মধ্যবিত্তের হুমায়ূন

বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২১, ০৮: ৩৬
আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২১, ২১: ১৪

২০১২ সাল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে কোনো একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে জীবনের জন্য হুমায়ূন আহমেদ প্রবল আকুতি ব্যক্ত করেছিলেন এই জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে: ‘একটি কচ্ছপ তিন শ বছর বেঁচে থাকে অথচ মানুষের আয়ু এত কম কেন?’ সত্যিই তো, কত জটিল সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা; কিন্তু ‘জীবন এত ছোট ক্যানে’-এর উত্তর তো পাওয়া যায়নি এখনো। ১৯ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমেরিকার একটি হাসপাতালে ৬৩ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন নন্দিত এই কথাসাহিত্যিক। জীবন এবং মৃত্যু এক বড় অনিশ্চয়তার খেলা!

হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্ম কিংবা নাটক-সিনেমা নিয়ে আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। তাঁর সম্পর্কে পাঠকদের কাছে নতুন কোনো তথ্যও আমি তুলে ধরতে পারব না। তিনি কতটি বই লিখেছেন, কয়টি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর পছন্দ-অপছন্দ প্রভৃতি বিষয়ে পাঠকরা আমার চেয়ে বেশি জানেন। পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ফয়জুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন, মা আয়েশা ফয়েজ তিন পুত্রকে ‘মানুষ’ করার জন্য কতটা জীবনসংগ্রাম করেছেন—সে কথাও অজানা নেই কারও। দুই অনুজ উজ্জ্বল প্রতিভাধর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীবও নিজ নিজ গুণেই পাঠকদের কাছে পরিচিত।

জনপ্রিয় লেখক, বড় ধরনের সেলিব্রেটি হুমায়ূন আহমেদ। ফলে ঘরের খবর থেকে শুরু করে তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মকাণ্ডের খবর, তাঁকে নিয়ে নানা কথা-কাহিনি পাঠকরা পড়েছেন। কিছু মানুষের এমন জাদুকরি প্রভাব থাকে, যা অন্যকে ছুঁয়ে যায়, স্পর্শ করে, কাছে টানে, ইচ্ছে করলেও তাদের এড়িয়ে যাওয়া যায় না। হুমায়ূন আহমেদও সম্ভবত সে রকমই একজন।

আড়ে-ঠাড়ে কেউ কেউ এমনটা বলার চেষ্টা করেন যে, হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্তের সেন্টিমেন্টকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে পাঠকদের এক্সপ্লয়েট করেছেন। তাঁর লেখা এক নিশ্বাসে যেমন পড়া যায়, তেমনি ভুলেও যাওয়া যায় দ্রুত। পড়তে মজা লাগে; কিন্তু মনে স্থায়ী গভীর কোনো রেখাপাত করে না। হতে পারে, ঋদ্ধ পাঠকদের কথা মনে রেখে তিনি লেখেননি; কিন্তু যাঁদের জন্য লিখেছেন, তাঁরা তো তাঁর লেখা গ্রহণ করেছেন, ভীষণভাবেই করেছেন। সবাই শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করবেন উচ্চমার্গের পাঠক-দর্শক-শ্রোতার জন্য–সেটাই-বা কেমন কথা! সাধারণ মানুষকে অবহেলা-উপেক্ষা করার কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। তাঁদের জন্য শিল্প-সাহিত্যের দুয়ার যদি কেউ উদারতার সঙ্গে খুলে দেন, তাহলে তো দোষের কিছু নেই। বরং এটা একটা বড় গুণ। হুমায়ূন আহমেদ ভান-ভণিতা না করে শিল্প-সাহিত্যের পথে হেঁটেছেন, পথটা তৈরি করে নিয়েছেন নিজেই।

এখানেই তিনি বিশিষ্ট, অনন্য। তাঁর সৃষ্টিকর্ম কালজয়ী কি না, তাঁর সাহিত্য তাঁকে কতটা অমর করবে–সেটা কি এখনই বিচার করার বিষয়? উপন্যাস, নাটক, নাকি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন—সে সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার সময় এখনই নয়। বেশি লিখেছেন বলে সব লেখার মান ধরে রাখতে পারেননি—এমন কথা শোনা যায়। কিন্তু তাঁর মতো উইট ও হিউমার আর কারও লেখায় সন্নিবেশিত হয়নি। সহজ কথা কঠিন করে বলা ভালো, নাকি কঠিন কথা সহজ করে বলাটাই বেশি ভালো?

তিনি সৃজনশীলতার যে জায়গায় হাত দিয়েছেন (গান, কবিতা লিখেছেন, ছবিও এঁকেছেন), সেখানেই বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে আমার বিবেচনায়, সবচেয়ে বড় যে কাজটি তিনি করেছেন, সেটা হচ্ছে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে শাসকগোষ্ঠী যখন আমাদের দেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানি ধারায় ধাবিত করতে চেয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে তথা রাজাকার-আলবদরদের রাজনীতিতে-সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা শুরু করেছে, তখন হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ করেছেন। যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভুলিয়ে দিতে চায়, দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নিতে চায়, তাদের সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করার মধ্য দিয়েই হুমায়ূন আহমেদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব হবে।

তিনি তাঁর রচনায় অন্ধতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে যুক্তিবাদিতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কোনো লেখায় পাঠকদের ‘শিক্ষা’ দেওয়ার মতো কোনো কিছু প্রতিফলিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন: ‘অনেক কথা যাও যে বলে, কোনো কথা না বলে’, হুমায়ূন আহমেদের রচনাও যেন তেমনি ধাঁচের।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে আরও লেখা পড়ুন

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত