বিভুরঞ্জন সরকার
ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব ভীরু বা ভিতু প্রকৃতির মানুষ। সাহস বলতে যা বোঝায়, তা আমার মোটেও নেই। আমার বেশি ভয় পুলিশে। স্কুলজীবনে আমার অন্তত চারজন বন্ধু এবং একজন বান্ধবীর বাবা ছিলেন থানার বড় কর্তা। আমরা তখন বলতাম দারোগা, ওসি। আমি তাদের বাসায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে থাকতাম। বান্ধবীটি দেখতে সুন্দরী ছিলেন। তার ওপর সেই সময়ে (১৯৬৬-৬৭ সাল) সাইকেল চালিয়ে বাজারে ঘুরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। তো, আমি ওই সুন্দরী বান্ধবীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অন্যদের কাছে ওর রূপের প্রশংসা শুনেছি। আমার শুধু ভয় হতো, রীনার (ওই বান্ধবীর নাম) দিকে তাকানোর অপরাধে যদি ওর দারোগা বাবা আমার চোখ তুলে নেন!
ভয়ের কারণে আমি কত কিছু থেকে যে বঞ্চিত হয়েছি! এখনো সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি বলে তেমন কোনো সাহসী লেখা লিখতে পারি না। কেউ কেউ আমাকে বলেন ওমুক দলের ‘দালাল’। দালাল শুনতে আমার খুব খারাপ লাগে। আমার খুব ইচ্ছে করে ‘দালাল’ হতে। দালালদের নাকি ভাগ্য খুলে যায়! আমারও মন চায় আমার ভাগ্যটা একটু খুলুক! সাহসের অভাবে ভাগ্য আর খোলে না। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, কই আপনার লেখা পড়ে আপনাকে তো তত ভীরু বলে মনে হয় না! তাঁরা কি করে জানবেন, ক্ষমতাবানদের সামনে যাওয়ার ভয়ে আমি কত কায়দা করে দূরে দূরে থাকি!
হ্যাঁ, আমি এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনার মতো সরকার প্রধানদের নিয়ে কিছু কিছু লিখে থাকি। তাতে সবটাই নিন্দা-সমালোচনা থাকে তা নয়। দু–চারটে প্রশংসাবাক্যও থাকে। এসব সাহসের কারণে নয়। লোভের কারণে। লোভ? হ্যাঁ, শুনেছি, কোনো কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে নাকি সরকার প্রধানদের খুব ভালো সম্পর্ক। আমার মনে একটি ক্ষীণ আশা কাজ করে—আমার কোনো লেখা পড়ে এই পর্যায়ের কেউ যদি আমাকে ডেকে একটু ‘দয়া’ দেখাতেন!
কী দুর্ভাগ্য দেখেন, আমি সম্ভবত কয়েক হাজার রাজনৈতিক লেখা লিখেছি, কিন্তু এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা কারওই মনোযোগ সেভাবে আকর্ষণ করতে পারিনি। এরশাদ সাহেব তো আরেকবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখে দেখে পৃথিবী থেকেই চির বিদায় নিয়েছেন। খালেদা জিয়াও আবার ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনা মনে পোষণ করেন। কিন্তু ক্ষমতার পথ তাঁর কাছ থেকে কেবলই দূরে সরে যাচ্ছে!
একেবারে কারও মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারিনি বললে ভুল বলা হবে। একটি ঘটনা বলি। তখন আমি সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে কাজ করি। খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনকাল। ইলিয়াস আলী নামের এক ডাকসাইটে ছাত্রদল নেতার চাঁদাবাজিসহ অন্য বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল যায়যায়দিনে। তখন কাকরাইলে যায়যায়দিন অফিস। একদিন সন্ধ্যায় একটি মাইক্রোবাসে করে কয়েকজন সশস্ত্র যুবক এলেন। অফিসে ঢুকে নাম-পরিচয় জেনে আমাকে টেনেহিঁচড়ে মাইক্রোতে তোলার চেষ্টা শুরু হলো। আমার তো ভয়ে কাপড় নষ্ট হওয়ার জোগাড়।
মাত্র কিছুদিন আগে বিয়ে করেছি। একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে। স্ত্রী-কন্যার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি মিনমিনে গলায় বললাম, ‘ভাই, আপনারা কারা? আমার দোষই–বা কী?’ বাজখাই গলায় একজন বলে উঠলেন, ‘আমার নাম ইলিয়াস আলী। আমার নাম শুনলে এখন বাংলাদেশে ডরায় না এমন কোনো হালার পুত আছে? তুই ব্যাটা নাম ভাঁড়াইয়া আমার বিরুদ্ধে নিউজ লেখস। আজ শালা তোর শেষ দিন।’ শেষ দিন শুনে আমি চোখ বুঁজে চুপ হয়ে গেলাম আর অপেক্ষা করতে থাকলাম, একটি গুলির শব্দের। না, সময় গড়ায়। গুলির শব্দ শুনি না।
কেউ একজন বলেন, ‘বস, এই হালা তো এমনিতেই মুইতা দিছে। ওরে মাইরা আপনার সুনাম নষ্ট করার দরকার কী?’ মহাপ্রাণ, সহৃদয় এবং অতি দয়ালু ইলিয়াস আলী তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, ‘ঠিক কইছস, মশা মাইরা হাত নষ্ট করার কাম নাই।’ তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে (তখন আমি এমন ‘টাকু’ ছিলাম না, মাথাভর্তি চুল ছিল) বসিয়ে দুই গালে কষে দুই থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘শালার পুত, ইলিয়াস আলীর নামে যদি আর কোনো কিছু লেখার সাহস দেখাস, তাহলে তোর লাশ চিতায় উঠব।’ তারপর তাঁরা বীরদর্পে মাইক্রোতে চড়ে চলে গেলেন।
আমার বুকের সেই ধুকপুকানি এখনো আছে। কেবল ইলিয়াস আলীকেই যেন কারা বেপাত্তা করে দিলেন! আহা, বেচারা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর দয়ায়ই তো আমি এখনো দু–চার লাইন লিখে সংসার চালাতে পারছি!
আমি যে একটা ভিতুর ডিম, তার আরও অনেক উদাহরণ-প্রমাণ আমি দিতে পারব। স্কুল জীবনের বন্ধুদের মধ্যে যারা এখনো জীবিত, তাঁরা আমার ভয়ের নানা ভয়ংকর গল্প এখনো মনে করতে পারবেন। কত কিছু নিয়ে যে আমি ভয় পেতাম! বাড়ি থেকে বন্ধুদের সঙ্গে দূরে কোথাও যেতাম না; যদি হারিয়ে যাই! পানিতে নেমে গোসল করতাম না, যদি ডুবে যাই। সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতাম না, যদি ‘ছলাকলা’ করে আমাকে ‘নষ্ট’ করে দেয়! গল্প-উপন্যাস পড়তাম না, যদি প্রেমের সংলাপ শিখে ফেলি! মাথায় তেল দিতাম না, যদি তেলতেলা স্বভাব হয়ে যায়। পেটপুরে খেতাম না, যদি চেহারাটা নাদুসনুদুস হয়। জীবনে কোনো দিন ফুটবলে লাথি মারিনি, যদি পায়ে ব্যথা পাই! কত ভয়ের কথা আর বলব!
কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। আমি ভয় বেশি পাই বলে ভয়ও সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু চলতে পছন্দ করে। আমি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ায় কেউ কেউ মনে করেছিলেন, এই নির্বিরোধ পেশায় আমি বুঝি ভালোই করব। এখানে ভয়ডর নিয়ে তটস্থ থাকতে হবে না। ও মা, সাংবাদিকের খাতায় নাম লিখিয়ে শুনি, এ পেশায় নাকি পদে পদে বিপদ, ঝুঁকি। একজন ভালো সাংবাদিকের নাকি কোনো বন্ধু থাকে না। তো, ঠিক করলাম, নিকুচি করি সৎ সাংবাদিকতার! আমি খারাপ সাংবাদিকই হব; আর বন্ধুহীন থাকব না।
কিন্তু ভয়ের ভয়ে আমি ভালো থাকতে চাইলে কী হবে, ভয় যে আমাকে ছাড়তেই চায় না। যতই হ্যাপামুক্ত থাকতে চাই, ততই হ্যাপা আমাকে জড়িয়ে ধরে! তখন ১৯৯৬ সাল। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। আমরা বেজায় খুশি। এত দিন পর বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। আমি যায়যায়দিন ছেড়ে নিজেই প্রকাশক-সম্পাদক হয়ে ‘চলতিপত্র’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করলাম। চলতিপত্রের এক সংখ্যায় ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাস-মাস্তানি নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হলো। প্রতিবেদনটি ছিল তথ্যবহুল এবং একেবারেই পক্ষপাতমুক্ত।
পত্রিকার ওই সংখ্যা বাজারে যাওয়ার পরদিন আমি বিকেলের দিকে অফিসে বসে আছি, পুরানা পল্টন মোড়ে বাসস-এর নিচের দিকে ছিল চলতিপত্র অফিস। বিকেলে আর তেমন কেউ অফিসে ছিলেন না। আট–দশজন তরুণ অফিসে ঢুকলেন। বেশ আদবের সঙ্গে আমাকে সালাম দিলেন। আমার শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। বললেন, তাঁরা আমার ভক্ত, পরিচিত হতে এসেছেন। আমি মনে মনে একটু পুলকিত হলাম। আমাদের ছাত্রকর্মীরা পড়াশোনা করছে জেনে ভালো লাগল। ওদের চা খেতে বললাম। রাজি হলেন না। একজন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আজ থাক দাদা, আপনার সঙ্গে আবার হয়তো দেখা হবে। করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমার নাম পিচ্চি শামিম। আমি ছাত্রলীগের নেতা। আপনার পত্রিকায় যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, তাতে আমাকে ভয়াবহ সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে!’
আমার শরীর শীতল হয়ে উঠল। তলপেটে চাপ অনুভব করলাম। ওর হাত তখনো আমার হাত চেপে ধরে আছে, ছাড়াতে পারছি না। মুখ দিয়ে আমার কোনো কথাও বের হচ্ছে না। এবার শামিমের হাত পকেটে ঢুকল। বেরিয়ে এল একটি পিস্তল। আমার ডান কান বরাবর মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, ‘দাদা ট্রিগার টিপলে কোনো শব্দ হবে না। আপনার নিথর দেহটা শুধু চেয়ারে বসে থাকবে। বৌদি বিধবা হবে। মেয়েটা এতিম হবে।’
আমি বাকরহিত। ইস, কেন যে সাংবাদিক হতে গেলাম! জীবনের শেষ মুহূর্ত ভেবে ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম। যদিও সাবেক কমিউনিস্ট হিসেবে তখন আমার ঈশ্বর বিশ্বাস প্রবল নয়। কয়েক মুহূর্ত কেটেছে বলতে পারব না। শামিম তাঁর অস্ত্রটি পকেটে ঢুকিয়ে সঙ্গীদের বললেন, ‘আজ দাদাকে একটু ভয়ডোজ দিলাম। আবার আমার নাম প্রতিবেদনে এলে বৌদির সাদা কাপড় আমিই পৌঁছে দিয়ে আসব।’ তারপর হাত তুলে সালাম দিয়ে চলে গেলেন মূর্তিমান আতঙ্ক পিচ্চি শামিম।
আমি ভাবলাম, কত বড় মনের মানুষ তিনি। সুযোগ পেয়েও আমার মাথা ফুটো করলেন না। এমন অসাধারণ দয়াবান মানুষ নিয়ে কী সব বাজে কেচ্ছা আমরা পত্রিকায় ছাপি! নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিলাম!
এই ঘটনার মাস তিনেকের মধ্যেই প্রতিপক্ষের গুলিতে প্রাণ হারান পিচ্চি শামিম। তার অমন করুণ মৃত্যুসংবাদ শুনে আমার চোখ গড়িয়ে দুফোঁটা পানি পড়েছিল। আহারে! মানুষের জীবন কত অনিত্য! জনমভিতু আমি এখনো বেঁচে আছি, অথচ নেই একসময়ের অতি সাহসী, বয়সে আমার চেয়ে ছোট অনেকের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক পিচ্চি শামিম। মাঝে মাঝে অতীতের কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয়, আমার এখন আর কিছুতেই ভয় পাওয়া উচিত নয়। আসলে ভয় করলেই ভয়, না করলে কিচ্ছু নয়।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব ভীরু বা ভিতু প্রকৃতির মানুষ। সাহস বলতে যা বোঝায়, তা আমার মোটেও নেই। আমার বেশি ভয় পুলিশে। স্কুলজীবনে আমার অন্তত চারজন বন্ধু এবং একজন বান্ধবীর বাবা ছিলেন থানার বড় কর্তা। আমরা তখন বলতাম দারোগা, ওসি। আমি তাদের বাসায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে থাকতাম। বান্ধবীটি দেখতে সুন্দরী ছিলেন। তার ওপর সেই সময়ে (১৯৬৬-৬৭ সাল) সাইকেল চালিয়ে বাজারে ঘুরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। তো, আমি ওই সুন্দরী বান্ধবীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অন্যদের কাছে ওর রূপের প্রশংসা শুনেছি। আমার শুধু ভয় হতো, রীনার (ওই বান্ধবীর নাম) দিকে তাকানোর অপরাধে যদি ওর দারোগা বাবা আমার চোখ তুলে নেন!
ভয়ের কারণে আমি কত কিছু থেকে যে বঞ্চিত হয়েছি! এখনো সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি বলে তেমন কোনো সাহসী লেখা লিখতে পারি না। কেউ কেউ আমাকে বলেন ওমুক দলের ‘দালাল’। দালাল শুনতে আমার খুব খারাপ লাগে। আমার খুব ইচ্ছে করে ‘দালাল’ হতে। দালালদের নাকি ভাগ্য খুলে যায়! আমারও মন চায় আমার ভাগ্যটা একটু খুলুক! সাহসের অভাবে ভাগ্য আর খোলে না। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, কই আপনার লেখা পড়ে আপনাকে তো তত ভীরু বলে মনে হয় না! তাঁরা কি করে জানবেন, ক্ষমতাবানদের সামনে যাওয়ার ভয়ে আমি কত কায়দা করে দূরে দূরে থাকি!
হ্যাঁ, আমি এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনার মতো সরকার প্রধানদের নিয়ে কিছু কিছু লিখে থাকি। তাতে সবটাই নিন্দা-সমালোচনা থাকে তা নয়। দু–চারটে প্রশংসাবাক্যও থাকে। এসব সাহসের কারণে নয়। লোভের কারণে। লোভ? হ্যাঁ, শুনেছি, কোনো কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে নাকি সরকার প্রধানদের খুব ভালো সম্পর্ক। আমার মনে একটি ক্ষীণ আশা কাজ করে—আমার কোনো লেখা পড়ে এই পর্যায়ের কেউ যদি আমাকে ডেকে একটু ‘দয়া’ দেখাতেন!
কী দুর্ভাগ্য দেখেন, আমি সম্ভবত কয়েক হাজার রাজনৈতিক লেখা লিখেছি, কিন্তু এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা কারওই মনোযোগ সেভাবে আকর্ষণ করতে পারিনি। এরশাদ সাহেব তো আরেকবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখে দেখে পৃথিবী থেকেই চির বিদায় নিয়েছেন। খালেদা জিয়াও আবার ক্ষমতায় যাওয়ার বাসনা মনে পোষণ করেন। কিন্তু ক্ষমতার পথ তাঁর কাছ থেকে কেবলই দূরে সরে যাচ্ছে!
একেবারে কারও মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারিনি বললে ভুল বলা হবে। একটি ঘটনা বলি। তখন আমি সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে কাজ করি। খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনকাল। ইলিয়াস আলী নামের এক ডাকসাইটে ছাত্রদল নেতার চাঁদাবাজিসহ অন্য বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল যায়যায়দিনে। তখন কাকরাইলে যায়যায়দিন অফিস। একদিন সন্ধ্যায় একটি মাইক্রোবাসে করে কয়েকজন সশস্ত্র যুবক এলেন। অফিসে ঢুকে নাম-পরিচয় জেনে আমাকে টেনেহিঁচড়ে মাইক্রোতে তোলার চেষ্টা শুরু হলো। আমার তো ভয়ে কাপড় নষ্ট হওয়ার জোগাড়।
মাত্র কিছুদিন আগে বিয়ে করেছি। একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে। স্ত্রী-কন্যার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি মিনমিনে গলায় বললাম, ‘ভাই, আপনারা কারা? আমার দোষই–বা কী?’ বাজখাই গলায় একজন বলে উঠলেন, ‘আমার নাম ইলিয়াস আলী। আমার নাম শুনলে এখন বাংলাদেশে ডরায় না এমন কোনো হালার পুত আছে? তুই ব্যাটা নাম ভাঁড়াইয়া আমার বিরুদ্ধে নিউজ লেখস। আজ শালা তোর শেষ দিন।’ শেষ দিন শুনে আমি চোখ বুঁজে চুপ হয়ে গেলাম আর অপেক্ষা করতে থাকলাম, একটি গুলির শব্দের। না, সময় গড়ায়। গুলির শব্দ শুনি না।
কেউ একজন বলেন, ‘বস, এই হালা তো এমনিতেই মুইতা দিছে। ওরে মাইরা আপনার সুনাম নষ্ট করার দরকার কী?’ মহাপ্রাণ, সহৃদয় এবং অতি দয়ালু ইলিয়াস আলী তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, ‘ঠিক কইছস, মশা মাইরা হাত নষ্ট করার কাম নাই।’ তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে (তখন আমি এমন ‘টাকু’ ছিলাম না, মাথাভর্তি চুল ছিল) বসিয়ে দুই গালে কষে দুই থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘শালার পুত, ইলিয়াস আলীর নামে যদি আর কোনো কিছু লেখার সাহস দেখাস, তাহলে তোর লাশ চিতায় উঠব।’ তারপর তাঁরা বীরদর্পে মাইক্রোতে চড়ে চলে গেলেন।
আমার বুকের সেই ধুকপুকানি এখনো আছে। কেবল ইলিয়াস আলীকেই যেন কারা বেপাত্তা করে দিলেন! আহা, বেচারা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর দয়ায়ই তো আমি এখনো দু–চার লাইন লিখে সংসার চালাতে পারছি!
আমি যে একটা ভিতুর ডিম, তার আরও অনেক উদাহরণ-প্রমাণ আমি দিতে পারব। স্কুল জীবনের বন্ধুদের মধ্যে যারা এখনো জীবিত, তাঁরা আমার ভয়ের নানা ভয়ংকর গল্প এখনো মনে করতে পারবেন। কত কিছু নিয়ে যে আমি ভয় পেতাম! বাড়ি থেকে বন্ধুদের সঙ্গে দূরে কোথাও যেতাম না; যদি হারিয়ে যাই! পানিতে নেমে গোসল করতাম না, যদি ডুবে যাই। সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতাম না, যদি ‘ছলাকলা’ করে আমাকে ‘নষ্ট’ করে দেয়! গল্প-উপন্যাস পড়তাম না, যদি প্রেমের সংলাপ শিখে ফেলি! মাথায় তেল দিতাম না, যদি তেলতেলা স্বভাব হয়ে যায়। পেটপুরে খেতাম না, যদি চেহারাটা নাদুসনুদুস হয়। জীবনে কোনো দিন ফুটবলে লাথি মারিনি, যদি পায়ে ব্যথা পাই! কত ভয়ের কথা আর বলব!
কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। আমি ভয় বেশি পাই বলে ভয়ও সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু চলতে পছন্দ করে। আমি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ায় কেউ কেউ মনে করেছিলেন, এই নির্বিরোধ পেশায় আমি বুঝি ভালোই করব। এখানে ভয়ডর নিয়ে তটস্থ থাকতে হবে না। ও মা, সাংবাদিকের খাতায় নাম লিখিয়ে শুনি, এ পেশায় নাকি পদে পদে বিপদ, ঝুঁকি। একজন ভালো সাংবাদিকের নাকি কোনো বন্ধু থাকে না। তো, ঠিক করলাম, নিকুচি করি সৎ সাংবাদিকতার! আমি খারাপ সাংবাদিকই হব; আর বন্ধুহীন থাকব না।
কিন্তু ভয়ের ভয়ে আমি ভালো থাকতে চাইলে কী হবে, ভয় যে আমাকে ছাড়তেই চায় না। যতই হ্যাপামুক্ত থাকতে চাই, ততই হ্যাপা আমাকে জড়িয়ে ধরে! তখন ১৯৯৬ সাল। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। আমরা বেজায় খুশি। এত দিন পর বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। আমি যায়যায়দিন ছেড়ে নিজেই প্রকাশক-সম্পাদক হয়ে ‘চলতিপত্র’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করলাম। চলতিপত্রের এক সংখ্যায় ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাস-মাস্তানি নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হলো। প্রতিবেদনটি ছিল তথ্যবহুল এবং একেবারেই পক্ষপাতমুক্ত।
পত্রিকার ওই সংখ্যা বাজারে যাওয়ার পরদিন আমি বিকেলের দিকে অফিসে বসে আছি, পুরানা পল্টন মোড়ে বাসস-এর নিচের দিকে ছিল চলতিপত্র অফিস। বিকেলে আর তেমন কেউ অফিসে ছিলেন না। আট–দশজন তরুণ অফিসে ঢুকলেন। বেশ আদবের সঙ্গে আমাকে সালাম দিলেন। আমার শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। বললেন, তাঁরা আমার ভক্ত, পরিচিত হতে এসেছেন। আমি মনে মনে একটু পুলকিত হলাম। আমাদের ছাত্রকর্মীরা পড়াশোনা করছে জেনে ভালো লাগল। ওদের চা খেতে বললাম। রাজি হলেন না। একজন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আজ থাক দাদা, আপনার সঙ্গে আবার হয়তো দেখা হবে। করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমার নাম পিচ্চি শামিম। আমি ছাত্রলীগের নেতা। আপনার পত্রিকায় যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, তাতে আমাকে ভয়াবহ সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে!’
আমার শরীর শীতল হয়ে উঠল। তলপেটে চাপ অনুভব করলাম। ওর হাত তখনো আমার হাত চেপে ধরে আছে, ছাড়াতে পারছি না। মুখ দিয়ে আমার কোনো কথাও বের হচ্ছে না। এবার শামিমের হাত পকেটে ঢুকল। বেরিয়ে এল একটি পিস্তল। আমার ডান কান বরাবর মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, ‘দাদা ট্রিগার টিপলে কোনো শব্দ হবে না। আপনার নিথর দেহটা শুধু চেয়ারে বসে থাকবে। বৌদি বিধবা হবে। মেয়েটা এতিম হবে।’
আমি বাকরহিত। ইস, কেন যে সাংবাদিক হতে গেলাম! জীবনের শেষ মুহূর্ত ভেবে ঈশ্বরকে স্মরণ করলাম। যদিও সাবেক কমিউনিস্ট হিসেবে তখন আমার ঈশ্বর বিশ্বাস প্রবল নয়। কয়েক মুহূর্ত কেটেছে বলতে পারব না। শামিম তাঁর অস্ত্রটি পকেটে ঢুকিয়ে সঙ্গীদের বললেন, ‘আজ দাদাকে একটু ভয়ডোজ দিলাম। আবার আমার নাম প্রতিবেদনে এলে বৌদির সাদা কাপড় আমিই পৌঁছে দিয়ে আসব।’ তারপর হাত তুলে সালাম দিয়ে চলে গেলেন মূর্তিমান আতঙ্ক পিচ্চি শামিম।
আমি ভাবলাম, কত বড় মনের মানুষ তিনি। সুযোগ পেয়েও আমার মাথা ফুটো করলেন না। এমন অসাধারণ দয়াবান মানুষ নিয়ে কী সব বাজে কেচ্ছা আমরা পত্রিকায় ছাপি! নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিলাম!
এই ঘটনার মাস তিনেকের মধ্যেই প্রতিপক্ষের গুলিতে প্রাণ হারান পিচ্চি শামিম। তার অমন করুণ মৃত্যুসংবাদ শুনে আমার চোখ গড়িয়ে দুফোঁটা পানি পড়েছিল। আহারে! মানুষের জীবন কত অনিত্য! জনমভিতু আমি এখনো বেঁচে আছি, অথচ নেই একসময়ের অতি সাহসী, বয়সে আমার চেয়ে ছোট অনেকের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক পিচ্চি শামিম। মাঝে মাঝে অতীতের কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয়, আমার এখন আর কিছুতেই ভয় পাওয়া উচিত নয়। আসলে ভয় করলেই ভয়, না করলে কিচ্ছু নয়।
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
২ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
২ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
২ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে