সুব্রত শংকর ধর
আশৈশব পত্রিকাকে জেনে এসেছি রাজনৈতিক মুখপত্র হিসেবেই। পত্রিকা ছিল কোনো না কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মতাদর্শের বাহক। মওলানা ভাসানীর ইত্তেফাক কিংবা কিছু পরে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ‘ইত্তেফাক’ কী লিখবে, আহমেদুল কবিরের ‘সংবাদ’ কী জানাতে চাইবে, আমরা জানতাম। তেমনি জানতাম ‘আজাদ’, ‘সংগ্রাম’, ‘মর্নিং নিউজ’–এর রাজনৈতিক মতাদর্শ। যা জানতাম তার থেকে খুব বেশি নড়চড় হতো না এই পত্রিকাগুলোর ভূমিকায়। ১৯৪৭ থেকে তো বটেই, এদেশে ’৪৭-পূর্বকালের পত্রিকাও ছিল মূলত রাজনৈতিক মুখপত্র। রাজনীতিতেই তার বসবাস, রাজনীতির আদর্শ নিয়েই তার গেরস্থালি।
রাজনীতির অনুগামী কোনো এক নির্মিত সত্য, খণ্ড সত্য কিংবা সত্যের একটি খণ্ডিত ভাষ্য গণমাধ্যম আমাদের কাছে হাজির করে। সেটি একটি ‘অবস্থান’ থেকে দেখা ‘সত্য’। ভিন্ন অবস্থান থেকে দেখলে, ভিন্ন বিশ্বাসের প্রিজম দিয়ে দেখলে তার রং, তার আদল বদলে যেতে পারে, বদলে যায়। ফলে আমরা গণমাধ্যম থেকে যা পাই, তা হলো উপলব্ধ ‘সত্যের’ বা একখণ্ড সত্যের বয়ান বা ন্যারেটিভ, যা পূর্ণ সত্যের দাবি নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। কিন্তু সে তো তার দিক থেকে। আমাদেরও প্রস্তুতি থাকে তাকে গ্রহণ বা অগ্রহণ করার। আমরাও বেছে বেছে দেখি, শুনি, বেছে বেছে বুঝি, বেছে বেছেই মনে রাখি। এমনি করেই চলে পাঠক-দর্শকের সঙ্গে গণমাধ্যমের অন্তহীন খেলা। পাঠকের সত্য আর মিডিয়ার সত্যের মাঝে।
ন্যারেটিভ রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয়। ন্যারেটিভের পেছনে ক্রিয়াশীল থাকে আদর্শ, বিশ্বাস এবং বৃহদার্থে কোনো না কোনো স্বার্থ। আদর্শের স্বার্থ, বিশ্বাসের স্বার্থও শেষ বিচারে স্বার্থই। আমরা দেখেছি, পরবর্তী সময়ে অন্যান্য স্বার্থও এসে যুক্ত হয়েছে। সে কথায় পরে আসা যাক।
রাজনীতির আদর্শ সীমানা টেনে দেয়, আদর্শ এঁকে দেয় জানার আর বোঝার লক্ষণরেখা। আদর্শ ও বিশ্বাস যত প্রোথিত শেকড়, সীমানা ততটাই অলঙ্ঘনীয়। মিডিয়ার ক্ষেত্রে অবস্থাটা এমনই ছিল গেল শতকের আটের দশকের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু একটা ভিন্নতর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ১৯৯০–এর শুরুতে। দশকের শুরুটা হয়েছিল গণতন্ত্রের সম্ভাবনা নিয়ে। গণতন্ত্র এমনিতেই গণমাধ্যমেরও সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তখন আরও একটি ঘটনা ঘটল। একঝাঁক তরুণ–তরুণী এল সাংবাদিকতায় একাডেমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে। পেশার নিচের দিকের শিক্ষানবিশের দায়িত্ব নিয়ে নয়, একেবারে ওপরের দিকের দায়িত্ব নিয়ে—তাঁদের মধ্য থেকেই হলো সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, চিফ রিপোর্টার—বলতে গেলে সবকিছুই এই নবীনদের হাতে। ‘আজকের কাগজ’ দিয়ে এর শুরু। তারপর ছড়িয়ে যেতে যেতে পুরো সংবাদপত্রের জগৎটাই গড়ে উঠল সেই আদলে। লক্ষ করার মতো ব্যাপার হলো, একাডেমিক প্রশিক্ষণের সীমানাগুলোও তারা ভেঙে বেরিয়ে এল। এ এক নতুন পত্রিকা! পেশাদারত্ব ছুঁয়ে আছে স্পর্শকের মতো, তবু সবটুকু পেশাদার নয়; কারণ এতে প্রাণ ছিল, স্বপ্ন ছিল, যা ঠিক পেশাদারত্বের অনুগামী নয়। সবচেয়ে বড় কথা—রাজনৈতিক আদর্শের লক্ষ্মণরেখা দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়নি। আদর্শে অঙ্গীকার থাকে, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেও অঙ্গীকার লাগে। কিন্তু এই দুইয়ে ভিন্নতা আছে। এই যে স্বপ্নাশ্রিত অঙ্গীকার, সেটি তখন দেখা গিয়েছিল সেই তরুণ সাংবাদিকদের মধ্যে।
এই নতুন সম্ভাবনার দিকে চোখ পড়েছিল অনেকেরই। পুরো নব্বইয়ের দশকে অনেক নতুন পত্রিকা বেরোলো। প্রায় সবারই একই আদল। শুরুতে। আরও একটি ব্যাপার লক্ষ করা গেল তখন—গণমাধ্যম তত দিনে ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠছে। এই নতুন পত্রিকার অধিকাংশই বের হতে শুরু করল বিভিন্ন ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউস’ থেকে। আজকের কাগজও তাই ছিল। নবীন সাংবাদিকদের স্বপ্ন ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউসের শিল্প কিংবা ব্যবসা-ভাবনা, কিংবা গণমাধ্যম নিয়ে তাদের অভিলাষ যে টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে, সে আমরা আজকের কাগজেই দেখেছিলাম। এর পরের ইতিহাস ক্রমাগত গণমাধ্যমকে ইন্ডাস্ট্রির দিকে ঠেলে নেওয়ারই ইতিহাস। সেসব নবীন সাংবাদিক প্রবীণ হলো, নতুনেরাও এল। সম্ভবত কোনো সামষ্টিক স্বপ্ন আর তেমন করে তাঁদের কাজের কেন্দ্রে থাকল না। কিংবা থাকার উপায় থাকল না। কারণ, নতুন কোনো সৃষ্টির উদ্যোগে তারা শামিল নয়, যা সৃষ্ট হয়ে আছে, তাতেই এসে যোগ দেওয়া। এমনকি যা আপাতদৃষ্টে নতুন, তা–ও হয়তো সম্পূর্ণ নতুন নয়। কাঠামোটি হয়তো দাঁড়িয়ে আছে পূর্বজন্ম বা জন্মপূর্ব থেকেই। ব্যক্তিগত স্বপ্ন হয়তো আছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন মূলত পেশাদার হয়ে ওঠার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণে হাউস বদল করতে হয়। সেই স্বপ্ন অন্যরকম, নিজের গণ্ডিতে আটকা। গণমাধ্যমের এই ঐতিহাসিক পথপরিক্রমায় রাজনীতি, রাজনৈতিক আদর্শ আর স্বপ্ন পেরিয়ে আমরা এখন যাকে বলে গণমাধ্যমশিল্প, তাতে এসে পৌঁছেছি।
এই যে গণমাধ্যমশিল্পে এসে উপনীত হলো, তাতে এমন ভাবার কারণ নেই যে পথের শেষ হয়েছে। পথে পথে অনেক টানাপোড়েন ছিল, সেসবকে টেনেহিঁচড়ে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সে। আবার নতুন অবস্থায় নতুন কিছু টানাপোড়েনও তৈরি হয়েছে। প্রথমত, রাজনীতির যে অন্তর্ধারাটি, সেটি কিন্তু কখনো পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। বাঙালির গণমাধ্যম রাজনীতিহীন—এটা ভাবাই যায় না। কিন্তু এই সম্পর্কের প্রকৃতি বদলেছে। এই যে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউসের মালিকানাধীন গণমাধ্যম, তার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কটি কী? সেখানে কী পরিবর্তন এল? নোয়াম চমস্কি, মাইকেল পেরেন্টিরা এসব আলোচনা অনেক করেছেন। আমরা বরং সেদিকে না গিয়ে আমাদের গণমাধ্যম বিকাশের গতি–প্রকৃতি এবং রাজনীতির সঙ্গে তার মিথস্ক্রিয়ার দিকে তাকাই।
সারা বিশ্বে যেমন, আমাদের রাজনীতিও তো বদলে গেছে অনেক। আদর্শ অনেকখানিই নির্বাসিত। জবাবদিহির প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম শর্ত বিরোধী দল নিশ্চিহ্নপ্রায়। আদর্শে দৃঢ় অঙ্গীকার নেই, দীর্ঘকাল ক্ষমতায় নেই, ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই এমন রাজনীতির টিকে থাকা কঠিন। রাজনৈতিক পরিবেশও তার বিকাশের প্রতিকূল। রাজনীতির কুশীলবদের আদলও অনেকটাই বদলে গেছে। রাজনীতিতে অর্থের জোগান বেড়েছে, রাজনীতি থেকে অর্থের জোগানও বাড়ছে। রাজনীতিতে যোগ দেওয়া এখন অনেকের জন্যই আর আদর্শিক কারণে নয়, বরং এটি আরেকটি বিনিয়োগ। মিডিয়াতে সেই স্বার্থগুলোই প্রধান হয়ে উঠল ক্রমশ।
এখানে এসে আমরা খুঁটিয়ে দেখি গণমাধ্যম আসলে কতটুকু শিল্প আর কতটুকু ব্যবসা। রাজনীতির কাছে শিল্পের থেকে ব্যবসায়ের দায় অনেক বেশি। তাকে অনেক বেশি সমঝে চলতে হয়। বিশেষত, যখন একই হাউসের অন্যান্য ব্যবসা অনেকখানিই রাজনীতির প্রসাদনির্ভর। সুস্থ ও দায়বদ্ধতার রাজনীতি নির্বাসিত হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানের সুযোগ নেয় তারা, বৃহদার্থে ক্ষমতার বলয়ে যাদের বাস রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি—অনেকেই। কিন্তু তাতে করে তারা নিজেদের বিপন্নও করে তোলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের কাছে। রাষ্ট্র জানে কে কোথায় ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানের সুবিধা নিয়েছে, কার কী দুর্বলতা। কারণ রাষ্ট্রই যে সেই সুবিধাগুলো তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। যারা ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, তাদের সুবিধা নেওয়ার সুযোগ যেমন বেশি, রাষ্ট্রের কাছে ধরা থাকার আশঙ্কাও তেমন বেশি। তারাই যদি হন সংবাদপত্র বা সাধারণভাবে গণমাধ্যমের কর্ণধার, রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে তাঁদের আপস করতে হয়। এই যখন গণমাধ্যমের হকিকত, তখন যাঁরা একাডেমিক প্রস্তুতি নিয়ে আসেন, পেশাদারত্ব দিয়ে, গণমাধ্যমকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা তেমন করে স্বপ্নপূরণ আর নিজের কাঙ্ক্ষিত বিকাশের জন্য সঠিক আলো–বাতাস পান না। সাংবাদিকতায় পেশাদারত্বের পরিসর সংকুচিত হয়ে আসে। ‘সত্যের অসংকোচ প্রকাশ’ তখন আরও কঠিন হয়। এই যখন অবস্থা, আমরা বুঝি, মিডিয়া যা জানায় তা সত্যের একটি ন্যারেটিভ, ঠিক সত্য নয়। অনেক সম্ভাব্য ন্যারেটিভের একটি।
গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক সে কথা জানেন। তিনিও হয়তো বসে আছেন তার খণ্ডসত্য নিয়ে, যাকে তিনি পূর্ণ সত্য বলে জানেন। বিশ্বাস, আদর্শ, পূর্বপাঠ কিংবা স্বার্থ অথবা এদের সমন্বয়ে জারিত এক সত্য নিয়ে। তিনি সংশয়ী। কেউ নতুন কিছু নিয়ে এলে আতশকাচের নিচে ফেলে দেখেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এই নতুন যে সত্য নিয়ে এল, সে কি আমার সত্য? আমার খণ্ড সত্য, যাকে আমি সত্য বলে জানি?
এই পাঠকের কাছেও হয়তো পৌঁছানো যায় যদি তাঁকে বিশ্বাস করানো যায় যে এই নতুনের একটা স্বপ্ন আছে, পেশাদারত্ব আছে। শুধু নিজের সত্য ফেরি করার জন্য সে আসেনি। ‘আজকের পত্রিকা’কে সেখানে পৌঁছাতে হবে। পথটি বন্ধুর।
লেখক: গ্লোবাল পার্টনারশিপ অব এডুকেশনের কর্মকর্তা
আশৈশব পত্রিকাকে জেনে এসেছি রাজনৈতিক মুখপত্র হিসেবেই। পত্রিকা ছিল কোনো না কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মতাদর্শের বাহক। মওলানা ভাসানীর ইত্তেফাক কিংবা কিছু পরে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ‘ইত্তেফাক’ কী লিখবে, আহমেদুল কবিরের ‘সংবাদ’ কী জানাতে চাইবে, আমরা জানতাম। তেমনি জানতাম ‘আজাদ’, ‘সংগ্রাম’, ‘মর্নিং নিউজ’–এর রাজনৈতিক মতাদর্শ। যা জানতাম তার থেকে খুব বেশি নড়চড় হতো না এই পত্রিকাগুলোর ভূমিকায়। ১৯৪৭ থেকে তো বটেই, এদেশে ’৪৭-পূর্বকালের পত্রিকাও ছিল মূলত রাজনৈতিক মুখপত্র। রাজনীতিতেই তার বসবাস, রাজনীতির আদর্শ নিয়েই তার গেরস্থালি।
রাজনীতির অনুগামী কোনো এক নির্মিত সত্য, খণ্ড সত্য কিংবা সত্যের একটি খণ্ডিত ভাষ্য গণমাধ্যম আমাদের কাছে হাজির করে। সেটি একটি ‘অবস্থান’ থেকে দেখা ‘সত্য’। ভিন্ন অবস্থান থেকে দেখলে, ভিন্ন বিশ্বাসের প্রিজম দিয়ে দেখলে তার রং, তার আদল বদলে যেতে পারে, বদলে যায়। ফলে আমরা গণমাধ্যম থেকে যা পাই, তা হলো উপলব্ধ ‘সত্যের’ বা একখণ্ড সত্যের বয়ান বা ন্যারেটিভ, যা পূর্ণ সত্যের দাবি নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। কিন্তু সে তো তার দিক থেকে। আমাদেরও প্রস্তুতি থাকে তাকে গ্রহণ বা অগ্রহণ করার। আমরাও বেছে বেছে দেখি, শুনি, বেছে বেছে বুঝি, বেছে বেছেই মনে রাখি। এমনি করেই চলে পাঠক-দর্শকের সঙ্গে গণমাধ্যমের অন্তহীন খেলা। পাঠকের সত্য আর মিডিয়ার সত্যের মাঝে।
ন্যারেটিভ রাজনীতি-নিরপেক্ষ নয়। ন্যারেটিভের পেছনে ক্রিয়াশীল থাকে আদর্শ, বিশ্বাস এবং বৃহদার্থে কোনো না কোনো স্বার্থ। আদর্শের স্বার্থ, বিশ্বাসের স্বার্থও শেষ বিচারে স্বার্থই। আমরা দেখেছি, পরবর্তী সময়ে অন্যান্য স্বার্থও এসে যুক্ত হয়েছে। সে কথায় পরে আসা যাক।
রাজনীতির আদর্শ সীমানা টেনে দেয়, আদর্শ এঁকে দেয় জানার আর বোঝার লক্ষণরেখা। আদর্শ ও বিশ্বাস যত প্রোথিত শেকড়, সীমানা ততটাই অলঙ্ঘনীয়। মিডিয়ার ক্ষেত্রে অবস্থাটা এমনই ছিল গেল শতকের আটের দশকের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু একটা ভিন্নতর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ১৯৯০–এর শুরুতে। দশকের শুরুটা হয়েছিল গণতন্ত্রের সম্ভাবনা নিয়ে। গণতন্ত্র এমনিতেই গণমাধ্যমেরও সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তখন আরও একটি ঘটনা ঘটল। একঝাঁক তরুণ–তরুণী এল সাংবাদিকতায় একাডেমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে। পেশার নিচের দিকের শিক্ষানবিশের দায়িত্ব নিয়ে নয়, একেবারে ওপরের দিকের দায়িত্ব নিয়ে—তাঁদের মধ্য থেকেই হলো সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, চিফ রিপোর্টার—বলতে গেলে সবকিছুই এই নবীনদের হাতে। ‘আজকের কাগজ’ দিয়ে এর শুরু। তারপর ছড়িয়ে যেতে যেতে পুরো সংবাদপত্রের জগৎটাই গড়ে উঠল সেই আদলে। লক্ষ করার মতো ব্যাপার হলো, একাডেমিক প্রশিক্ষণের সীমানাগুলোও তারা ভেঙে বেরিয়ে এল। এ এক নতুন পত্রিকা! পেশাদারত্ব ছুঁয়ে আছে স্পর্শকের মতো, তবু সবটুকু পেশাদার নয়; কারণ এতে প্রাণ ছিল, স্বপ্ন ছিল, যা ঠিক পেশাদারত্বের অনুগামী নয়। সবচেয়ে বড় কথা—রাজনৈতিক আদর্শের লক্ষ্মণরেখা দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়নি। আদর্শে অঙ্গীকার থাকে, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেও অঙ্গীকার লাগে। কিন্তু এই দুইয়ে ভিন্নতা আছে। এই যে স্বপ্নাশ্রিত অঙ্গীকার, সেটি তখন দেখা গিয়েছিল সেই তরুণ সাংবাদিকদের মধ্যে।
এই নতুন সম্ভাবনার দিকে চোখ পড়েছিল অনেকেরই। পুরো নব্বইয়ের দশকে অনেক নতুন পত্রিকা বেরোলো। প্রায় সবারই একই আদল। শুরুতে। আরও একটি ব্যাপার লক্ষ করা গেল তখন—গণমাধ্যম তত দিনে ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠছে। এই নতুন পত্রিকার অধিকাংশই বের হতে শুরু করল বিভিন্ন ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউস’ থেকে। আজকের কাগজও তাই ছিল। নবীন সাংবাদিকদের স্বপ্ন ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউসের শিল্প কিংবা ব্যবসা-ভাবনা, কিংবা গণমাধ্যম নিয়ে তাদের অভিলাষ যে টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে, সে আমরা আজকের কাগজেই দেখেছিলাম। এর পরের ইতিহাস ক্রমাগত গণমাধ্যমকে ইন্ডাস্ট্রির দিকে ঠেলে নেওয়ারই ইতিহাস। সেসব নবীন সাংবাদিক প্রবীণ হলো, নতুনেরাও এল। সম্ভবত কোনো সামষ্টিক স্বপ্ন আর তেমন করে তাঁদের কাজের কেন্দ্রে থাকল না। কিংবা থাকার উপায় থাকল না। কারণ, নতুন কোনো সৃষ্টির উদ্যোগে তারা শামিল নয়, যা সৃষ্ট হয়ে আছে, তাতেই এসে যোগ দেওয়া। এমনকি যা আপাতদৃষ্টে নতুন, তা–ও হয়তো সম্পূর্ণ নতুন নয়। কাঠামোটি হয়তো দাঁড়িয়ে আছে পূর্বজন্ম বা জন্মপূর্ব থেকেই। ব্যক্তিগত স্বপ্ন হয়তো আছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন মূলত পেশাদার হয়ে ওঠার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণে হাউস বদল করতে হয়। সেই স্বপ্ন অন্যরকম, নিজের গণ্ডিতে আটকা। গণমাধ্যমের এই ঐতিহাসিক পথপরিক্রমায় রাজনীতি, রাজনৈতিক আদর্শ আর স্বপ্ন পেরিয়ে আমরা এখন যাকে বলে গণমাধ্যমশিল্প, তাতে এসে পৌঁছেছি।
এই যে গণমাধ্যমশিল্পে এসে উপনীত হলো, তাতে এমন ভাবার কারণ নেই যে পথের শেষ হয়েছে। পথে পথে অনেক টানাপোড়েন ছিল, সেসবকে টেনেহিঁচড়ে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সে। আবার নতুন অবস্থায় নতুন কিছু টানাপোড়েনও তৈরি হয়েছে। প্রথমত, রাজনীতির যে অন্তর্ধারাটি, সেটি কিন্তু কখনো পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। বাঙালির গণমাধ্যম রাজনীতিহীন—এটা ভাবাই যায় না। কিন্তু এই সম্পর্কের প্রকৃতি বদলেছে। এই যে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউসের মালিকানাধীন গণমাধ্যম, তার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কটি কী? সেখানে কী পরিবর্তন এল? নোয়াম চমস্কি, মাইকেল পেরেন্টিরা এসব আলোচনা অনেক করেছেন। আমরা বরং সেদিকে না গিয়ে আমাদের গণমাধ্যম বিকাশের গতি–প্রকৃতি এবং রাজনীতির সঙ্গে তার মিথস্ক্রিয়ার দিকে তাকাই।
সারা বিশ্বে যেমন, আমাদের রাজনীতিও তো বদলে গেছে অনেক। আদর্শ অনেকখানিই নির্বাসিত। জবাবদিহির প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম শর্ত বিরোধী দল নিশ্চিহ্নপ্রায়। আদর্শে দৃঢ় অঙ্গীকার নেই, দীর্ঘকাল ক্ষমতায় নেই, ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই এমন রাজনীতির টিকে থাকা কঠিন। রাজনৈতিক পরিবেশও তার বিকাশের প্রতিকূল। রাজনীতির কুশীলবদের আদলও অনেকটাই বদলে গেছে। রাজনীতিতে অর্থের জোগান বেড়েছে, রাজনীতি থেকে অর্থের জোগানও বাড়ছে। রাজনীতিতে যোগ দেওয়া এখন অনেকের জন্যই আর আদর্শিক কারণে নয়, বরং এটি আরেকটি বিনিয়োগ। মিডিয়াতে সেই স্বার্থগুলোই প্রধান হয়ে উঠল ক্রমশ।
এখানে এসে আমরা খুঁটিয়ে দেখি গণমাধ্যম আসলে কতটুকু শিল্প আর কতটুকু ব্যবসা। রাজনীতির কাছে শিল্পের থেকে ব্যবসায়ের দায় অনেক বেশি। তাকে অনেক বেশি সমঝে চলতে হয়। বিশেষত, যখন একই হাউসের অন্যান্য ব্যবসা অনেকখানিই রাজনীতির প্রসাদনির্ভর। সুস্থ ও দায়বদ্ধতার রাজনীতি নির্বাসিত হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানের সুযোগ নেয় তারা, বৃহদার্থে ক্ষমতার বলয়ে যাদের বাস রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি—অনেকেই। কিন্তু তাতে করে তারা নিজেদের বিপন্নও করে তোলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের কাছে। রাষ্ট্র জানে কে কোথায় ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানের সুবিধা নিয়েছে, কার কী দুর্বলতা। কারণ রাষ্ট্রই যে সেই সুবিধাগুলো তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। যারা ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, তাদের সুবিধা নেওয়ার সুযোগ যেমন বেশি, রাষ্ট্রের কাছে ধরা থাকার আশঙ্কাও তেমন বেশি। তারাই যদি হন সংবাদপত্র বা সাধারণভাবে গণমাধ্যমের কর্ণধার, রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে তাঁদের আপস করতে হয়। এই যখন গণমাধ্যমের হকিকত, তখন যাঁরা একাডেমিক প্রস্তুতি নিয়ে আসেন, পেশাদারত্ব দিয়ে, গণমাধ্যমকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা তেমন করে স্বপ্নপূরণ আর নিজের কাঙ্ক্ষিত বিকাশের জন্য সঠিক আলো–বাতাস পান না। সাংবাদিকতায় পেশাদারত্বের পরিসর সংকুচিত হয়ে আসে। ‘সত্যের অসংকোচ প্রকাশ’ তখন আরও কঠিন হয়। এই যখন অবস্থা, আমরা বুঝি, মিডিয়া যা জানায় তা সত্যের একটি ন্যারেটিভ, ঠিক সত্য নয়। অনেক সম্ভাব্য ন্যারেটিভের একটি।
গণমাধ্যমের পাঠক-দর্শক সে কথা জানেন। তিনিও হয়তো বসে আছেন তার খণ্ডসত্য নিয়ে, যাকে তিনি পূর্ণ সত্য বলে জানেন। বিশ্বাস, আদর্শ, পূর্বপাঠ কিংবা স্বার্থ অথবা এদের সমন্বয়ে জারিত এক সত্য নিয়ে। তিনি সংশয়ী। কেউ নতুন কিছু নিয়ে এলে আতশকাচের নিচে ফেলে দেখেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এই নতুন যে সত্য নিয়ে এল, সে কি আমার সত্য? আমার খণ্ড সত্য, যাকে আমি সত্য বলে জানি?
এই পাঠকের কাছেও হয়তো পৌঁছানো যায় যদি তাঁকে বিশ্বাস করানো যায় যে এই নতুনের একটা স্বপ্ন আছে, পেশাদারত্ব আছে। শুধু নিজের সত্য ফেরি করার জন্য সে আসেনি। ‘আজকের পত্রিকা’কে সেখানে পৌঁছাতে হবে। পথটি বন্ধুর।
লেখক: গ্লোবাল পার্টনারশিপ অব এডুকেশনের কর্মকর্তা
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১২ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১২ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১২ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে