মাহবুব কামাল
শৈশবে আমার জাপানি রূপকথা নিয়ে খুব সুন্দর একটি বই ছিল। বইজুড়ে ছিল দারুণ সুন্দর সব ছবি। মূল দশটি জাপানি গল্পের অনুবাদ নিয়ে এই সংকলনের গল্পগুলোর অনুবাদক ছিলেন জালাল আহমদ। তিনি বোধকরি একসময় টোকিওর পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। বইটির প্রচ্ছদে ওপর থেকে নিচে কোনো এক জাপানি বর্ণমালায় লেখা ছিল ‘নিপ্পন নো ওতোগি বানাসি’, অর্থ জাপানি রূপকথা। আমি তো জাপানি ভাষা জানি না, তবে মনে আছে, ভূমিকায় অনুবাদক উল্লেখ করেছিলেন। প্রচ্ছদে ছবি ছিল একটি জাপানি শিশু চমৎকার একটি ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।
পুরোটা আমার মনে নেই, তবে মনে আছে, প্রথম গল্পটি ছিল ‘জাপান দেশের জন্মকথা’। আরও কয়েকটি গল্প ছিল ‘ইস্সুনবোশি’, ‘মমতারো’, ‘কাগওয়াহিমে’ (জ্যোৎস্নাকুমারী?), ‘হানাসাকাজিজি’, ‘উরাশিমা তারো’। আরও একটি গল্প ছিল ‘সাগরের পানি নোনা কেন’। তবে এই গল্প ইউরোপের কোনো কোনো দেশে প্রায় হুবহু প্রচলিত আছে। জাপানি গল্পটিই মূল গল্প কি না, আমার ঠিক জানা নেই। এই সাতটি গল্পের কথাই কিছু কিছু মনে আছে।
‘জাপান দেশের জন্মকথা’ ঠিক রূপকথা বলা চলে না, এটি শিন্টো পুরাণে বিবৃত একটি উপাখ্যান। প্রথম দেবদেবী ইজানাগি ও ইজানামি স্বর্গ কিংবা আকাশে বসে একটি লম্বা বল্লমের সাহায্যে কাদার রং দিয়ে সমুদ্রের বুকে কয়েকটি দ্বীপ আঁকলেন কিংবা সৃষ্টি করলেন। সেই দ্বীপগুলো নিয়েই জাপান।
ইস্সুনবোশি ছিল এক বয়স্ক দম্পতির শেষ বয়সের সন্তান। সে লম্বায় ছিল আঙুলের চেয়েও ছোট। ষোলো বছর বয়স হওয়ার পর সে একদিন ভাগ্যের খোঁজে ভাতের বাটিতে চেপে রাজধানীর দিকে যাত্রা করল, ভাতের কাঠি হলো তার দাঁড়, সামুরাই তরবারি হিসেবে নিল একটি সুই। রাজধানীর কাছেই এক ভূস্বামীর বাড়িতে খুদে সামুরাই হিসেবে তার চাকরি জুটল। একদিন এক দানব এসে ভূস্বামীর মেয়েকে অপহরণ করলে ইস্সুনবোশি তার পিছু ধাওয়া করল। দানব অতিষ্ঠ হয়ে তাকে সোজাসুজি গিলে ফেলল।
ইস্সুনবোশি তার তরবারির সাহায্যে দানবের নাড়িভুঁড়ি ক্ষতবিক্ষত করা শুরু করলে দানব তাকে উগরে দিয়ে পালিয়ে গেল। দানবের ফেলে যাওয়া হাতুড়িটা কয়েকবার ঘোরানোর পরেই ইস্সুনবোশি মানুষের মতোই লম্বা হয়ে গেল। ভূস্বামীর মেয়েকে বিয়ে করে সামুরাই ইস্সুনবোশি সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। বইটিতে প্রতিটি গল্পের শেষে একটি জাপানি ছড়া কিংবা গান আর বাংলা অনুবাদ দেওয়া ছিল।
এমন একটা গল্প আছে ঠাকুরমার ঝুলিতে, দেড় আঙুলে মানুষ, তার তিন আঙুলে টিকি। কাঠুরের ছেলে দেড় আঙুলে হুলোবেড়ালে চেপে, সাতনলি লাউয়ের খোলস হাতে রাজ্যের চোরদের দমন করার পুরস্কার হিসেবে রাজা তাঁর অন্ধ মেয়ের বিয়ে দেন। কুনোরানির (কুনোব্যাঙের রানি) থুতু দিয়ে রাজকন্যার চোখ ফোটায় দেড় আঙুলে পিপ্পলকুমার। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের গল্প থাম্বেলিনা বুড়ো আঙুলের আকারের এক মেয়ের গল্প। থাম্বেলিনার গল্প আরও বেশি ঘটনাবহুল অভিযানে ভরা। গল্পের শেষে থাম্বেলিনা পরির দেশে তারই আকারের জীবনসাথি খুঁজে পায় বন্ধু সোয়ালোপাখির সাহায্যে।
মমতারো নামটির অর্থ পিচকুমার। এক নিঃসন্তান দম্পতি একদিন নদীতে একটি বিশাল মম অর্থাৎ পিচ ফল কুড়িয়ে পায়। ফলটি খাওয়ার জন্য দুভাগ করতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ফুটফুটে এক শিশু। সেই গ্রামে প্রায়ই একদল দানব হানা দিয়ে লুটতরাজ করত। একদিন মমতারো বেরিয়ে পড়ল দানবদ্বীপের উদ্দেশে। বের হওয়ার সময় তার মা একটি থলেতে কিছু ‘যিবিদানগো’ পিঠে দিয়ে দেয়। পথে এক এক করে মমতারোর দেখা হয় এক কুকুর, বানর এবং মোরগের (?) সঙ্গে, যিবিদানগো খেতে দেওয়ায় ওদের সঙ্গে মমতারোর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বন্ধুদের সাহায্যে মমতারো দানবদের পরাজিত করে। অনুবাদক লিখেছিলেন, ইয়োকোহামায় যিবিদানগো পিঠে এখনো পাওয়া যায়। ১৯৮৭ সালে কয়েক ঘণ্টার জন্য ইয়োকোহামায় গিয়েছিলাম। যিবিদানগোর কথা মনেই হয়নি, মনে হলেই–বা কী হতো? পিচকুমার নাম থেকে মনে হয়ে যায় ঠাকুরমার ঝুলির ‘ডালিমকুমার’ গল্পের কথা। তবে গল্পটি একেবারেই অন্যরকম। ডালিমকুমারের জন্ম ডালিম ফল থেকে নয়, তবে তার আয়ু ডালিমের বীজের মাঝে। এক ভরা পূর্ণিমার রাতে এক নিঃসন্তান দম্পতি বাঁশবাগানের মাঝে এক ফুটফুটে কন্যাশিশুকে খুঁজে পায়। সেই শিশুই বড় হয়ে এক অনিন্দ্যসুন্দর যুবতী হয়ে ওঠে, সেই কন্যাই কাগওয়াহিমে। কাগওয়াহিমের রূপে মুগ্ধ হয়ে জাপানের সম্রাট তাকে বিয়ে করতে চায়। কাগওয়াহিমে প্রত্যাখ্যান করলে এক পূর্ণিমার রাতে সম্রাট সৈন্যসামন্ত পাঠায় তাকে ধরে আনতে। সেই পূর্ণিমার রাতেই কাগওয়াহিমে সরাসরি স্বর্গে ফিরে যায়। কাগওয়াহিমের উপাখ্যান নিয়ে চলচ্চিত্রও হয়েছে।
হানাসাকাজিজি এক নিঃসন্তান দম্পতি, তাদের কুকুর ও দুষ্টু প্রতিবেশীর গল্প। এই গল্পের শেষ অংশটুকু হলো, বৃদ্ধ লোকটি ছাই ছড়িয়ে চেরি ফুল ফুটিয়েছিলেন। গল্পটির শেষে দুই স্তবকের একটি গান ছিল। গানটির প্রথম স্তবকটির শুরু ছিল ‘হারু গা মিতা’ (বসন্ত এসেছে), দ্বিতীয় স্তবকটির শুরু ছিল ‘হানা গা সাকু’ (ফুল ফুটেছে)। উরাশিমা তারো ছিল অত্যন্ত ভালো মানুষ এক জেলে। একদিন এক সামুদ্রিক কচ্ছপকে সে দুষ্টু শিশুদের হাত থেকে বাঁচায়। সেই কচ্ছপ উরাশিমাকে পিঠে করে পাতালপুরীতে নিয়ে যায়, সেখানে মহানন্দে তার তিন দিন কেটে যায়। উরাশিমা ডাঙায় আসতে চাইলে পাতাল রাজকন্যা তাকে একটি বাক্স দিয়ে বলে, কোনো অবস্থায়ই যেন না খোলে। উরাশিমা তীরে এসে কিছুই চিনতে পারে না। পরে লোকজন তাকে বলে, প্রায় তিন শ বছর আগে উরাশিমা নামের এক জেলে গ্রাম থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। উরাশিমা মনের দুঃখে বাক্স খুলে ফেলার পর চারদিকে ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। ধোঁয়া সরে গেলে উরাশিমা টের পায় সে লোলচর্ম বৃদ্ধে পরিণত হয়েছে। অনেকটা এই ধরনের কাহিনি ওয়াশিংটন আরভিঙের লেখা রিপ ভ্যান উইংকল। তবে উরাশিমার জীবন থেকে ৩০০ বছর হারিয়ে গিয়েছিল, আর রিপ ভ্যান উইংকল ‘মাত্র’ বিশ বছর ঘুমিয়ে ছিল।
‘সাগরের পানি লোনা কেন’ গল্পটি একটি জাদুর জাঁতা নিয়ে। জাঁতাটি ছিল এক ভালো মানুষের, কীভাবে সে জাঁতাটি পেয়েছিল মনে করতে পারছি না। ‘দেরো দেরো দেরো’ বলে কোনো কিছু চেয়ে জাঁতার হাতলটি ডানে ঘোরালে সেই বস্তুটি আসতেই থাকত, ‘তোমোরো তোমোরো তোমোরো’ বলে হাতলটি বামে ঘোরালে আসা থেমে যেত। এক মন্দ পড়শি অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে জাঁতাটি চুরি করল। ধরা পড়ার ভয়ে সে নৌকা নিয়ে সাগরে রওনা হলো। খাওয়ার জন্য সে সঙ্গে নিল কিছু ভাত, তবে লবণ বা কোনো তরকারি নিতে ভুলে গেল। খাওয়ার সময় সে হাতল ঘুরিয়ে লবণ চাইল। রাশি রাশি লবণ আসা শুরু হলে সে হাতল ঘুরিয়ে থামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু মন্ত্র বলতে ভুলে যাওয়ায় কাজ হলো না। কিছুতেই সে মন্ত্রটি মনে করতে পারল না। ঘোরানোর চোটে হাতলটি ভেঙেই গেল; কিন্তু লবণ আসা থামল না। শেষে লবণের ভারে মন্দলোকটিকে নিয়ে জাঁতাসুদ্ধ নৌকাটি তলিয়ে গেল। সমুদ্রের নিচেও লবণ বের হওয়া থামল না, এখনো থামেনি। সেই থেকে সাগরের পানি লোনা। ১৯০৭ সালে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সংগৃহীত দশটি রূপকথা এবং চারটি লোককথা নিয়ে প্রকাশিত হয় ঠাকুরমার ঝুলি। দক্ষিণারঞ্জন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় তাঁর পিসিমার জমিদারির রক্ষণাবেক্ষণের ফাঁকে ফাঁকে কাহিনিগুলো সংগ্রহ করেন। প্রথম সংস্করণে ঠাকুরমার ঝুলির পাত্র-পাত্রীদের মুখে ছিল ময়মনসিংহের আঞ্চলিক বুলির সংলাপ। পরবর্তী সংস্করণে তিনি সেটি বদলে ফেলেন।
ঠাকুরমার ঝুলি সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত প্রণিধানযোগ্য: ‘তিনি ঠাকুরমার মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পুঁতিয়াছেন তবু তাহার পাতাগুলি প্রায় তেমনি সবুজ, তেমনি তাজাই রহিয়াছে; রূপকথার সেই বিশেষ ভাষা, বিশেষ রীতি, তাহার সেই প্রাচীন সরলতাটুকু তিনি যে এতটা দূর রক্ষা করিতে পারিয়াছেন, ইহাতে তাঁহার সূক্ষ্ম রসবোধ ও স্বাভাবিক কলানৈপুণ্যের প্রকাশ পাইয়াছে।’ ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথাগুলোতে জাপানি এবং বিশ্বের সব দেশের রূপকথার গল্পের মতোই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির জয় হয়। তাই ঠাকুরমার ঝুলিতে ‘পাতালপুরী রাজ্যের সব সাপ বাতাস হয়ে’ উড়ে যায়, ‘পৃথিবীতে যত রাক্ষস জন্মের মতো’ ধ্বংস হয়ে যায়। আর জাপানি রূপকথার ইস্সুনবোশি আর মমতারোর হাতে দানবের দল পরাস্ত হয়, মন্দ প্রতিবেশী সাগরের জলে ডুবে মরে।
লেখক∶ প্রবাসী
শৈশবে আমার জাপানি রূপকথা নিয়ে খুব সুন্দর একটি বই ছিল। বইজুড়ে ছিল দারুণ সুন্দর সব ছবি। মূল দশটি জাপানি গল্পের অনুবাদ নিয়ে এই সংকলনের গল্পগুলোর অনুবাদক ছিলেন জালাল আহমদ। তিনি বোধকরি একসময় টোকিওর পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। বইটির প্রচ্ছদে ওপর থেকে নিচে কোনো এক জাপানি বর্ণমালায় লেখা ছিল ‘নিপ্পন নো ওতোগি বানাসি’, অর্থ জাপানি রূপকথা। আমি তো জাপানি ভাষা জানি না, তবে মনে আছে, ভূমিকায় অনুবাদক উল্লেখ করেছিলেন। প্রচ্ছদে ছবি ছিল একটি জাপানি শিশু চমৎকার একটি ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।
পুরোটা আমার মনে নেই, তবে মনে আছে, প্রথম গল্পটি ছিল ‘জাপান দেশের জন্মকথা’। আরও কয়েকটি গল্প ছিল ‘ইস্সুনবোশি’, ‘মমতারো’, ‘কাগওয়াহিমে’ (জ্যোৎস্নাকুমারী?), ‘হানাসাকাজিজি’, ‘উরাশিমা তারো’। আরও একটি গল্প ছিল ‘সাগরের পানি নোনা কেন’। তবে এই গল্প ইউরোপের কোনো কোনো দেশে প্রায় হুবহু প্রচলিত আছে। জাপানি গল্পটিই মূল গল্প কি না, আমার ঠিক জানা নেই। এই সাতটি গল্পের কথাই কিছু কিছু মনে আছে।
‘জাপান দেশের জন্মকথা’ ঠিক রূপকথা বলা চলে না, এটি শিন্টো পুরাণে বিবৃত একটি উপাখ্যান। প্রথম দেবদেবী ইজানাগি ও ইজানামি স্বর্গ কিংবা আকাশে বসে একটি লম্বা বল্লমের সাহায্যে কাদার রং দিয়ে সমুদ্রের বুকে কয়েকটি দ্বীপ আঁকলেন কিংবা সৃষ্টি করলেন। সেই দ্বীপগুলো নিয়েই জাপান।
ইস্সুনবোশি ছিল এক বয়স্ক দম্পতির শেষ বয়সের সন্তান। সে লম্বায় ছিল আঙুলের চেয়েও ছোট। ষোলো বছর বয়স হওয়ার পর সে একদিন ভাগ্যের খোঁজে ভাতের বাটিতে চেপে রাজধানীর দিকে যাত্রা করল, ভাতের কাঠি হলো তার দাঁড়, সামুরাই তরবারি হিসেবে নিল একটি সুই। রাজধানীর কাছেই এক ভূস্বামীর বাড়িতে খুদে সামুরাই হিসেবে তার চাকরি জুটল। একদিন এক দানব এসে ভূস্বামীর মেয়েকে অপহরণ করলে ইস্সুনবোশি তার পিছু ধাওয়া করল। দানব অতিষ্ঠ হয়ে তাকে সোজাসুজি গিলে ফেলল।
ইস্সুনবোশি তার তরবারির সাহায্যে দানবের নাড়িভুঁড়ি ক্ষতবিক্ষত করা শুরু করলে দানব তাকে উগরে দিয়ে পালিয়ে গেল। দানবের ফেলে যাওয়া হাতুড়িটা কয়েকবার ঘোরানোর পরেই ইস্সুনবোশি মানুষের মতোই লম্বা হয়ে গেল। ভূস্বামীর মেয়েকে বিয়ে করে সামুরাই ইস্সুনবোশি সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। বইটিতে প্রতিটি গল্পের শেষে একটি জাপানি ছড়া কিংবা গান আর বাংলা অনুবাদ দেওয়া ছিল।
এমন একটা গল্প আছে ঠাকুরমার ঝুলিতে, দেড় আঙুলে মানুষ, তার তিন আঙুলে টিকি। কাঠুরের ছেলে দেড় আঙুলে হুলোবেড়ালে চেপে, সাতনলি লাউয়ের খোলস হাতে রাজ্যের চোরদের দমন করার পুরস্কার হিসেবে রাজা তাঁর অন্ধ মেয়ের বিয়ে দেন। কুনোরানির (কুনোব্যাঙের রানি) থুতু দিয়ে রাজকন্যার চোখ ফোটায় দেড় আঙুলে পিপ্পলকুমার। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের গল্প থাম্বেলিনা বুড়ো আঙুলের আকারের এক মেয়ের গল্প। থাম্বেলিনার গল্প আরও বেশি ঘটনাবহুল অভিযানে ভরা। গল্পের শেষে থাম্বেলিনা পরির দেশে তারই আকারের জীবনসাথি খুঁজে পায় বন্ধু সোয়ালোপাখির সাহায্যে।
মমতারো নামটির অর্থ পিচকুমার। এক নিঃসন্তান দম্পতি একদিন নদীতে একটি বিশাল মম অর্থাৎ পিচ ফল কুড়িয়ে পায়। ফলটি খাওয়ার জন্য দুভাগ করতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ফুটফুটে এক শিশু। সেই গ্রামে প্রায়ই একদল দানব হানা দিয়ে লুটতরাজ করত। একদিন মমতারো বেরিয়ে পড়ল দানবদ্বীপের উদ্দেশে। বের হওয়ার সময় তার মা একটি থলেতে কিছু ‘যিবিদানগো’ পিঠে দিয়ে দেয়। পথে এক এক করে মমতারোর দেখা হয় এক কুকুর, বানর এবং মোরগের (?) সঙ্গে, যিবিদানগো খেতে দেওয়ায় ওদের সঙ্গে মমতারোর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বন্ধুদের সাহায্যে মমতারো দানবদের পরাজিত করে। অনুবাদক লিখেছিলেন, ইয়োকোহামায় যিবিদানগো পিঠে এখনো পাওয়া যায়। ১৯৮৭ সালে কয়েক ঘণ্টার জন্য ইয়োকোহামায় গিয়েছিলাম। যিবিদানগোর কথা মনেই হয়নি, মনে হলেই–বা কী হতো? পিচকুমার নাম থেকে মনে হয়ে যায় ঠাকুরমার ঝুলির ‘ডালিমকুমার’ গল্পের কথা। তবে গল্পটি একেবারেই অন্যরকম। ডালিমকুমারের জন্ম ডালিম ফল থেকে নয়, তবে তার আয়ু ডালিমের বীজের মাঝে। এক ভরা পূর্ণিমার রাতে এক নিঃসন্তান দম্পতি বাঁশবাগানের মাঝে এক ফুটফুটে কন্যাশিশুকে খুঁজে পায়। সেই শিশুই বড় হয়ে এক অনিন্দ্যসুন্দর যুবতী হয়ে ওঠে, সেই কন্যাই কাগওয়াহিমে। কাগওয়াহিমের রূপে মুগ্ধ হয়ে জাপানের সম্রাট তাকে বিয়ে করতে চায়। কাগওয়াহিমে প্রত্যাখ্যান করলে এক পূর্ণিমার রাতে সম্রাট সৈন্যসামন্ত পাঠায় তাকে ধরে আনতে। সেই পূর্ণিমার রাতেই কাগওয়াহিমে সরাসরি স্বর্গে ফিরে যায়। কাগওয়াহিমের উপাখ্যান নিয়ে চলচ্চিত্রও হয়েছে।
হানাসাকাজিজি এক নিঃসন্তান দম্পতি, তাদের কুকুর ও দুষ্টু প্রতিবেশীর গল্প। এই গল্পের শেষ অংশটুকু হলো, বৃদ্ধ লোকটি ছাই ছড়িয়ে চেরি ফুল ফুটিয়েছিলেন। গল্পটির শেষে দুই স্তবকের একটি গান ছিল। গানটির প্রথম স্তবকটির শুরু ছিল ‘হারু গা মিতা’ (বসন্ত এসেছে), দ্বিতীয় স্তবকটির শুরু ছিল ‘হানা গা সাকু’ (ফুল ফুটেছে)। উরাশিমা তারো ছিল অত্যন্ত ভালো মানুষ এক জেলে। একদিন এক সামুদ্রিক কচ্ছপকে সে দুষ্টু শিশুদের হাত থেকে বাঁচায়। সেই কচ্ছপ উরাশিমাকে পিঠে করে পাতালপুরীতে নিয়ে যায়, সেখানে মহানন্দে তার তিন দিন কেটে যায়। উরাশিমা ডাঙায় আসতে চাইলে পাতাল রাজকন্যা তাকে একটি বাক্স দিয়ে বলে, কোনো অবস্থায়ই যেন না খোলে। উরাশিমা তীরে এসে কিছুই চিনতে পারে না। পরে লোকজন তাকে বলে, প্রায় তিন শ বছর আগে উরাশিমা নামের এক জেলে গ্রাম থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। উরাশিমা মনের দুঃখে বাক্স খুলে ফেলার পর চারদিকে ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। ধোঁয়া সরে গেলে উরাশিমা টের পায় সে লোলচর্ম বৃদ্ধে পরিণত হয়েছে। অনেকটা এই ধরনের কাহিনি ওয়াশিংটন আরভিঙের লেখা রিপ ভ্যান উইংকল। তবে উরাশিমার জীবন থেকে ৩০০ বছর হারিয়ে গিয়েছিল, আর রিপ ভ্যান উইংকল ‘মাত্র’ বিশ বছর ঘুমিয়ে ছিল।
‘সাগরের পানি লোনা কেন’ গল্পটি একটি জাদুর জাঁতা নিয়ে। জাঁতাটি ছিল এক ভালো মানুষের, কীভাবে সে জাঁতাটি পেয়েছিল মনে করতে পারছি না। ‘দেরো দেরো দেরো’ বলে কোনো কিছু চেয়ে জাঁতার হাতলটি ডানে ঘোরালে সেই বস্তুটি আসতেই থাকত, ‘তোমোরো তোমোরো তোমোরো’ বলে হাতলটি বামে ঘোরালে আসা থেমে যেত। এক মন্দ পড়শি অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে জাঁতাটি চুরি করল। ধরা পড়ার ভয়ে সে নৌকা নিয়ে সাগরে রওনা হলো। খাওয়ার জন্য সে সঙ্গে নিল কিছু ভাত, তবে লবণ বা কোনো তরকারি নিতে ভুলে গেল। খাওয়ার সময় সে হাতল ঘুরিয়ে লবণ চাইল। রাশি রাশি লবণ আসা শুরু হলে সে হাতল ঘুরিয়ে থামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু মন্ত্র বলতে ভুলে যাওয়ায় কাজ হলো না। কিছুতেই সে মন্ত্রটি মনে করতে পারল না। ঘোরানোর চোটে হাতলটি ভেঙেই গেল; কিন্তু লবণ আসা থামল না। শেষে লবণের ভারে মন্দলোকটিকে নিয়ে জাঁতাসুদ্ধ নৌকাটি তলিয়ে গেল। সমুদ্রের নিচেও লবণ বের হওয়া থামল না, এখনো থামেনি। সেই থেকে সাগরের পানি লোনা। ১৯০৭ সালে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সংগৃহীত দশটি রূপকথা এবং চারটি লোককথা নিয়ে প্রকাশিত হয় ঠাকুরমার ঝুলি। দক্ষিণারঞ্জন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় তাঁর পিসিমার জমিদারির রক্ষণাবেক্ষণের ফাঁকে ফাঁকে কাহিনিগুলো সংগ্রহ করেন। প্রথম সংস্করণে ঠাকুরমার ঝুলির পাত্র-পাত্রীদের মুখে ছিল ময়মনসিংহের আঞ্চলিক বুলির সংলাপ। পরবর্তী সংস্করণে তিনি সেটি বদলে ফেলেন।
ঠাকুরমার ঝুলি সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত প্রণিধানযোগ্য: ‘তিনি ঠাকুরমার মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পুঁতিয়াছেন তবু তাহার পাতাগুলি প্রায় তেমনি সবুজ, তেমনি তাজাই রহিয়াছে; রূপকথার সেই বিশেষ ভাষা, বিশেষ রীতি, তাহার সেই প্রাচীন সরলতাটুকু তিনি যে এতটা দূর রক্ষা করিতে পারিয়াছেন, ইহাতে তাঁহার সূক্ষ্ম রসবোধ ও স্বাভাবিক কলানৈপুণ্যের প্রকাশ পাইয়াছে।’ ঠাকুরমার ঝুলির রূপকথাগুলোতে জাপানি এবং বিশ্বের সব দেশের রূপকথার গল্পের মতোই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির জয় হয়। তাই ঠাকুরমার ঝুলিতে ‘পাতালপুরী রাজ্যের সব সাপ বাতাস হয়ে’ উড়ে যায়, ‘পৃথিবীতে যত রাক্ষস জন্মের মতো’ ধ্বংস হয়ে যায়। আর জাপানি রূপকথার ইস্সুনবোশি আর মমতারোর হাতে দানবের দল পরাস্ত হয়, মন্দ প্রতিবেশী সাগরের জলে ডুবে মরে।
লেখক∶ প্রবাসী
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১৪ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১৪ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১৪ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ দিন আগে