পাঁচ.
বাংলাদেশ টেলিভিশনে আজম খানের ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ গানটিই বোধ হয় জনপ্রিয়তায় আকাশ ছোঁয়। এর পর পপ গানের জয়জয়কার আর ঠেকানো যায়নি।
এখানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নামটি আসবে অবধারিতভাবেই। তিনি আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ, আর ফকির আলমগীরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন টিভি–দর্শকদের। কনসার্টগুলো জনপ্রিয় হচ্ছিল, কিন্তু টেলিভিশনের কল্যাণে তাঁরা হয়ে উঠলেন দেশের তারকা শিল্পী। গানের জগতে এত জনপ্রিয়তা বোধ হয় তাঁরাই প্রথম পেয়েছিলেন।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘সপ্তবর্ণা’ অনুষ্ঠানে কিংবা ঈদের আনন্দমেলায় এই শিল্পীদের দেখা যেত। মনে আছে, একবার ‘অন্তক্ষরী’রও আয়োজন করেছিলেন তিনি। যে শব্দ দিয়ে একটা গান শেষ করবে এক পক্ষ, অন্য পক্ষ সেই শব্দ অথবা শব্দের শেষ অক্ষর দিয়ে শুরু করবে নতুন গান। হয়তো আগে থেকেই স্ক্রিপ্ট করা থাকত, কিন্তু আমরা যারা সে অনুষ্ঠান দেখতাম, তাদের মন আনন্দে ভরে যেত।
ছয়.
ফিরোজ সাঁই মূলত লোকগানকে পপ সংগীতে পরিণত করে গাইতেন। ‘ইশকুল খুইলাছেরে মওলা’, ‘মন তুই চিনলিনারে’, ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা’ ইত্যাদি গানগুলো তখন ছিল তরুণদের মুখে মুখে। পিলু মমতাজের ‘একদিন তো চলে যাব’ গানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘নানি গো নানি’ গানটিও কি প্রথম তিনি গেয়েছিলেন? মনে করতে পারছি না। ফেরদৌস ওয়াহিদ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ‘এমন একটা মা দেনা’ গানটি দিয়ে। তবে তাঁর ‘পাপী আমি তা তো জানি’, ‘স্মৃতির সেই পথে আজও’, ‘পাগলার মন নাচাইয়া’ গানগুলোও জনপ্রিয় হয়েছিল।
থাকলেন ফকির আলমগীর। যদি ভুল করে না থাকি, তাহলে বলতে হবে ‘কে দিলো জ্বালা এ বলো’ গানটি দিয়েই তাঁকে চিনেছিলাম। আর ‘কামেলিরা কাম করিয়া কোথায় জানি লুকাইসে ’ গানটি গেয়ে তিনি পাগল করে তুলেছিলেন একটি প্রজন্মকে।
ষাটের দশকে তাঁরা কোন রাজনীতি করতেন, কোন গান করতেন, সে কথায় গেলাম না। কারণ, আমরা আসলে স্বাধীনতা–উত্তর পপ সংগীতের সেই সোনালি সময়টা নিয়েই কথা বলতে চাইছি।
সাত.
‘সখিনা’র গানগুলো আরও অনেক পরের। আফ্রিকা বা রাজনীতিবিষয়ক গান গেয়েছেন তিনি। পয়লা মে আসবে, অথচ ফকির আলমগীরের কণ্ঠে ‘জন হেনরির’ গান শোনো যাবে না, এ তো অবিশ্বাস্য কথা। নানা ধরনের গানের মধ্য দিয়ে ফকির আলমগীর তাঁর সংগীতযাত্রা চালিয়ে গেছেন। আর আমরা এ কথাও জেনে গেছি, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে শব্দসৈনিক হিসেবে তিনি কাল কাটিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। দেশাত্মবোধক গান ও গণসংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণের একটি বড় কারণ তাঁর দেশপ্রেমিক মনটি—এ কথা বললে কিছু বাড়িয়ে বলা হয় না।
আট.
ফকির ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম পারিবারিকভাবেই। হঠাৎ জানা গেল, তিনি আমাদের মায়ের দেশের লোক। ফরিদপুরের ভাঙ্গার মানুষ। আমার প্রয়াত মামাতো ভাই এম এম শাহরিয়ার রুমীর সঙ্গে তাঁর খুব যোগাযোগ। সেই থেকে তিনি তো একেবারে আপন করে নিলেন আমাদের। দেখা হতে থাকল নানা জায়গায়। আমার আগের কর্মস্থলেও তিনি আসতেন। যেহেতু বিনোদন সাংবাদিকতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, তাই মূলত মে–মাসের এক তারিখে তাঁর একটা সাক্ষাৎকার যেন ছাপা হয়, সে অনুরোধ করতেন। নানা কারণে সব সময় সে অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি, তবে কখনো কখনো রাখতে পেরেছি বলে ভালো লাগছে।
আরেকটা ঘটনা না বললেই নয়। যেবার ভূপেন হাজারিকা এসেছিলেন গান করতে, সেবার আমার সদ্যপ্রয়াত মেজ ভাই শাহীন রেজা নূরের সঙ্গে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে গিয়েছিলাম। শাহীন ভাই তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। হঠাৎ করিডরে চিৎকার–চ্যাঁচামেচি। ভূপেন হাজারিকার অনুরোধ ছিল একসঙ্গে অনেক অতিথি নয়, তাই ফকির আলমগীরকে করিডরেই থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফকির ভাই চিৎকার করে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তিনিও ভূপেনের মতোই একজন গণসংগীত শিল্পী!
শাহীন ভাইয়ের মধ্যস্থতায় ফকির আলমগীর এলেন। তারপর ভূপেনের একেবারে নাক বরাবর দাঁড়িয়ে গাইলেন—
‘বিপ্লব বিপ্লব, সামাজিক বিপ্লব’
ভূপেন তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই দৃশ্য এখনো আমার মনে গাঢ় হয়ে আছে।
নয়.
উচ্চারণ, স্পন্দন, ঋষিজ—ব্যান্ড সংগীতের বেড়ে ওঠা এই শিল্পীদের হাত ধরেই। তারপর একের পর এক ব্যান্ডের জন্ম হতে থাকে। অনেকেই আসতে থাকেন এই ধারায়। অনেকেই তরুণদের মন কেড়ে নেন। আর আমরা এই নতুনদের মেনে নিয়েও ফিরে যাই তাঁদের কাছে। পুরোনো গানগুলো শুনলে বুঝতে পারি, এ গানগুলোই আমাদের শৈশব আর কৈশোর গড়ে দিয়েছে, আমাদের তৈরি করেছে যৌবনের দিনগুলোর জন্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভাবনাজগতে যখন অবিশ্বাসের চারা থেকে বেড়ে উঠছে গাছ, তখনই বিট আন্দোলন, হিপি আন্দোলন, হাংরি জেনারেশন আন্দোলন নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। তবে ইউরোপই সবচেয়ে বেশি দোলা খেয়েছিল তাতে। জীবনের অর্থ খোঁজার জন্য তখন এমন সব সেবন শুরু হলো, যা লৌকিকতার মধ্যেই অলৌকিকের সন্ধান দেয়। নেশা আর সংগীতের কেমন যেন যূথবন্ধন তৈরি হলো। ইউরোপ এখনো সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
তার ছোঁয়া এসে লেগেছিল আমাদের দেশেও। সে অন্য ইতিহাস। তবে গণসংগীত, লোকসংগীত আর পপ সংগীতের গলিত–মিলিত–স্রোতোধারায় প্রাণ পেয়েছিল এই নতুন ধারা। টিকেও গেল সেই প্রাণশক্তির বলেই।
দশ.
২০১৮ সালের বইমেলায় বাংলা একাডেমি অংশে ফকির ভাই আমাকে পাকড়াও করলেন একদিন। বললেন, ‘মোবাইলের ক্যামেরা অন করো। আমি কিছু কথা বলব।’
প্রায় ১০ মিনিট একনাগাড়ে কথা বললেন তিনি। আমি এখন সে ভিডিওটি খুঁজছি। বইমেলায় তাড়াহুড়ার মধ্যে তিনি কী নিয়ে কথা বলেছিলেন, সেটা এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে কোনো হার্ডড্রাইভে নিশ্চয়ই খুঁজতে খুঁজতে একদিন সেটা পেয়ে যাব। আর তখন আবার জীবন্ত হয়ে উঠবেন ফকির আলমগীর।
আরও পড়ুন
ফকির আলমগীর মারা গেলে আমরা বহুদূরের এক জগতে চলে যাই। সে জগতে ছায়ার মতো দুলতে থাকে পাঁচটি মূর্তি। বাস্তবে ফিরে এলে দেখি, একা ফেরদৌস ওয়াহিদ পাহারা দিচ্ছেন সেই সময়কে। বাকি চারজন—আজম খান, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, আর ফকির আলমগীর ছায়া হয়েই থেকে যান আমাদের কতিপয় হৃদয়ে। এবং সেখানেই প্রগাঢ় ছায়া দিতে থাকেন।
দুই.
সত্তরের দশকের শুরুর ঢাকা এখন স্বপ্নের মতো। কল্পনায় ধরা দেয় সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য। কংক্রিটের বস্তি তখনো এভাবে গড়ে ওঠেনি। ছোট ছোট একতলা, দোতলা বাড়িই বেশি। সরু রাস্তায় যানবাহন কম। রাস্তাঘাটে নিরন্ন মানুষের পাশাপাশি ফুলেফেঁপে অস্থির মানুষেরাও দৃশ্যমান।
কিছুদিন আগে, ১৬ ডিসেম্বর, ফাঁকা গুলির আওয়াজ জানান দিয়েছিল দেশ স্বাধীন হয়েছে। দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরছিলেন দেশে। স্টেনগান শোনাচ্ছিল মধুর সংগীত। আমাকে কোলে নিয়ে চামেলিবাগের মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক ভাই এক হাতে স্টেনগানের গুলি ছুড়েছিলেন নারকেল গাছ লক্ষ্য করে। কাঁদি ছিঁড়ে সে গাছের ডাব ছিটকে পড়েছিল আমাদের সামনে—মনে পড়ে। এবং তখনই একদিন দেখতে পাই একটা নতুন গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িবারান্দার কোল ঘেঁষে। সে গাড়িতে করে আমাদের ঢাকার রাস্তা ঘুরিয়েও আনেন একজন। পরে শুনতে পাই, এ গাড়ি হাইজ্যাক করে আনা হয়েছে।
গ্রামের চাষা–মজুর যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, তারা কোনো কিছুর লোভ না করেই অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে গিয়েছিল যে যার কাজে। শহুরে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ হাইজ্যাক, লুটতরাজ করছিল। দেশ তখন ভঙ্গুর। পাকিস্তানিরা এ দেশের শস্যক্ষেত্র জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেতু পুড়িয়ে দিয়েছে, গাড়ি নষ্ট করেছে এবং মানুষ মেরেছে। বিধ্বস্ত এ দেশ তখন একটু একটু করে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সবার পেট থেকে খিদে তাড়ানো যাচ্ছিল না। সে কী ভয়াবহ খিদে!
সে রকম একটা সময়েই অন্যরকম এক সুর ভেসে উঠল। আমরা অবাক হয়ে শুনলাম, আজম খান গাইছেন—‘রেললাইনের ওই বস্তিতে, জন্মেছিল একটি ছেলে, মা তাঁর কাঁদে, ছেলেটি মরে গেছে…!’
আমরা অন্য ঘরে অন্য স্বর শুনতে পেলাম। সে স্বর ক্রমশই হয়ে উঠতে থাকল নাগরিক জীবনের প্রবল সত্যের প্রকাশ।
তিন.
আমাদের পপ জামানার শুরুর কথা বলতে গেলে আজম খানের কাছে ফিরে যেতে হয় বারবার। ঢ্যাঙা, লম্বা, মেদহীন এক শরীর থেকে যখন বেরিয়ে আসত শব্দ, তখন মনে হতো, এ যেন আমারই কথা বলছেন তিনি। খুবই সহজ–সরল লিরিক, কোনো গভীর কথাও ঠেসে দেওয়া নেই ‘আলাল দুলাল’ নামের গানটিতে, কিংবা ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে’ গানগুলোয়। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন তা আত্মার আত্মীয় হয়ে পড়ে। জীবনের যে পাঠ নিজেকে চিনতে শেখায়, এই অস্থির গানগুলো যেন সেদিকেই নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু কোনো এক অচেনা পথে।
সুশীল মানুষেরা একটু খেপে ওঠেন। তাঁরা বলার চেষ্টা করেন, ‘সংগীতের বারোটা বাজাচ্ছে এরা। আমাদের দেশের সংগীতের খোলনলচে পাল্টে দেওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়!’
ধন্য হই এ কথা ভেবে যে, এই ধরনের সমালোচনায় পিছিয়ে যাননি তাঁরা। আমরা যেন এলভিস প্রিসলির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বিটলস হয়ে সংগীতের একটা খোলা ময়দান পেয়ে যাই ঢাকা শহরেই। ‘উচ্চারণ’ নামে নিজের দল গড়লেন আজম খান, আর আমরা দেখতে পেলাম গড়ে উঠেছে স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী—আমাদেরই নিউ ইস্কাটনে। বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। এ ব্যান্ড দলটি গড়ে তোলার মূল কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু–পুত্র শেখ কামাল।
চার.
স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর বাড়িটা এখনো চোখে ভাসে। দোতলা বাড়ি। বাইরে ছোট একটা সাইনবোর্ড—স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী। মৌচাক মার্কেটের কাছে সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকে যখন হেঁটে হেঁটে নিউ ইস্কাটনের বাড়িতে ফিরতাম, তখনই গিটার কিংবা বঙ্গ বা কঙ্গোর আওয়াজ শুনতে পেতাম। খুব লোভ হতো একবার সেখানে গিয়ে মহড়া শুনে আসতে। সাহসে কুলাত না। জানতাম, এখানেই আসেন ফিরোজ সাঁই, আর ফেরদৌস ওয়াহিদ। লাকী আকান্দ আর হ্যাপী আকান্দকে তখনো সেভাবে চিনতাম না। অনেক পরে লাকি ভাই একদিন ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমাকে কত কোলে নিয়ে বেড়িয়েছি, তোমার মনে নাই?’
আর আজম খান? আজম ভাই তো আমাদের স্কুলের ছাত্র! আমরা আট ভাই সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকেই পাস করেছি এসএসসি, আজম ভাইও সে স্কুল থেকেই পেয়েছিলেন এসএসসির সনদ।
পাঁচ.
বাংলাদেশ টেলিভিশনে আজম খানের ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ গানটিই বোধ হয় জনপ্রিয়তায় আকাশ ছোঁয়। এর পর পপ গানের জয়জয়কার আর ঠেকানো যায়নি।
এখানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নামটি আসবে অবধারিতভাবেই। তিনি আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ, আর ফকির আলমগীরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন টিভি–দর্শকদের। কনসার্টগুলো জনপ্রিয় হচ্ছিল, কিন্তু টেলিভিশনের কল্যাণে তাঁরা হয়ে উঠলেন দেশের তারকা শিল্পী। গানের জগতে এত জনপ্রিয়তা বোধ হয় তাঁরাই প্রথম পেয়েছিলেন।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘সপ্তবর্ণা’ অনুষ্ঠানে কিংবা ঈদের আনন্দমেলায় এই শিল্পীদের দেখা যেত। মনে আছে, একবার ‘অন্তক্ষরী’রও আয়োজন করেছিলেন তিনি। যে শব্দ দিয়ে একটা গান শেষ করবে এক পক্ষ, অন্য পক্ষ সেই শব্দ অথবা শব্দের শেষ অক্ষর দিয়ে শুরু করবে নতুন গান। হয়তো আগে থেকেই স্ক্রিপ্ট করা থাকত, কিন্তু আমরা যারা সে অনুষ্ঠান দেখতাম, তাদের মন আনন্দে ভরে যেত।
ছয়.
ফিরোজ সাঁই মূলত লোকগানকে পপ সংগীতে পরিণত করে গাইতেন। ‘ইশকুল খুইলাছেরে মওলা’, ‘মন তুই চিনলিনারে’, ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা’ ইত্যাদি গানগুলো তখন ছিল তরুণদের মুখে মুখে। পিলু মমতাজের ‘একদিন তো চলে যাব’ গানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘নানি গো নানি’ গানটিও কি প্রথম তিনি গেয়েছিলেন? মনে করতে পারছি না। ফেরদৌস ওয়াহিদ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ‘এমন একটা মা দেনা’ গানটি দিয়ে। তবে তাঁর ‘পাপী আমি তা তো জানি’, ‘স্মৃতির সেই পথে আজও’, ‘পাগলার মন নাচাইয়া’ গানগুলোও জনপ্রিয় হয়েছিল।
থাকলেন ফকির আলমগীর। যদি ভুল করে না থাকি, তাহলে বলতে হবে ‘কে দিলো জ্বালা এ বলো’ গানটি দিয়েই তাঁকে চিনেছিলাম। আর ‘কামেলিরা কাম করিয়া কোথায় জানি লুকাইসে ’ গানটি গেয়ে তিনি পাগল করে তুলেছিলেন একটি প্রজন্মকে।
ষাটের দশকে তাঁরা কোন রাজনীতি করতেন, কোন গান করতেন, সে কথায় গেলাম না। কারণ, আমরা আসলে স্বাধীনতা–উত্তর পপ সংগীতের সেই সোনালি সময়টা নিয়েই কথা বলতে চাইছি।
সাত.
‘সখিনা’র গানগুলো আরও অনেক পরের। আফ্রিকা বা রাজনীতিবিষয়ক গান গেয়েছেন তিনি। পয়লা মে আসবে, অথচ ফকির আলমগীরের কণ্ঠে ‘জন হেনরির’ গান শোনো যাবে না, এ তো অবিশ্বাস্য কথা। নানা ধরনের গানের মধ্য দিয়ে ফকির আলমগীর তাঁর সংগীতযাত্রা চালিয়ে গেছেন। আর আমরা এ কথাও জেনে গেছি, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে শব্দসৈনিক হিসেবে তিনি কাল কাটিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। দেশাত্মবোধক গান ও গণসংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণের একটি বড় কারণ তাঁর দেশপ্রেমিক মনটি—এ কথা বললে কিছু বাড়িয়ে বলা হয় না।
আট.
ফকির ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম পারিবারিকভাবেই। হঠাৎ জানা গেল, তিনি আমাদের মায়ের দেশের লোক। ফরিদপুরের ভাঙ্গার মানুষ। আমার প্রয়াত মামাতো ভাই এম এম শাহরিয়ার রুমীর সঙ্গে তাঁর খুব যোগাযোগ। সেই থেকে তিনি তো একেবারে আপন করে নিলেন আমাদের। দেখা হতে থাকল নানা জায়গায়। আমার আগের কর্মস্থলেও তিনি আসতেন। যেহেতু বিনোদন সাংবাদিকতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, তাই মূলত মে–মাসের এক তারিখে তাঁর একটা সাক্ষাৎকার যেন ছাপা হয়, সে অনুরোধ করতেন। নানা কারণে সব সময় সে অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি, তবে কখনো কখনো রাখতে পেরেছি বলে ভালো লাগছে।
আরেকটা ঘটনা না বললেই নয়। যেবার ভূপেন হাজারিকা এসেছিলেন গান করতে, সেবার আমার সদ্যপ্রয়াত মেজ ভাই শাহীন রেজা নূরের সঙ্গে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে গিয়েছিলাম। শাহীন ভাই তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। হঠাৎ করিডরে চিৎকার–চ্যাঁচামেচি। ভূপেন হাজারিকার অনুরোধ ছিল একসঙ্গে অনেক অতিথি নয়, তাই ফকির আলমগীরকে করিডরেই থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফকির ভাই চিৎকার করে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তিনিও ভূপেনের মতোই একজন গণসংগীত শিল্পী!
শাহীন ভাইয়ের মধ্যস্থতায় ফকির আলমগীর এলেন। তারপর ভূপেনের একেবারে নাক বরাবর দাঁড়িয়ে গাইলেন—
‘বিপ্লব বিপ্লব, সামাজিক বিপ্লব’
ভূপেন তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই দৃশ্য এখনো আমার মনে গাঢ় হয়ে আছে।
নয়.
উচ্চারণ, স্পন্দন, ঋষিজ—ব্যান্ড সংগীতের বেড়ে ওঠা এই শিল্পীদের হাত ধরেই। তারপর একের পর এক ব্যান্ডের জন্ম হতে থাকে। অনেকেই আসতে থাকেন এই ধারায়। অনেকেই তরুণদের মন কেড়ে নেন। আর আমরা এই নতুনদের মেনে নিয়েও ফিরে যাই তাঁদের কাছে। পুরোনো গানগুলো শুনলে বুঝতে পারি, এ গানগুলোই আমাদের শৈশব আর কৈশোর গড়ে দিয়েছে, আমাদের তৈরি করেছে যৌবনের দিনগুলোর জন্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভাবনাজগতে যখন অবিশ্বাসের চারা থেকে বেড়ে উঠছে গাছ, তখনই বিট আন্দোলন, হিপি আন্দোলন, হাংরি জেনারেশন আন্দোলন নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। তবে ইউরোপই সবচেয়ে বেশি দোলা খেয়েছিল তাতে। জীবনের অর্থ খোঁজার জন্য তখন এমন সব সেবন শুরু হলো, যা লৌকিকতার মধ্যেই অলৌকিকের সন্ধান দেয়। নেশা আর সংগীতের কেমন যেন যূথবন্ধন তৈরি হলো। ইউরোপ এখনো সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
তার ছোঁয়া এসে লেগেছিল আমাদের দেশেও। সে অন্য ইতিহাস। তবে গণসংগীত, লোকসংগীত আর পপ সংগীতের গলিত–মিলিত–স্রোতোধারায় প্রাণ পেয়েছিল এই নতুন ধারা। টিকেও গেল সেই প্রাণশক্তির বলেই।
দশ.
২০১৮ সালের বইমেলায় বাংলা একাডেমি অংশে ফকির ভাই আমাকে পাকড়াও করলেন একদিন। বললেন, ‘মোবাইলের ক্যামেরা অন করো। আমি কিছু কথা বলব।’
প্রায় ১০ মিনিট একনাগাড়ে কথা বললেন তিনি। আমি এখন সে ভিডিওটি খুঁজছি। বইমেলায় তাড়াহুড়ার মধ্যে তিনি কী নিয়ে কথা বলেছিলেন, সেটা এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে কোনো হার্ডড্রাইভে নিশ্চয়ই খুঁজতে খুঁজতে একদিন সেটা পেয়ে যাব। আর তখন আবার জীবন্ত হয়ে উঠবেন ফকির আলমগীর।
আরও পড়ুন
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
২ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
২ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
২ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে