শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে যা প্রয়োজন

রায়হান আরা জামান
প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২১, ০৯: ৪০

দেশের অন্তত ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় না এনে স্বাভাবিকভাবে স্কুল-কলেজ খুলে দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রমে ফিরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়টি আমরা সবাই বুঝতে পারছি। কবে ৭০-৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে, তা এখনো অনিশ্চিত। এমনকি চার বছরও লেগে যেতে পারে। এ রকম অনিশ্চয়তার মাঝে নিকট ভবিষ্যতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে পূর্বের প্র্যাকটিসে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকা সমীচীন হবে না বলেই মনে হয়। অথচ সেই প্রত্যাশাই বোধ হয় মহামারির প্রভাবে পরিবর্তিত চাহিদা ও সময়ের উপযোগিতা বিবেচনা করে অতি প্রয়োজনীয় বিকল্প শিক্ষা-পরিকল্পনা করা যাচ্ছে না। ‘খুলে গেল, খুলে গেল’ করতে করতে এক বছর চার মাস অতিবাহিত হয়েছে; আক্রান্তের হার ৫ শতাংশের নিচে নামতে আরও এক বছর যে লাগবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অবস্থায় বাস্তবতা স্বীকার করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জরুরি অবস্থায় শিক্ষার (Education in emergency) জন্য বিশদ ও উপযোগী পরিকল্পনা করা ভীষণ প্রয়োজন। এ জন্য টিকার প্রাপ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের ৭০-৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে কত সময় লাগতে পারে, তা হিসাব করা দরকার। প্রয়োজনীয় সময় ছয় মাস, এক বছর কিংবা দুই বছর যা-ই হোক–সে সময় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে, তার কার্যকর ও বিস্তারিত পরিকল্পনা হাতে নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

মহামারিকালীন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সম্ভাব্য শিক্ষা-পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মূলত তিনটি ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে: সব শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ফিরিয়ে আনা, শিখন ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া এবং শিক্ষকদের প্রস্তুতি ও সহায়তা।

মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় ক্লাসের বাইরে থাকায় ধারণা করা যায়, হয়তো অনেক শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফিরবে না। শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাওয়া, বাল্যবিবাহের হার বৃদ্ধি, বাবা-মায়ের কাজ হারানোসহ জীবনযাপন পদ্ধতিতে নানা ধরনের পরিবর্তন আসায় অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না-ও ফিরতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায়ও এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এমন শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর জন্য, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও বিভিন্নভাবে ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

শিক্ষার কোনো স্তর থেকে কোনো শিক্ষার্থী যেন ঝরে না পড়ে, সে বিষয়ে পরিকল্পনা থাকলে ভালো। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের তালিকা রয়েছে। সেই তালিকা থেকে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, বিশেষ করে যারা ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তা ছাড়া, সরকারের বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার জন্য বিদ্যালয় ই-ব্যবস্থাপনা নামক একটি ওয়েবসাইট আছে। শিক্ষার্থীদের ট্র্যাক করতে ওই ওয়েবসাইটও ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব তথ্যানুযায়ী সম্ভাব্য ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে ও বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ঠিক করতে হবে। এ জন্য এসব শিক্ষার্থী ও তার পরিবারকে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়াসহ কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হতে পারে।

দীর্ঘদিন মুখোমুখি ক্লাসের বাইরে থাকা, পরীক্ষা ও প্রচলিত মূল্যায়ন না হওয়া, ঘরে থাকা ও জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট অবসাদজনিত কারণে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন ঘাটতি (লার্নিং গ্যাপ) তৈরি হয়েছে। বিগত বছরের অনেক আবশ্যকীয় শিখন দক্ষতা অর্জন না করেই শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতে উঠে গেছে। এখনই এই শিখন ঘাটতি পুষিয়ে নিতে না পারলে সুদূরপ্রসারী ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যায়। সংসদ টেলিভিশনে এবং গুগল মিট, জুম, ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কিছু ক্লাস হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ অনলাইন ক্লাসের সুবিধা নিতে পারেনি। তাই এই ঘাটতি দূর করার জন্য অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। এই পরিকল্পনার মধ্যে পূর্ববর্তী শ্রেণিসহ বর্তমান শ্রেণির শিখন দক্ষতা অর্জনের নির্দেশনা থাকতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা নতুন কিছু শেখার সঙ্গে সঙ্গে আগে শেখার কথা থাকলেও শিখতে পারেনি এমন বিষয়গুলোও আস্তে আস্তে শিখতে পারে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় আবশ্যিক শিখন দক্ষতা অর্জন করার উদ্দেশ্যে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য যথাক্রমে ৬০ এবং ৮৫ দিনের পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাস তৈরি করেছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর যথাক্রমে ৬০ এবং ৮৫ দিন ক্লাস করে তারপর এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা হবে–এমন পরিকল্পনা ছিল। তবে করোনা পরিস্থিতি অবনতির কারণে সে সম্ভাবনাও কমে আসছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলে সারা দেশের শিক্ষক এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অফিসারদের অংশগ্রহণে খুব কম সময়ের মধ্যে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য ওই পরিমাণ রেকর্ডেড ক্লাস তৈরি করা সম্ভব। এসএসসির ৬০ এবং এইচএসসির ৮৫ দিনের বিষয়ভিত্তিক রেকর্ডেড ক্লাসের অডিও এবং ভিডিও ভার্সন তৈরি করে এসব ক্লাস সংসদ টিভি, প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষা টিভি চ্যানেল, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ, বাংলাদেশ বেতার, কমিউনিটি রেডিওসহ যতভাবে সম্ভব শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য করা যেতে পারে। এ জন্য প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্ক এবং ডিভাইস সব শিক্ষার্থীর হাতের নাগালে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ করার দরকার হবে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। নেটওয়ার্ক এবং ডিভাইস নিশ্চিত করা সাপেক্ষে শিক্ষার্থীরা অন্তত কোনো একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ক্লাসগুলো যে করছে–তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য প্রতিটি রেকর্ডেড ক্লাসের পর সবার জন্য কুইজ থাকতে পারে। সব শিক্ষার্থীর জন্য একটি করে লগবুক সরবরাহ করা যেতে পারে। লগবুকে শিক্ষার্থীরা তারিখ এবং ক্লাস নম্বর উল্লেখ করে এসব কুইজের উত্তর দেবে। এভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব কটি ক্লাস করা হয়ে গেলে লগবুক একবারে শিক্ষকের কাছে জমা দিতে পারে।

প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে থাকায় অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখার সঙ্গে মানসিক দূরত্বও সৃষ্টি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীর বিনোদন এবং সময় কাটানোর একমাত্র মাধ্যম হয়ে পড়েছে মোবাইল, ট্যাব বা অন্য ডিভাইস। পড়ালেখায় আগ্রহ ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক রুটিন অনুসরণে আগ্রহী করার দিকেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য শিক্ষার্থীদের ফ্রি টেলিমেনটরিং সেবা চালু করা যায়। এ ধরনের টেলিমেনটরিং সেবা শিক্ষার্থীদের অবসাদ ও দুশ্চিন্তা কমিয়ে স্বাভাবিক রুটিনে ফিরতে ও পড়ালেখায় মনোযোগী হতে সাহায্য করবে।

নতুন পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ে শিক্ষণ কার্যক্রম চালানোর জন্য শিক্ষকদেরও নতুন নতুন দক্ষতার প্রয়োজন হবে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মনোযোগ ফেরানোর জন্য, মানসিক সহায়তা প্রদানের জন্য, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কার্যকর উপায়ে পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এসব বিষয়ে অনলাইনে শিক্ষকদের জন্য ফ্রি কোর্স ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহারে আরও পারদর্শিতা অর্জন, মানসিকতার পরিবর্তন এবং পেশায় আরও আগ্রহী ও নিবেদিত করার জন্য অনলাইনে রিফ্রেসার্স ট্রেনিং চলমান থাকতে পারে। বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধির জন্য কাজ করার প্রয়োজন হতে পারে। এ জন্যও বাজেট দরকার হবে।

তবে সাম্প্রতিক বাজেটে মহামারির ফলে বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কার্যকর পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়ার প্রতিফলন ঘটেনি বলেই শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেছেন, শিক্ষাব্যবস্থায় পুনরুদ্ধার কার্যক্রম চালাতে যে বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল, তার দিশা বাজেটে পাওয়া যায়নি।

আজ ২০২১ সালে বসে শিক্ষাকার্যক্রম কার্যত বন্ধ থাকার ফলাফল হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না। শিক্ষার এই ঘাটতি থেকে জাতির কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে–তা হয়তো আমরা অনুমান করতে পারছি না। তবে এভাবে চলতে থাকলে চার-পাঁচ বছর পরেই আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাব–কী অভাবনীয় ক্ষতি আমাদের হয়ে গেছে! আমাদের আর অদৃষ্টের দিকে তাকিয়ে বসে থাকার অফুরন্ত অবসর নেই। দেশে উন্নয়নের যে ধারা চলমান, তা বজায় রাখতে এবং উন্নয়নকে টেকসই করতে শিক্ষার দিকে অমনোযোগী হওয়ার কোনো উপায় নেই। শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখনই আমাদের কর্মযজ্ঞ শুরু করতে হবে। 

লেখক: শিক্ষা-গবেষক ও শিক্ষক
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত