চিররঞ্জন সরকার
সেদিন এক জায়গায় রিকশায় যাচ্ছিলাম। রিকশা থেকে নেমে চালকের হাতে ১০০ টাকার একটা নোট দিলাম। ভাড়া বাবদ তাঁর সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ৫০ টাকা। কিন্তু রিকশাচালক জানালেন, তাঁর কাছে ৫০ টাকা ভাঙতি নেই। আমিও মানিব্যাগ হাতড়ে ৫০ টাকা ভাঙতি পেলাম না। আশপাশে কোনো দোকানও নেই। এ অবস্থায় উভয়েই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। খানিকক্ষণ পর রিকশাচালক ব্যক্তিটি আমাকে বললেন, ‘স্যার, আপনার কি বিকাশ আছে? যদি বিকাশ থাকে, তা হইলে আপনি আমারে বিকাশে টাকা দিতে পারেন!’
রিকশাচালকের কথা শুনে তো আমি থ! দ্রুত মোবাইল ফোন বের করে তাঁর ভাড়ার সঙ্গে আরও ১০ টাকা যোগ করে মোট ৬০ টাকা তাঁর বিকাশ নম্বরে পাঠিয়ে দিলাম। রিকশাচালক হেসে বিদায় নিলেন।
ঘটনাটি আমার কাছে একেবারেই ব্যতিক্রমী। একজন রিকশাচালক বিকাশের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধের প্রস্তাব করতে পারেন এবং সেটি পরিশোধ করা যেতে পারে, যা আমার কাছে ছিল অবিশ্বাস্য!
হ্যাঁ, যা আগে কল্পনা করা যায়নি, এখন তেমন ঘটনা হামেশাই ঘটছে। তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পরিবর্তনটা এক যুগ আগেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে তা অনেক বিস্তৃত হয়েছে। এ পরিবর্তনটা সম্ভব হয়েছে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণদের নানা উদ্যোগ আর প্রচেষ্টায়। তাঁদের হাত ধরেই দেশে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। এতে দ্রুত বদলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন খাত। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার সঙ্গে মানুষের জীবনে এর বড় প্রভাবও দেখা গেছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ—সবকিছুতেই লেগেছে প্রযুক্তিনির্ভরতার ছোঁয়া। পাশাপাশি, করোনার ভয়াল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে যে লকডাউন পর্ব চলছে, সেই সময় জীবিকা নির্বাহ এবং জীবনযাত্রার নতুন উপায় খুঁজে পেতে প্রযুক্তি বিশেষভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
করোনা মহামারি আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করলেও থামিয়ে দিতে পারেনি। এর কারণ তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি। এই মহামারি শুরু হওয়ার পর দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বিস্ময়কর রকমভাবে বেড়েছে। করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারের কারণে দেশে দেশে সরকারিভাবে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিনের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করায় আমরা যখন গৃহবন্দী হয়ে পড়েছিলাম, তখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পেয়েছি জীবনের নতুন গতি। ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে মিটিং করে যাবতীয় আদেশ-নির্দেশ দিয়েছেন এবং এখনো দিচ্ছেন ভিডিও কলের মাধ্যমে। গ্রামাঞ্চল বা মফস্বলের প্রশাসনিক কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। এমনকি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীরা ঢাকায় বসে অনেক সময় প্রকল্প উদ্বোধন করেন, জনসভায়ও তাঁদের বক্তব্য সরাসরি দেখানো হয়।
করোনার কারণে পুরো ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন আসে অফিস সংস্কৃতিতে। বিশ্বজুড়েই জরুরি সেবার জন্য যাঁদের একান্তই পথেঘাটে কাজ করতে হয়, তাঁদের বাদ দিয়ে আর সবার জন্যই শুরু হয় ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। আমাদের দেশেও ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সংস্কৃতি চালু হয়। অনেক অফিস ও কোম্পানি কর্মীদের ঘরে থেকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। ফলে মাসের পর মাস চলাচলের ক্ষেত্রে একধরনের বিধিনিষেধ জারি থাকার পরও অফিসগুলো কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পেরেছে।
করোনাভাইরাস বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার দিক থেকে অন্তত কয়েক বছর এগিয়ে দিয়েছে! প্রযুক্তির হাত ধরে করোনাকালে সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছে ই–কমার্স খাত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দিয়ে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিয়েছে দেশে পরিচালিত ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরে তৃণমূলে ইউনিয়ন পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিতে পেরেছে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ই–কমার্স সেবার গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকারও এটিকে ‘জরুরি সেবা’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে অনলাইনে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় অনেক বেড়েছে। এখনো অনেক ক্রেতা সাবধানতা অবলম্বন করে দোকানে বা মার্কেটে না গিয়ে অনলাইন মাধ্যম থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনছেন। চালু হয়েছে অসংখ্য অনলাইন শপ। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ফিজিক্যাল স্টোর চালু করেছে। এগুলো তাদের পিকআপ পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে গ্রাহকদের কাছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীরাও উদ্যোক্তা হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। দেশে এখন প্রায় ৩০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর অর্ধেকই চালাচ্ছেন নারীরা। ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্প পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন নারীরা।
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, কোভিড-১৯ মহামারি প্রযুক্তির নিত্যনতুন ব্যবহারের সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা–দুটোর দরজাই খুলে দিয়েছে। এমনকি করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়েও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনাসংক্রান্ত তথ্য আদান–প্রদান, ম্যাপিং, ট্র্যাকিং, করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি–এসবই হচ্ছে উন্নততর প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে। করোনার টিকা প্রদানের ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনা টিকার জন্য প্রথমেই নিবন্ধন করতে হয়। করোনার টিকা পেতে আগ্রহীরা সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে (www. surokkha. gov. bd) গিয়ে অথবা মোবাইলে অ্যাপ ডাউনলোড করে নিবন্ধন করেন। নিবন্ধন হয়ে গেলে টিকার প্রথম ডোজের তারিখ ও কেন্দ্রের নাম এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, জন্মতারিখ দিয়ে লগইন করে এসএমএসের মাধ্যমে পাওয়া ওটিপি কোড দিয়ে টিকা কার্ড ডাউনলোড করে এসএমএসে দেওয়া তারিখ অনুযায়ী টিকা কার্ড ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে নির্ধারিত টিকাদান কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে কোভিড-১৯-এর টিকা নিতে পারছেন। এভাবে দুটি ডোজ শেষ হলে সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন থেকে ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির সনদও সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে। জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়ন ও টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাও দেওয়া হচ্ছে। কলসেন্টারে ফোন করে, ওয়েবসাইটে ঢুকে ও অ্যাপসের মাধ্যমের করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানা ও জানানো যাচ্ছে। করোনার উপসর্গ থাকলে ফোন করে পরীক্ষার জন্য তথ্যও জানানো যাচ্ছে। ঝক্কি এড়াতে অনলাইনে পরীক্ষার সিরিয়াল নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে উবার-পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ায় দেশে বড় পরিবর্তন এসেছে। এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান যেমন বেড়েছে, তেমনি অনেকের যাতায়াতে সুবিধাও হয়েছে।
উবার-পাঠাওয়ের মতো আরও দুটি বড় মাপের সেবা কার্যক্রম হলো, মোবাইল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন এবং অনলাইন ব্যাংকিং। বিকাশ-নগদ প্রভৃতি সেবা চালু হওয়ায় কোটি কোটি মানুষ ঘরে বসেই টাকা লেনদেন করতে পারছেন। বিকাশ অ্যাপের মাধ্যমে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ বিভিন্ন ইউটিলিটির বিল পরিশোধের সুযোগ মানুষের অনেক দুর্ভোগ কমিয়েছে।
আজকাল তো ইন্টারনেটের মাধ্যমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তির রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন যেমন করা যায়, তেমনি পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশ হয়। এখন অনেক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া, ফরম ফিলআপ, বেতন জমা ইত্যাদি কাজ চলে অনলাইনে। একইভাবে বিদেশে চাকরির রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন, হজযাত্রার নিবন্ধন, বিভিন্ন ধরনের অফিশিয়াল বা সরকারি ফরম সংগ্রহ, টেন্ডার বা দরপত্রে অংশগ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্ম অনলাইনেই সম্পন্ন করা যায়। এ রকম আরও অনেক কার্যক্রম এখন ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ অনলাইনে সম্পন্ন করা হয়।
করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিচ্ছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ যন্ত্রনির্ভর পড়ালেখা আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি অভূতপূর্ব ও যুগোপযোগী ধারণার পরীক্ষামূলক সূচনা বলা যায়। নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা সঙ্গে নিয়ে কঠিন ক্রান্তিকালেও স্বল্পপরিসরে পড়ালেখাটা হচ্ছে, এটিই অন্যতম প্রাপ্তি।
এ ছাড়া কৃষিপ্রযুক্তির বহুল ব্যবহারের ফলে শস্য উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। এখন আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ঘরে বসেই কৃষকেরা কৃষিবিষয়ক সব পরামর্শ পাচ্ছেন। কৃষি বিপণনে মোবাইল ব্যাংকিং, বিকাশ, নগদ কৃষকবান্ধব হিসেবে কাজ করে চলেছে।
করোনা কবে যাবে, তা কেউ বলতে পারছে না। আর করোনা বিদায় নিলেও বিশ্ব তথা বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির বিন্যাসে যে অভূতপূর্ব বদল আনবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হলে আমাদেরও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে মনোনিবেশ করতে হবে। আমরা যত দ্রুত উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারব, ততই দেশের লাভ।
লেখক: গবেষক, রম্য কলাম লেখক
সেদিন এক জায়গায় রিকশায় যাচ্ছিলাম। রিকশা থেকে নেমে চালকের হাতে ১০০ টাকার একটা নোট দিলাম। ভাড়া বাবদ তাঁর সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ৫০ টাকা। কিন্তু রিকশাচালক জানালেন, তাঁর কাছে ৫০ টাকা ভাঙতি নেই। আমিও মানিব্যাগ হাতড়ে ৫০ টাকা ভাঙতি পেলাম না। আশপাশে কোনো দোকানও নেই। এ অবস্থায় উভয়েই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। খানিকক্ষণ পর রিকশাচালক ব্যক্তিটি আমাকে বললেন, ‘স্যার, আপনার কি বিকাশ আছে? যদি বিকাশ থাকে, তা হইলে আপনি আমারে বিকাশে টাকা দিতে পারেন!’
রিকশাচালকের কথা শুনে তো আমি থ! দ্রুত মোবাইল ফোন বের করে তাঁর ভাড়ার সঙ্গে আরও ১০ টাকা যোগ করে মোট ৬০ টাকা তাঁর বিকাশ নম্বরে পাঠিয়ে দিলাম। রিকশাচালক হেসে বিদায় নিলেন।
ঘটনাটি আমার কাছে একেবারেই ব্যতিক্রমী। একজন রিকশাচালক বিকাশের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধের প্রস্তাব করতে পারেন এবং সেটি পরিশোধ করা যেতে পারে, যা আমার কাছে ছিল অবিশ্বাস্য!
হ্যাঁ, যা আগে কল্পনা করা যায়নি, এখন তেমন ঘটনা হামেশাই ঘটছে। তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পরিবর্তনটা এক যুগ আগেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে তা অনেক বিস্তৃত হয়েছে। এ পরিবর্তনটা সম্ভব হয়েছে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণদের নানা উদ্যোগ আর প্রচেষ্টায়। তাঁদের হাত ধরেই দেশে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। এতে দ্রুত বদলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন খাত। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার সঙ্গে মানুষের জীবনে এর বড় প্রভাবও দেখা গেছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ—সবকিছুতেই লেগেছে প্রযুক্তিনির্ভরতার ছোঁয়া। পাশাপাশি, করোনার ভয়াল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে যে লকডাউন পর্ব চলছে, সেই সময় জীবিকা নির্বাহ এবং জীবনযাত্রার নতুন উপায় খুঁজে পেতে প্রযুক্তি বিশেষভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
করোনা মহামারি আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করলেও থামিয়ে দিতে পারেনি। এর কারণ তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি। এই মহামারি শুরু হওয়ার পর দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বিস্ময়কর রকমভাবে বেড়েছে। করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারের কারণে দেশে দেশে সরকারিভাবে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিনের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করায় আমরা যখন গৃহবন্দী হয়ে পড়েছিলাম, তখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পেয়েছি জীবনের নতুন গতি। ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে মিটিং করে যাবতীয় আদেশ-নির্দেশ দিয়েছেন এবং এখনো দিচ্ছেন ভিডিও কলের মাধ্যমে। গ্রামাঞ্চল বা মফস্বলের প্রশাসনিক কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। এমনকি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীরা ঢাকায় বসে অনেক সময় প্রকল্প উদ্বোধন করেন, জনসভায়ও তাঁদের বক্তব্য সরাসরি দেখানো হয়।
করোনার কারণে পুরো ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন আসে অফিস সংস্কৃতিতে। বিশ্বজুড়েই জরুরি সেবার জন্য যাঁদের একান্তই পথেঘাটে কাজ করতে হয়, তাঁদের বাদ দিয়ে আর সবার জন্যই শুরু হয় ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। আমাদের দেশেও ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সংস্কৃতি চালু হয়। অনেক অফিস ও কোম্পানি কর্মীদের ঘরে থেকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। ফলে মাসের পর মাস চলাচলের ক্ষেত্রে একধরনের বিধিনিষেধ জারি থাকার পরও অফিসগুলো কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পেরেছে।
করোনাভাইরাস বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার দিক থেকে অন্তত কয়েক বছর এগিয়ে দিয়েছে! প্রযুক্তির হাত ধরে করোনাকালে সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছে ই–কমার্স খাত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দিয়ে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিয়েছে দেশে পরিচালিত ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরে তৃণমূলে ইউনিয়ন পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিতে পেরেছে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ই–কমার্স সেবার গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকারও এটিকে ‘জরুরি সেবা’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর থেকে অনলাইনে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় অনেক বেড়েছে। এখনো অনেক ক্রেতা সাবধানতা অবলম্বন করে দোকানে বা মার্কেটে না গিয়ে অনলাইন মাধ্যম থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনছেন। চালু হয়েছে অসংখ্য অনলাইন শপ। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ফিজিক্যাল স্টোর চালু করেছে। এগুলো তাদের পিকআপ পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে গ্রাহকদের কাছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীরাও উদ্যোক্তা হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। দেশে এখন প্রায় ৩০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর অর্ধেকই চালাচ্ছেন নারীরা। ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্প পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন নারীরা।
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, কোভিড-১৯ মহামারি প্রযুক্তির নিত্যনতুন ব্যবহারের সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা–দুটোর দরজাই খুলে দিয়েছে। এমনকি করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়েও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনাসংক্রান্ত তথ্য আদান–প্রদান, ম্যাপিং, ট্র্যাকিং, করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি–এসবই হচ্ছে উন্নততর প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে। করোনার টিকা প্রদানের ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। করোনা টিকার জন্য প্রথমেই নিবন্ধন করতে হয়। করোনার টিকা পেতে আগ্রহীরা সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে (www. surokkha. gov. bd) গিয়ে অথবা মোবাইলে অ্যাপ ডাউনলোড করে নিবন্ধন করেন। নিবন্ধন হয়ে গেলে টিকার প্রথম ডোজের তারিখ ও কেন্দ্রের নাম এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, জন্মতারিখ দিয়ে লগইন করে এসএমএসের মাধ্যমে পাওয়া ওটিপি কোড দিয়ে টিকা কার্ড ডাউনলোড করে এসএমএসে দেওয়া তারিখ অনুযায়ী টিকা কার্ড ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে নির্ধারিত টিকাদান কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে কোভিড-১৯-এর টিকা নিতে পারছেন। এভাবে দুটি ডোজ শেষ হলে সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন থেকে ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির সনদও সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে। জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়ন ও টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাও দেওয়া হচ্ছে। কলসেন্টারে ফোন করে, ওয়েবসাইটে ঢুকে ও অ্যাপসের মাধ্যমের করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানা ও জানানো যাচ্ছে। করোনার উপসর্গ থাকলে ফোন করে পরীক্ষার জন্য তথ্যও জানানো যাচ্ছে। ঝক্কি এড়াতে অনলাইনে পরীক্ষার সিরিয়াল নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে উবার-পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ায় দেশে বড় পরিবর্তন এসেছে। এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান যেমন বেড়েছে, তেমনি অনেকের যাতায়াতে সুবিধাও হয়েছে।
উবার-পাঠাওয়ের মতো আরও দুটি বড় মাপের সেবা কার্যক্রম হলো, মোবাইল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন এবং অনলাইন ব্যাংকিং। বিকাশ-নগদ প্রভৃতি সেবা চালু হওয়ায় কোটি কোটি মানুষ ঘরে বসেই টাকা লেনদেন করতে পারছেন। বিকাশ অ্যাপের মাধ্যমে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ বিভিন্ন ইউটিলিটির বিল পরিশোধের সুযোগ মানুষের অনেক দুর্ভোগ কমিয়েছে।
আজকাল তো ইন্টারনেটের মাধ্যমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তির রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন যেমন করা যায়, তেমনি পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশ হয়। এখন অনেক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া, ফরম ফিলআপ, বেতন জমা ইত্যাদি কাজ চলে অনলাইনে। একইভাবে বিদেশে চাকরির রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন, হজযাত্রার নিবন্ধন, বিভিন্ন ধরনের অফিশিয়াল বা সরকারি ফরম সংগ্রহ, টেন্ডার বা দরপত্রে অংশগ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্ম অনলাইনেই সম্পন্ন করা যায়। এ রকম আরও অনেক কার্যক্রম এখন ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ অনলাইনে সম্পন্ন করা হয়।
করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিচ্ছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ যন্ত্রনির্ভর পড়ালেখা আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি অভূতপূর্ব ও যুগোপযোগী ধারণার পরীক্ষামূলক সূচনা বলা যায়। নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা সঙ্গে নিয়ে কঠিন ক্রান্তিকালেও স্বল্পপরিসরে পড়ালেখাটা হচ্ছে, এটিই অন্যতম প্রাপ্তি।
এ ছাড়া কৃষিপ্রযুক্তির বহুল ব্যবহারের ফলে শস্য উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। এখন আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ঘরে বসেই কৃষকেরা কৃষিবিষয়ক সব পরামর্শ পাচ্ছেন। কৃষি বিপণনে মোবাইল ব্যাংকিং, বিকাশ, নগদ কৃষকবান্ধব হিসেবে কাজ করে চলেছে।
করোনা কবে যাবে, তা কেউ বলতে পারছে না। আর করোনা বিদায় নিলেও বিশ্ব তথা বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির বিন্যাসে যে অভূতপূর্ব বদল আনবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হলে আমাদেরও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে মনোনিবেশ করতে হবে। আমরা যত দ্রুত উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারব, ততই দেশের লাভ।
লেখক: গবেষক, রম্য কলাম লেখক
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১২ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১২ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১২ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে