বদিউদ্দিন নাজির
চীনারা তাদের প্রযুক্তি ও প্রকৌশলী দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রায় শেষ করে এনেছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল কেটে রাস্তা তৈরি করছে। সেখানে তাদের আর্থিক সহায়তাও আছে। শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীজুড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তারা অর্থসহায়তা ও নানা উন্নয়নমূলক কাজে লিপ্ত আছে। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে। সামরিক শক্তিতেও কারও থেকে কম যাচ্ছে না। তারা মহাকাশ অভিযানে নেমেছে।
তার পরও টেলিভিশনের বদৌলতে যে ঝকঝকে-তকতকে চীনের ছবি দেখি, চীনফেরত মানুষের মুখে যে উন্নয়নের কথা শুনি, তখন ভাবি, কীভাবে এটা সম্ভব হলো! কোন জাদু-স্পর্শে এশিয়া মহাদেশের পশ্চাৎপদ এই দেশ এভারেস্ট শৃঙ্গের মতো সবাইকে ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, আমার কাছে তার হিসাব মেলে না।
১৯৮৮ সালের মার্চে ইউনেসকো আয়োজিত এক ওয়ার্কশপে প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য বেইজিংয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। পশ্চিমা মিডিয়ার ভাষায় তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ম্যাসাকারের আগের বছর। তখন চীন একটু একটু করে বিদেশিদের কাছে উন্মুক্ত হচ্ছিল। বাইরের বিশ্ব থেকে সেদেশে যাতায়াত ছিল কম। ব্যাংকক থেকে সপ্তাহের সব দিন ফ্লাইট ছিল না। ব্যাংককে এক রাত কাটিয়ে চীনা এয়ারলাইনসের যে বোয়িংয়ে চড়েছিলাম, তাতে ক্যাপাসিটির এক-তৃতীয়াংশের কম যাত্রী ছিল। এত অল্প যাত্রী নিয়ে একটা রুট কীভাবে চলে ভেবেছি; কিন্তু বিমানটি চীনের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা বিমানবন্দরে বিরতি নিতেই স্থানীয় যাত্রীতে সব সিট পূর্ণ হতেই সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। কিন্তু যাত্রীদের আমার মতোই অতিসাধারণ মানুষ মনে হয়েছে। কর্মজীবী শ্রেণির। বেইজিং সেখান থেকে ছয় ঘণ্টার পথ। নিশ্চয় সরকারি কোনো বিশেষ ব্যবস্থা আছে মনে হয়েছিল।
বেইজিংয়ে নামতেই যিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন, পরে শুনেছি ভালো ইংরেজি জানার জন্য তাঁকে এই কাজে ভিন প্রদেশ থেকে আনা হয়েছে, একজন অতি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, আমাকে নিয়ে সোজা বেইজিং হোটেলে এলেন রাতের আহারের জন্য। খাবারের টেবিলে তিনি, গাড়ির ড্রাইভার ও আমি। চীনের ঐতিহ্যবাহী খাবার, সেই সঙ্গে বেশি করে হার্ড ড্রিংসের ফরমায়েশ করলেন। খাওয়া শেষে তিনি ড্রিংসের অতিরিক্ত ক্যানগুলো ওভারকোটের ঝোলা পকেটে ঢোকালেন। বেইজিংয়ে ঢুকে এটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।
যে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে ওয়ার্কশপ, সেখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা। বাথরুমের কমোড-বেসিন থেকে যেদিকে তাকাই সবকিছুর গায়ে প্রিন্ট করা ‘ইউএস স্ট্যান্ডার্ড’। অথচ তারা তখনো ডলার চেনেনি। ফেরার পথে ব্যাংককে এক রাত থাকার ব্যয় বাবদ তারা আমার জন্য ১০০ ডলার জোগাড় করতে পারেনি। শেষমেশ ইউনেসকোর প্রতিনিধি নিজের পকেট থেকে ১০০ ডলার আমাকে দিলে আয়োজকদের মুশকিল আসান হয়।
বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের যেসব জায়গায় নেওয়া হয়, ওয়ার্কশপের বিদেশি অংশগ্রহণকারীদের তার সবখানে নেওয়া হয়, আর আমার ব্যাংককে যাওয়ার ফ্লাইট তিন দিন পরে ছিল বলে আমি বেড়ানোর বাড়তি সুবিধাও পাই। গ্রেট ওয়ালে যাওয়ার পথে হাইওয়ের পাশের লেন দিয়ে ইঞ্জিন কম্বলে মোড়ানো পুরোনো আমলের ট্রাককে ধোঁয়া তুলে ধুকধুক করে চলতে দেখেছি। তাদের জাতীয় গর্ব অ্যাক্রোবেটিক এক্সিবিশন দেখতে পুরোনো বেইজিং শহরে থিয়েটারে গিয়েছি। সেই স্থাপনা, স্টেজ এবং অ্যাক্রোবেটদের পরিধান অত্যন্ত ম্যাড়মেড়ে ও মলিন দেখেছি। সম্ভবত তখন ওদের একমাত্র বড় সুপারশপে গিয়ে দেখেছি, সেলস পারসনরা ক্যালকুলেটর দিয়ে নয়, কাঠের তৈরি ছোট ধরনের অ্যাবাকাস দিয়ে হিসাব-নিকাশ করছে। মাওয়ের মুসোলিয়ামে যাওয়ার হাঁটাপথে বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণ আমার কাছে এসে ডলার বিক্রি করব কি না জিজ্ঞেসও করল। পুরো বেইজিং ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। কারণ, রান্নার জ্বালানি ও বিদ্যুতের জ্বালানি কয়লা। ধোঁয়ার উৎপত্তি সেখান থেকে। রাস্তায় হাজার হাজার সাইকেল। ট্রাম-কাম-বাস আছে, যদিও সংখ্যায় অল্প। সব কথা লিখলে পশ্চাৎপদতার নমুনার তালিকা বেশ দীর্ঘ হবে। সেই চীন আর আজকের এই চীন! রহস্য কোথায়? আলাদিনের চেরাগ পেল কোথা থেকে?
হঠাৎ-ই দিল্লি থেকে আমার বন্ধু ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান পাবলিশার্সের প্রেসিডেন্ট রমেশ মিত্তাল করোনাকালেই একটি বই পাঠিয়েছেন। দেখলাম বইটিতে আমার সেই জিজ্ঞাসার উত্তর রয়েছে। ইংরেজি লেখা বইয়ের বাংলা অনুবাদ। লেখক উ জিয়াওবো। বইয়ের নাম ‘চীনের উত্থান ১৯৭৮-২০০৮: কীভাবে পরিবর্তনের কথা ভেবেছিল’। বইটি লেখক চীনের সংস্কার ও উত্থানের তিরিশতম বর্ষকে উৎসর্গ করেছেন। প্রকাশক ক্রিয়েশন্স, নয়াদিল্লি (২০১৯)। মূল বইটির নাম ‘China Emerging 1978-2008: How Thinking About Business changed’ যা কিনা চায়না ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্রেস, বেইজিং, চায়না থেকে প্রকাশিত। আলোচ্য বইটি উপরোক্ত দুই প্রতিষ্ঠানের একটি যৌথ উদ্যোগ।
বইটি পড়ে আমি অভিভূত। সংস্কার চলাকালেও চীনের তত্ত্বগত দ্বন্দ্ব ও কায়েমি স্বার্থের কারণে প্রশাসন থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সংস্কারের বিরোধিতা, চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা, মূলধন সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য, ফাটকাবাজি, কিছু লোকের রাতারাতি বড়লোক হওয়া, শেয়ারবাজারের অস্থিতিশীলতা–এমন কোনো বিষয় নেই, লেখক যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেননি। উল্লেখ করতে ভোলেননি উন্নয়নের জন্য নেতাদের একরোখা ডু অর ডাই প্রচেষ্টার বিষয়টিও। বইটি যেন মহাচীন হয়ে ওঠার এক মহাকাব্যিক বর্ণনা।
বইটিতে যে পাঁচটি অধ্যায় আছে সেগুলোর উল্লেখ আমার দাবি প্রমাণ করবে: ১. আরম্ভ: ১৯৭৮-১৯৮৩; ২. মন্থন ও উত্থান-পতন: ১৯৮৪-১৯৯২; ৩. আমূল সংস্কারের স্বপ্ন: ১৯৯৩-১৯৯৭; ৪. জলাভূমি ও ল্যান্ডমাইন [প্রতিবন্ধক ও বিপদের রূপকার্থে]: ১৯৭৮-২০০২; এবং ৫. দায়িত্ব এবং যুক্তি: ২০০৩-২০০৮।
কেন বিশেষ করে এই তিরিশ বছর? লেখক ভূমিকায় বলেছেন: ‘১৯৭৮ থেকে ২০০৮–এই তিরিশ বছর চীনের দ্রুত উত্থানের সময়। এই তিন দশকে চীনের এই আকস্মিক অগ্রগতি বিশ্ব অর্থনীতির এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আজকের দিনে আমি যখন পুরোনো ছবিগুলো দেখি, আরও একবার অবাক হই চীনের পরিবর্তন দেখে–বইয়ে লেখা শব্দগুলোতে ধরে রাখা ইতিহাসের ছবিগুলো অতটাই মুখর।’
নিজেই নিজেকে বলি, এই কি সেই পুরোনো চীন? সত্যি কি আমরা এত কিছু করতে পেরেছি?
বইটি পড়েই আমি জানতে পারি, আমি চীনের সংস্কারকালীন বেইজিং গিয়েছিলাম; কিন্তু বাইরে থেকে টের পাইনি। ওই ওয়ার্কশপে চীনা অংশগ্রহণকারীরা প্রায় সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পড়া যুবক-যুবতী। তাঁদের ওই অংশগ্রহণও কি ছিল বই-খাতে সংস্কারকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভ্যানগার্ড তৈরি করার আয়োজকদের একটি প্রচেষ্টা? হবেও-বা।
আমি জানি, ব্যাপকভাবে ওই বই সংগ্রহ ও পড়ার মতো পাঠক এখন দেশে নেই। কিন্তু দরকার আছে। এত দিন আমাদের উন্নয়ন–ভাবনায় স্বনির্ভরতা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রস্তুতি, আত্ম-বিশ্লেষণ ছিল না। অপরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ারও বালাই ছিল না। আমাদের ভাবনা ভেবেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও তাদের পরামর্শকেরা। এবং তাদের কাছ থেকে কমিশন পাওয়া এনজিও মালিকেরা। এই সবে আমরা গুটি গুটি পায়ে কিছু ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা ও নিজেদের মতো করে উন্নয়নের চিন্তা করছি। বইটিতে বর্ণিত অভিজ্ঞতা এ সময় আমাদের সাহায্য করতে পারে। সে কারণে উন্নয়নকামী ও অনিসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের কাছে বইটির বার্তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি মনে করছি।
লেখক: গ্রন্থ বিশেষজ্ঞ
চীনারা তাদের প্রযুক্তি ও প্রকৌশলী দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রায় শেষ করে এনেছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল কেটে রাস্তা তৈরি করছে। সেখানে তাদের আর্থিক সহায়তাও আছে। শুধু বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীজুড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তারা অর্থসহায়তা ও নানা উন্নয়নমূলক কাজে লিপ্ত আছে। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে। সামরিক শক্তিতেও কারও থেকে কম যাচ্ছে না। তারা মহাকাশ অভিযানে নেমেছে।
তার পরও টেলিভিশনের বদৌলতে যে ঝকঝকে-তকতকে চীনের ছবি দেখি, চীনফেরত মানুষের মুখে যে উন্নয়নের কথা শুনি, তখন ভাবি, কীভাবে এটা সম্ভব হলো! কোন জাদু-স্পর্শে এশিয়া মহাদেশের পশ্চাৎপদ এই দেশ এভারেস্ট শৃঙ্গের মতো সবাইকে ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, আমার কাছে তার হিসাব মেলে না।
১৯৮৮ সালের মার্চে ইউনেসকো আয়োজিত এক ওয়ার্কশপে প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য বেইজিংয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। পশ্চিমা মিডিয়ার ভাষায় তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ম্যাসাকারের আগের বছর। তখন চীন একটু একটু করে বিদেশিদের কাছে উন্মুক্ত হচ্ছিল। বাইরের বিশ্ব থেকে সেদেশে যাতায়াত ছিল কম। ব্যাংকক থেকে সপ্তাহের সব দিন ফ্লাইট ছিল না। ব্যাংককে এক রাত কাটিয়ে চীনা এয়ারলাইনসের যে বোয়িংয়ে চড়েছিলাম, তাতে ক্যাপাসিটির এক-তৃতীয়াংশের কম যাত্রী ছিল। এত অল্প যাত্রী নিয়ে একটা রুট কীভাবে চলে ভেবেছি; কিন্তু বিমানটি চীনের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা বিমানবন্দরে বিরতি নিতেই স্থানীয় যাত্রীতে সব সিট পূর্ণ হতেই সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। কিন্তু যাত্রীদের আমার মতোই অতিসাধারণ মানুষ মনে হয়েছে। কর্মজীবী শ্রেণির। বেইজিং সেখান থেকে ছয় ঘণ্টার পথ। নিশ্চয় সরকারি কোনো বিশেষ ব্যবস্থা আছে মনে হয়েছিল।
বেইজিংয়ে নামতেই যিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন, পরে শুনেছি ভালো ইংরেজি জানার জন্য তাঁকে এই কাজে ভিন প্রদেশ থেকে আনা হয়েছে, একজন অতি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, আমাকে নিয়ে সোজা বেইজিং হোটেলে এলেন রাতের আহারের জন্য। খাবারের টেবিলে তিনি, গাড়ির ড্রাইভার ও আমি। চীনের ঐতিহ্যবাহী খাবার, সেই সঙ্গে বেশি করে হার্ড ড্রিংসের ফরমায়েশ করলেন। খাওয়া শেষে তিনি ড্রিংসের অতিরিক্ত ক্যানগুলো ওভারকোটের ঝোলা পকেটে ঢোকালেন। বেইজিংয়ে ঢুকে এটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।
যে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে ওয়ার্কশপ, সেখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা। বাথরুমের কমোড-বেসিন থেকে যেদিকে তাকাই সবকিছুর গায়ে প্রিন্ট করা ‘ইউএস স্ট্যান্ডার্ড’। অথচ তারা তখনো ডলার চেনেনি। ফেরার পথে ব্যাংককে এক রাত থাকার ব্যয় বাবদ তারা আমার জন্য ১০০ ডলার জোগাড় করতে পারেনি। শেষমেশ ইউনেসকোর প্রতিনিধি নিজের পকেট থেকে ১০০ ডলার আমাকে দিলে আয়োজকদের মুশকিল আসান হয়।
বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের যেসব জায়গায় নেওয়া হয়, ওয়ার্কশপের বিদেশি অংশগ্রহণকারীদের তার সবখানে নেওয়া হয়, আর আমার ব্যাংককে যাওয়ার ফ্লাইট তিন দিন পরে ছিল বলে আমি বেড়ানোর বাড়তি সুবিধাও পাই। গ্রেট ওয়ালে যাওয়ার পথে হাইওয়ের পাশের লেন দিয়ে ইঞ্জিন কম্বলে মোড়ানো পুরোনো আমলের ট্রাককে ধোঁয়া তুলে ধুকধুক করে চলতে দেখেছি। তাদের জাতীয় গর্ব অ্যাক্রোবেটিক এক্সিবিশন দেখতে পুরোনো বেইজিং শহরে থিয়েটারে গিয়েছি। সেই স্থাপনা, স্টেজ এবং অ্যাক্রোবেটদের পরিধান অত্যন্ত ম্যাড়মেড়ে ও মলিন দেখেছি। সম্ভবত তখন ওদের একমাত্র বড় সুপারশপে গিয়ে দেখেছি, সেলস পারসনরা ক্যালকুলেটর দিয়ে নয়, কাঠের তৈরি ছোট ধরনের অ্যাবাকাস দিয়ে হিসাব-নিকাশ করছে। মাওয়ের মুসোলিয়ামে যাওয়ার হাঁটাপথে বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণ আমার কাছে এসে ডলার বিক্রি করব কি না জিজ্ঞেসও করল। পুরো বেইজিং ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। কারণ, রান্নার জ্বালানি ও বিদ্যুতের জ্বালানি কয়লা। ধোঁয়ার উৎপত্তি সেখান থেকে। রাস্তায় হাজার হাজার সাইকেল। ট্রাম-কাম-বাস আছে, যদিও সংখ্যায় অল্প। সব কথা লিখলে পশ্চাৎপদতার নমুনার তালিকা বেশ দীর্ঘ হবে। সেই চীন আর আজকের এই চীন! রহস্য কোথায়? আলাদিনের চেরাগ পেল কোথা থেকে?
হঠাৎ-ই দিল্লি থেকে আমার বন্ধু ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান পাবলিশার্সের প্রেসিডেন্ট রমেশ মিত্তাল করোনাকালেই একটি বই পাঠিয়েছেন। দেখলাম বইটিতে আমার সেই জিজ্ঞাসার উত্তর রয়েছে। ইংরেজি লেখা বইয়ের বাংলা অনুবাদ। লেখক উ জিয়াওবো। বইয়ের নাম ‘চীনের উত্থান ১৯৭৮-২০০৮: কীভাবে পরিবর্তনের কথা ভেবেছিল’। বইটি লেখক চীনের সংস্কার ও উত্থানের তিরিশতম বর্ষকে উৎসর্গ করেছেন। প্রকাশক ক্রিয়েশন্স, নয়াদিল্লি (২০১৯)। মূল বইটির নাম ‘China Emerging 1978-2008: How Thinking About Business changed’ যা কিনা চায়না ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্রেস, বেইজিং, চায়না থেকে প্রকাশিত। আলোচ্য বইটি উপরোক্ত দুই প্রতিষ্ঠানের একটি যৌথ উদ্যোগ।
বইটি পড়ে আমি অভিভূত। সংস্কার চলাকালেও চীনের তত্ত্বগত দ্বন্দ্ব ও কায়েমি স্বার্থের কারণে প্রশাসন থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সংস্কারের বিরোধিতা, চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা, মূলধন সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য, ফাটকাবাজি, কিছু লোকের রাতারাতি বড়লোক হওয়া, শেয়ারবাজারের অস্থিতিশীলতা–এমন কোনো বিষয় নেই, লেখক যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেননি। উল্লেখ করতে ভোলেননি উন্নয়নের জন্য নেতাদের একরোখা ডু অর ডাই প্রচেষ্টার বিষয়টিও। বইটি যেন মহাচীন হয়ে ওঠার এক মহাকাব্যিক বর্ণনা।
বইটিতে যে পাঁচটি অধ্যায় আছে সেগুলোর উল্লেখ আমার দাবি প্রমাণ করবে: ১. আরম্ভ: ১৯৭৮-১৯৮৩; ২. মন্থন ও উত্থান-পতন: ১৯৮৪-১৯৯২; ৩. আমূল সংস্কারের স্বপ্ন: ১৯৯৩-১৯৯৭; ৪. জলাভূমি ও ল্যান্ডমাইন [প্রতিবন্ধক ও বিপদের রূপকার্থে]: ১৯৭৮-২০০২; এবং ৫. দায়িত্ব এবং যুক্তি: ২০০৩-২০০৮।
কেন বিশেষ করে এই তিরিশ বছর? লেখক ভূমিকায় বলেছেন: ‘১৯৭৮ থেকে ২০০৮–এই তিরিশ বছর চীনের দ্রুত উত্থানের সময়। এই তিন দশকে চীনের এই আকস্মিক অগ্রগতি বিশ্ব অর্থনীতির এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আজকের দিনে আমি যখন পুরোনো ছবিগুলো দেখি, আরও একবার অবাক হই চীনের পরিবর্তন দেখে–বইয়ে লেখা শব্দগুলোতে ধরে রাখা ইতিহাসের ছবিগুলো অতটাই মুখর।’
নিজেই নিজেকে বলি, এই কি সেই পুরোনো চীন? সত্যি কি আমরা এত কিছু করতে পেরেছি?
বইটি পড়েই আমি জানতে পারি, আমি চীনের সংস্কারকালীন বেইজিং গিয়েছিলাম; কিন্তু বাইরে থেকে টের পাইনি। ওই ওয়ার্কশপে চীনা অংশগ্রহণকারীরা প্রায় সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পড়া যুবক-যুবতী। তাঁদের ওই অংশগ্রহণও কি ছিল বই-খাতে সংস্কারকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভ্যানগার্ড তৈরি করার আয়োজকদের একটি প্রচেষ্টা? হবেও-বা।
আমি জানি, ব্যাপকভাবে ওই বই সংগ্রহ ও পড়ার মতো পাঠক এখন দেশে নেই। কিন্তু দরকার আছে। এত দিন আমাদের উন্নয়ন–ভাবনায় স্বনির্ভরতা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রস্তুতি, আত্ম-বিশ্লেষণ ছিল না। অপরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ারও বালাই ছিল না। আমাদের ভাবনা ভেবেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও তাদের পরামর্শকেরা। এবং তাদের কাছ থেকে কমিশন পাওয়া এনজিও মালিকেরা। এই সবে আমরা গুটি গুটি পায়ে কিছু ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা ও নিজেদের মতো করে উন্নয়নের চিন্তা করছি। বইটিতে বর্ণিত অভিজ্ঞতা এ সময় আমাদের সাহায্য করতে পারে। সে কারণে উন্নয়নকামী ও অনিসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের কাছে বইটির বার্তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি মনে করছি।
লেখক: গ্রন্থ বিশেষজ্ঞ
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১০ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১০ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১০ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে