কুদরত-ই-হুদা
বাংলাদেশকে কী দিয়ে চেনা যায়? উত্তরে অনেক কিছুই হয়তো আসতে পারে–ভালো ও খারাপ দুদিক থেকেই। কিন্তু বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যসূচক কোনো ছোট্ট তালিকা করলেও বোধকরি বর্ষা, বৃষ্টি, পানির অবস্থান প্রথম দিকেই থাকবে। শুধু এই দিক বিবেচনা করে বেশ জোরেশোরে যেখানে-সেখানে বলা যায়, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’
সেটা বোধকরি ১৯৩৪-৩৫ সালের কথা। সৈয়দ মুজতবা আলী তখন মিসরের রাজধানী কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সেখানে কোনো বৃষ্টিপাত নেই। কায়রোর গাছপালাগুলোর ওপর সাহারার ধূসর ধুলো জেঁকে বসে আছে। গাছগুলো যে সবুজ, তা বুঝবার জো নেই। এই অবস্থা দেখে মুজতবার ভারি দুঃখ হচ্ছিল। গাছপালার জন্য আফসোস করে তিনি বলেছিলেন, ‘এদের কপালে কি কোনো প্রকার মুক্তিস্নান নেই!’ বর্ষা সম্পর্কে এবং বর্ষা নিয়ে কাব্য-কবিতায় বিচিত্রভাবে উচ্ছ্বসিত বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে তিনি তাঁর বন্ধুদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁরা তা অনুভব করতে নারাজ। শুধু নারাজ নয়, অপারগও বটে। কারণ, তাঁদের কাছে বৃষ্টি মানে আপদ। বর্ষাকাল বলে তাদের কোনো ঋতু নেই। ঋতু সেখানে চারটি—গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত আর বসন্ত। মুজতবা কায়রোয় যত দিন ছিলেন, একবার বা দুবার হয়তো বৃষ্টি দেখেছিলেন। তা-ও তো এক-দুবার সেখানে বৃষ্টি হয়! মুজতবার এক সুদানি বন্ধু তাঁকে কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, তাঁদের দেশে নাকি একবার বৃষ্টি হয়েছিল। হঠাৎ বৃষ্টি দেখে বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে ‘জোয়ান-মদ্দরা’ পর্যন্ত দোয়া-দরুদ পড়তে থাকল। কাঁদতে আরম্ভ করল হাউমাউ করে। কারণ, সবার ধারণা হয়েছিল, কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। যদি তা–ই না হবে, তবে এভাবে আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে ভেঙে পড়বে কেন! এমন তো কোনোদিন দেখা যায়নি। সেবার ষাট বছর পর সুদানের ওই এলাকায় বৃষ্টি হয়েছিল। এদিক থেকে বাংলাদেশ চোখে পড়ার মতো আলাদা বৈকি! বাংলাদেশকে বলা হয় ‘অবিরল বৃষ্টিধারার দেশ’। বৃষ্টি, বর্ষা আর পানি বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচয়কে স্থায়ী রূপ দিয়েছে।
একটা সময় ছিল কলকাতায় বাংলাদেশের বাঙালিদের আলাদা করা হতো পানি দিয়ে। ব্যাপারটা খোলাসা করা যেতে পারে। ১৮৬৬ সালের কথা। এই সালে দীনবন্ধু মিত্রের একটা নাটক প্রকাশিত হয়। নাটকের নাম ‘সধবার একাদশী’। সেখানে কলকাতার অধিবাসীদের সঙ্গে একটা ‘বাঙ্গাল’ (তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষকে ব্যঙ্গ করে ‘বাঙ্গাল’ বলা হতো) চরিত্র ছিল। সেই চরিত্রকে কলকাতার এক চরিত্র দুই পা ফাঁক করে খুব হাস্যকর এক ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে বলছে, ‘বাঙ্গাল! ডেঙ্গা পথের কাঙ্গাল।’ মানে হলো, বাঙাল মুলুকে স্থলপথ নেই, খালি জলপথ। বাংলাদেশে দীনবন্ধু কিছুদিন ডাক বিভাগে চাকরি করেছিলেন। তখন তাঁর কর্মস্থল ছিল নদীয়া ও ঢাকা বিভাগে। এ কারণে বোধ করি তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘নীলদর্পণ’ ঢাকা থেকেই ১৮৬০ সালে প্রথম ছাপা হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব বাংলার কৃষক এবং ভৌগোলিক স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে তিনি খুবই ওয়াকিবহাল ছিলেন। ফলে তিনি ভালো করেই জানতেন, ‘বাঙ্গাল! ডেঙ্গা পথের কাঙ্গাল।’ এই জল-জঙ্গলের এলাকা বলেই কিন্তু ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। কারণ, সরকারি উদ্যোগে পূর্ব বাংলার সব নৌকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কারণ, জাপানি বাহিনী এখানে যদি এসেই যায়, তবে নৌকা ছাড়া তাদের চলাচলতি যেন বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু ফল হলো উল্টো। চলাচলতির অভাবে খাবার না পেয়ে বাংলাদেশে মারা গেল লাখ লাখ মানুষ। সে এক করুণ ইতিহাস বটে!
শুধু উনিশ শতকের নাটকে নয়, অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, খোদ ‘বঙ্গ’ শব্দটিরই উদ্ভব হয়েছে তিব্বতি ভাষার শব্দ ‘বঙস্’ থেকে। কারণ, তিব্বতি ভাষায় ‘বঙস্’ শব্দের অর্থ ‘ভেজা’, ‘আর্দ্র’। অনেকে মনে করেন, ‘বঙস্’ শব্দটির ‘অং’ অংশের অর্থ ‘জলাভূমি’। জলপূর্ণ দেশে যারা বাস করে তাদেরকে ‘বঙ্গ’ বলা হয়। এই বঙ্গজাতির দেশ বঙ্গদেশ; বাংলাদেশ। শুধু তা–ই নয়, ১০২৫ সালের রাজেন্দ্র চোলের তিরুমলয় শিলালিপিতে বাংলাদেশকে ‘অবিরল বৃষ্টিধারার দেশ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
বর্তমান বাংলাদেশকে শুধু ঢাকা শহর থেকে দেখলে বোঝা যাবে না। যেকোনো গ্রামে গেলে বাংলাদেশের অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, জলমহাল, ঝোপ-জঙ্গল বলে দেবে এটি একসময় বিশাল জলরাশিরই অংশ ছিল। এ কারণেই কি পূর্ব বাংলার চতুর্দশ শতকের কবি কানা হরিদত্ত ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য লিখেছিলেন? সম্ভবত তাই। সাপের অতিরিক্ত উপদ্রবের কারণেই এখানে মনসার পূজাকেন্দ্রিক কাব্য মনসামঙ্গলের উদ্ভব হয়েছিল। এ কারণে, মঙ্গলকাব্যগুলোর মধ্যে একমাত্র মনসামঙ্গলকেই বলা হয় পূর্ব বাংলার নিজস্ব সম্পদ।
বিপুল-বিস্তীর্ণ জলরাশি, অঢেল বৃষ্টি আর দীর্ঘমেয়াদি বর্ষাকাল বাংলাদেশকে বলা যায় সারা পৃথিবী থেকে আলাদা করেছে। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই তাঁর বিভিন্ন কথাবার্তায় বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতেন বাংলাদেশের এই অপরিকল্পিত বিস্তীর্ণ জলরাশি দিয়ে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে তাঁর চীন ভ্রমণের কথা; ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ের কথা। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘পীর সাহেব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইরা নদীর পাড়, বিরাট নদী, নদীর পাড়ে কারখানা, নদীর ঢেউ দেখতে ভালোবাসে। কারণ, পাঞ্জাব ও সীমান্তের ভাইদের কপালে এ সমস্ত কম জোটে।
আমরা পূর্ব-বাংলার লোক নদীর পাড়ে যাদের ঘর, নদীর সাথে যাদের বন্ধুত্ব, ঢেউয়ের সাথে যাদের কোলাকুলি, তারা কি দেখতে ভালোবাসে এগুলো?’ চীনের এক লেকে বঙ্গবন্ধুর নৌকা চালনা দেখে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অবাক হয়ে তাঁকে তাঁর দেশের নাম জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তরে মুজিব বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান।’ কিন্তু তিনি যখন টের পেলেন, তারা এই দেশের নাম কখনো শোনেনি, তখন তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমাদের পানির দেশ, বৎসরে ৬ মাস আমরা পানির মধ্যে বাস করি।’
এই পানি, বর্ষা, বৃষ্টি বাংলাদেশের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকসহ যাবতীয় শিল্পে আখর রেখে যায়। কাব্য-কবিতায়-সাহিত্যে বৃষ্টি, বর্ষা আর পানির আওয়াজ সহজেই শোনা যায়। এখানকার কবির পক্ষেই বলা সম্ভব, ‘পিঁপড়ারা রোজ রোজ নৌকাভর্তি জ্যোৎস্না নিয়ে আসে।’ এমনকি রবীন্দ্রনাথের গল্প বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নীরদচন্দ্র চৌধুরী আবিষ্কার করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে পানির প্রবল প্রতাপ মূলত তাঁর বাংলাদেশের পানির সংস্পর্শে আসার ফল।
শুধু কি রবীন্দ্রনাথের গল্প আর বাংলাদেশের সাহিত্যে-শিল্পে পানি-বর্ষার প্রভাব? না, শুধু তা নয়। বাংলাদেশের ভাষাকেও সম্ভবত এখানকার বিস্তীর্ণ জলভাগ প্রভাবিত করে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। তা না হলে এখানকার নামবাচক আর ক্রিয়াবাচক বিচিত্র শব্দের মধ্যে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চলের জলরাশির মতো বিস্তারিত হওয়ার ঝোঁক কেন! কেন ‘আসতেছি’, ‘কইরা’, ‘যাইয়া’, ‘মাইয়া’, ‘নাইয়া’র মতো অসংখ্য শব্দ শুধুই দিগন্তমুখী হয়ে ছড়িয়ে পড়তে চায়! কেন শব্দগুলো ‘আসছি’, ‘করে’, ‘যেয়ে’, ‘মেয়ে’, ‘নেয়ে’ নয়! এ কথা শুনে কেউ নিশ্চয় বলবেন না যে, আমি বাংলাকে (পড়ুন বাংলা ভাষাকে) ভাগ করতে বসেছি! বাংলাদেশের বাংলা ভাষার এই বিস্তারিত হওয়ার খাসলতের কথা কিন্তু শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রায় সবাই-ই স্বীকার করেছেন।
পানির ছলাৎ শব্দে জেগে উঠলেই বুঝতে পারি, এই তো বাংলাদেশ। পানি বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য, যাপন, চিন্তা, প্রযুক্তি, বাস্তুসংস্থান থেকে শুরু করে ভাষা পর্যন্ত গভীর ছাপ রেখে গেছে এবং বহুকাল যাবেও বটে। বাংলাদেশের মানুষ মূলত ‘পানির দেশের মানুষ’ কথাটা অমূলক নয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শ্রীনগর সরকারি কলেজ, মুন্সিগঞ্জ
বাংলাদেশকে কী দিয়ে চেনা যায়? উত্তরে অনেক কিছুই হয়তো আসতে পারে–ভালো ও খারাপ দুদিক থেকেই। কিন্তু বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যসূচক কোনো ছোট্ট তালিকা করলেও বোধকরি বর্ষা, বৃষ্টি, পানির অবস্থান প্রথম দিকেই থাকবে। শুধু এই দিক বিবেচনা করে বেশ জোরেশোরে যেখানে-সেখানে বলা যায়, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’
সেটা বোধকরি ১৯৩৪-৩৫ সালের কথা। সৈয়দ মুজতবা আলী তখন মিসরের রাজধানী কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সেখানে কোনো বৃষ্টিপাত নেই। কায়রোর গাছপালাগুলোর ওপর সাহারার ধূসর ধুলো জেঁকে বসে আছে। গাছগুলো যে সবুজ, তা বুঝবার জো নেই। এই অবস্থা দেখে মুজতবার ভারি দুঃখ হচ্ছিল। গাছপালার জন্য আফসোস করে তিনি বলেছিলেন, ‘এদের কপালে কি কোনো প্রকার মুক্তিস্নান নেই!’ বর্ষা সম্পর্কে এবং বর্ষা নিয়ে কাব্য-কবিতায় বিচিত্রভাবে উচ্ছ্বসিত বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে তিনি তাঁর বন্ধুদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁরা তা অনুভব করতে নারাজ। শুধু নারাজ নয়, অপারগও বটে। কারণ, তাঁদের কাছে বৃষ্টি মানে আপদ। বর্ষাকাল বলে তাদের কোনো ঋতু নেই। ঋতু সেখানে চারটি—গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত আর বসন্ত। মুজতবা কায়রোয় যত দিন ছিলেন, একবার বা দুবার হয়তো বৃষ্টি দেখেছিলেন। তা-ও তো এক-দুবার সেখানে বৃষ্টি হয়! মুজতবার এক সুদানি বন্ধু তাঁকে কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, তাঁদের দেশে নাকি একবার বৃষ্টি হয়েছিল। হঠাৎ বৃষ্টি দেখে বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে ‘জোয়ান-মদ্দরা’ পর্যন্ত দোয়া-দরুদ পড়তে থাকল। কাঁদতে আরম্ভ করল হাউমাউ করে। কারণ, সবার ধারণা হয়েছিল, কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। যদি তা–ই না হবে, তবে এভাবে আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে ভেঙে পড়বে কেন! এমন তো কোনোদিন দেখা যায়নি। সেবার ষাট বছর পর সুদানের ওই এলাকায় বৃষ্টি হয়েছিল। এদিক থেকে বাংলাদেশ চোখে পড়ার মতো আলাদা বৈকি! বাংলাদেশকে বলা হয় ‘অবিরল বৃষ্টিধারার দেশ’। বৃষ্টি, বর্ষা আর পানি বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচয়কে স্থায়ী রূপ দিয়েছে।
একটা সময় ছিল কলকাতায় বাংলাদেশের বাঙালিদের আলাদা করা হতো পানি দিয়ে। ব্যাপারটা খোলাসা করা যেতে পারে। ১৮৬৬ সালের কথা। এই সালে দীনবন্ধু মিত্রের একটা নাটক প্রকাশিত হয়। নাটকের নাম ‘সধবার একাদশী’। সেখানে কলকাতার অধিবাসীদের সঙ্গে একটা ‘বাঙ্গাল’ (তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষকে ব্যঙ্গ করে ‘বাঙ্গাল’ বলা হতো) চরিত্র ছিল। সেই চরিত্রকে কলকাতার এক চরিত্র দুই পা ফাঁক করে খুব হাস্যকর এক ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে বলছে, ‘বাঙ্গাল! ডেঙ্গা পথের কাঙ্গাল।’ মানে হলো, বাঙাল মুলুকে স্থলপথ নেই, খালি জলপথ। বাংলাদেশে দীনবন্ধু কিছুদিন ডাক বিভাগে চাকরি করেছিলেন। তখন তাঁর কর্মস্থল ছিল নদীয়া ও ঢাকা বিভাগে। এ কারণে বোধ করি তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘নীলদর্পণ’ ঢাকা থেকেই ১৮৬০ সালে প্রথম ছাপা হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব বাংলার কৃষক এবং ভৌগোলিক স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে তিনি খুবই ওয়াকিবহাল ছিলেন। ফলে তিনি ভালো করেই জানতেন, ‘বাঙ্গাল! ডেঙ্গা পথের কাঙ্গাল।’ এই জল-জঙ্গলের এলাকা বলেই কিন্তু ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। কারণ, সরকারি উদ্যোগে পূর্ব বাংলার সব নৌকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কারণ, জাপানি বাহিনী এখানে যদি এসেই যায়, তবে নৌকা ছাড়া তাদের চলাচলতি যেন বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু ফল হলো উল্টো। চলাচলতির অভাবে খাবার না পেয়ে বাংলাদেশে মারা গেল লাখ লাখ মানুষ। সে এক করুণ ইতিহাস বটে!
শুধু উনিশ শতকের নাটকে নয়, অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, খোদ ‘বঙ্গ’ শব্দটিরই উদ্ভব হয়েছে তিব্বতি ভাষার শব্দ ‘বঙস্’ থেকে। কারণ, তিব্বতি ভাষায় ‘বঙস্’ শব্দের অর্থ ‘ভেজা’, ‘আর্দ্র’। অনেকে মনে করেন, ‘বঙস্’ শব্দটির ‘অং’ অংশের অর্থ ‘জলাভূমি’। জলপূর্ণ দেশে যারা বাস করে তাদেরকে ‘বঙ্গ’ বলা হয়। এই বঙ্গজাতির দেশ বঙ্গদেশ; বাংলাদেশ। শুধু তা–ই নয়, ১০২৫ সালের রাজেন্দ্র চোলের তিরুমলয় শিলালিপিতে বাংলাদেশকে ‘অবিরল বৃষ্টিধারার দেশ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
বর্তমান বাংলাদেশকে শুধু ঢাকা শহর থেকে দেখলে বোঝা যাবে না। যেকোনো গ্রামে গেলে বাংলাদেশের অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, জলমহাল, ঝোপ-জঙ্গল বলে দেবে এটি একসময় বিশাল জলরাশিরই অংশ ছিল। এ কারণেই কি পূর্ব বাংলার চতুর্দশ শতকের কবি কানা হরিদত্ত ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য লিখেছিলেন? সম্ভবত তাই। সাপের অতিরিক্ত উপদ্রবের কারণেই এখানে মনসার পূজাকেন্দ্রিক কাব্য মনসামঙ্গলের উদ্ভব হয়েছিল। এ কারণে, মঙ্গলকাব্যগুলোর মধ্যে একমাত্র মনসামঙ্গলকেই বলা হয় পূর্ব বাংলার নিজস্ব সম্পদ।
বিপুল-বিস্তীর্ণ জলরাশি, অঢেল বৃষ্টি আর দীর্ঘমেয়াদি বর্ষাকাল বাংলাদেশকে বলা যায় সারা পৃথিবী থেকে আলাদা করেছে। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই তাঁর বিভিন্ন কথাবার্তায় বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতেন বাংলাদেশের এই অপরিকল্পিত বিস্তীর্ণ জলরাশি দিয়ে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে তাঁর চীন ভ্রমণের কথা; ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ের কথা। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘পীর সাহেব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইরা নদীর পাড়, বিরাট নদী, নদীর পাড়ে কারখানা, নদীর ঢেউ দেখতে ভালোবাসে। কারণ, পাঞ্জাব ও সীমান্তের ভাইদের কপালে এ সমস্ত কম জোটে।
আমরা পূর্ব-বাংলার লোক নদীর পাড়ে যাদের ঘর, নদীর সাথে যাদের বন্ধুত্ব, ঢেউয়ের সাথে যাদের কোলাকুলি, তারা কি দেখতে ভালোবাসে এগুলো?’ চীনের এক লেকে বঙ্গবন্ধুর নৌকা চালনা দেখে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অবাক হয়ে তাঁকে তাঁর দেশের নাম জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তরে মুজিব বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান।’ কিন্তু তিনি যখন টের পেলেন, তারা এই দেশের নাম কখনো শোনেনি, তখন তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমাদের পানির দেশ, বৎসরে ৬ মাস আমরা পানির মধ্যে বাস করি।’
এই পানি, বর্ষা, বৃষ্টি বাংলাদেশের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকসহ যাবতীয় শিল্পে আখর রেখে যায়। কাব্য-কবিতায়-সাহিত্যে বৃষ্টি, বর্ষা আর পানির আওয়াজ সহজেই শোনা যায়। এখানকার কবির পক্ষেই বলা সম্ভব, ‘পিঁপড়ারা রোজ রোজ নৌকাভর্তি জ্যোৎস্না নিয়ে আসে।’ এমনকি রবীন্দ্রনাথের গল্প বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নীরদচন্দ্র চৌধুরী আবিষ্কার করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে পানির প্রবল প্রতাপ মূলত তাঁর বাংলাদেশের পানির সংস্পর্শে আসার ফল।
শুধু কি রবীন্দ্রনাথের গল্প আর বাংলাদেশের সাহিত্যে-শিল্পে পানি-বর্ষার প্রভাব? না, শুধু তা নয়। বাংলাদেশের ভাষাকেও সম্ভবত এখানকার বিস্তীর্ণ জলভাগ প্রভাবিত করে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। তা না হলে এখানকার নামবাচক আর ক্রিয়াবাচক বিচিত্র শব্দের মধ্যে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চলের জলরাশির মতো বিস্তারিত হওয়ার ঝোঁক কেন! কেন ‘আসতেছি’, ‘কইরা’, ‘যাইয়া’, ‘মাইয়া’, ‘নাইয়া’র মতো অসংখ্য শব্দ শুধুই দিগন্তমুখী হয়ে ছড়িয়ে পড়তে চায়! কেন শব্দগুলো ‘আসছি’, ‘করে’, ‘যেয়ে’, ‘মেয়ে’, ‘নেয়ে’ নয়! এ কথা শুনে কেউ নিশ্চয় বলবেন না যে, আমি বাংলাকে (পড়ুন বাংলা ভাষাকে) ভাগ করতে বসেছি! বাংলাদেশের বাংলা ভাষার এই বিস্তারিত হওয়ার খাসলতের কথা কিন্তু শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রায় সবাই-ই স্বীকার করেছেন।
পানির ছলাৎ শব্দে জেগে উঠলেই বুঝতে পারি, এই তো বাংলাদেশ। পানি বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য, যাপন, চিন্তা, প্রযুক্তি, বাস্তুসংস্থান থেকে শুরু করে ভাষা পর্যন্ত গভীর ছাপ রেখে গেছে এবং বহুকাল যাবেও বটে। বাংলাদেশের মানুষ মূলত ‘পানির দেশের মানুষ’ কথাটা অমূলক নয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শ্রীনগর সরকারি কলেজ, মুন্সিগঞ্জ
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১০ ঘণ্টা আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১০ ঘণ্টা আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১০ ঘণ্টা আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
১ দিন আগে