জাহীদ রেজা নূর
নিজের সংগ্রহের তিনটি গোল্ডেন গ্লোব ভাস্কর্য ১১ মে ফিরিয়ে দিয়েছেন টম ক্রুজ। হলিউডের এই অভিনেতা হলিউড ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের (এইচএফপিএ) বিরদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর কারণে মূল্যবান এই পুরস্কারগুলো ফিরিয়ে দিলেন। সংগঠনটির বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষ ও নারীবিদ্বেষের অভিযোগ ওঠায় টম ক্রুজ তাঁর পুরস্কার ফিরিয়ে দেন। অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছেন অনেকেই, কিন্তু পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার কাজটি আর কেউ করেননি। টম ক্রুজই সম্ভবত সে পথটি দেখালেন।
সুবিখ্যাত হলিউড তারকা টম ক্রুজ তাঁর এই পদক্ষেপের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন—যে সম্মানই তিনি পেয়ে থাকুন না কেন, সেটা যদি ঘোলাজলে মৎস্য শিকার হয়ে থাকে, তাহলে তা পরিত্যাজ্য।
আমাদের মনে পড়ে যাবে, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর যখন খবরটি পেলেন, তখন সারা রাত নির্ঘুম কেটেছিল রবীন্দ্রনাথের। তিনি একটি শক্ত চিঠি লিখে তাঁর নাইট উপাধি বর্জন করেছিলেন।রবীন্দ্রনাথের লেখা সেই চিঠিটি কি কেউ এখন পড়ে? কী বলিষ্ঠভাবেই তিনি তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছিলেন!
রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছিলেন ভাইসরয়ের কাছে। জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ঘটে যাওয়া সেই হত্যাকাণ্ডের খবর রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন দেড় মাস পর। তারপর থেকেই তিনি খুবই বিচলিত বোধ করতে থাকেন। তিনি দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজকে পাঠিয়েছিলেন গান্ধীর কাছে। রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব ছিল, গান্ধিজী ও রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবেশ নিষিদ্ধ’ পাঞ্জাবে একসঙ্গে যাবেন এবং আইন ভঙ্গ করে প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব সমর্থন করেননি। তিনি এ সময় সরকারকে বিব্রত করতে চাননি।
রবীন্দ্রনাথ সাহায্য চেয়েছেন চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে। দেশবন্ধু নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি যেন এর প্রতিবাদে সভা ডাকেন, সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের চাওয়া। এখান থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয় রবীন্দ্রনাথকে। এরপর রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। দুজন মিলে অনেক আলোচনা করলেন। এরপর ১৯১৯ সালের ৩১ মে রবীন্দ্রনাথ চিঠি পাঠালেন ভাইসরয়ের কাছে। তার আগে অবশ্য চিঠিটি পড়িয়ে নিলেন দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজকে। দীনবন্ধু রবীন্দ্রনাথকে চিঠির ভাষা একটু নরম করতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তা শোনেননি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাইটহুড ত্যাগের কথা লিখলেন। লিখলেন ভেতরের তাড়না থেকেই।
টম ক্রুজ বহুকাল ধরে টিকে থাকা হলিউড সাংবাদিকদের সংগঠনটির কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সোচ্চার হয়েছিলেন ব্রিটিশ নৃশংসতার বিরুদ্ধে। দুটো বিষয়ে ভিন্ন হলেও চারিত্রিকভাবে একই। বিবেকের তাড়নায় তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন।
বিবেক শব্দটিও এখন ক্লিশে হয়ে গেছে। বহুকাল ধরে এমন সব মানুষের নামের সঙ্গে ‘বিবেক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষদের কানে বিরক্তিকর ঠেকেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেও অনেকে আখের গুছিয়ে নেওয়ায়, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দ দুটি এখন আর কারও মনে কোনো শক্তি জোগায় না। বরং যাঁরা ফন্দিফিকিরের রাস্তা মসৃণ করতে চান, তাঁরাই শব্দ দুটিকে অতিমাত্রায় ব্যবহার করেন।
আমাদের দেশে গর্ব করার মতো বিষয়গুলোকে অতি সূক্ষ্মভাবে টেনে নিচে নামানো হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী আর পাকিস্তানি প্রেতাত্মা একসঙ্গে মিলে এ কাজটি করেছে। আর যাঁরা মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে নিজ পরিচয় গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ নিজেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে আখের গুছিয়ে নিয়েছেন, কেউ কেউ আখের গোছানো মানুষদের রমরমা দেখে নীরবে নিজেকে অন্তরীণ করেছেন নিজেরই ছায়ায়। এ কারণেই এই পুরস্কার বর্জনের বিষয়টি হয়তো এখন মানুষের মনে খুব একটা দাগ নাও কাটতে পারে।
২.
টম ক্রুজ আরও কয়েকটি ভাবনার দিকে নিয়ে গেল আমাদের। আমাদের দেশে যে পুরস্কারগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ছিল, সেসব পুরস্কার কেউ বিতর্কিত করে তোলা হচ্ছে অনেক কাল ধরে। শুরুতে যাঁরা এই পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা যোগ্যতার ভিত্তিতেই পেয়েছেন। কিন্তু একসময় দেখা গেল, ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং তৈল মর্দন অনেক ক্ষেত্রেই পুরস্কারের নিয়ামক হয়ে উঠেছে। পুরস্কারের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এমন অনেককেই পুরস্কার পেতে দেখা গেছে, যাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে একেবারে সাধারণ মহলেই। অনেক বিচারকই যুক্তি ও সৃজনশীলতার পথে না থেকে উনুনে ছড়ানো হাড়ির ঘিয়ের মতো গলে গেছেন।
তাই যাঁদের হাতে পুরস্কার গিয়ে পৌঁছেছে, তাঁরা নিজেরা আনন্দে উদ্ভাসিত হতে পারেন, কিন্তু বোদ্ধা মানুষ এবং সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছেন, ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। তাই সেসব পুরস্কার এখন আর আনন্দবার্তা হিসেবে আসে না।
কোনো ঐতিহ্যবাহী পুরস্কার বা পদক যখন মান হারায়, তখন বুঝতে হয়—সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যখন পুনঃসংস্কার ছাড়া এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। আমরা এখন সেই ভঙ্গুর পথটাই পাড়ি দিচ্ছি।
৩.
তথ্যের জন্য বলে রাখি, টম ক্রুজ প্রথম গোল্ডেন গ্লোব পেয়েছিলেন ১৯৯০ সালে‘বর্ন অন দ্য ফোর্থ অব জুলাই’ ছবিতে অভিনয় করে। পরিচালক ছিলেন অলিভার স্টোন। ছবিটি অস্কারের সেরা পরিচালক, সেরা সম্পাদনার পুরস্কার পেয়েছিল। গোল্ডেন গ্লোব পেয়েছিল সেরা চিত্রনাট্যের, সেরা অভিনয়শিল্পীর। ক্যামেরন ক্রো পরিচালিত ‘জেরি মাগুয়ার’ ছবির জন্য দ্বিতীয় গোল্ডেন গ্লোবটি আসে ১৯৯৭ সালে। ২০০০ সালে টমাস অ্যান্ডারসনের ‘ম্যাগনোলিয়া’ ছবির জন্য তিনি তৃতীয় গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারটি পান। এ রকম তিনটি গোল্ডেন গ্লোব যার কাছে থাকে, তিনি তো তারকা মহলে এবং সাংবাদিক মহলে চিরকালের জন্য সুপারস্টার! সেই তিনিই কিনা গোল্ডেন গ্লোবগুলো ফিরিয়ে দিলেন!
৪.
একটু পেছন থেকে আসা যাক। হলিউডে বিদেশি সাংবাদিকদের সংগঠন এইচএফপিএ গঠিত হয়েছিল ১৯৪৩ সালে। চলচ্চিত্রে অবদান রাখার জন্য ১৯৪৪ সাল থেকে নানা খ্যাতিমান চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়েছিল। অস্কারের পরই আমেরিকার এই পদকটিকে সেরা পুরস্কার হিসেবে ধরা হয়। বিদেশি সাংবাদিকদের এই ঘরানায় রয়েছেন ৮৭ জন বিদেশি সাংবাদিক, যাঁরা হলিউডে থাকেন। তবে অন্য দেশের কয়েকজন চলচ্চিত্র প্রতিনিধিও রয়েছেন নির্বাচকদের কাতারে। যেমন রাশিয়ার শিল্পী ও প্রযোজক আলেকজান্ডার নেভস্কি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই সংগঠনে একজনও কৃষ্ণাঙ্গ সাংবাদিক নেই!
গোল্ডেন গ্লোব নিয়ে হরহামেশা প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন পদ্ধতিতে কখনোই স্বচ্ছতা ছিল না বলে বহুবার তারা সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালে তাদের ব্যাপারে যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি ভয়ানক। বলা হচ্ছে, এই নির্বাচকেরা বর্ণবাদকে ধারণ করেছেন তাঁদের পোশাকে। ব্যাপারটা এত দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে গত মার্চ মাসে চলচ্চিত্রসংক্রান্ত হলিউডের বড় বড় কোম্পানি গোল্ডেন গ্লোবের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে আহ্বান জানিয়েছেন চলচ্চিত্রকার ও অভিনেতাদের।
গত সপ্তাহে বোমা ফাটাল নেটফ্লিক্স ও আমাজন। তারা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে, তাদের চলচ্চিত্র ও সিরিয়ালগুলো গোল্ডেন গ্লোবের হর্তাকর্তাদের কাছে দেওয়া হবে না। চলচ্চিত্র কোম্পানি এনবিসি এরপর জানিয়ে দিয়েছে যে আগামী বছর গোল্ডেন গ্লোব অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার তারা করবে না। এরই মধ্যে নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো শুধরে না নিলে আরও বড় সংকটে পড়তে হতে পারে হলিউডের বিদেশি সাংবাদিকদের এই সংগঠনকে।
তবে সবচেয়ে হতাশার জায়গা হচ্ছে, অনেকেই এই বয়কটকে সমর্থন করছেন বটে, কিন্তু তা শুধু কথা দিয়ে। পুরস্কার ফেরত দেওয়ার সাহসিকতা দেখালেন একমাত্র টম ক্রুজই। এই তালিকায় আরও কারও কারও নাম হয়তো বা শিগগিরই যুক্ত হবে।
৫.
ভাবনার জগতে আমাদের দুর্দশা নিয়ে এখানেই কথা ওঠে। আমরা দিনে দিনে এতটাই খ্যাতির কাঙাল হয়ে উঠেছি যে, যেকোনো মূল্যে কোনো পুরস্কার জিতে নেওয়ার সুযোগ থাকলে, তা হাতছাড়া করি না। যে দু-একটি পুরস্কার সম্মানসূচক হিসেবে মনে রাখার কথা, সেগুলো বিতর্কিত করে তোলা হয়েছে। বিনোদন জগতের মানুষদের জন্য একটি পত্রিকার দেওয়া পুরস্কারের স্বচ্ছতাও প্রশ্নবিদ্ধ।
এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন তারকা সৃষ্টির যে পুরস্কারগুলো রয়েছে, সেগুলোর নোংরামি সম্পর্কে নানা সময় নানা খবর প্রকাশিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক মান, রুচি এবং নিজের ওপর শ্রদ্ধা না থাকলে যা ঘটার, তা–ই ঘটছে।
অথচ তেলবাজি ছাড়া, লোভ ছাড়া কিংবা স্বজনপ্রীতি ছাড়া যদি নির্মোহভাবে পুরস্কারগুলো দেওয়া হতো, তাহলে পুরস্কার রাজ্যটি এ রকম অরুচিকর জায়গায় গিয়ে পৌঁছাত না।
আমাদের দেশে একজন টম ক্রুজ নেই। কেন নেই সেটাও পরিষ্কার। যিনি কোনোপ্রতিবাদী ভূমিকা নেবেন, তার পেছনে দাঁড়িয়ে যাবে একটি সত্যিকারের সংস্কৃতিসেবী গোষ্ঠী, সে গুড়েবালি।
আমাদের শিরদাঁড়াটা এখনো ততটা মজবুত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ কিংবা টম ক্রুজ যে বোধের জায়গা থেকে ছুঁড়ে ফেলেছেন পুরস্কার, সে বোধ এখন সবার মধ্যে থাকবে—এতটা ভেবে নেওয়া মুশকিল।
নিজের সংগ্রহের তিনটি গোল্ডেন গ্লোব ভাস্কর্য ১১ মে ফিরিয়ে দিয়েছেন টম ক্রুজ। হলিউডের এই অভিনেতা হলিউড ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের (এইচএফপিএ) বিরদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর কারণে মূল্যবান এই পুরস্কারগুলো ফিরিয়ে দিলেন। সংগঠনটির বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষ ও নারীবিদ্বেষের অভিযোগ ওঠায় টম ক্রুজ তাঁর পুরস্কার ফিরিয়ে দেন। অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছেন অনেকেই, কিন্তু পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার কাজটি আর কেউ করেননি। টম ক্রুজই সম্ভবত সে পথটি দেখালেন।
সুবিখ্যাত হলিউড তারকা টম ক্রুজ তাঁর এই পদক্ষেপের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন—যে সম্মানই তিনি পেয়ে থাকুন না কেন, সেটা যদি ঘোলাজলে মৎস্য শিকার হয়ে থাকে, তাহলে তা পরিত্যাজ্য।
আমাদের মনে পড়ে যাবে, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর যখন খবরটি পেলেন, তখন সারা রাত নির্ঘুম কেটেছিল রবীন্দ্রনাথের। তিনি একটি শক্ত চিঠি লিখে তাঁর নাইট উপাধি বর্জন করেছিলেন।রবীন্দ্রনাথের লেখা সেই চিঠিটি কি কেউ এখন পড়ে? কী বলিষ্ঠভাবেই তিনি তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছিলেন!
রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছিলেন ভাইসরয়ের কাছে। জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ঘটে যাওয়া সেই হত্যাকাণ্ডের খবর রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন দেড় মাস পর। তারপর থেকেই তিনি খুবই বিচলিত বোধ করতে থাকেন। তিনি দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজকে পাঠিয়েছিলেন গান্ধীর কাছে। রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব ছিল, গান্ধিজী ও রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবেশ নিষিদ্ধ’ পাঞ্জাবে একসঙ্গে যাবেন এবং আইন ভঙ্গ করে প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব সমর্থন করেননি। তিনি এ সময় সরকারকে বিব্রত করতে চাননি।
রবীন্দ্রনাথ সাহায্য চেয়েছেন চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে। দেশবন্ধু নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি যেন এর প্রতিবাদে সভা ডাকেন, সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের চাওয়া। এখান থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয় রবীন্দ্রনাথকে। এরপর রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। দুজন মিলে অনেক আলোচনা করলেন। এরপর ১৯১৯ সালের ৩১ মে রবীন্দ্রনাথ চিঠি পাঠালেন ভাইসরয়ের কাছে। তার আগে অবশ্য চিঠিটি পড়িয়ে নিলেন দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজকে। দীনবন্ধু রবীন্দ্রনাথকে চিঠির ভাষা একটু নরম করতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তা শোনেননি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাইটহুড ত্যাগের কথা লিখলেন। লিখলেন ভেতরের তাড়না থেকেই।
টম ক্রুজ বহুকাল ধরে টিকে থাকা হলিউড সাংবাদিকদের সংগঠনটির কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সোচ্চার হয়েছিলেন ব্রিটিশ নৃশংসতার বিরুদ্ধে। দুটো বিষয়ে ভিন্ন হলেও চারিত্রিকভাবে একই। বিবেকের তাড়নায় তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন।
বিবেক শব্দটিও এখন ক্লিশে হয়ে গেছে। বহুকাল ধরে এমন সব মানুষের নামের সঙ্গে ‘বিবেক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষদের কানে বিরক্তিকর ঠেকেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেও অনেকে আখের গুছিয়ে নেওয়ায়, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দ দুটি এখন আর কারও মনে কোনো শক্তি জোগায় না। বরং যাঁরা ফন্দিফিকিরের রাস্তা মসৃণ করতে চান, তাঁরাই শব্দ দুটিকে অতিমাত্রায় ব্যবহার করেন।
আমাদের দেশে গর্ব করার মতো বিষয়গুলোকে অতি সূক্ষ্মভাবে টেনে নিচে নামানো হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী আর পাকিস্তানি প্রেতাত্মা একসঙ্গে মিলে এ কাজটি করেছে। আর যাঁরা মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে নিজ পরিচয় গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ নিজেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে আখের গুছিয়ে নিয়েছেন, কেউ কেউ আখের গোছানো মানুষদের রমরমা দেখে নীরবে নিজেকে অন্তরীণ করেছেন নিজেরই ছায়ায়। এ কারণেই এই পুরস্কার বর্জনের বিষয়টি হয়তো এখন মানুষের মনে খুব একটা দাগ নাও কাটতে পারে।
২.
টম ক্রুজ আরও কয়েকটি ভাবনার দিকে নিয়ে গেল আমাদের। আমাদের দেশে যে পুরস্কারগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ছিল, সেসব পুরস্কার কেউ বিতর্কিত করে তোলা হচ্ছে অনেক কাল ধরে। শুরুতে যাঁরা এই পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা যোগ্যতার ভিত্তিতেই পেয়েছেন। কিন্তু একসময় দেখা গেল, ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং তৈল মর্দন অনেক ক্ষেত্রেই পুরস্কারের নিয়ামক হয়ে উঠেছে। পুরস্কারের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এমন অনেককেই পুরস্কার পেতে দেখা গেছে, যাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে একেবারে সাধারণ মহলেই। অনেক বিচারকই যুক্তি ও সৃজনশীলতার পথে না থেকে উনুনে ছড়ানো হাড়ির ঘিয়ের মতো গলে গেছেন।
তাই যাঁদের হাতে পুরস্কার গিয়ে পৌঁছেছে, তাঁরা নিজেরা আনন্দে উদ্ভাসিত হতে পারেন, কিন্তু বোদ্ধা মানুষ এবং সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছেন, ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। তাই সেসব পুরস্কার এখন আর আনন্দবার্তা হিসেবে আসে না।
কোনো ঐতিহ্যবাহী পুরস্কার বা পদক যখন মান হারায়, তখন বুঝতে হয়—সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যখন পুনঃসংস্কার ছাড়া এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। আমরা এখন সেই ভঙ্গুর পথটাই পাড়ি দিচ্ছি।
৩.
তথ্যের জন্য বলে রাখি, টম ক্রুজ প্রথম গোল্ডেন গ্লোব পেয়েছিলেন ১৯৯০ সালে‘বর্ন অন দ্য ফোর্থ অব জুলাই’ ছবিতে অভিনয় করে। পরিচালক ছিলেন অলিভার স্টোন। ছবিটি অস্কারের সেরা পরিচালক, সেরা সম্পাদনার পুরস্কার পেয়েছিল। গোল্ডেন গ্লোব পেয়েছিল সেরা চিত্রনাট্যের, সেরা অভিনয়শিল্পীর। ক্যামেরন ক্রো পরিচালিত ‘জেরি মাগুয়ার’ ছবির জন্য দ্বিতীয় গোল্ডেন গ্লোবটি আসে ১৯৯৭ সালে। ২০০০ সালে টমাস অ্যান্ডারসনের ‘ম্যাগনোলিয়া’ ছবির জন্য তিনি তৃতীয় গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারটি পান। এ রকম তিনটি গোল্ডেন গ্লোব যার কাছে থাকে, তিনি তো তারকা মহলে এবং সাংবাদিক মহলে চিরকালের জন্য সুপারস্টার! সেই তিনিই কিনা গোল্ডেন গ্লোবগুলো ফিরিয়ে দিলেন!
৪.
একটু পেছন থেকে আসা যাক। হলিউডে বিদেশি সাংবাদিকদের সংগঠন এইচএফপিএ গঠিত হয়েছিল ১৯৪৩ সালে। চলচ্চিত্রে অবদান রাখার জন্য ১৯৪৪ সাল থেকে নানা খ্যাতিমান চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়েছিল। অস্কারের পরই আমেরিকার এই পদকটিকে সেরা পুরস্কার হিসেবে ধরা হয়। বিদেশি সাংবাদিকদের এই ঘরানায় রয়েছেন ৮৭ জন বিদেশি সাংবাদিক, যাঁরা হলিউডে থাকেন। তবে অন্য দেশের কয়েকজন চলচ্চিত্র প্রতিনিধিও রয়েছেন নির্বাচকদের কাতারে। যেমন রাশিয়ার শিল্পী ও প্রযোজক আলেকজান্ডার নেভস্কি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই সংগঠনে একজনও কৃষ্ণাঙ্গ সাংবাদিক নেই!
গোল্ডেন গ্লোব নিয়ে হরহামেশা প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন পদ্ধতিতে কখনোই স্বচ্ছতা ছিল না বলে বহুবার তারা সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালে তাদের ব্যাপারে যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি ভয়ানক। বলা হচ্ছে, এই নির্বাচকেরা বর্ণবাদকে ধারণ করেছেন তাঁদের পোশাকে। ব্যাপারটা এত দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে গত মার্চ মাসে চলচ্চিত্রসংক্রান্ত হলিউডের বড় বড় কোম্পানি গোল্ডেন গ্লোবের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে আহ্বান জানিয়েছেন চলচ্চিত্রকার ও অভিনেতাদের।
গত সপ্তাহে বোমা ফাটাল নেটফ্লিক্স ও আমাজন। তারা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে, তাদের চলচ্চিত্র ও সিরিয়ালগুলো গোল্ডেন গ্লোবের হর্তাকর্তাদের কাছে দেওয়া হবে না। চলচ্চিত্র কোম্পানি এনবিসি এরপর জানিয়ে দিয়েছে যে আগামী বছর গোল্ডেন গ্লোব অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার তারা করবে না। এরই মধ্যে নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো শুধরে না নিলে আরও বড় সংকটে পড়তে হতে পারে হলিউডের বিদেশি সাংবাদিকদের এই সংগঠনকে।
তবে সবচেয়ে হতাশার জায়গা হচ্ছে, অনেকেই এই বয়কটকে সমর্থন করছেন বটে, কিন্তু তা শুধু কথা দিয়ে। পুরস্কার ফেরত দেওয়ার সাহসিকতা দেখালেন একমাত্র টম ক্রুজই। এই তালিকায় আরও কারও কারও নাম হয়তো বা শিগগিরই যুক্ত হবে।
৫.
ভাবনার জগতে আমাদের দুর্দশা নিয়ে এখানেই কথা ওঠে। আমরা দিনে দিনে এতটাই খ্যাতির কাঙাল হয়ে উঠেছি যে, যেকোনো মূল্যে কোনো পুরস্কার জিতে নেওয়ার সুযোগ থাকলে, তা হাতছাড়া করি না। যে দু-একটি পুরস্কার সম্মানসূচক হিসেবে মনে রাখার কথা, সেগুলো বিতর্কিত করে তোলা হয়েছে। বিনোদন জগতের মানুষদের জন্য একটি পত্রিকার দেওয়া পুরস্কারের স্বচ্ছতাও প্রশ্নবিদ্ধ।
এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন তারকা সৃষ্টির যে পুরস্কারগুলো রয়েছে, সেগুলোর নোংরামি সম্পর্কে নানা সময় নানা খবর প্রকাশিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক মান, রুচি এবং নিজের ওপর শ্রদ্ধা না থাকলে যা ঘটার, তা–ই ঘটছে।
অথচ তেলবাজি ছাড়া, লোভ ছাড়া কিংবা স্বজনপ্রীতি ছাড়া যদি নির্মোহভাবে পুরস্কারগুলো দেওয়া হতো, তাহলে পুরস্কার রাজ্যটি এ রকম অরুচিকর জায়গায় গিয়ে পৌঁছাত না।
আমাদের দেশে একজন টম ক্রুজ নেই। কেন নেই সেটাও পরিষ্কার। যিনি কোনোপ্রতিবাদী ভূমিকা নেবেন, তার পেছনে দাঁড়িয়ে যাবে একটি সত্যিকারের সংস্কৃতিসেবী গোষ্ঠী, সে গুড়েবালি।
আমাদের শিরদাঁড়াটা এখনো ততটা মজবুত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ কিংবা টম ক্রুজ যে বোধের জায়গা থেকে ছুঁড়ে ফেলেছেন পুরস্কার, সে বোধ এখন সবার মধ্যে থাকবে—এতটা ভেবে নেওয়া মুশকিল।
এখন রাজনীতির এক গতিময়তার সময়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিপরায়ণ শাসন ছাত্র আন্দোলনে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী শাসনকালে দ্রুততার সঙ্গে নানা রকম রাজনৈতিক কথাবার্তা, চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-অপচেষ্টা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটছে।
১ দিন আগেবহু বছর আগে সেই ব্রিটিশ যুগে কাজী নজরুল লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন।’ আসলে পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাই তো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধ হয় আর কোনো অসহায়তা নেই। খালি পেটে কেউ তত্ত্ব শুনতে চায় না। কাওয়ালিও ন
১ দিন আগেতিন বছরের শিশু মুসা মোল্লা ও সাত বছরের রোহান মোল্লা নিষ্পাপ, ফুলের মতো কোমল। কারও সঙ্গে তাদের কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকার কথা নয়। কিন্তু বাবার চরম নিষ্ঠুরতায় পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে তাদের। আহাদ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি দুই ছেলেসন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর নিজের গলায় নিজে ছুরি চালিয়েছেন।
১ দিন আগেদলীয় রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন পাশে রেখেই ইউনূস সরকারের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে এর ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার সময়টায়। তবে সাধারণ মানুষ মনে হয় প্রতিদিনই তার জীবনে সরকারের ভূমিকা বিচার করে দেখছে।
২ দিন আগে