‘স্মাগলার’ মানে চোরাকারবারি

আব্দুর রাজ্জাক
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২১, ০৯: ২৬
আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২১, ১২: ১৭

হরহামেশা আমরা একটা শব্দ শুনে থাকি, ‘স্মাগলার’। শব্দটার বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায় চোরাচালানকারী অথবা চোরাকারবারি। সেভাবেই সমাজে কথাটা প্রচলিত। এই চোরাচালানকারী বা চোরাকারবারিরা ব্যক্তিগতভাবে কারও কোনো পণ্য বা বস্তু চুরি করে না। এরা সীমান্ত পার করে এক দেশের মাল অন্য দেশে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে, রাষ্ট্রের বিধিবিধান অমান্য করে কারবার করে। তাই এদের নাম স্মাগলার বা চোরাকারবারি। এই কারবার হতে পারে বিভিন্ন এয়ারপোর্ট ব্যবহার করে, অন্য দেশের পণ্য রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজের দেশে প্রবেশ করানো অথবা এক দেশের পণ্য অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া, রাষ্ট্রীয় আইন উপেক্ষা করে।

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে অফিসের কাজে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই স্থলবন্দরের কাস্টম অফিসে মিটিং করতে যেতাম। মিটিং করার পর কাস্টমস কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সীমান্ত এলাকা দেখতে যেতাম। আমার কৌতূহল হলো, সেখানে প্রচুর অনাবাদি জমি। কেউ কোনো চাষবাস করছে না কেন? স্থানীয় লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ‘জমি কেন চাষবাস করা হয় না? কেন পতিত অবস্থায় আছে?’ 
স্থানীয় লোকজন উত্তর দিল, ‘চাষাবাদে অনেক পরিশ্রম। লাভ কম হয়। এ অঞ্চলের মানুষ একটি বস্তা এপার থেকে ওপার অথবা ওপার থেকে এপার করতে পারলে কমপক্ষে ৫০০ টাকা পায়। তাই চাষাবাদ বা কায়িক পরিশ্রমের কাজ কেউ করতে চায় না।’

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এত লোকজন, তারা এটা নিবারণ করে না?’

উত্তরে জানলাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়াকড়ির জন্যই কাজটি ঠিকমতো করা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী না থাকলে নিজের টাকায় এত বড় ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ কেউ করত না। পথিমধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী মাল লুট করে নিয়ে যেত।’

সে সময় আমার যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলাম।

এরপর অনেক দিন পার হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততা হয়তো কমেছে। চোরাচালান যেন না হয়, সে ব্যাপারে ওপরমহল থেকেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু সেই জমিগুলোয় এখন চাষবাস হয় কি না, সেটা জানার জন্য সেখানে আর যাওয়া হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোরতা সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। এক লোক উদ্দেশ্যহীনভাবে সীমান্ত এলাকায় ঘোরাফেরা করছে। সাধারণ সৈনিকেরা তাকে ধরে নিয়ে সুবেদার বা দারোগার কাছে হস্তান্তর করল। ওই লোকের শরীর তল্লাশি করে তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। লোকটি বলল, ‘এখন আমাকে ছেড়ে দিন। আমার কাছে তো কোনো অবৈধ পণ্য বা কিছু পাননি।’ সুবেদার সাহেব বললেন, ‘তোমাকে সহজে ছাড়া যাবে না। তুমি ছাড়া পাওয়ার পর গিয়ে বলবে, আমার একটি কেশও ছিঁড়তে পারল না ওই সুবেদার। সুবেদার সাহেব সৈনিকদের নির্দেশ দিলেন, ওকে ওই ঘরে নিয়ে কয়েকটা কেশ ছিঁড়ে দাও। ও যেন বলতে না পারে–এই সুবেদার ওর একটি কেশও ছিঁড়তে পারে নাই।’

এ রকম অনেক গল্প আছে। কেউ যদি স্মাগলিং করে, তাকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। মনে করুন, একটি লোকের কাল্পনিক নাম নিতাই। লোকটা যদিও ফরসা, তাকে ডাকা হয় কালা নিতাই, স্মাগলার নিতাই, চোরাকারবারি নিতাই, ইন্ডিয়া নিতাই, ব্ল্যাক নিতাই, বর্ডার নিতাই, লাগেজ নিতাই ইত্যাদি। এসব বিশেষণ শুনলেই বুঝতে পারবেন সে কী কাজ করে।

পাকিস্তান আমলের একটি ঘটনা। গল্পটি শুনেছি মাগুরার একজন বড় ভাইয়ের কাছে।

তখন সীমান্ত এলাকায় প্রচুর চোরাচালান হতো। ভারত থেকে অনেক পণ্য এপারে আসত। এপার থেকে অনেক পণ্য ভারতে যেত—চোরাপথে, রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে। এ রকম চোরাচালানে ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হয় না, ক্ষতি যা হয় রাষ্ট্রের। সার্বিকভাবে বলতে গেলে রাষ্ট্রের, সামষ্টিক জনগণের। তাই এসব ব্যাপারে সাধারণ জনগণ স্মাগলারদের তেমন প্রতিহত করে না বা ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না।

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে একজন ভারতীয় চোরাকারবারিকে ইপিআর সদস্যরা গ্রেপ্তার করল। নামধাম জিজ্ঞাসা করার পর স্বীকার করল, সে চোরাকারবারি। তার বাড়ি কলকাতার রানাঘাটে। বংশপরম্পরায় তারা চোরাকারবারি করে থাকে। তাকে অনেক নির্যাতন করা হলো, চোরাকারবারের পণ্য আদায় করার জন্য।

রানাঘাটের এই চোরাকারবারিকে ইপিআরের মেজর সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। মেজর সাহেব ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। তিনি রুটি খেতেন। ভাত খাওয়া পছন্দ করতেন না। সেই সময় আমাদের এই অঞ্চলে তেমন ভালো আটা পাওয়া যেত না। মেজর সাহেব চোরাকারবারিকে বললেন, ‘তুমি আমাদের কয়েক বস্তা ভালো আটা দাও, তোমাকে আমি ছেড়ে দেব।’

চোরাকারবারি কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাথা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আটা আমি দিতে পারব না। আমাদের দেশে এখন খাদ্যের সংকট। আটা এবং চাল বাদে অন্য যেকোনো পণ্য দিতে পারব। দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে এই কাজ আমি করতে পারব না।

মেজর সাহেবসহ সবাই হতবাক হয়ে গেলেন চোরাকারবারির কথা শুনে।

কথায় আছে, ‘চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনি’। দেখা গেল, চোরাকারবারি দেশের মানুষের দুর্ভিক্ষের কথা মাথায় রেখে খাদ্যপণ্য চোরাচালান করতে চায় না। 
আমাদের দেশের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ব্যাংকের টাকা, রাষ্ট্রের অনেক সম্পদ অবৈধভাবে উপার্জন করে—দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে, গৃহহীন রেখে, শিক্ষা-চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে, নির্দ্বিধায় হাজার হাজার কোটি টাকা মালয়েশিয়া, দুবাই, কানাডা, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করে—জাতিকে গরিব ও অভুক্ত রেখে। সমাজের উঁচু পর্যায়ের এসব মানুষ রানাঘাটের ওই চোরাকারবারির চেয়েও অধম। এদের বিচার দেশদ্রোহিতার আইনে হওয়া উচিত। 
 
লেখক: প্রকৌশলী ও গবেষক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত