রশীদ হায়দার: বন্ধুমিত্রসখা

দাউদ হায়দার
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২১, ১০: ১০

১৫ জুলাই ২০২১, বেঁচে থাকলে পূর্ণ করতেন ৮০ বছর। ১৬ জুলাইয়ে পা রেখে রস মাখিয়ে বলতেন হয়তো, যেমন বলেছিলেন ওপন্যাসিক শওকত ওসমান: ‘বয়সে রবীন্দ্রনাথকে টেক্কা দিয়েছি।’

রশীদ হায়দারের বিশ্বাস ছিল, ৮৫ পর্যন্ত সুস্থ, সবল, সুঠাম থাকবেন। বাঁচবেন। লিখবেন। অসমাপ্ত কাজ শেষ করবেন। গল্প। উপন্যাস। নাটক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও গবেষণা। অকস্মাৎ ছেদ। ঝরার (আনিসা হায়দার) মৃত্যু। অসহনীয়। মায়ায় জড়িয়ে বিয়ে। ৫০ বছরের বেশি সংসার। দাম্পত্যজীবন। ঝরার প্রয়াণে ক্রমশ গুটিয়ে, শরীর-স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতি। অথর্ব। হুইলচেয়ারে চলা। বাক্‌শক্তিও রহিত। কথাশিল্পীর কথা নেই। চাহনি উদাস। চেনা মানুষও অচেনা। সীমাহীন স্তব্ধতার গভীরে একা। নিমজ্জিত। জীবন যখন শুকিয়ে যায় করুণাধারায়ও শূন্যতার বয়ন। সীমানা পেরিয়ে বন্ধুর অবন্ধুতা শুরু। রেশ থাকে কিছুকাল। আত্মীয়কুলে, বন্ধুমহলে। পারিবারিক ঘনতায়। ঠিক তবে, একজন খাঁটি লেখক বা শিল্পীর প্রস্থান নেই। সব সময়ই সমকালীন। বন্ধু। বন্ধুতার নানা দিক। মিত্র। সখা। হিতৈষী। সঙ্গী। পার্শ্বস্থ। সব বিশেষণে যুক্ত। সংস্কৃত ভাষায় ‘সযুজা সখায়া’। একই ডালে বসে সমস্তর স্তরে আপনতা, সমস্তর আঙ্গিকে এককতা, আত্মিকতা। মানবতা।

আমাদের কাছে, ভাইবোনদের কাছে, এমনকি দুই কন্যা, নাতনির কাছে রশীদ হায়দার বন্ধুমিত্রসখা। হিতৈষী। সঙ্গী। গল্প-আড্ডায় আপাত গাম্ভীর্য নেই। দিলখোলা। সমবয়সী যেন। শাসন, কঠোরতায় কখনো মৃদু, কখনো অভিভাবক। তত্ত্বাবধায়ক।

রশীদ হায়দারের ডাকনাম দুলাল। অনুজ-অনুজার সম্বোধন দাদাভাই। কে চালু করেন, কার আবিষ্কার–বলতে অপারগ। অগ্রজ জিয়া হায়দারের ক্ষেত্রেও রহস্য, বাবা-মায়ের দেওয়া নাম রউফ, আমরা বলতুম সোনাভাই।

রশীদ হায়দারের জন্ম ১৫ জুলাই ১৯৪১, দোহারপাড়া, পাবনায়। মা রহিমা খাতুন। বাবা শেখ মোহাম্মদ হাকিমউদ্দীন। বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান। দ্বিতীয় পুত্র। কিন্তু শেখ মোহাম্মদ হাকিমউদ্দীনের পঞ্চম।

ঘটনা নিম্নলিখিত।
তিন বিয়ে। প্রথম বউ কন্যার জন্মের কিয়ৎকাল পরেই গত। কন্যার নাম রিজিয়া। আমাদের বড় আপা। ‘হায়দার’ বর্জিত। দ্বিতীয় বউ রহিমা। তাঁর সন্তান জ্যোৎস্না (রোকেয়া)। রউফ (জিয়া)। ঝর্ণা (সেলিনা দুই সপ্তাহ আগে গত, ৮১ পূর্ণ করে ৮২ বছর বয়সে)। দুলাল (রশীদ)। নার্গিস (যৌবনপ্রাপ্তির প্রাক্কালে মৃত্যু)। রোকন (মাকিদ)। হেনা (ফরিদা)। খোকন (নির্বাসিত)। স্বপন (জাহিদ)। নয়জন।

তৃতীয় বউ মাজেদা। তাঁর গর্ভস্থ হাসু (আফরোজা)। তপন (আবিদ)। বানু (ফওজিয়া)। এলি (এলিজা)। তৌফিক (জলে ডুবে অকালে মৃত্যু)। তৌহিদ (আরিফ)।
বাবা শেখ হাকিমউদ্দীনের ষোলো সন্তান। প্রত্যেকে ‘হায়দার’। কী করে হায়দার পদবি, মূলে ছোট চাচা আবুল কাসেম।

আমরা সুখী। কেউ ‘সৎ’ ভাইবোন নন। সবাই আপন, আপনতর। এ-ও এক কালচার। সুচারুতা নির্মাণ হায়দার পরিবারে।

বলবেন হয়তো দশরথের তিন শ পঞ্চাশ বউ, পাঁচ সন্তান (কন্যা একটি), চার পুত্র তিন বউয়ের, সৎ ভাইয়ের অপবাদ ছিল না। লক্ষণ তো বড়দা রামের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত, বনবাসে বৌদি সীতার কাপড়চোপড় কাঁধে বয়ে নিয়েও অক্লান্ত, কৈকেয়ীর ছাওয়াল ভরত রামদার পাদুকা সিংহাসনে রেখে, মেঝেয় বসে রাজ্য চালিয়েছেন।

মহাভারতের পঞ্চ পাণ্ডবের কথাও বলতে পারেন। তবে আব্বাজান একজন নয়। কর্ণ শত্রু তথা বিরোধী শিবির কৌরবে। কুন্তির কেচ্ছা বাদ দিচ্ছি।

দাদুভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা জানুয়ারি ২০০৬ সালে। কলকাতায়। ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন এসেছেন। নরক গুলজার। স্মৃতি কুরে খাচ্ছে। খাক।

দাদুভাই এক সন্ধ্যায় ‘প্রিয়’ কঞ্চিদির (অপলা দাশগুপ্ত মহেশ্বেতা দেবীর ছোট বোন। অপলার স্বামী সমীর দাশগুপ্ত। অমৃতবাজার পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। কবি। অনুবাদক।) যোধপুর পার্কের আস্তানায় ছয়তলা ফ্ল্যাটে। এই পরিবারের সঙ্গে রশীদপরিবারের সখ্য, ঘনিষ্ঠতা, আত্মিকতা মজবুত।

মনে পড়ছে, ওই সন্ধ্যায় দাদুভাই বললেন, আমিও রবীন্দ্রনাথের মতো পাঠক-পাঠিকা, ভক্তজনের চিঠির উত্তর দিই।

কঞ্চিদির কণ্ঠ চড়া। রবীন্দ্রনাথের মতো? দাদুভাই। জানেন, তবু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। রবীন্দ্র বানানে আদ্যাক্ষর ‘র’। পদবির শেষে ‘র’। ইহাতে কী প্রমাণিত?

কাঞ্চিদি। ঝরার নামেও ‘র’ আছে। 

রশীদ হায়দারের আত্মকথা ‘ও বেলা এ বেলা’য় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ, চাকর, বিয়ে, মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুকুল, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। গোপনও করেছেন কিছু। হয়তো পারিবারিক, সামাজিকতায়।

উঠতি যৌবনে যা হয়, কলেজে পড়াকালীন মনো’র (মনোয়ারা) প্রতি নজর, তাঁরও। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বড় আপা রিজিয়ার দ্বিতীয় কন্যা শিউলি। সহপাঠিনী ওঁরা। প্রেমের সমাপ্তি, মনো খুন হন। প্রেমের কারণে নয়, মনোর চাচাতো ভাইদের সঙ্গে জমিজমা, টাকাকড়ি ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে।

 ঢাকায় এসেও প্রেম। বেশি দিন টেকেনি। নিজেই কেটে পড়েছেন। হেতু, ‘বড়লোকের মেয়ে’।

দেখতে সুন্দর, কথাশিল্পীর বচনশিল্পে সুন্দরীরা নয়নে গেঁথে নিয়েছেন; কিন্তু ঝরাকেই (আনিসা আখতার) মনপ্রাণ সঁপেছেন। আমৃত্যু।

অসম্ভব স্মৃতিশক্তিধর। অতীতের কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলে সময়, দিন, তারিখ, মাস, বছর সড়গড়। যেন দেয়ালে লেখা বড় অক্ষর দেখে বলছেন।

বিপ্লবী নন, মধ্যবিত্ত। নিয়ম ভাঙার নিয়মে খুব বেশি আগুয়ান নন। পরিশ্রমী। কর্মে সুচারু। বিশ্বস্ত। উঁচু পদে আসীন। একে-ওকে সুপারিশ অসহ্য।

একটি বিষয় লক্ষ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার শুরুতেই পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডে স্বল্প বেতনে কাজ, তাই দিয়ে লেখাপড়া। রঙ্গমাখা সিনেসাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’র যুক্ত, নায়িকা দূরঅস্ত, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে মোহসীন। (বাংলাদেশের সিনেমাও)।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সহপরিচালক, কেন্দ্রর মুখপত্র ‘বই’য়ের সহসম্পাদক। মূলত তাঁরই দায়িত্ব। বাংলা একাডেমির সাহিত্যপত্র ‘উত্তরাধিকার’-এর প্রথম সম্পাদক। একাডেমির পরে আবার গ্রন্থকেন্দ্রে, পরিচালক। নজরুল ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক। ইনস্টিটিউটের পত্রিকার সম্পাদক। সম্পাদকতা তাঁর ললাটলিখন।

পূর্ব পাকিস্তান আমলে, ১৯৬৮ সালে, নারীদের সাপ্তাহিক ‘ললনা’ পত্রিকার বেনামী লেখক, সম্পাদনায় অংশী। ললনা বিপুল জনপ্রিয়। সব লেখকই পুং, মহাম্মদ আখতার, শাহাদাত চৌধুরী (পরে ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক) সমস্তর দেখভালে, পত্রিকার মালিকের বউ সম্পাদক। একবার বলেন, ‘কী ছাপা হয় জানিনে। ছাপার পর পড়ি। পত্রিকার দপ্তরে গিয়েছি মাঝেমধ্যে, চা খেতে।’

ইত্তেফাক গ্রুপের ‘অনন্যা’ নারীদের মাসিক পত্রিকা। রশীদ হায়দার পত্রিকার নেপথ্যে, লেখা নির্বাচক।

ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রাহাত খানের অনুরোধ–ইত্তেফাকে সাপ্তাহিক কলাম লেখার। রশীদের সবিনয় প্রত্যাখ্যান। সংবাদপত্রের চটক-গ্ল্যামার থেকে কোটি হস্ত দূরে।

রশীদ হায়দার জীবিত থাকলে (১৩ অক্টোবর ২০২০-এ গত) তাঁর কন্যাদ্বয় হেমা (হেমন্তী হায়দার), ক্ষমা (শাওন্তী হায়দার) ঠিক করেছিলেন, ‘বাবার ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সম্মাননাগ্রন্থ প্রকাশের’। বহু লেখক লিখতে উৎসাহী। প্রকাশকও উন্মুখ। ভেস্তে গেছে মৃত্যুতে।

এখন স্মারকগ্রন্থ। সম্পাদক হেমন্তী হায়দার, শাওন্তী হায়দার। জানাচ্ছেন, ‘সত্তর জনের বেশি লেখক-লেখিকার লেখা সংগ্রহে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী থেকে রিফা ইশরাতের (রায়া)। প্রকাশকের ছাপার কাজ শেষ। বাঁধাই বাকি। বাঁধাই হলেও বিতরণ সমস্যা। এ-ও বাহ্য। বই প্রকাশের অনুষ্ঠান অসম্ভব, করোনার দাপটে। পরেও করা যাবে প্রকাশনা অনুষ্ঠান। বাবা হারিয়ে যাচ্ছেন না। আছেন। থাকবেন।’

আমাদের অগ্রজ রশীদ হায়দার, দাদুভাই, পারিবারিকই নয় শুধু, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক। তাঁর মন-মনন, মননবোধে। ‘দেশ-মাটির সংলগ্নতাই বৈশ্বিক’। বলতেন। তিনিও সংলগ্নতায় অবিমিশ্র। অগ্রজকে প্রণতি।

লেখক: কবি

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত